সমকালীন ছোটগল্প |
ইনিউমারেটর
হরনাথ সবে মাত্র চিঠিটা হাতে পেয়েছে। খাকি খামের মধ্যে ভরা। এ যে কোন সাধারণ
কারোর পাঠানো চিঠি নয়, তা হরনাথ বুঝতে পারছে। আর তাতেই তার
হাতটা থরথর করে কাঁপছে! কেউ দেখলে ভাববে হরনাথ বুঝি কোন আদালতের সমন পেয়েছে। হরনাথের হঠাৎ মনে পড়ল সে জীবনে আর একবারই এমন খাকি খামের চিঠি পেয়েছিল। আর তা ছিল এই প্রাইমারি স্কুলের চাকরীর নিয়োগপত্র। সেটাই প্রথম আর সেটাই শেষ! কিন্তু এই চিঠিটিও যে সরকারি তা বুঝতে হরনাথের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সে চিঠিটা পাঞ্জাবীর বুক পকেটে পুরে সাইকেলের প্যাডেলে ডান পায়ের চাপ দিল। শুকনো
পাতায় খচমচ শব্দ তুলে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় হরনাথকে নিয়ে সাইকেলটা এগিয়ে চলল।
ছুটির দিন তাই পার্বতী চরণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক কৃপাসিন্ধু তখন সবে মাত্র বিড়িতে দুটো সুখটান দিয়ে হাঁসুয়ার ধারটা পরখ করছিলেন। পরনের লুঙ্গিটি সামান্য হাঁটুর উপরে তোলা। হাঁসুয়াটাকে নির্দিষ্ট ফাঁটা বাঁশের খুঁটির মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে এক আঁটি খড় টেনে নিলেন। এবার কুঁচিকুঁচি করে কেটে তা নির্দিষ্ট মাটির পাত্রে রেখে কিছু ধানের তুষ ও সামান্য চিটাগুড় তাতে ছড়িয়ে হাত দিয়ে মেখে একটা উত্তম জাবনা তৈরি করবেন। তারপর দুধের গাই দুটোকে গোয়ালঘর থেকে বের করে জাবনার সামনে বেঁধে দেবেন। ব্যস, তারপর আপাতত তার কাজ শেষ। এরমধ্যে করুণাময়ী এককাপ তিতকুটে চা বানিয়ে আনলে কৃপাসিন্ধু তা পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিয়ে মুখে একটা আ-শব্দ করবেন। কিন্তু আজ আর তা হল না। হাঁসুয়াটা বাঁশের ফাঁকে লাগাতেই সামনে একটা সাইকেল এসে থামল। কৃপাসিন্ধু মাথা তুললেন। দেখলেন তার স্কুলের শিক্ষক হরনাথ বেশ উত্তেজিত মুখে সাইকেল থেকে নামল। সাত সকালে এখানে হরনাথ কেন এ কথা ভেবে তিনি হাতের কাজ ফেলে রেখে দু’পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “কি ব্যাপার হর? বাড়িতে কোন বিপদ—
হরনাথ কোন কথা না বলে পকেট থেকে খাকি খামটা বের করে এগিয়ে দিল। কৃপাসিন্ধু অবাক হয়ে বললেন, “এটা কী হর? এতো তোমার নামের চিঠি! খোলনি কেন!”
হরনাথ তবুও কোন কথা না বলে শুধু কৃপাসিন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকল। কৃপাসিন্ধু ভুরু কুঁচকে খামটাকে বার কয়েক দেখে অতি যত্নে মুখটা খুলে ফেললেন ।তারপর দু’বার চিঠিটি পড়ে তা হরনাথের হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, “তা তুমি এখন
কী করতে চাও?”
“আপনি যদি অভয় দেন তাহলে আমি কাজটা করব ভাবছি। আসলে জীবনে তো
দ্বিতীয়বার কোন সরকারি চিঠি পাইনি। তাই ভাবছিলাম”। হরনাথ তার
বাকি কথা শেষ না করে প্রধানশিক্ষক কৃপাসিন্ধুর দিকে উত্তরের প্রত্যাশায় তাকিয়ে
থাকে।
কৃপাসিন্ধু কোন রকম ভণিতা না করেই বলেন, “দেখ হর, এখানে আমার অভয় দেওয়ার কিছু নেই।
রোজ ক্লাস করে বাকি সময়ে তুমি এই কাজটা করতে পারলে কর। এতে আমার
আপত্তির কিছু নেই। তবে এই ব্যাপারে আমি একবার ডিআই সাহেবের সাথে কথা বলে নেব। আমার মনে হয় তোমাকে বোধহয় ক্লাস করতে হবে না। কারণ এটাও তো
একটা সরকারি দায়িত্বপূর্ণ কাজ”।
“তাহলে তো খুবই ভাল হয় স্যার। আমি জানি এসব কাজে বেশ খাটুনি। অনেক বড় বড় ফর্ম ভর্তি করতে হয়। তার হাজারটা প্রশ্ন। সবটাই আমি বেশ
যত্ন নিয়ে করতে চাই স্যার”। হরনাথের বুকটা যে কিঞ্চিৎ স্ফিত হয়েছে তা তার গদগদ ভাব দেখেই বোঝা
গেল।
“হ্যাঁ, বেশ যত্ন সহকারেই কাজটা করা উচিত। এর সঠিক
হিসেবের উপর দেশের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। তবে ক’জনই বা বাড়ি বাড়ি
যায়। বেশির ভাগই তো চায়ের দোকানে বসে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে ফর্ম
ফিলাপ করে জমা দিয়ে দেয়। আমি জানি তুমি তা
করবে না। তুমি ডোর টু ডোর যাও আর কাজটা মন দিয়ে কর”। কৃপাসিন্ধু
হরনাথের পিঠ চাপড়ে বলেন।
হরনাথ মাথা দুলিয়ে কৃতার্থ হয়ে সাইকেলে উঠে পড়ে।
(দুই)
হরনাথ যত জোরে সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিল ফেরার পথে আরো দ্বিগুণ জোরে চালিয়ে এল।
রীতিমত বুকটা হাঁপরের মতো ওঠা-নামা করছে! অবশ্য এটা যতটা না জোরে
সাইকেল চালানোর জন্য, তার থেকে বেশি হচ্ছে উত্তেজনায়। কারণ পার্বতীচরণ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার থেকেও অনেক সিনিয়র শিক্ষক থাকতেও সরকার এই গণনার কাজটা
কেবল মাত্র তাকেই দিয়েছে্ন কেন। তার মানে নিশ্চয়ই সরকারের
খাতায় তার নামটা বেশ ভাল জায়গায় রয়েছে ।অবশ্য হবে নাই বা কেন। কাজে কোন ফাঁকি নেই। এটা কৃপাসিন্ধু
স্যারও যেমন জানেন তেমনি সরকারও নিশ্চয়ই জানেন। তা না হলে তার
কপালে সরকারের সুনজর জুটতো না। এতে অনেক সহকর্মীর হিংসে হবে! তা হোক। তারা ফিসফিস করে ওকে দেখে কিছু হয়তো বলবে! তা বলুক। পাড়ার অনেকেই যখন ব্যাপারটা জানবে তখন তারাও নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে অনেক আলোচন করবে। এসব ভাবলেই হরনাথের বুকটা সত্যিই ফুলে ওঠে।
মাত্র দু’মাসের সময় পাওয়া গেছে। এর মধ্যেই কাজটা করে জমা দিতে হবে। হরনাথ জানে যে প্রত্যেক ইনিউমারেটরকে দু’শো পরিবারের সাক্ষাৎ নিয়ে বড় বড় ফর্ম
ফিলাপ করতে হবে। ফর্মের আকৃতি দেখলেই ভিরমি খেতে হয়। তাই হরনাথ আজ
থেকেই কাজটা শুরু করতে চায়। আজ ছুটি থাকায় অহেতুক বাড়িতে বসে থেকে লাভ
নেই। বরং যতটুকু এগিয়ে রাখা যায় ততই ভাল।
মাথায় তেল ঠাসতে ঠাসতে বারান্দা থেকে একটানে গামছাটা নিয়ে কাঁধে ফেলে হরনাথ
স্ত্রী সুধারাণীকে বলল, “আমাকে এখন চাট্টি ভাতে ভাত ফুটিয়ে দেবে নাকি?”
সুধারাণী তখন সবে এক পাঁজা বাসন নিয়ে পুকুর থেকে ধুয়ে উঠোনে পা দিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি বারান্দায় বাসন নামিয়ে রেখে অবাক হয়ে বলল,
‘হ্যাঁগো, তোমার শরীর
খারাপ হয়নি তো! যে লোক ছুটির দিনে বেলা দেড়টার আগে রান্না ঘর মুখো হয় না, সে কিনা সাত সকালেই খেতে চাইছে! তোমার হয়েছেটা কি বলতো!”
হরনাথ হাসতে হাসতে বলল, ‘এখন থেকে
সকালেই খাব ভাবছি। তুমি দিতে পারবে কিনা ব ?”
হরনাথ পুকুর পানে ছুটতে ছুটতে শুধু বলল, এখন থেকে আমি
আর শুধু মাস্টার নই , বুঝলে!”
হরনাথ বাড়ির পেছনের পুকুরে গিয়ে অন্যদিন অনেক্ষণ ধরে পা ঘষে, গামছা দিয়ে ঘষে ঘষে পিঠের নোংরা তোলে, তারপর একবার সাঁতরে পারাপার করে ।আর মাঝ
পুকুরে ডুব দিয়ে মাথা ভেজায়। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। এতে শরীরটা বেশ ঝরঝরে থাকে ।কিন্তু আজ সে কোন মতে ভুস ভুস করে বার কয়েক
ডুব দিয়ে পাড়ে উঠে পড়ে। ওকে দেখে অনেকেই অবাক হয়। কিন্তু কেউ
কিছু জানতে চায় না। শুধু বার কয়েক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।
উঠোনে পা দিতে না দিতেই হরনাথ গলা চড়িয়ে বলে, কিগো, ভাতের খবর কতদূর?”
সুধারাণী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে। “তুমি যা বলে
গেলে তার মানেটা কী? তুমি মাস্টার নয় তো কী?”
হরনাথ লুঙ্গি পরতে পরতে বলে, ‘আরে বাবা এখন
আমার কত দায়িত্ব জান। মাস্টারি ছাড়াও সরকার আমাকে অন্য কাজও দিয়েছেন। এ কি আর কম সম্মানের ব্যাপার! অথচ আমাদের স্কুলের আর কেউ এমন দায়িত্ব
পায়নি। তাহলে বুঝতেই পারছ যে আমাকে উপরের লোকেরা কতটা ভালবাসে”।
“কিন্তু কাজটা কী তা বলবে তো?” সুধারাণীর গলায় একরাশ কৌ্তুহল ঝরে পড়ে।
“আরে বাবা আজ থেকে আমি শুধু মাস্টার নই। সাথে
ইনিউমারেটরও বটে। লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার সাথে কথা বলব। তাদের অনেক প্রশ্ন করব। একি আর কম ঝক্কির ব্যাপার। তাই সবাইকে দিয়ে এ কাজ হয় না। মানে ফাঁকি দিয়ে এ কাজ করাটা ঠিক নয়”। হরনাথ ভাল
করে মাথা মুছে গামছাটা বারান্দায় মেলে দেয়।
কথাটা বোধহয় সুধারাণীর ঠিক পছন্দ হল না। সে কিঞ্চিৎ অভিমানের সুরে বলল, “কিন্তু যারা আমাদের বিয়ের পর থেকেই আমাকে মাস্টারের বউ বলে ডেকে আসছে আজ তার কী বলে ডাকবে শুনি! ওরা তো আর ঐ খটোমটো নাম ধরে ডাকতে পারবে না। তাহলে আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দেখেছ ।“এবার হরনাথের হাসার পালা। সে মৃদু হেসে বলে, “আরে বাবা আমি কি আর মাস্টারি ছাড়ছি নাকি! ওটা তো আমার থাকছেই । সে যে আমার পাকা চাকরী। তুমি তাই যেমন মাস্টারের বউ ছিলে তেমনিই থাকবে”। হরনাথ দেখে এ কথায় সুধারাণীর মুখটা আগের মতোই বেশ চকচকে হয়ে ওঠে। ও নিঃশব্দে কাছে গিয়ে বউকে কাছে টেনে নেয় ।
(তিন)
“আপনার নাম?” হরনাথ জিজ্ঞাসা করে।
“অ্যাঁজ্ঞে, ভবেশ খাটুয়া”।
“আপনার পরিবারে ক’জন আছেন?”
ভবেশ অনেক্ষণ আঙুলের কড় গুণে বলেন, “তা দশ জন হবে”।
“এদের মধ্যে ক’জন পুরুষ আর ক’জন নারী?”
“সাতজন পুরুষ আছি। আর তিনজন আছে মেয়ে মানুষ”।
“এবার বলুন এদের মধ্যে কর্মী ক’জন?” হরনাথ মাথা নীচু করে লিখতে থাকে।
“বুঝলাম না বাবু”! ভবেশ অবাক হয়ে বলে।
“বলছি ক’জন কাজ করেন আর কতজন বেকার”। হরনাথ বুঝিয়ে বলে।
এ কথার উত্তর দিতে ভবেশ এবার একটু সময় নেয়। সরকার নিশ্চয়ই বেশি করে বেকার ভাতা দেবে। অথবা পরে হয়তো কোন কাজ দেবে। তাই ভবেশ বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, “কেউ কাজ করে না বাবু"।
“সেকি! তাহলে এত বড় সংসার চলে কীভাবে?”
হরনাথ এমন কথায় কম বিস্মিত হয় না।
হরনাথ এবার পরের প্রশ্ন করে,“ আপনার পরিবারে চোখে দেখতে পায় না এমন কেউ আছে নাকি?”
ভবেশ একবার মাথা চুলকে বলে,
“অ্যাঁজ্ঞে দু’জন। তবে আমাকে
ধরলে তিনজন।“
“কেন,আপনি কি চোখে দেখতে পান না?”
“অ্যাঁজ্ঞে দেখি। তবে ভাল দেখি না। সরকার যদি টাকা দেয় তো
দু’জনের ছানি কাটাব আর আমিও তাহলে শহরের বড় ডাক্তার দেখাব।“
হরনাথ একজন মহিলার দিকে দেখিয়ে বলল, ইনি কে ?আপনার পরিবার?”
এ কথায় ভবেশ কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ে।
হরনাথ মহিলার উদ্দেশে বলে,
“আপনার ক’জন ছেলে-মেয়ে?”
“চারজন”। ঘোমটার আড়াল থেকে বউটি বলে।
“সবাই বেঁচে আছে তো?” হরনাথ পরের প্রশ্নটি করে।
“ধুর, আটকুড়ার মুখে আগুন”। বউটি হঠাৎ চিৎকার করে বলে ওঠে।
হরনাথ কিছুটা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বলে, “না,মানে
জন্মানোর পরে কেউ যদি মারা গিয়ে থাকে তাই-“ বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই হরনাথের গালে একটা
থাপ্পড় আছড়ে পড়ে। সেই সাথে বউটির চিল চিৎকারে পাড়ার লোকও জুটে যায় ।
(চার)
হরনাথ চিৎপাত হয়ে উঠোনে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবে, সে বোধহয় এত যত্ন করে প্রশ্ন না করলেই পারত। কিন্তু
হেডস্যার শুনলে কি ভাববেন। ওনাকে যে কথা দিয়ে এসেছিলাম, সব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নেব! এখন তার কী হবে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন