কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০০ |
এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ
সেকেন্দার আলীর
বাড়িতে দেয়াল আয়না নেই। তার আছে ছোট একটা আয়না। সে আবার এই আয়নাটা লুকিয়ে রাখে। তার
কাজই হলো ঘুম থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াবে। সকালের আলো তার মুখে পড়বে। একটা আলো মৃদু
করে মুখে নাকে চিবুকে চুলে লেগে থাকবে, তখনই তার আয়না পর্ব শুরু। সেকেন্দার আলী তখন
নিজেকে সুন্দর ভাবতে শুরু করে। তখনই নিজেকে আয়নায় দেখে।
নারকেলের একটা
মালায় কাল রাতের বৃষ্টি জমেছে বলে কয়েকটা চড়ুই লেজ নাচিয়ে ওখানে ভিজছে। সে আয়না থেকে
চোখ সরিয়ে ওদিকে তাকায়। জানালার বাইরে এক টুকরো নৈমিত্তিক পৃথিবী। কড়ই গাছ সুপারি গাছ।
তার ফাঁক গলে আকাশের ছাদ। আয়নায় নিজের গোঁফ, থুতনির নিচে দৃঢ় ভাঁজ, চকচক দাঁত, ঢেউ
খেলানো চুল আর গোঁফের নিচে তার ঝুলে থাকা হাসি। সে প্রতিদিন নিজের প্রেমে পড়ে। স্কুলমাস্টার
রমণীমোহন বলতেন, পুরুষ হলো সিংহ। সিংহের কেশর থাকে, পুরুষের থাকবে গোঁফ। সে নিজের গোঁফ দেখে আর স্যারকে
স্মরণ করে পুলক ছড়ায় নিজের পৌরুষে।
সেকেন্দার টের
পাচ্ছে তার চারপাশ থেকে ঘণ্টা উড়ে যাচ্ছে। গ্রাম বাতাসে শিমুল তুলো উড়ছে। সে দাঁড়িয়ে
আছে স্টেজের মাঝখানে। গ্রিনরুমে ঘামে ভেজা উৎকণ্ঠিত ঝুমঝুমি ধনুকের মতো প্রস্তুত। তার
সংলাপ শেষ হলেই স্টেজে ঢুকে পড়বে ঝুমঝুমি। তারা দুজনে এখন কোরাস গান করবে।
শ্মশানে কবরে ঘুম জাগাও জাগাও
বানিয়েছি ডুগডুগি বাজাও বাজাও
সেকেন্দার হয়ত
জন্ম অভিনেতা। অধিকারী প্রায়ই ঝুমঝুমি আর সেকেন্দারকে নাচ করতে শেখায়, নতুন নতুন মুদ্রা।
চড়ুই পাখিগুলোকে
নারকেলের মালায় আর দেখা যাচ্ছে না, সুপারি গাছের আড়ালে আকাশটা দেখা যাচ্ছে না। সেকেন্দার
হয়ত স্টেজে আর নেই তবু আয়না থেকে তার মুখ সরছে না। সে স্বপ্ন দৃশ্যের সুবাস পায়। তার
শরীর হয়ত পুরনো কিন্তু তার স্বপ্নদৃশ্য আঁকা
প্রতিদিন নতুন। এই সব দৃশ্যরাশি কি প্রথমে নয়নে আসে, তারপর স্বপ্নে, নাকি আগে স্বপ্নে
পরে নয়নে আয়নায়?
দূর থেকে মা
ডাক দেয় তাকে। একবার মনে হলো তাকে ডাকছে, আবার মনে হচ্ছে তাকে না, অন্য কাউকে। তবুও
সে জোরে জবাব দেয়, মায়ের ডাকে। নিজেকেই নিজে বলে;
: পৃথিবীর সব
মায়ের ডাকে তার সন্তানের ছায়া পড়ে।
সেকেন্দার জানালা
থেকে সরে দাঁড়ায়, আয়নাটা লুকিয়ে রাখে তার জামার নিচে। কার যেন একটা বেদনার ছায়া ঘরময়
হেঁটে বেড়ায় ওর সাথে। ঝুমঝুমি কি তার সাথে হাঁটে নাকি অধিকারীর শাসন গরমচোখ?
মা আবার তার
অলসতা, বেকারত্ব নিয়ে হৈ রৈ করে ওঠে বাড়িঘর ছড়িয়ে। সেই একই দৈর্ঘ্যে, টোনে ও যন্ত্রণার
স্বরগ্রামে। সেকেন্দার হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। এই বেরিয়ে পড়ার মাঝে সেই চড়ুইগুলোর
মতো লেজ নাচানো নেই।
কড়ই গাছের সাথে
সে দড়ি ঝুলায়, দেখলে মনে হবে আত্মহত্যা করবার আয়োজন। সে আয়নাটা বের করে আর পকেট থেকে
কাঁচি।
গোঁফ কেঁটে
ফেলল সেকেন্দার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন