সমকালীন ছোটগল্প |
টিফিনবক্স
হাঁ
করে খোলা একটা টিফিনবক্স। রিমা স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। গোলাপি রঙের টিফিনবক্সের গায়ে
একটা বার্বি পুতুলের ছবি। সৌমিলির কাছেও ঠিক এমনই একটা টিফিনবক্স ছিল। গুড্ডিরও ছিল।
নবম শ্রেণীর বিশেষ ত্রয়ী। কেউ বলত ত্রিধারা। রিমা, সৌমিলি আর গুড্ডি। তিন বান্ধবী।
ক্লাসের শেষ বেঞ্চ ওদের ‘রিজার্ডভ বগি’। একজন বিনুনি। অন্যজন বব ছাঁট। তৃতীয়জন পনিটেইল।
রিমার বব ছাঁট। সৌমিলির পনিটেল আর গুড্ডির
বিনুনি ধরে কতবার নাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি তিনটে ব্যাগ। তিনজনেরই অপেক্ষার নাম দুপুর
দুটোর 'বড় টিফিন'। ঢং করে একটা ঘন্টা বাজা মানে 'ছোট টিফিন'। তার ঠিক এক ঘণ্টা পরেই
ঢং ঢং করে দুবার ঘণ্টা বাজা। ওদের 'বড় টিফিন'। ব্যস শুরু হতো গোল্লাছুট। রাজলক্ষী
বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠ জুড়ে তখন রোদের খেলা। জোট বেঁধে কাবাডি, ব্যাডমিন্টন খেলা।
রিমা, সৌমিলি আর গুড্ডি স্কুলের মাঠের অশত্থ গাছের নীচে টিফিনবক্সে মত্ত। ঠিক যেন ঝিনুক খুলছে। রিমার টিফিন পছন্দ সৌমিলির। লুচি বা পরোটা আর আলুভাজা। সৌমিলির টিফিনবক্স থেকে উঁকি দিত 'নিউট্রিশন'। সোয়াবিন পোলাও, কখনো সবজি দিয়ে খিচুড়ি। গুড্ডির বেশিরভাগ দিনই রুটি, ঝোলাগুড় বা মুড়ি। ভাগাভাগি করে খাচ্ছে তিনজনে। খুশির ঝিলিক চোখে।
-''কি
সুন্দর টিফিনবক্সটা রে!''
একদিন
রিমার টিফিনবক্সটা দেখে প্রশ্ন করেছিলো সৌমিলি।
-''বাবিনকাকুর
দোকানে পাওয়া যায়। আর বোধহয় দুটো আছে দেখেছিলাম, কিনবি?'' রিমার ঝটপট উত্তর।
সেদিন অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় উচ্ছ্বসিত দুই কিশোরী টিফিনবক্সের রংমিলান্তিতে ব্যস্ত। গুড্ডির চোখ ছলছল। ওর বাবা টিফিন নিয়ে যায় পলিথিন প্যাকেটে মুড়ে। বাড়িতে থাকা একটা মাত্র টিফিনবক্সই বরাদ্দ গুড্ডির জন্য। স্টিলের বাক্সটায় জং ধরার হলদেটে রং গুড্ডির মুখের মতই পাংশু।
পরের দিন দুটো একই রঙের টিফিনবক্স নিয়ে হাজির হয় সৌমিলি। গোলাপী। নিজের আর গুড্ডির। তিনজনেরই টিফিনবক্সের রং এখন এক। গুড্ডি কেঁদে ফেলেছিল। তারপর কতবার পাল্টাপাল্টি হয়ে গেছে একই রঙের, একই ছবি দেওয়া টিফিনবক্স। তবুও পাল্টায়নি বন্ধুত্বের রং।
-''আমি গুড্ডি বলছি। পাড়ার এক কাকুর দোকান থেকে ফোন করছি, কাল স্কুলে আসবি? সৌমিলির স্মরণসভা।'' থমথমে গলায় গুড্ডির প্রশ্ন।
-"ওটা
বোধহয় ভার্চুয়ালি হবে।'' গুড্ডির ফোনে ভাবনার জাল কেটে বেরিয়ে উত্তর দেয় রিমা।
হঠাৎই ফোনটা রেখে দেয় ও। কথা বলতে ইচ্ছে করে না ওর।
কোভিড বিধির গেরোয় ছটফটানো কৈশোর। সৌমিলি ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিল। ডিজিটাল খোলসের স্কুলে বারবার হতাশা জেঁকে বসেছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর আন্তর্জাল জুড়ে মিমের ভিড়। ভিড় একেবারে পছন্দ ছিল না সৌমিলির। বন্দী ঝিনুকে হাঁসফাঁস করা প্রাণ। তারপর টুপ করে খসে যাওয়া। জীবনের পাতা থেকে। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ একসঙ্গে। চিরনিদ্রা। একটা চিঠি। '' স্মার্টফোনটা গুড্ডির জন্য রইল। এবার এই ফোন থেকে ও নিজেই ক্লাস করবে।" রিমা বোঝাত সৌমিলিকে। শুধুই ফোনে। বন্ধুত্বের স্পর্শবিহীন। খুনসুটি নেই। শূন্য পাতারা ওড়াউড়ি করত বন্ধুত্বের মাঝে।
রিমা চোখ বুজে বসে আছে। ভার্চুয়ালি স্মরণসভা হচ্ছে সৌমিলির। প্রত্যেকের ‘যোগদান’ বাধ্যতামূলক। অনেকগুলো ছোট ছোট উইন্ডো। বিন্দুর মতো। প্রত্যেকটা যেন আলাদা দ্বীপ। রিমা চোখ বুজেও দেখতে পাচ্ছে। একটা গোলাপী টিফিনবক্স উড়ে বেড়াচ্ছে। আস্তে আস্তে সেটা রূপান্তরিত হচ্ছে একটা শক্ত ঝিনুকে। ঢাকনাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিরকালের মতো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন