সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

 

প্রসঙ্গ : তরুণ মজুমদার (১)




আমার সবচেয়ে ভালো লাগা তিনটি বাংলা ছবির মধ্যে দু’টিই তো আপনার করা! অথচ, প্রথম যখন আপনার ছবি দেখি তখন আমার কেমন লেগেছিল?

একটুকু বাসা (১৯৬৫/৬৬)

ভবানীপুরের ‘বিজলী’ সিনেমা, রাতের শো। পর্দায় প্রথম এলেন অনুপকুমার, তুলে দেখালেন তাঁর একপাটি জুতোঃ সোলে গর্ত! এরপর গল্প এগিয়ে চললো। বাবা পাহাড়ী সান্যাল। ছেলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নববিবাহিতা স্ত্রী সন্ধ্যা রায়কে নিয়ে নিজস্ব একটি বাসস্থান খুঁজতে গিয়ে ওঠেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোটেলে। সেখানে আবাসিকরা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ করে যে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক বৈধ নয়। এই নিয়েই যত মজা। শেষে সৌমিত্র হাফ-প্যান্ট আর চশমা পরে একদল ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে বেরিয়ে যান। সঙ্গের বড়রা, মা, বাবা, দাদা, মাসীমা, সবাই বেশ উপভোগ করেছিলেন। আমি ওই ৮ বছর বয়েসে খুব একটা কিছু বুঝিনি, ভালও লাগেনি। ছবিটি বোধহয় আর নেই।

বালিকা বধূ (১৯৬৭)

তখন রাসেল স্ট্রীটে ভোল্টা কোম্পানীর ফ্ল্যাটে থাকি, বাবার চাকরীসূত্রে। অতএব, বাংলা ছবি দেখা হতো ভবানীপুর/কালীঘাট অঞ্চলেই। এবার ইন্দিরা সিনেমা, সেই রাতের শো (বাবার অফিস থেকে ফিরে এর আগে আমাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না)। ঢোকার আগেই চমক! সম্ভবত নায়ক-নায়িকা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন, তাই উৎসুক জনতার ভীড়। ছবিটি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন আমার মাসীমা, বিষয়বস্তু শোনার পর। তাই সদলবলে যাওয়া।

ছবির প্রথমেই আছে দু’টি হাত, একখানি অ্যালবামের পাতা উল্টে-উল্টে কাহিনীর চরিত্রদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরে জেনেছি সেই হাত আর সংলাপের কন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের! তারপর পূর্ণভাবে উপভোগ্য একটি  সুন্দর ছবি! গানে গানে মুখর! প্রথমে বিয়ের গাড়িতে করে যেতে যেতে অমল (পার্থ)-এর জামাইবাবু অনুপকুমার গাইছেন দ্বিজেন্দ্রগীতি, ‘আজি এসেছি, এসেছি বধূ হে’, যন্ত্রানুসঙ্গ গাড়ির হর্ন! বাসরঘরে সেই জামাইবাবুই গেয়ে ওঠেন ‘মলয়  আসিয়া কয়ে গেছে কানে’। গান শেষ করবেন, ‘এইবার তুমি...’, এমন সময় দেখেন যে নববধূ রজনী (মৌসুমী) দিব্যি একজনের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন! মুখ বেঁকিয়ে জামাইবাবু হারমোনিয়াম বন্ধ করে শেষ শব্দটি উচ্চারণ করেন, ‘আসিবে!’ নেপথ্য কন্ঠে রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে এই জামাইবাবুর মুখেই আমরা শুনব রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’, সেখানেও রবীনবাবুর গলা। (আচ্ছা তরুণবাবু, তপন সিংহ মশায় কিন্তু একরকম জোর করেই হেমন্তবাবুকে তাঁর ছবিতে দ্বিজেন্দ্রগীতি (আরোহী) আর অতুলপ্রসাদের গান (ক্ষণিকের অতিথি) গাইয়েছিলেন। আপনি সেই জোর করলেন না কেন? পরে তো  ‘খেলার পুতুল’এ আপনিই হেমন্তবাবুকে দিয়ে ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’ গাইয়েছেন!)

এরপর ভোরবেলায় অমল আর রজনী গিয়ে বসবে বাড়ির বাইরে মাঠে। দূর থেকে  ভেসে আসবে হেমন্তবাবুর উদাত্ত কন্ঠে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’। আর অমল গেয়ে উঠবে ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনের ঘ্রাণে পাগল করে’, সেও সেই একজনেরই ঐশ্বরিক স্বরে! রজনী বাপের বাড়ি গেলে বিরহী অমল স্কুলের বাংলা ক্লাসে ভাব সম্প্রসারণ (‘নাহি কিরে সুখ, শুধু কিরে দুখ, এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?’) লিখতে গিয়ে খাতা ভরে ফেলবে ‘রজনী’র নামে, ফলে জুটবে মাস্টারমশায়ের প্রহার! বিরহী শ্যালককে নিয়ে জামাইবাবু যাবেন যাত্রা দেখাতে। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেখানেও এক বিরহী রাজার কন্ঠে, ‘সখী রে, প্রাণপাখী রে’, কিন্তু রাজার বিরহমোচনে মঞ্চে ছুটে আসবেন রাণী, ‘আমি এসেছি, এসেছি গো সখা,  ফেলো না কো আঁখিজল!’ (রাণীর ভূমিকায় যে সময় দেখানো হচ্ছে, তার রীতি মেনে পুরুষ – গোঁফ-কামানো জহর রায়!)। বিরক্ত অমল উঠে চলে যায়। এরপর গৃহশিক্ষকের স্বদেশী করার অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া, পুলিশের সঙ্গে তাঁর চলে যাবার সময় নেপথ্যে হেমন্তকণ্ঠে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। জামাইবাবুর বোন/দিদিকে লেখা চিঠি হাতে এসে পড়ায়, তার নকলে অমল চিঠি লেখে রজনীকে, তাকে সম্বোধন করে, ‘প্রিয়তমা রজনী’! উত্তর আসে, “তোমার চিঠি [বড়রা] সবাই পড়েছে; বলেছে, ‘বাঁদর ছেলে’! আর কখনো আমাকে এরকম করে লিখবে না!” ক্ষিপ্ত অমল স্ত্রীর উত্তর ছুঁড়ে ফেলে দেয় পুকুরে।

রজনী ফিরে এলে সে মেলায় গিয়ে শোনে চারণকবি মুকুন্দদাসের গান (ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত) ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী’, সব মেয়েরা মঞ্চে ছুঁড়ে দিচ্ছেন তাঁদের হাতের চুড়ি, রজনী চট করে তার চুড়ি ভর্তি হাত লুকোবে আঁচলের তলায়। পরে বাক্সভর্তি চুড়ি সে দিয়ে যাবে সম্ভবত ননদের হাতে (জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়) গঙ্গায় ফেলে দেবার জন্যে।

অনেক, অনেক স্মৃতি ‘বালিকা বধূ’কে ঘিরে। প্রথমবার দেখার পর দাদার মাথায় আসে ঠাকুমাকে নিয়ে আসার। মাসীমার মতো তিনিও তো এককালে বালিকা বধূই ছিলেন! ঠাকুমার অবশ্য ছবিটি ভালো লাগেনি। অনেক বছর পরে কিন্তু এই ঠাকুমাই আমার কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে শুনবেন তরুণবাবুর ‘মেঘমুক্তি’ ছবির গল্প! এরপর ‘বালিকা বধূ’ তৃতীয়বারও দেখা হয়। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে আমার পক্ষে তা এই প্রথম! এই অসাধারণ ছবিটিও আর দেখা যায় না, হিন্দী রূপান্তর ছাড়া!

আজকের কিস্তি এখানেই শেষ করছি। তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আবার দেখা হবে ৫ বছর পর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজে’, আমার সবচেয়ে প্রিয় ৩টি বাংলা ছবির একটি।

(ক্রমশ)


২টি মন্তব্য:

  1. Ar "suk bole sari keno"? Sesh drisye behalay "amaro parana jaha chay"? Tarunbabu seshe awaj ta barate jacchilen, tokhon "aha, baracchen keno music ta, ami to obhabe korini..."

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এটা জানা ছিল না! ধন্যবাদ! প্রসঙ্গত, হাসির গান নিয়ে কাল রাতে অনেকটা লিখে ফেলেছি। 'শুক বলে, "সারী'' আজ যোগ করব।

      মুছুন