শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জি

 

সমকালীন ছোটগল্প


এমপাওয়ারড উয়োম্যান

 

-''ইউ আর নট এন্ড এমপাওয়ারড উয়োম্যান সীমা, ইউ আর হাউজওয়াইফ, অ্যা গুড হোমমেকার।’’

প্রতিযোগিতায় বিচারকের বলা কথাগুলো কানে বাজছে সীমার। রাতের খাবার টেবিলে দিয়ে এসেছে। সমীর আর শতদ্রু খাচ্ছে। ওদের কোন অভিযোগ নেই সীমাকে নিয়ে। সমীরের অফিসের 'ফ্যামিলিথন' প্রতিযোগিতা। ছোট্ট একটা মঞ্চ। কোথাও যেন আকাশ। নিজেকে মেলে ধরার মতো। সীমা ইচ্ছে করেই নাম দিয়েছিল। নতুন কিছু এক্সপ্লোর করতে ভালো লাগে ওর। এটাও তেমনই একটা খেয়াল। সমীর বারণ করেছিল শুরুতেই। "কেরিয়ার যখন পার্সুই করলে না, শুধু শুধু আবার এসব প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো কেন?"ছেলের চোখেও দ্বিধা মেশানো মতামত। সীমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনি। মাঝে মাঝে ওর কথা হারায়। পাক খায় মাথার ভেতরে। ও তখন পাহাড় দেখতে পায়। পাহাড়ের গায়ে সবুজ রঙের চা-বাগান। তার মধ্যে হলুদ প্রজাপতি। উড়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনভাবে। প্রতিযোগিতা নেই। কারোর অনুমতি নেওয়ার নেই।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সীমার পড়াশোনা। দুর্দান্ত রেজাল্ট। 'গোল্ড মেডেল'। পড়াশোনা, চাকরি, টাকা-পয়সা। কেতাদুরস্ত জীবনের হাতছানি। সীমার ইচ্ছে করেনি। ও পাহাড় ছুঁয়ে থাকতে চেয়েছে। নাম-না-জানা ফুলের মত আটকে থাকতে চেয়েছে। 'যত হিজিবিজি চিন্তা'। বাড়ির লোক বলে। তিরিশোর্ধ মেয়ের জীবনে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। চাকরি এবং বিয়ে। দুটোই নাকি মসৃণ। শান্তিপূর্ণ। সীমার এবড়ো-খেবড়ো পাহাড় পছন্দ।

'তবে কী পছন্দ আপনার?' সমীর জানতে চেয়েছিল। প্রথম যেদিন বাইরে দেখা  হয়। চাকরি মানেই কোথাও একটা স্বাধীনতার সঙ্গে আপোস। সীমার ইচ্ছে ছিল  ও ব্যবসা করবে। পাহাড়ের কোলে চা-বাগান। অনেকগুলো সবুজ-সবুজ প্রাণ। মুক্ত। মানুষ। স্বাধীনতা। ও সকলকে নিয়ে সবুজ, স্বাধীন পৃথিবী গড়ে তুলবে। সমীর সেদিন হাত রেখেছিল সীমা'র হাতে। 'দেখা যাবে'। সীমা খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। যাক কেউ অন্তত ওর ইচ্ছেকে পাগলামি বলেনি। সীমা আশা করেছিল। ওর ভালো লেগেছিল। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিল আশা আর ভাললাগাকে সম্বল করে। বাকিটার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি হয়েছিল ও।

বিবাহ আর অপেক্ষা সমান্তরাল। ফুলশয্যার রাতে তারা এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। 'এতদিনের অপেক্ষা বল'। সমীর বলেছিল মৈথুন শেষে। সীমার অপেক্ষা? কেউ জানতে চায়নি। সীমার স্বপ্ন নিয়ে আর কথা হয়নি কখনো। ব্রেকফাস্ট মেনু, লাঞ্চের মাছ-মাংস আর ডিনারের ক্যালোরিতে হারিয়ে গেছে তারা।

সীমা এখন রোজ বেসিনের কলের জলের আওয়াজ শুনতে পায়। 'টুপ টুপ'। মন দিয়ে শোনে ও। পাহাড়ি বৃষ্টি কল্পনা করে নেয়। সমীরের প্রিয় 'ব্র্যান্ডেড দার্জিলিং টি'-এর প্যাকেট কিনে আনে বাজার থেকে। তার সুবাস নেয় সীমা। পাহাড়ের গন্ধ। সীমার চা-বাগানের স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। ওর বান্ধবী ফুলমণি চা বাগানের সবুজ পাতা থেকে চা তৈরি করে। সীমা ওর ছবি দেখতে পায়। চায়ের প্যাকেটে।

পাহাড়ি ফুল সমতলে এসে অন্য স্বপ্নের আশ্রয় খুঁজেছিল। সমীরের জ্বর। সারারাত সামলেছে। ছেলের অসুখেও 'মাতৃ-মহিমা'র প্রমাণ দিয়েছে। ফুলকাকুর অপারেশন, ছোট মাসির ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ঝাঁপিয়ে পড়েছে সীমা। ভালো লেগেছে ওর। 'গুড অ্যাটিচিউড'। পরিবারের লোক বলেছে। সীমা কী চেয়েছে? আন্তরিকতা। ভালোবাসা। সম্মান। সীমা ওর ঘরের দেওয়ালে পাহাড় আঁকতে চায়। 'রাবিশ'। সমীর আজকাল খুব ব্যবহার করে শব্দটা। সীমা ওর ঘরের  আধুনিক ওয়ালপেপার-এর মাঝে পাহাড় খোঁজে। শুধু খুঁজে বেড়ায়। ওর এম্পাওয়ার্ড হয়ে ওঠা হয় না।


1 টি মন্তব্য:

  1. স্বল্প কথায় অসাধারণ উপস্থাপনা - অবশ্যই লেখিকার সাধুবাদ প্রাপ্য।

    উত্তরমুছুন