অমৃতা
সম্প্রতি গিয়েছিলুম মংপু। সেখান থেকে ফিরে মৈত্রেয়ী দেবীকে মনে পড়লো আবার। তাঁর প্রসিদ্ধ লেখা 'ন হন্যতে' আমাকে টানেনি কখনও। কিন্তু 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' চিরকালই আমার লেখার টেবিলের সঙ্গী। সামনেই থাকে। কবির যে কজন 'বসওয়েল' বা 'শ্রীম' ছিলেন, দুই 'রানি'-সহ মৈত্রেয়ী, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কবিকে চিনতে তাঁরা আমাদের হাত ধরেন।
মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিও এভাবে জড়িয়ে আছে আমার। সাক্ষী একটি কবিতা। কাঁচাবয়সী এক বালকের, কবি গোপালহরি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদেশে লিখে ফেলা একটি কাঁচা পদ্য। পটভূমিকাটি ছিলো একটু আলাদা। মৈত্রেয়ী দেবীর জন্মদিনে একটি সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিলো আমাদের গ্রামে। জামশেদপুরে, টেলকো ক্লাবের প্রেক্ষাগৃহে। 'ন হন্যতে'-উত্তর মৈত্রেয়ী দেবী তখন তিনি। এই দীর্ঘ পদ্যটি প্রস্তাবনা হিসেবে আমাকে পড়তে হয়েছিলো। সময় গিয়েছে চলে চার দশকের পার। সম্প্রতি 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' আরেকবার পড়তে গিয়ে লেখাটির কথা মনে পড়লো। খসড়া লেখা ছিলো একটি পাতলা ফুলস্কেপ কাগজে। তা দেখেই পড়েছিলুম সেদিন। পড়ার পর মঞ্চ থেকে যখন নেমে যাচ্ছিলুম, মৈত্রেয়ী দেবী আমাকে ডাকলেন। 'শোনো'! কাছে যেতে বললেন 'কবিতাটি আমায় দেবে না?' আমি তো রীতিমতো বিব্রত। এই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি তাঁকে 'দেবার' ধৃষ্টতা আমার ছিলো না। আবার বললেন, 'এই কাগজটাই দিয়ে দাও আমাকে'। তাঁর এই প্রশংসিত উৎসাহ আমাকে আরও দীন করে ফেলে। অথচ সেই বয়সে বেশ আত্মপ্রসাদও লাভ করেছিলুম। জানি, লেখাটির গুণগত মান বিচার্য নয়। তাই কখনও ছাপতেও দিইনি তাকে। কিন্তু ব্যক্তি আমার কাছে এর কিছু মূল্য থেকে গেছে। সেই সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ পূর্বসূরিই আর আমাদের মধ্যে নেই। সমকালীন কে কে আছেন এখনও, মনে নেই।
এটির অস্তিত্ব প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম, কিন্তু জীর্ণ প্যাপিরাসের মতো কোনও একটা খাতা থেকে খুঁজে পাওয়া গেলো। এতোদিন পরে পড়তে গিয়ে দেখলুম, হয়তো আর একবার পড়া যেতেও পারে। বনপাহাড়ে সম্পৃক্ত শহর জামশেদপুর আর জেলা সিংভূমের আবহে আমাদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠার কিছু ইঙ্গিত এখানে প্রত্যক্ষ।
অমৃতা
এইখানে
বনস্থলী
ছিলো
এখন
দুর্বোধ শহুরে চিতারা তৎপর
ডলোমাইটের
রেঞ্জ কতোদূরগামী
ততোদূর
মগ্ন সিংভূম জংশন
আমরা
শিকড় পুঁতেছি
এইখানে
কতো
দীর্ঘ শালবন ধ্বস্ত করে
ধূর্ত
চিমনির নোংরা হাত
জ্যোৎস্নাকে
অমাবস্যার
চেয়ে ম্লান বেইজ্জত
করে
যায়
এইখানে
আমরা
সবাই রাতডিউটি দিই
ভাই-বন্ধু-পরিজন
প্রত্যেকে
বিভিন্ন রাতে
নিজেদের
বিভিন্ন অন্ধকারে
হাহা
হাসি হাহাকারে
গলা
চিরে খুঁজে নিতে চাই
নিজেদের
মুগ্ধ গৃহকোণ
স্ল্যাগের
কমলা আলোয়
খুঁজে
নিতে চাই
বালি
মাটি ঘাস উপড়িয়ে
বাপদাদার
ফেলে যাওয়া নাভিকুন্ড
আমাদের
কেউ ছিলো
আমাদের
কেউ থাকবে
আমরা
শিকড় পুঁতেছি
এইখানে
জন্মদিন
মানে
আরও একপাত্র সোনালি অমৃত
শরীরে
ছড়িয়ে দেওয়া
ঘাস,
বুনোফুল, ঝরাপাতা
টুকুন
মউয়ার বাস
স্মৃতিকে
জড়িয়ে
সত্ত্বাকে
মাড়িয়ে
বোধি
চূর্ণ করে
ক'ফোঁটা
মহার্ঘ মদ
আমাদের
জিভে ঢেলে দেয়
সেই
প্রেম
কখনো
মরেনা
কখনো
মরেনা পদ্মঝিলে ডুবে
বাতার
ফাঁসির টানে
মরেনা
নিজের
রক্ত চুষে
নিজের
মাংস ছিঁড়ে
যা
মরেনা
তাই
নিয়ে তুমি কিছু লেখো
তোমার
অমৃতের ভাগ
এসো
ভাগ করে নিই
তোমার
জন্মদিনে তুমি তো অনিঃশেষ
যেমন
মানুষ থাকে প্রত্যেক
জন্মদিনে
তুমি
তো কবিকে দেখো পাহাড়ি বাংলোয়
চায়ের
বাগান আর
সিনকোনা
উদ্যানে
দেবদারু
সাইপ্রেস অবিরল রোদের
ধারায়
ফুরফুরে শাদা দাড়ি
আমাদের
পিতামহ
আমাদের
কবিকে
দেখেছো
অম্লান
এখনও
কি সেই লোক
তোমায়
স্বপ্নে কিছু বলে
কিছু
কি বলে
তার
সোনার কাঠিটা কই গেলো
কোথায়
রয়েছে
তার
প্রাংশু অধিকার
আমরা
এখনও এতো রোগা কেন
তার
কোনও চিঠি আজ
তুমি
কি শোনাবে
আমাদের
আমাদের
কবিকে দেখি ঘর্মাক্ত
জষ্টিমাসে
ফার্নেসে তাত মাপে
মুর্মু
মেয়েটির
কালোচুলে
শালতেল
লাল
কৃষ্ণচূড়া
তার
চোখে শীতলতা এনে দেয় নাকি
রবীন্দ্রসংগীতের
শান্তি আনে
নিরাময় কবিতার দিন
এনে
দেয়
সে
কি আমাদের দেখে
এখনও
তেমনি ভালোবাসে
আমাদের
এদেশে শিকড়
এইখানে
এসো
বন্ধু
মিত্রা
মৈত্রেয়ী পারমিতা
তার
স্মৃতি
উষ্ণউর্বর
পরাগ
অবিরল এখানে ছড়াও
আমাদের
কাঁটাবন
ধন্য
করে একটি গোলাপ ফুটুক
মনভোলা
অসাধারণ
উত্তরমুছুন