শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

কেদারনাথ সিং

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

 

কেদারনাথ সিং’এর কবিতা        

             

(অনুবাদ : দেবলীনা চক্রবর্তী)

 


 

লেখক পরিচিতিঃ ১৯৩৪ সালে উত্তরপ্রদেশের চাকিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বেণারস থেকে স্নাতক হয়ে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি সম্পন্ন করেন। কিছু সময় গোরখপুরে হিন্দি ভাষার শিক্ষকতা এবং তারপর দিল্লি জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটিতে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। ছোট্ট বয়স থেকেই কাব্যচর্চার শুরু। কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন গদ্যকার ও সমালোচক। তাঁর কবিতায় প্রথম ও প্রধান আকর্ষণ হলো সরল ভাষা, কিন্তু তার গভীর তাৎপর্য। কেদারনাথ সিংয়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে যহাঁ সে দেখো, অভি বিলকুল অভি, জমিন পাক রহি হ্যায় ও বাঘ। কাব্যগ্রন্থ 'অকাল মেঁ সারস' কবি হিসেবে তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এই কাব্যগ্রন্থের জন্যই ১৯৮৯ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং ২০১৩-য় তাঁকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয়। বিগত কয়েক দশক ধরে হিন্দি ভাষায় কাব্যচর্চা করে অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন। তাঁর অনুরাগীর সংখ্যাও কম নয়।এই হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় কবি পরলোকগমন করেন ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ।

 

বিদ্রোহ

 

আজ ঘরে প্রবেশ করতেই

এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়লো

 

 আমার বিছানা বলে উঠলো — শুনুন

এই নিন আমার ইস্তফা

আমি আমার কার্পাস জীবনে ফিরে যেতে চাই

 

ওদিকে চেয়ার ও টেবিলের একটা সংযুক্ত আঁতাত ছটফটিয়ে বলে উঠলো -

এবার অনেক হয়েছে

আপনাকে সহ্য করতে করতে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি

ভীষণভাবে মনে পরে সেই সবুজ গাছের সারি

তাতে প্রাণের স্পন্দন

যা আপনি হত্যা করেছেন

 

ঐ দিকে আলমারির ভিতর বন্দী বইগুলো

চিৎকার করে বলছিলো -

মুক্ত করো আমাদের মুক্ত করো 

আমরা ফিরতে চাই সেই ঘন বাঁশের বনে

অনুভব করতে চাই বিষাক্ত দংশন ও সর্পিল চুম্বন

 

তবে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট ছিলো

সেই পশমিনা শাল

যা কিছু দিন আগেই কিনে আনা হয়েছিল পাহাড় থেকে

বলল — সাহেব!

আপনি এত মহান

আমার প্রাণপ্রিয় মেষ আমার জন্য ব্যাকুল হচ্ছে তবু আপনি আমাকে এভাবে নিজের শরীরে জড়িয়ে রেখেছেন

 

অন্যদিকে টিভি আর টেলিফোনের অবস্থা আরও সঙ্গীন

 প্রচন্ড শব্দে ওরাও কিছু বলছিলো

 কিন্তু ওদের ভাষা আমার বোঝার অগম্য

ঠিক তখনই

কল থেকে পড়া জল

সশব্দে বলে উঠলো — সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল সাহেব!

পারলে শুনে নিন এই টপটপ ঝরে পড়া জলের আর্তনাদ

 

আমরা সকলেই আপনার বন্দী

এই মানুষের তৈরি খাঁচা থেকে আমরা মুক্তি চাই

 

সমস্বরে কিছু আওয়াজ বলে উঠলো

আপনি যাচ্ছেন কোথায় —

 

আমার দরজায় টোকা

পড়তেই আমি বাইরে বেড়িয়ে গেলাম

 

পুঁজি

 

সারা শহর খোঁজ-তল্লাশির পর

আমি এই পরিণামে উপনীত হলাম যে  

এই এত বড় শহরে

 আমার একমাত্র পুঁজি হল

আমার  চলতে থাকা এই শ্বাস-প্রশ্বাস 

আমার বুকের পাঁজরে বন্দী ছোট্ট এই পুঁজি  

যা আমি প্রতিদিন অল্প অল্প

খরচ করে থাকি।

 

এরকম কেন হতে পারে না

যে একদিন জেগে উঠি আর 

ঐ ধূসর-ধূসর রঙের জনব্যাঙ্ক

আছে যে শহরের শেষ প্রান্তে —

সেখানে জমা রেখে আসি

 

আর ভাবি

জমা পুঁজি থেকে পাবো যতটুকু সুদ

তাই দিয়েই কাটিয়ে দেবো আরামে

এই ভুরি ভুরি জীবন।

 

অধিকার

 

ফুলকে অধিকার দাও, হাওয়াকে ভালোবাসার 

শিশিরকণা, সূর্যালোক রঙ থেকে যত ইচ্ছে রঙ নিক, শুষে নিক,

শিহরিত হোক, কেঁপে উঠুক, উত্থিত হোক

আর যদি কোন এক তীক্ষ্ণ আঙ্গুলের স্পর্শে

পাপড়ি - পাপড়ি জীবন পণ করে দেয়,

দিক সে কোন অচেনা - অদেখা সময়ের কাছে

নতুন ফুল ফোটার সম্ভাবনার জন্য!

 

সুগন্ধকে অধিকার দাও উড়ে যাওয়ার, বয়ে যাওয়ার, ঘিরে থাকার, ঝরে যাওয়ার ও নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার

নতুন আরো কিছু সুগন্ধের জন্য!

 

মেঘকে অধিকার দাও -

যেন সে প্রত্যেক শিশু চারাগাছকে ছায়া দেয়,

ভালোবাসে, তন্তুতে তন্তুতে রামধনু কিশলয় জাগিয়ে দেয়

তারপর যেখানে সেখানে যখন খুশি ঝরে যাক, গর্জে উঠুক, ঘনিয়ে আসুক, আহত হোক

নতুন মেঘসঞ্চারের জন্য!

 

পথকে অধিকার দাও, সে যেন যে কোনো

অরণ্যে, পর্বতে, শস্যক্ষেত্রে, লোকালয় থেকে প্রতি প্রান্তে গিয়ে উজার করে দেয় তার ক্লান্তি, বাহু প্রসারিত করে

নতুন সে এক পথের উৎস সন্ধানে!

 

স্রোতকে অধিকার দাও, সে যেন কখনো পূব হাওয়া'য় কখনো পশ্চিমী হাওয়া'র দোলায় এক তীর থেকে অন্য তীরে ভেসে বেড়ায়,

আবার ক্লান্ত হয়ে কোন বালুতটে মাথা রেখে জিরিয়ে নেয়,

নতুন তরঙ্গ সৃষ্টির আশায়!

 

দুঃখকে সেই অধিকার দিও,

যেন সে তার ছোট্ট ছেঁটে যাওয়া দু’ডানাতে

পবিত্র ভোরের প্রথম আলো সহ্য করে নিতে পারে,

 তারপর ভেঙে যায়, ছড়িয়ে পরে

 অনন্ত দুঃখের খোঁজে!

 

মাটিকে অধিকার দিও,

ভিজে সরস হতে, প্রস্ফুটিত হতে, অঙ্কুরিত হতে

ঢালু জমির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছেয়ে যাক –

সে যেন কখনো পরাজিত না হয়

 

যদি বা হয়ও,

তবুও যেন সে মাথার ওপর আন্দোলিত হয়

হয়েই চলে

 ক্রমশ বেড়ে ওঠে

 যেন দূর্বাঘাসের পতাকার মতো

নতুন আগামী প্রজন্মের জন্য!

    


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন