ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(১৮)
শিখা
ব্যস্ত ছিল কাস্টমারকে প্রডাক্টস্ দেখাতে। হর্ষকে ঢুকতে দেখে চোখের কোণ দিয়ে পরিচিতের
হাসি হাসে, হাতের ভঙ্গিতে অপেক্ষা করার অনুরোধ জানায়। সোনী শিখাকে সাহায্য করছিল, তার
দিকে চেয়ে হাসে। অদিতির চেয়ারটা খালি। হর্ষর বুকের মধ্যে গুর-গুর করে ওঠে, নামে। সে
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। শো-উইন্ডোর শেষ কিনারে মোড়ায় বসা একটি মেয়ে। দাঁড়ানোমাত্র উঠে
আসে কাউন্টারে। আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে,
--আয়্যাম
রাধিকা, ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?
--ইট’স ওকে—।
বলে
হর্ষ মাথা ঝাঁকায়। মেয়েটি অদিতি বা শিখার তুলনায় বেশ ছোটো। যথেষ্ট রোগা। হর্ষর দিকে
তাকিয়ে ছোট্ট শ্রাগ্ করে স্বস্থানে গিয়ে বসল। হর্ষ ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোয়। শিখা
কাস্টমারদের ‘এক্সিউজ মী প্লিজ’ বলে কাউন্টার
ছেড়ে তাড়াহুড়ো করে হর্ষর পাশে এসে চাপা গলায় বলে,
--প্লিজ
ওয়েট, কথা আছে।
--নীচে
আছি।
--ও-কে।
ফাইভ টু টেন মিনিটস্ মোর। অলরেডি সাড়ে ছটা বেজে গেছে। আজ একটু আগেই ওয়াইণ্ড-আপ করে
দেবো, যেয়ো না।
হর্ষ
ঘাড় ঝাঁকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। মনোরম সময়টা, সন্ধ্যে নামছে। প্রচুর গাছ থাকার কারণে
অজস্র পাখির চেঁচামিচি শোনা যাচ্ছে। ঝিমঝিমে মিঠে আলো দিয়ে সাজানো সিঁড়ির রেইলিং, খুব
রুচিশীল। অন্যদিন দিনের এই মাধুর্যমাখা সময়ে সে হা-ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরে। কখনো
কাছাকাছি রেস্তোঁরায় বন্ধুদের ডেকে নেয়, না হলে সোজা ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। অদিতির কল্
আসার পর থেকে মনটা কাটা ঘুড়ির মতো লাট খাচ্ছে। তখন সে অফিসে জরুরি ক্লায়েন্ট-মিটিং-এ
ব্যস্ত ছিল, ফোন সায়লেন্ট-এ। তিনঘন্টা পরে বাড়ি ফেরার পথে ক্যাবে বসে কল্ দেখতে পায়।
ফোন করল বারদুই, অদিতি ধরেনি। ড্রিম-হোমসের নম্বর তার কাছে ছিল না। অতএব সশরীরে এসে
হাজির হতে হল। অন্যমনস্কতা ছিঁড়ে দিয়ে শিখা ওর কাঁধে হাত রাখে। হর্ষ সামান্য চমকায়।
হাসে,
--ওভার?
--ইয়াঃ।
চলো কোথাও বসি।
--ও-কে।
ওপর
থেকে সোনী আর নতুন মেয়েটি নীচে নেমে আসে। সোনী ব্যুটিকের চাবি শিখার হাতে দিয়ে বলে
‘বাই ম্যাম’। অন্য মেয়েটিও বলে। গমনপথের দিকে চেয়ে
হর্ষ বলে,
--নিউ?
--হুঁ,
বিজনেস চালাতে হবে তো! চলো।
হর্ষ
মাথা নাড়ে। দু-জনে পাশাপাশি হাঁটে। নিউ দিল্লীর অভিজাত রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াগুলো তকতকে,
গাছপালা ঘেরা। কাছাকাছি ছোটো-ছোটো মার্কেট, সবই পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটার পরে
হর্ষ দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলে,
--অদিতির
কী... হয়েছে?
তেরছাভাবে
ঘাড় কাত করে শিখা বলে,
--কোথাও
বসে কথা বলি!
হর্ষ
রাজী হয়। দিনের শেষ আলোটুকু শিখার মুখে প্রসাধনী হয়ে ফুটে আছে। কাঁধ-ছোঁয়া চুলের একপশলা
বারবার ডান চোখের ওপরে এসে পড়ছে। চশমার সরু ফ্রেমে মোটা ডাঁটি, চোখে ঘন কাজল। ছোটো
কুর্তার নীচে এ্যাঙ্কল-লেন্থ ঢিলে প্রিন্টেড পাজামা, কাজ-করা নাগরা। শিখার সপ্রতিভতায়
সতেজ লাগে হর্ষর, যেন হালকা ফুঁয়ে এক-পরত ধুলো উড়ে যায়। শিখা হাতঘড়ি দ্যাখে, রেস্তোঁরাগুলোতে
ভীড় বাড়তে শুরু করছে। দ্বিধা নিয়ে বলে,
--আরেকটু
হেঁটে গেলে ছোট্ট কফিশপ্--নতুন। তত ক্রাউড হয় না। তোমার প্রব্লেম নেই তো?
চিজ্-চিকেন
স্যাণ্ডউইচ আর কফি অর্ডার করেছে শিখা। সরুচোখে তাকিয়ে জেরা করে,
--আজ
লীভ নিয়েছ মনে হচ্ছে? অদিতির জন্যে?
--ভেবেছিলাম
ব্যুটিকে থাকবে...।
আমতা
আমতা করে উত্তর দেয় হর্ষ। শিখা চুপচাপ হাতের শৌখিন পার্স নাড়াচাড়া করে। হর্ষ ঘাড় ঘুরিয়ে
দোকানের ইন্টিরিয়র দেখে। মাথার মধ্যে ঢেউ খেলে। গায়ে-পড়া হয়ে এখানে চলে এসেছে বলে লজ্জা
করতে থাকে। এতমাস পরে অদিতি ফোন করেছে, সে ধরেনি। পরে সে কলব্যাক করেছে, অদিতি ধরেনি।
ব্যাপারটা চুকে গিয়েছিল, আর টানার দরকার ছিল না।
শিখা
উঠে গিয়ে কাউন্টার থেকে ট্রে নিয়ে আসে। কফির কাপ এগিয়ে দেয়। স্যাণ্ডউইচ তুলে কামড় দেয়। হর্ষ মাথা নীচু করে বসে থাকে। শিখা
সরাসরি জানতে চায়,
--হ্যাভ
ইট, টেস্টি। তুমি ব্যুটিকে চলে এলে অদিতির খোঁজে? বাট্ শী টোল্ড মী ইউ হ্যাভ নো মো’
কন্টাক্ট?
হোয়েন য়্যু ব্রোক আপ?
হর্ষ
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ব্রেক-আপ আবার কী? সে অন্তত কোনো রিলেশনশিপে জড়ায় নি। এখানে আসা
চরম বোকামির কাজ হয়েছে। শিখা ছাড়ে না, টুকটাক খোঁচা-মারা কথা বলে যায়। বিরক্তভাবে চেয়ারটা
আলতো করে ঠেলে সে উঠে দাঁড়ায়। শুকনোভাবে বলে,
--থ্যাঙ্কস
ফর এভ্রিথিং শিখা-ম্যাম। মনে হয় না আর কোনো আলোচনার দরকার আছে।
শিখা
তার হাত ধরে টেনে বসায়, তীক্ষ্ণভাবে বলে,
--ওয়েট,
বোসো। আমার যা বলার বলে দিই, দেন ডু হোয়াট ইউ ওয়ান্না...।
হর্ষ
বাধ্য ছেলের মতো বসে, সামনে সুখাদ্য। ‘ডোন্ট মাইণ্ড, মা’
হাংরি’
বলে
শিখা প্লেট শেষ করে কফিতে চুমুক দেয়। হর্ষও খায়, খিদে পেয়েছে বৈকি। শিখা বলে,
--অদিতি
ছ-দিন হল পুনে চলে গেছে। একটা কম্পানি জয়েন করেছে। তোমার কী কী জানার আছে?
--আমাকে
ও ফোন করেছিল আট-দশদিন আগে। কন্ট্যাক্ট হয় নি।
--ওর
বাড়িতে প্রচুর অশান্তি।
অদিতির
বিষয়ে অনেক খবর জানল হর্ষ। প্রথম প্রথম কিছু আভাস অদিতি দিয়েছিল, বলতে চেয়েওছিল সমস্তটা।
সে তখন শুনতে চায়নি। এত সমস্যা কেন আসে কারো জীবনে? অদিতির বাবা-মা ডিভোর্সি। সে ছোটো
থেকে বাবার কাছে থাকে। বারো বছর আগে তার বাবা আবার বিয়ে করেন। তখন অদিতি ক্লাস টেনে।
‘স্টেপ-মাদার’জ্ এক্সট্রিমলি পোজেজিভ অ্যাবাউট মাই
ফাদার’—একদিন বলেছিল। দ্বিতীয়পক্ষে দশ বছরের
পুত্রসন্তান। ‘ছোড়ো ইয়ে সব’ বলে কাটিয়ে
দিয়েছিল হর্ষ। অদিতি আর কোনোদিন বলেনি। প্রায়শঃ গুম হয়ে থাকত, আচমকা মেজাজ খারাপ করে
ফেলত। দুম করে ভালো চাকরি ছেড়ে জমানো টাকা ইনভেস্ট করে ব্যবসা শুরু করল। শিখা অবশ্য
খুব সৎ এবং অনুভবী, হয়ত অদিতিকে ঠকাবে না। তিনচার বছর ধরে অদিতির বিয়ে দেওয়ার জন্যে
ভয়ানক চাপ দিচ্ছিল ওর সৎমা—তারই কোনো পরিচিত
পরিবার। পঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে হোলসেল ব্যবসা, জমিজমা। ছেলেটি দিল্লী এলে অদিতিদের বাড়িতে
থাকত। অদিতির অসহ্য লাগত। ‘গাঁওয়ার’—শিখাকে বলেছিল
এবং বলত দিল্লী ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। অদিতির চাপা স্বভাব বলে অত্যন্ত জেদী
সে। মুখে বিশেষ কিছু বলত না। তার কঠোর আপত্তি সে বাবাকে জানিয়েছিল। ভদ্রলোক নিষ্ক্রিয়,
দ্বিতীয় স্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
শিখা
নিরাবেগে ঘটনাগুলো বলে গেল। তারপর বলল,
--দিস
মাচ্ আই নো, রেস্ট কুড গেস। বাড়িতে রোজ লড়াই-ঝগড়া, অদিতি বলত। বলত খুদকুশী করবে। আমি
কাউন্সেলিং করতাম। তখন থেকে পাগলের মতো ট্রাই করছিল চাকরির এন্ শীজ্ লাক্কি—গট্ আ গুড
জব।
একা
ঘরে বসে অপরাধবোধ হচ্ছে হর্ষর। অগঠিত সম্পর্ক—অমীমাংসিত সমস্যা।
অদিতি বিয়েতে রাজী নয়, এক্ষেত্রে তার কি করার ছিল? তার ওপরে নির্ভর করতে চাইছে অদিতি?
চলে যাওয়ার দু-চারদিন আগে ফোন করার কি কারণ? অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে। শান্ত হতে চেয়ে
ল্যাপটপ খুলে কিছু পেণ্ডিং কাজ নিয়ে বসে। ফোন বাজে, সুমিত গর্গ! বন্ধু জুটিয়ে ভীষণ
মদ খায় ছেলেটা, উল্টোপাল্টা স্ল্যাং বলতে থাকে। হর্ষ ফোন ধরে বিরস গলায় কাটিয়ে দিতে
চায়,
--বিজি
হুঁ ইয়ার।
--আ
জা থোড়া দেরকে লিয়ে।
--আজ
নহীঁ, বহুৎ কাম হ্যায়।
নোংরা
গালি দিয়ে ফোন কেটে দেয় সুমিত। অদিতিকে একবার ফোন করলে কেমন হয়? ও কি নম্বর বদলে ফেলেছে?
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন