শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৯৩


মানুষ তার জন্মগত স্বভাবদোষে সবকিছুরই পরিণতি আশা করে। তা সে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধার্মিক, শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা, ব্যক্তিগত ও সামগ্রীক জীবনযাপন, যাইহোক না কেন। অন্যদিকে প্রকৃতি তার   সৃষ্টিগত স্বভাবগুণে কোনো পরিণতির ধার ধারে না। প্রতিনিয়ত সে ব্যস্ত থাকে তার সৃষ্টির নিত্যনতুন লীলাখেলায়। কোনো নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছনো মানেই তো সেই সৃষ্টির সম্পূর্ণতা! আর সম্পূর্ণতা মানেই স্থবিরতা। কিন্তু প্রকৃতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট তা  নয়। আর এখানেই আসল দ্বন্দ্ব মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বা সৃষ্টির। এবং বিশ্ব সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশেষত কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে, গল্প বা উপন্যাস অথবা উপন্যাসিকা পাঠের পেছনে যে চাহিদাগুলো মূলত সক্রিয় থাকে, তার মধ্যে প্রধান চাহিদা হলো, তারা পাঠশেষে একটা নির্দিষ্ট পরিণতি আশা করে। গল্পের নটে গাছটি না মুড়োনো পর্যন্ত যেন তাদের মন পরিতৃপ্ত হয় না, বরং রসভঙ্গ ঘটে। আর তাই অধিকাংশ লেখকদের তাঁদের পাঠক-পাঠিকাদের এই চাহিদার কথা  মাথায় রেখে, গল্পের বৃত্ত রচনায় মনোযোগী হন। এবং সেই বৃত্তরচনা অর্থাৎ গল্পের উপক্রমণিকা থেকে উপসংহার যে গল্পকার যত নিখুঁত ও নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারেন, তিনি তত পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু গল্প যেহেতু গণিত নয়, তাই কোনো নির্দিষ্ট উত্তর বা পরিণতি তার থাকতে পারে না। সচেতন গল্পকাররা একথা জানেন ও বোঝেন। কিন্তু জনপ্রিয়তা লাভের আশায় অথবা জনপ্রিয়তা হ্রাসের আশঙ্কায় তাঁরা পাঠকদের চাহিদাকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। আসলে সাহিত্যের প্রবাহমান ধারায় গা ভাসানো যতটা নিরাপদ, স্রোতের ধারা অন্য কোনো অভিমুখে বা ‘ডাইমেনশনে’ ঘুরিয়ে দেওয়া ততটাই বিপজ্জনক। এবং সেই প্রয়াস যদি যথার্থই দক্ষতার সঙ্গে যাঁরা করেন বা  করেছেন, সমকালীন পাঠক-পাঠিকা তাঁদের বরণ করার জন্য আগ্রহী না হলেও ভবিষ্যতের পাঠক-পাঠিকা যে উন্মুখ থাকবেন, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে।

আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় আমি একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। উদাহরণটা অবশ্য সাহিত্যের গল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, মূলত চলচ্চিত্রের গল্পের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। সাহিত্যিক অমলেন্দু চক্রবর্তীর একটি গল্প ‘একদিন প্রতিদিন’ অবলম্বনে মৃণাল সেন পরিচালনা করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’ চলচ্চিত্র। সেই গল্পে ও চলচ্চিত্রে একটি মেয়ের গল্প বলা হয়েছে, যে মেয়েটি হঠাৎই একদিন প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে আসে না। যখন ফিরে আসে, তখন রাত অতিক্রান্ত হয়ে ভোর হয়ে এসেছে। ‘একদিন প্রতিদিন’এর প্রিমিয়ার শো হয়েছিল কলকাতার মেট্রো সিনেমাহলে। মৃণাল সেনের মুখ থেকে শুনেছি, তিনি নিজেও সেদিন মেট্রোতে উপস্থিত ছিলেন। ছবির প্রদর্শন শেষ হতে মেট্রোর লাউঞ্জে একদল দর্শক ঘিরে দাঁড়ান তাঁকে। তাঁর কাছে তাঁদের আবদার ছিল, এভাবে ছবির গল্পটা শেষ কেন হয়েছে?  আমরা জানতে চাই, সারারাত মেয়েটি কোথায় ছিল? কী করছিল? উত্তরে মৃণাল সেন বলেছিলেন, মেয়েটি সারারাত কোথায় ছিল, কী করছিল, তা আমিও জানি না। জানার দরকারও নেই। ছবিতে শুধু দেখাতে চেয়েছি, কোনো মেয়ে রাতে  ঘরে না ফিরলে তার পরিবারে ও পাড়ায় কী বিপত্তি ঘটে। গল্পটা শুধুমাত্র  এইটুকুই।  

আসলে মানুষ জন্মগত কারণে, তার জন্মের রহস্য জানতে আগ্রহী হয়েছে তার জন্মমুহূর্ত থেকেই। আবার সেই একই আগ্রহে সে জানতে চেয়েছে প্রাকৃতিক সব রহস্যই। সারাজীবন ধরে তার সেই অন্বেষণ চলে। এবং এভাবেই একে একে অনেক রহস্যেরই সুলুকসন্ধান সে পেয়েও যায়। কিন্তু সেই রহস্যের ভান্ডার এতই বিপুল ও বিশাল যে, জানার থেকে অজানার দাঁড়িপাল্লা সবসময় ভারীই থেকে যায়। এবং যেহেতু সবটুকু জানা সম্ভব হয় না, অনেকটাই অজানা থেকে যায়, সেই অজানার অচেনার পৃষ্ঠভূমিতেই সৃষ্ট হয় সাহিত্যে ও শিল্পকলা।   

যেহেতু আমি এখানে সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি, কোনো প্রবন্ধ বা নিবন্ধ নয়, তাই লেখাটি আর বিশদ করারও কোনো উপায় নেই। তবে যে কারণে এই লেখাটির অবতারণা, তার পেছনে একটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনারা জানেন যে, কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনের প্রতিটি সংখ্যায় আমরা ‘ঝুরোগল্প’ প্রকাশ করি। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ‘ঝুরোগল্প’র ফর্ম বা ফরম্যাট সম্পর্কিত ভাবনা ও ধারণা প্রথম আমরাই উপস্থাপন করি। তবে যেহেতু এখনও পর্যন্ত সাহিত্যের অনেক পাঠক-পাঠিকারা ঝুরোগল্প পর্যায়ে বিশদভাবে অবহিত হননি, তাই তাঁরা ঝুরোগল্পকে গুলিয়ে ফেলেন অণুগল্পের সঙ্গে। কিন্তু বলা বাহুল্য, এই দুটি ফরম্যাটের গল্প কখনই এক নয় এবং তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও সম্পূর্ণ আলাদা। আমার উপরোক্ত আলোচনায় ঝুরোগল্পের সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম সংক্ষেপে। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।

সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।   


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

  


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১১ 




 

এই লেখার চার নম্বর পর্বে কিছু হলিউড ক্লাসিক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম ও বলেছিলাম, কোন এক সময় গোটা পৃথিবীর কিছু ক্লাসিক সিনেমা নিয়েও লিখ্‌  যাতে আলোচনা সম্পূর্ণ হয়। এবার সময় হয়েছে সেই কথা রাখার। আজ খুব বাছাই করে গোটা পৃথিবীর মাত্র বারোখানা ক্লাসিক মাস্টারপিস সিনেমার এক লিস্ট বানাবঅবশ্য শুরুতেই বলে রাখি, আজ ইচ্ছে করেই এই আলোচনায় হলিউডকে ঢোকাবো না। নইলে ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) বা অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১) বা জন ফোর্ডের ‘দ্য সার্চার্স’ (১৯৫৬) বা আলফ্রেড হিচককের ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) হাসতে হাসতে এই ১২টা মুভির তালিকায় ঢুকে যেত।

আমার বাছাই প্রথম চার: রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ (১৯৩৭, ফ্রান্স), ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ (১৯৪৯, ইতালি), ওজুর ‘টোকিও স্টোরি’ (১৯৫৩, জাপান), কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮, ব্রিটেন)

আমার বাছাই পরিবর্ত চার: কুরোসাওয়ার ‘রসোমন’ (১৯৫০, জাপান), বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ (১৯৫৭, সুইডেন), ফেলিনির ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ (১৯৬৩, ইতালি), তারকোভস্কির ‘মিরর’ (১৯৭৪, রাশিয়া)।

পরবর্ত্তী চার: আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫, রাশিয়া), ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’ (১৯২৭, জার্মানি), ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ (১৯৫৯, ফ্রান্স), বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’ (১৯৬১, স্পেন/মেক্সিকো)

হ্যাঁ, একটা কথা আগেই শুনিয়ে রাখি, যেটা মাঝে মাঝেই আমি ফাটা রেকর্ডারের মত বলতে থাকি। মনে রাখবেন, এটা ‘আমার’ বাছাই পৃথিবীর সেরা ১২, ক্লাসিক ও মাষ্টারপিসযেগুলো মুভি সম্বন্ধে পৃথিবীকে বেশ কিছু ব্যাপার শিখিয়েছে – সিনেমা বলতে কি বোঝায়, কিরকম সিনেমা বানাতে হয়, কিভাবে বানাতে হয়অন্য কারো বাছাই সেরা ১২ এর থেকে আলাদা হতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক। যেমন, আমি জানি জগৎবিখ্যাত পরিচালক বা সমালোচকরা কখনোই ইংমার বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ বা ফ্রিজ ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’ বা লুই বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’-কে সেরা ৩০-র তালিকাতেও রাখবেন না। কিন্তু আমি এদের সেরা ১২-য় রাখবো। কেন, সেটা আমি ব্যাখ্যা করব। বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে নির্মাণ ও ক্যামেরা – এগুলো মাথায় রেখে। হয়ত অনেকেই আমার লিস্ট দেখে নাক সিঁটকে বলবেন, ‘রসোমন’ এর জায়গায় ‘দ্য সেভেন সামুরাই’ রাখা উচিৎ ছিল, ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ না রেখে ‘রুলস অব দ্য গেম’ রাখা দরকার ছিল, কার্ল ড্রেয়ারের ‘প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক' নেই কেন, হলিউডের সিনেমাকে ঢোকালে ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’ বা ‘গডফাদার পার্ট ওয়ান’ থাকা উচিৎ ইত্যাদি ইত্যাদিতাহলে অধিক মর্মরে কাজ নেই, ‘আমার’ সেরা ১২ শুরু করি।

ইতালি থেকে আমার ক্লাসিক বাছাই ভিত্তোরিও ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ ও ফেদেরিকো ফেলিনির ‘এইট অ্যান্ড হাফ’এর ভেতর ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ নিয়ে পরে আলোচনা করব। আপাতত এখানে শুধু ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ নিয়েই কাটাছেঁড়া

ফ্রান্স থেকে আমার পছন্দের তালিকায় জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ ও ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ আজ আলোচনায় রাখব শুধু ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’অন্য সিনেমাটা নিয়ে ফ্রান্সের আলোচনার দিন বলা যাবে। রাশিয়া থেকে ক্লাসিক লিস্টে থাকছে সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ও আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘মিরর’তবে আজ শুধু ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ নিয়ে লিখব। জাপান থেকে আমি বেছেছি আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রসোমন’ ও ইয়াসুজিরো ওজুর ‘টোকিও স্টোরি’। যদিও কুরোসাওয়া ও ওজুকে নিয়ে পরে বিস্তারিত কথা হবে, পৃথিবী খ্যাত পরিচালকদের নিয়ে আলোচনার সময়, তবুও আজ ‘টোকিও স্টোরি’ নিয়ে খানিকটা বলবজার্মানি থেকে আমি নিয়েছি ফ্রিজ ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’। এটা আজ আলোচনায় রাখব। সুইডেন থেকে একটিই ছবি, ইংমার বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ বার্গম্যানকে নিয়েও পরে আলোচনা করব, এবং ওনার ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ নিয়েও  স্পেন/মেক্সিকো থেকে নিলাম লুই বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’। অসাধার ক্যামেরার কাজ ও থিম। স্পেন নিয়ে যখন আলোচনা করেছিলাম, তখন  বুনুয়েলের এই সিনেমাকে লিস্টে রাখিনি কার আমরা রহস্য নিয়ে কথা  বলেছিলাম। আজ আমরা এটা শুধু ছুঁয়ে যাব, বিশদ আলোচনা করব না। ব্রিটেন থেকেও একটা - স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’তবে না, এটাও আজ বলব না। ব্রিটেনের ছবি নিয়ে আলোচনার দিন এটা থাকবে। আজ আলোচনা ওপরের কয়েকটা মাত্র ছবি নিয়েই থাক। একদিনে বেশি ভাল খাবার একসঙ্গে হজম নাও হতে পারে।

১৯২৫। সিনেমা তখনো সাবালক হয়নি, নির্বাক। সেই সময় আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫, রাশিয়া) রাশিয়ান জারেদের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালের বিপ্লবের একদম শুরুর দিকের এক দলিল। পোটেমকিন নামক এক কল্পিত যুদ্ধজাহাজে অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধার নাবিকরা খাবারের গুণগত মান নিয়ে  বিদ্রোহ শুরু করে। পোটেমকিন জাহাজ-বন্দরে লাগার পর এই বিদ্রোহ ওডেসা শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান সরকার পুলিশের সাহায্যে অনেক জনসাধারকে  গুলি করে মেরে এই বিদ্রোহ দমন করে। এই গল্প নিয়েই ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’।

বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত সিনেমা, এতই কুখ্যাত যে কোন এককালে বহুবছর ধরে রাশিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য কিছু দেশে এই সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তা সত্বেও এই ছবি সিনেমার একদম শুরুর যুগের এক ল্যান্ডমার্ক। বিভিন্ন দেশে এই সিনেমা ফিল্ম স্টাডির ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যেক শট ধরে ধরে বোঝানো হয়। কার জাক্সটাপোজিশন বা পাশাপাশি দুটো জিনিষের বৈষম্য যেভাবে এই সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা এক কথায় অনবদ্য। একটা উদাহর দিই। নিরীহ মানুষের  ভয়ার্ত মুখ আর পাশাপাশি পুলিসের ভয়ডরহীন প্যারেডঅথবা রাষ্ট্রশক্তির কাছে মানুষ কত অসহায় বোঝানোর জন্য গুলিতে মৃত এক মানুষ আর পরের সিনে পা কাটা এক বিদ্রোহী। হঠাৎ হঠাৎ সিনে কাট্‌, খাপছাড়া মন্তাজ, এগুলো সত্বেও এই সিনেমা এখনো অব্ধি এক মিথ। কার এখানে ব্যক্তিগত কারণে কোন সিন টেনে  বড় করা হয় নি, কোন ব্যক্তিকে এখানে হিরো হিসেবে তুলে ধরা হয় নি, বিদ্রোহকে সমষ্টিগত কার হিসেবেই দেখানো হয়েছে, ১ ঘন্টা ১৩ মিনিটের পুরো সিনেমায়  সাউন্ডট্র্যাক লিরিকাল – এমনকি ওডেসার সিঁড়িতে গহত্যার সময়েও। সিঁড়ি দিয়ে  প্যারাম্বুলেটরে বাচ্চার গড়িয়ে পড়া থেকে শুরু থেকে বয়স্কার চিৎকারের ভঙ্গি অব্ধি কোনটাই অযথা বাড়ান হয়নি। আউটডোর সিনে ক্যামেরার রোলিং, ফোকাসিং, এগুলোও মনে রাখার মত। পোটেমকিন সমুদ্র থেকে এগিয়ে আসছে আর সমুদ্রতীরে সারি সারি ভাসমান ক্যানো – সেই ১৯২৫ সালে এই সিন যেভাবে তোলা হয়েছে, তা আজো শিক্ষণীয়। আমার মতে, এইরকম অ্যাগ্রেসিভ ক্লাসিক ছবি খুব কমই তৈরি হয়েছে।

এরপর আসব ১৯২৭ সালে রিলিজ হওয়া জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের একদম শুরুর দিকের সিনেমা ফ্রিজ ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’ প্রসঙ্গে। জার্মান এক্সপ্রেসনিজম বলতেই আমাদের চোখে ভাসে ‘ক্যাবিনেট অব ডঃ ক্যালিগারি’ (১৯২০) আর ‘নসফেরাতু’ (১৯২২)কিন্তু ‘মেট্রোপোলিস’ শুধু জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের উদাহর হিসেবে নয়, সায়েন্স ফিকশন সিনেমা হিসেবেও ইতিহাসের পাতার শুরুর দিকে থাকবে যা দেখে পরবর্তীকালে ভুরি ভুরি সিনেমা তৈরি হয়েছে। সিনেমার কাহিনি কোন এক ভবিষ্যতের শহরকে ঘিরে। যার ওপরে উঁচু শ্রেণীর জন্য বড় বড় টাওয়ার, স্কাইওয়ে, অলিম্পিক স্টেডিয়াম, অবসরকালীল বাগান। আর মাটির নিচে আরেক সমান্তরাল অজানা জগৎ যেখানে শ্রমিকদের দিয়ে বেশি করে খাটানোর জন্য ঘড়িতে মাত্র ১০ ঘন্টা দেখানো হয়, তারা বস্তিতে থাকে, কাজ করতে করতে সবাই প্রায় মেশিন হয়ে গেছে। এক যুবক যখন এই অজানা জগতের দুঃখ দেখে ফেলে, সে তার পাশে পায় এক যুবতী মারিয়া-কে। আর সেখানে শুরু হয় এক সামাজিক ড্রামা। ভাবুন, কল্পবিজ্ঞানের ছলে দেখানো সমাজের দুটো সমান্তরাল শ্রেণী যা মার্কসের সময় থেকে আজ অব্ধিও ভয়ঙ্করভাবে প্রাসঙ্গিক। এই সিনেমার বিশেষত্ব হল অনেক বড় বড় সেট, হাজার হাজার এক্সট্রা অভিনেতা, দারু স্পেশাল এফেক্ট  – এগুলো সেই সময়ে প্রায় অকল্পনীয়। আমি এর সঙ্গে জুড়তে চাই ক্যামেরার আলোছায়ার কাজ আর ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, যা না দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না। আর পুরো সিনেমা জুড়ে কিছু না বলেও বারবার সমাজের এই ক্লাস সিস্টেমকে চাবুক মারা। যেখানে ফ্যাক্টরিতে এক শিফট্‌ শেষ হয়ে আরেক শিফট্‌ শুরু হচ্ছে, শ্রমিকরা একদিকে রোবটের মত ঢুকছে আর অন্যদিকে বেরিয়ে আসছে, সিনটা দেখলে শক্ত মনের মানুষও ভাবুক হয়ে উঠবে।

সায়েন্স ফিকশন হিসেবে এই সিনেমার অনেক ত্রুটি আছে। কিন্তু এই সিনেমাকে একদম ওপরের ক্লাসিক হিসেবে না রাখলে সাই-ফাই জেনারেশনকেই অস্বীকার করতে হবে। প্রায় একশ বছর আগে এক্সট্রা অভিনেতাদের ঠান্ডা জলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত তাদের মধ্যে রোবটের মত চলাফেরা আনার জন্য বা নায়িকাকে উঁচু জায়গা থেকে লাফ মারতে বাধ্য করা হয়েছিল বা তার গায়ে সত্যিকারের আগুন লাগানো হয়েছিল বা সেটের ভেতরে আয়না রেখে লোকজনকে ছোট দেখিয়ে মিনিয়েচার সেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হত যাতে এক শটেই পুরোটা টেক করা যায় – এগুলো এখন শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে। জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর সাথে সাথেই আলোছায়ার মাঝে আসল ও নকল মারিয়ার মুখের ভঙ্গি, ফ্রেডারের ভয়ার্ত মুখ – পুরোটাই উপভোগ্য। এবং ২০০৮ সালে এই সিনেমার ১৫৩ মিনিটের পুরো আদি সংস্কর খুঁজে পাওয়ার পর মনে হয়, এখন, এই সিনেমার ক্লাসিক উপাধি নিয়ে সমালোচকদের দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়।  

জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ ১৯৩৭ সালে ফ্রান্সে তৈরি হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এক রোমহর্ষক ছবি যা একইসঙ্গে সূক্ষ্ম, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অনুভূতিপ্রব। তদ্দিনে  অবশ্য সিনেমা খানিকটা সাবালক হয়ে গেছে, অর্থাৎ এই সিনেমা সবাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের হাতে বন্দী কিছু ফ্রেঞ্চ সেনা-অফিসার পালানোর প্ল্যান করে। কিন্তু সেই প্ল্যান কার্যকর হবার আগেই এক সেনা অফিসারকে অন্য এক দুর্গম জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এদিকে জার্মান অফিসার ও বন্দী ফ্রেঞ্চ অফিসারের ভেতর বন্ধুত্ব বেড়েই চলে যেহেতু দুজনেই তথাকথিত উঁচু শ্রেণীর মানুষ। অবশ্য তার মাঝেই সেই ফ্রেঞ্চ অফিসার আবারো তার মেকানিক-কে নিয়ে পালানোর প্ল্যান বানান।

আমি মনে করি এই সিনেমার বিশেষত্ব হল রেনোয়া একবার যুদ্ধ বাজে বা  অর্থহীন বা বিয়োগান্তিক, এসব কিছুই ক্যামেরায় না বলেও প্রতি ছত্রে বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘ওরে হল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল্‌’। ইউরোপিয়ান সভ্যতার একটা ক্লাস কনসাসনেস ছিল, বিশেষ করে উঁচু শ্রেণীর। রেনোয়া এই ছবিতে সেই ইলিউশন ভেঙে দিয়েছেন। দেখাতে চেয়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কর্তৃত্ব চলে গেছে সাধার মানুষের হাতে। আমি এই সিনেমাকে পরাবাস্তব বা ব্যঙ্গ ছবি বলব না, বরং মানবতাবাদী বললে ঠিকঠাক আখ্যা দেওয়া হবে। আমার দেখা-চেনা সিনেমা জগতে ফ্রান্স থেকে তৈরি হওয়া এটাই প্রথম সূক্ষ্ম ও বুদ্ধিদীপ্ত ছবি, যে কারণে আমি একে ক্লাসিক লিস্টে রাখতে দ্বিধাবোধ করিনি। এবং একজন  ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার কাছে এই সিনেমার প্রধান আকর্ষ এর  সিনেমাটোগ্রাফি। রেনোয়ার ছবিগুলোর এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ক্যামেরার গ্লাইডিং, অনেকটা পাখির মত। ফলে একটা সিন যেন শেষ হয়েও চোখের সামনে রয়ে যায়। এই সিনেমায় তার অসাধার কিছু উদাহর আছে। যেমন ক্যাম্পে খাবার সময়। ক্যামেরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে, প্রতি খুঁটিনাটি ক্যামেরা বন্দী হতে থাকে, এক  চলমান ফ্রেমের মত – যতক্ষ না এই সিনের দরকার ফুরোয় (আমার মনে হয়  রেনোয়ার এই ক্যামেরা মুভমেন্ট থেকেই সত্যজিৎ রায় প্রতি সিনের ডিটেলিং শিখেছিলেন)। এর ফলে ব্যক্তিগত ডিটেলিং আলাদা করে দরকার হয় না, অনেক ফুল নিয়ে গাঁথা মালার মত এক বড় সিনে সেটাও এক অংশ হয়ে রয়ে যায়। এর সঙ্গে আছে এই ছবির অভিনয়। অপূর্ব। এই মুভি দেখার পর ক্যাপ্টেন ভন রফেনস্টাইন-কে কি আদৌ ভোলা যায়? এবং এই সমস্ত কারণেই ‘দ্য গ্র্যান্ড  ইলিউশন’কে খানিকটা এগিয়ে রেখেছি ‘রুলস অব দ্য গেম’-এর (১৯৩৯) থেকে।  

আমেরিকায় একটানা ২৬ সপ্তা জুড়ে চলা সাড়া জাগানো এই সিনেমাও কিন্তু ইতালি আর জার্মানি-তে অনেক বছর নিষিদ্ধ ছিল। এবং একসময় ফিল্মের নেগেটিভ হারিয়ে গেছিল। বহু বছর পর সেই নেগেটিভ পাওয়া যায়। আবার হইচই শুরু হয়। একেই হয়ত বলে পোয়েটিক জাস্টিস। এই সিনেমার লাইন ধরেই বলতে হয় - ‘নেইদার ইউ নর আই ক্যান স্টপ দ্য মার্চ অব টাইম’  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে নব্য-বাস্তবতার ঢেউ উঠেছিল, তার সার্থক রূপায় ভিত্তোরিও ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ (১৯৪৯)একে ড্রামা না বলে  রূপক কাহিনী বলাই ভাল। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত রোমে এক বেকার যুবক অ্যান্তনিও এক কাজ খুঁজে পায় – দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর। শর্ত একটাই – নিজস্ব সাইকেল থাকতে হবে। অ্যান্তনিওর স্ত্রী বিছানার চাদর বেচে তার পুরনো সাইকেল দোকান থেকে ছাড়িয়ে আনে। এবং অ্যান্তনিও বেরিয়ে পড়ে নতুন চাকরিতে। কিন্তু বিধি বাম। সাইকেল চুরি যায়। চোর ধরতে না পারলে সংসার চলবে না, অতএব অ্যান্তনিও নিজের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে চোর ধরতে। চোর ধরা পড়ে না, কিন্তু অ্যান্তনিও হতাশার বশে অন্য একজনের সাইকেল চুরি করতে যায় ও ধরা পড়েঅনবদ্য থিম। এবং আজো প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে এই কোভিড পিরিওডে যখন চাকরি নিয়ে মানুষের মধ্যে হাহাকার। 

লুইগি বার্তোলিনির বিখ্যাত উপন্যাস (১৯৪৬) অবলম্বনে এই ছবি সিনেমার ইতিহাসের এক অন্যতম সহজ, শক্তিশালী ও উজ্জ্বল আর্ট-ফিল্ম। আমার এই ছবি আরো ভাল লাগে এর ক্যামেরার কাজের জন্য। একদম শুরুর সিনটা ভাবা যাক। একটা বাস আস্তে আস্তে এসে নতুন তৈরি হওয়া এক হাউসিং-এর মধ্যে দাঁড়াল, তার থেকে ভিড় বেরিয়ে মিশে গেল অন্য এক শটে এক বাড়ির সামনে, চাকরির আশায়। ক্যামেরা ধীরগতি। এরপর অ্যান্তনিও ভিড় থেকে আলাদা বসে। বেকারত্বের হতাশায়। সেখান থেকে একজন এসে তাকে কিছু বলার পর সে গিয়ে ভিড়ে মিশে গেল। ফ্রেমিংটা দেখুন। আর ঠিক এখানেই আপনার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ ভাল লেগে যাবে। কার ক্যামেরা ইচ্ছে করলেই অ্যান্তনিওর সঙ্গে রোল করে এগিয়ে  যেতে পারত। কিন্তু তা না করে ক্যামেরা নায়ককে ভিড়ের ভেতর মিশে যেতে দিয়ে বুঝিয়ে দিল ঐ সমস্ত বেকারদের মাঝে সেও একজন। সিন কাট্‌। তারপরের সিনেই ক্যামেরা অ্যান্তনিওকে ধরে ফেলল। এরপর ক্যামেরা কখনো দর্শকের ভূমিকায়, কখনো অ্যাকশনে। রোমের রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি চলে যাচ্ছে, সেটা ক্যামেরা যেমন দোতলার জানলা থেকে চুপচাপ দেখল, তেমনি টানেলের ভেতরে গাড়ি চেপে অ্যান্তনিওর এক সাইকেল তাড়া করে যাওয়া, সেটা ক্যামেরায় বেশ টানটান উত্তেজনা তৈরি করল। এই মুভি কেন সত্যজিতের এত ফেভারিট, সেটা না দেখলে বুঝবেন না। কেন সিনেমা জানতে, বুঝতে ও শিখতে হলে এই সিনেমা দেখা আবশ্যিক, সেটাও ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট একটানা না দেখলে বুঝবেন না। হ্যাঁ, যে কথাটা না বললে এই সিনেমার আলোচনা অসম্পূর্ণ  রয়ে যাবে, তা হল অ্যান্তনিওর  ছেলের রোলে ৯ বছর বয়সি এনজো স্টায়োলার দুর্দান্ত অভিনয়। এবং তার চোখের অভিব্যক্তি।  

ইয়াসুজিরো ওজু এবং তার ‘টোকিও স্টোরি’ (১৯৫৩) নিয়ে আমি পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপাতত এটাই বলি যে ওজুর এই সিনেমায় আমার ভাললাগার প্রধান বিষয় হল ডায়লগ এবং মধ্যবিত্ত জীবনধারাওজুর সিনেমায় ক্যামেরার কাজ খুব একটা ভাল লাগবে না কার উনি মাটি থেকে কম উচ্চতায় ক্যামেরা  রাখতেন এবং প্রায় সমস্ত সিনেই ক্যামেরা হত স্ট্যাটিক যদিও ওজুর ক্যামেরার এই স্ট্যাটিক প্লেসিং আর অ্যাঙ্গল জাপানের সনাতনী প্রথাগুলো ভাল ফুটিয়ে তুলতে পারত বলেই সমালোচকরা মনে করেন, আমার মনে হয়েছে এর ফলে কোথাও কোথাও সিনগুলো স্লো হয়ে গেছে, ফ্রেমিং মার খেয়েছে। যদিও এই সিনেমার অন্যতম আসল ভাললাগা লুকিয়ে আছে এর প্লট আবেগপ্রব হয়েও মেলোড্রামা না হওয়ার মুন্সিয়ানায়।   

লুই বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’ (১৯৬১) এক সাহসি মাস্টারপিস। এর থিম এমন ছিল যে স্পেনে ও ভাটিকান সিটিতে এই সিনেমা বহুবছর নিষিদ্ধ ছিল ‘ব্লাসফেমাস’ হিসেবে। এক যুবতী সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে সিনেমা চার্চ তো ভাল চোখে দেখবে না, সেটা ঠিক। অবশ্য এটাও ঠিক যে বুনুয়েলকে ব্ল্যাক কমেডি-র প্রাণপুরুষ বলা হয়ে থাকে। সেটা ‘ডিস্ক্রিট চার্ম অব বুর্জোয়া’ (১৯৭২) হোক বা ‘এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ (১৯৬২)সমস্যাটা হচ্ছে, বুনুয়েল সুররিয়েলিস্ট সিনেমা বানালেও সেটা সামাজিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। আর এজন্যই বুনুয়েলের সিনেমা বহুমাত্রিক। তাই আজো ভিরিডিয়ানা নিয়ে বিতর্ক থামেনি। কার এই সিনেমা প্রশ্নাতীত ভাবেই বুনুয়েলের  সেরা সিনেমা। বলে রাখি, এখানে ক্যামেরায় ডিপ ফোকাসের ব্যবহার বেশ ভাল।

তাহলে আমার সেরা বারোয় (হলিউড বাদে) যে যে দেশ উঠে এল, তারা হলঃ ইতালি, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, স্পেন, ব্রিটেন ও মেক্সিকোহয়ত এই লিস্টে আমি ইতালি বা ফ্রান্স থেকে আরো একটা করে সিনেমা নির্বাচন করতে পারতাম, কিন্তু তাহলে অন্য দুটো দেশ বাদ পড়ত যেটা আমি চাইনি। কার আমার মুখ্য উদ্দেশ্য পাঠককে গোটা পৃথিবীর সেরা ক্লাসিক ছবিগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, শুধু কয়েকটা দেশের ছবি নয়।  

পরিশেষে, ভাল লাগত যদি নিচে লেখা সিনেমাগুলোও আজ আমার ‘টাইমলেস ক্লাসিক’ লিস্টে রাখতে পারতাম যেগুলো আমার বিচারে সেরা ২০-র ভেতর অবশ্যই আসবে – রিডের ‘দ্য থার্ড ম্যান' (১৯৪৯, ব্রিটেন), ড্রেয়ারের ‘অর্ডেট’ (১৯৫৫, ডেনমার্ক), সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫, ভারত), ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ (১৯৬০, ইতালি), গোদারের ‘ব্রেথলেস’ (১৯৬০, ফ্রান্স), অ্যান্তনিয়নির ‘রেড ডেসার্ট’ (১৯৬৪, ইতালি), বার্গম্যানের ‘পারসোনা’ (১৯৬৬, সুইডেন), এরিসের স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ (১৯৭৩, স্পেন)হ্যাঁ, এটাও বলে রাখি যে আমার পছন্দের আরো দুটো ছবি – কিয়ারোস্তামির ‘ক্লোজ-আপ’ (১৯৯০, ইরান) এবং কার-ওয়াইয়ের ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ (২০০০, চিন) এই ক্লাসিক লিস্টে থাকতেই পারত। রাখিনি শুধুমাত্র সাম্প্রতিক সিনেমা বলে। অবশ্য যেদিন ইরান বা চিনের ছবি নিয়ে আলোচনা করব, এগুলো অবশ্যই থাকবে।


শিবাংশু দে


অমৃতা




সম্প্রতি গিয়েছিলুম মংপু। সেখান থেকে ফিরে মৈত্রেয়ী দেবীকে মনে পড়লো আবার। তাঁর প্রসিদ্ধ লেখা 'ন হন্যতে' আমাকে টানেনি কখনও। কিন্তু 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' চিরকালই আমার লেখার টেবিলের সঙ্গী। সামনেই থাকে। কবির যে কজন 'বসওয়েল' বা 'শ্রীম' ছিলেন, দুই 'রানি'-সহ মৈত্রেয়ী, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কবিকে চিনতে তাঁরা আমাদের হাত ধরেন। 

মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিও এভাবে জড়িয়ে আছে আমার। সাক্ষী একটি কবিতা।  কাঁচাবয়সী  এক বালকের,  কবি গোপালহরি ​​​​​​​বন্দ্যোপাধ্যায়ের  আদেশে লিখে ফেলা একটি কাঁচা পদ্য। পটভূমিকাটি ছিলো একটু আলাদা। মৈত্রেয়ী ​​​​​​​দেবীর  জন্মদিনে একটি সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিলো আমাদের গ্রামে। জামশেদপুরে, টেলকো ক্লাবের প্রেক্ষাগৃহে। 'ন হন্যতে'-উত্তর মৈত্রেয়ী দেবী তখন তিনি। এই দীর্ঘ পদ্যটি প্রস্তাবনা হিসেবে আমাকে পড়তে হয়েছিলো। সময় ​​​​​​​গিয়েছে চলে ​​​​​​​চার দশকের পার। সম্প্রতি 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' আরেকবার পড়তে গিয়ে লেখাটির ​​​​​​​কথা ​​​​​​​মনে ​​​​​​​পড়লো। খসড়া লেখা ছিলো একটি পাতলা ফুলস্কেপ কাগজে। তা দেখেই পড়েছিলুম সেদিন। পড়ার পর মঞ্চ থেকে যখন নেমে যাচ্ছিলুম, মৈত্রেয়ী দেবী আমাকে ​​​​​​​ডাকলেন। 'শোনো'! কাছে যেতে বললেন 'কবিতাটি আমায় দেবে না?' আমি তো রীতিমতো বিব্রত। এই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি তাঁকে 'দেবার' ধৃষ্টতা আমার ছিলো না। আবার বললেন, 'এই কাগজটাই দিয়ে দাও আমাকে'। তাঁর এই  প্রশংসিত উৎসাহ আমাকে ​​​​​​​আরও ​​​​​​​দীন ​​​​​​​করে ​​​​​​​ফেলে। অথচ সেই বয়সে বেশ  আত্মপ্রসাদও লাভ করেছিলুম।  জানি, লেখাটির গুণগত মান বিচার্য ​​​​​​​নয়। ​​​​​​​তাই ​​​​​​​কখনও ​​​​​​​ছাপতেও ​​​​​​​দিইনি ​​​​​​​তাকে। কিন্তু ব্যক্তি আমার কাছে এর কিছু মূল্য থেকে গেছে। সেই সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ পূর্বসূরিই আর আমাদের মধ্যে নেই। সমকালীন কে কে আছেন এখনও, মনে নেই। 

এটির অস্তিত্ব প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম, কিন্তু জীর্ণ প্যাপিরাসের মতো কোনও একটা খাতা থেকে খুঁজে পাওয়া গেলো।  এতোদিন পরে পড়তে গিয়ে দেখলুম, হয়তো আর একবার পড়া যেতেও পারে। বনপাহাড়ে  সম্পৃক্ত শহর জামশেদপুর আর জেলা সিংভূমের আবহে আমাদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠার কিছু ইঙ্গিত এখানে প্রত্যক্ষ। 

 

অমৃতা

 

এইখানে

বনস্থলী ছিলো

এখন দুর্বোধ শহুরে চিতারা তৎপর

 

ডলোমাইটের রেঞ্জ কতোদূরগামী

ততোদূর মগ্ন সিংভূম জংশন

আমরা শিকড় পুঁতেছি

এইখানে

 

কতো দীর্ঘ শালবন ধ্বস্ত করে

ধূর্ত চিমনির নোংরা হাত

জ্যোৎস্নাকে

অমাবস্যার চেয়ে ম্লান বেইজ্জত

করে যায়

 

এইখানে

 

আমরা সবাই রাতডিউটি দিই

ভাই-বন্ধু-পরিজন

প্রত্যেকে বিভিন্ন রাতে

নিজেদের বিভিন্ন অন্ধকারে

হাহা হাসি হাহাকারে

গলা চিরে খুঁজে নিতে চাই

নিজেদের মুগ্ধ গৃহকোণ

স্ল্যাগের কমলা আলোয়

খুঁজে নিতে চাই

বালি মাটি ঘাস উপড়িয়ে

বাপদাদার ফেলে যাওয়া নাভিকুন্ড

আমাদের কেউ ছিলো

আমাদের কেউ থাকবে

আমরা শিকড় পুঁতেছি

 

এইখানে

 

জন্মদিন

মানে আরও একপাত্র সোনালি অমৃত

শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া

ঘাস, বুনোফুল, ঝরাপাতা

টুকুন মউয়ার বাস

স্মৃতিকে জড়িয়ে

সত্ত্বাকে মাড়িয়ে

বোধি চূর্ণ করে

ক'ফোঁটা মহার্ঘ মদ

আমাদের জিভে ঢেলে দেয়

সেই প্রেম

কখনো মরেনা

কখনো মরেনা পদ্মঝিলে ডুবে

বাতার ফাঁসির টানে

মরেনা

নিজের রক্ত চুষে

নিজের মাংস ছিঁড়ে

 

যা মরেনা

তাই নিয়ে তুমি কিছু লেখো

তোমার অমৃতের ভাগ

এসো ভাগ করে নিই

তোমার জন্মদিনে তুমি তো অনিঃশেষ

যেমন মানুষ থাকে প্রত্যেক

জন্মদিনে

 

তুমি তো কবিকে দেখো পাহাড়ি বাংলোয়

চায়ের বাগান আর

সিনকোনা উদ্যানে

দেবদারু সাইপ্রেস অবিরল রোদের

ধারায় ফুরফুরে শাদা দাড়ি

আমাদের পিতামহ

আমাদের কবিকে

দেখেছো অম্লান

 

এখনও কি সেই লোক

তোমায় স্বপ্নে কিছু বলে

কিছু কি বলে

 

তার সোনার কাঠিটা কই গেলো

কোথায় রয়েছে

তার প্রাংশু অধিকার

আমরা এখনও এতো রোগা কেন

তার কোনও চিঠি আজ

তুমি কি শোনাবে

আমাদের

 

আমাদের কবিকে দেখি ঘর্মাক্ত

জষ্টিমাসে ফার্নেসে তাত মাপে

মুর্মু মেয়েটির

কালোচুলে শালতেল

লাল কৃষ্ণচূড়া

তার চোখে শীতলতা এনে দেয় নাকি

রবীন্দ্রসংগীতের শান্তি আনে

নিরাময়  কবিতার দিন

এনে দেয়

 

সে কি আমাদের দেখে

এখনও তেমনি ভালোবাসে

আমাদের এদেশে শিকড়

 

এইখানে

 

এসো বন্ধু

মিত্রা মৈত্রেয়ী পারমিতা

তার স্মৃতি

উষ্ণউর্বর পরাগ

অবিরল  এখানে ছড়াও  

 

আমাদের কাঁটাবন

ধন্য করে  একটি গোলাপ ফুটুক

মনভোলা 

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

 

উত্তম থেকে মধ্যম পুরুষ: সুমনের গানে রাজনীতি আর ভালবাসার কামনাপাঠ

 


সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর সুমন -- সময়ের অনুক্রমে দু’দশক পর ওঁকে নিয়ে  লিখতে বসে প্রত্যেক বারের মত এবারও বাধ সাধছে দূরত্বহীনতা, বাধ সাধছে আমার বেড়ে ওঠার লতায় পাতায় ওঁর গানের সরব এবং অরব উপস্থিতি। আর যা বাধ সাধছে তা হলো আমার সাঙ্গীতিক প্রশিক্ষণের অভাব। আমি সাহিত্য এবং দর্শনের ছাত্র; তাই এই লেখার শুরুতেই আমার সাঙ্গীতিক অপারগতা স্বীকার করে নিয়ে সুমনের গানের এক বিষয়ভিত্তিক এবং সাহিত্য ও দর্শন লালিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব কারণ লিখতে তো হবেই। লেখার যে দায় আছে আমাদের! আমাদের সময়ের অন্ধকারে সুমনের যদি অহর্নিশ গান বানানোর  দায় থাকে তবে আমার তথা আমাদের দায় হলো সেই সময়ের শরিক হয়ে সুমনের গানকে প্রতি-প্রতর্কের আলোয় তুলে ধরা। সুমনের গানের অভিসন্ধি এমন এক প্রতর্ক যা তার প্রত্যুত্তরে আরো প্রতর্ক, আরো অভিসন্ধি দাবি করে। এভাবেই তাঁর গান রাজনৈতিক সংলাপ তৈরী করে। সুমন নিজেই লিখেছেন 'দেখাতে পারিনি আমি কোনো উপমায় / যে আমিকে তুমি তার সময়ে দেখোনি'। সুমনের উত্তরকালে আমরা কি সুমনের সমসময়ের এই আমি'কে তুলে ধরতে পারবো? উত্তরকালের কাছে সমকাল নিজেই অতীত! সে কি বুঝে নিতে পারে আমির জটিল চলন, তার বর্তমান থেকে তার অতীতে যা নির্মাণ করে তার ভবিষ্যৎ! হয়ত তখন আর সমকাল সেখানে এসে একা চ্যাপলিন হয়ে বসবে না, হয়ত তখন আমরা এক অন্য সুমনকে পাবো, এই সুমনকে নয়। সেই কারণেও বর্তমানের এই ঘটমানতার কাছে আমার বা আমাদের দায় থেকে যায়: সুমনকে নিয়ে প্রতর্ক নির্মাণের দায়।

ইতালির দার্শনিক জর্জীয় আগাম্বেন বলেছেন প্রকৃত সমসাময়িক তিনি যিনি তাঁর সময়ে থেকেও সেই সময়ে বিচরণ করেন না। প্রকৃত সমসাময়িকের সাথে তাঁর সমসময়ের এক জটিল দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কথা বলেছেন আগাম্বেন--'It is that relationship with time that adheres to it through a disjunction and an anachronism.' সুমনের গান সমসাময়িকতার এমন এক স্বাক্ষর যা সময়ের সঙ্গে এই দ্বিবিধ সম্পর্ক অনবরত বজায় রেখে চলেছে। এই গান আমাদের সময়ের বিবেক পাহারাদার, আমাদের নৈতিক সংবাদদাতা আবার সমসময়ের ক্ষমতাতন্ত্রের দিক থেকে যা কিছু প্রভুত্ত্বকামী এবং সংখ্যাগুরু তাদের প্রতিস্পর্ধী। সুমনের গান কালোত্তীর্ণ এবং সেই অর্থে সময়হীন কিন্তু এখানে সেই প্রসঙ্গ ব্যতিরেকেই আমাদের সমসাময়িকতার দ্বন্দ্বকে বুঝতে হবে। সমসাময়িক তাঁর সময়ের সঙ্গে ওই প্রতিস্পর্ধার সম্পর্ক তৈরী করতে পারেন বলেই অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে একটা দূরত্ব থেকে নিজের সময়কে বিশ্লেষণ করতে পারেন। আগাম্বেন বলেছেন--'The contemporary is he who firmly holds his gaze on his own time so as to perceive not its light, but rather its darkness.' দু’দশক পেরিয়ে গেল এই প্রেমহীন সময়ের  অন্ধকারে বসে গান বানাচ্ছেন নাগরিক কবিয়াল। জোনাকিকে ধরে এনে অন্ধকারটাকেই তো চিনিয়ে দিতে চাইছেন, মন্থন করতে চাইছেন। এই কারণে সুমন কাউকে তার নিজের সময়ে দেখার ওপর এতো গুরুত্ব দিচ্ছেন। আগাম্বেনের বয়ানে সমসাময়িক মানুষটি তাঁর সময়কে তফাৎ থেকে দেখতে পারেন বলেই তাকে ভাগ করে একটি সময়কে অন্যান্য সময়গুলোর সাথে মিলিয়ে দিতে পারেন: '[...] he is also the one who, dividing and interpolating time, is capable of transforming it, and putting it in relation with other times.' সুমনের গান এক ইতিহাস রচনা করতে পারে যা হয়ে ওঠে এক সময় দিয়ে অন্য সময়কে বদলে দেবার ইতিহাস। সুমনের গান এমনই এক বদলে দেবার ইতিহাসের মুখ চেয়ে থাকে। তাই বোঝাতে না পারলেও তাঁর কাব্য দিয়ে সুমন অন্য এক সময়ে বসে হাফিজের প্রথম প্রেমিকাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকেন। সময়টাকে কামড়ে ধরে বাঘের শিকার ধরার মত 'দুঃসময়' টাকেই ধরে আনে তাঁর গান।

সুমনের গানে বারবার যেসব অনুষঙ্গের পুনরাবৃত্তি দেখা যায় তাদের অন্যতম হলো প্রেম এবং রাজনীতিকে এক একক বন্ধনীর মধ্যে নিয়ে আসা। প্রেমের গানকে তিনি বিদ্রোহের গানে পরিণত করেছেন এবং বিদ্রোহকে প্রেমে। প্রশ্ন করেছেন 'প্রেমিকা আমার কবে বিদ্রোহ হবে?' সুমন বলেছেন, ৭০এর শেষে ভারতীয় রাগসঙ্গীৎ ছেড়ে নিজের গান রচনা করতে শুরু করার পেছনে ছিল সমসময়ের রাজনীতিকে ধরতে চাইবার ইচ্ছা; এখন যে রাগসঙ্গীতকে (বাংলা খেয়াল) তিনি রাজনৈতিক আঙ্গিকে পরিণত করতে উদ্দ্যোগী হয়েছেন। সুমন লিখেছেন 'ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করো প্রেমের পদ্যটাই / বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্ব্যি শুধু তোমাকেই চাই'; চুম্বনকে ব্যারিকেডের রূপকের কাছে এনে তিনি রাজনৈতিক প্রতিরোধ আর প্রেমকে এক করে দিয়েছেন। যে বাতাস তাঁর গানে বদলের নিশান হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে সেই বাতাসও প্রেম আর প্রতিরোধকে মিলিয়ে দিয়েছে:

'ধারা পাল্টায় মাও সে তুঙের চীন

প্রেম পাল্টায়, শরীরও পাল্টে যায়

ডাকছে জীবন, আয় পাল্টাবি আয়।'

এমন আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় কিন্তু আমার মনে হয় না সুমনের শ্রোতাদের কাছে রাজনীতি ও প্রেমের এই মিলমিশ নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকবে। আমরা বরং দেখি সুমনের গান কীভাবে এই মিলমিশ ঘটায়। এই ঘটানোটা শুধু টেকনিকের ব্যপার বলে আমার মনে হয় না। সুমনের গানের সৃজনী বিশ্বাসের অন্তর্লীন নান্দনিকতা প্রভাবিত করে এই যোগাযোগকে। সুমনের গানের লিরিককে আশ্রয় করে রাজনীতি ও প্রেমের অন্তরঙ্গতা নিয়ে এবার কিছু কথা বলা যাক।

১৯৯২ সালে 'তোমাকে চাই' ক্যাসেটের সমনামী 'তোমাকে চাই' গানটি দিয়ে সুমনের উত্থান এবং এত বছর পরেও হয়ত জনপ্রিয়তার বিচারে এই গানটি দিয়েই সুমনপ্রেমীদের বাইরে অধিকাংশ লোক তাঁকে চেনেন। এই গানটি সুমনের লেখা এবং সুর করা সেরা গান কিনা তা বিতর্কস্বাপেক্ষ এবং আমি সেই বিতর্কে যেতে চাই না। তবে আমার মনে হয় 'তোমাকে চাই' সুমনের গানের একেবারে মূল ভাবটিকে আমাদের সামনে এসে হাজির করে; ভাব বলছি, কিন্তু এটা আদৌ কোনো ভাব বা ভাবনা নয়; এটা এক সক্রিয়তা যাকে আমরা 'সম্বোধন' বলতে পারি। সুমনের গান আহ্বানের গান; গণসঙ্গীতের নন্দনপুষ্ট স্বতত এই সম্বোধনক্রিয়া 'তোমাকে চাই'-এর অন্তর্লীন চালিকাশক্তি। সুমনের গানের ভরকেন্দ্রে রয়েছে এই রাজনৈতিক সংলাপ যা 'আমি' থেকে 'তুমি'র দিকে নির্মাধ্যম সেতুবন্ধনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। অলংকারশাস্ত্রে যাকে বলে 'Apostrophe' বা কারুর উদ্দেশে প্রতক্ষ উচ্চারণ, সুমনের গানের সর্বত্র এমন এক তোমাকে চাওয়ার ডাক শোনা যায়। ওই ডাকের মধ্যে দিয়েই ওঁর গান আমাদের উদাসীন থাকতে বারণ করে; সাড়া দিতে আহ্বান জানায়। তাই ওঁর গানে 'তুমি'র আধিক্য। এই 'তুমি' গানের শিকড়ে সংলাপসম্ভাবনার মন্ত্র সঞ্চার করে। গান এক থেকে বহুর দিকে হাত বাড়ায়, সম্মিলিত হবার ইচ্ছা যুগপদে প্রেম এবং রাজনীতির কমিউনের দিকে এগিয়ে যায়। আর এই কারণেই সুমনের গানে প্রেম রাজনীতি আর রাজনীতি প্রেম হয়ে ওঠে। এই দুইয়ের পারস্পরিক পরিবর্তন বিপ্লবের স্বাক্ষর হয়ে যায়।

উত্তম পুরুষ (আমি) থেকে মধ্যম পুরুষগামী (তুমি) এই সম্বোধন সুমনের গানে রাজনীতি এবং প্রেমের সমার্থকতা তথা তাদের সমীভবন-গ্রন্থি। সুমনের গান এই সম্বোধনের প্রতিশ্রুতিকে ধারণ করার মাধ্যমেই রাজনীতি আর প্রেমকে মিলিয়ে দিতে পারে। প্রেম আর প্রতিস্পর্ধার রাজনীতির যোগসূত্র হলো আমির একাকিত্ব থেকে সমন্বয়ের দিকে যাত্রা করা আর এই যাত্রায় তুমির প্রতি বন্ধুতা অবশ্যম্ভাবী। সুমন বারবার তাঁর গানে এই তুমিকে নানাভাবে মোবিলাইজ  করেন। চুম্বন এখানে ব্যারিকেডের আকার ধারণ করে। সুমনের গানে তুমির ছড়াছড়ি, কখনো কখনো অন্তরঙ্গার্থে 'তুই', কিন্তু সেই তুলনায় 'সে' খুব কম। অল্প কয়েকটি গান যেখানে সুমন প্রথম পুরুষ (সে) ব্যবহার করেন সেখানে প্রায় অনিবার্যভাবে তার চলে যাবার কথা থাকে, যেমন 'সে চলে গেলেও থেকে যাবে তার স্পর্শ আমারই হাতের ছোঁয়ায়' কিম্বা 'ফিরিয়ে দিইনি নিজেই গিয়েছে চলে'র মত উদাসী বিরহযাপনের গানে। 'তুমি'র মধ্যে যে রক্তমাংসের উপস্থিতি আছে 'সে'র পরোক্ষতায় সেই স্পন্দন অনুপস্থিত। তাই কখনো কখনো বিরহের অনুপস্থিতির 'সে'কেও তিনি 'তুমি' তে পরিণত করেন, যেমন 'বাতাস গাইছে গান' এর মধ্যে 'তুমি কেন সাথে নেই' কিম্বা 'গালিবের গানে' 'মনে রেখে দিলাম এখানে / তুমি ছিলে কবিতায় গানে'। 'তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো', 'তুমি এলে' 'তুমি চললেই', 'তোমার কথার রং', 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা', 'তোমার সঙ্গে একা', 'তুমি বললেই হবে', 'তোমাকে দেখছি' 'দেখছি তোকে', 'হারিয়ে যেও না' 'তুমি তোমার গল্প বলো ', 'তোমার তুলনা', 'কাঙালপনা', 'খোদার কসম জান', 'তুই হেসে উঠলেই', 'বন্ধু কি খবর বল', 'হাল ছেড়োনা বন্ধু', 'এক মুহূর্তে ফিরিয়ে দিলে', 'গান তুমি হও' 'কখন  তোমার দেখা পাব' 'ফেরারী দিনে তুমি এলে সহসা', 'কেননা তুমি তো', 'জনতার হাতে হাতে ঘোরো তুমি নিশানের মত' -- এই তালিকা অসমাপ্য। সুমনের গান পদে পদে এমন অজস্র তুমি উগরে দ্যায়। এভাবে সে শ্রোতাদের সঙ্গে যেমন নিবিড় এক নাড়ির টান তৈরী করে, তেমন লালন করে প্রেম এবং বদলের রাজনীতি উভয়েরই গভীরে থাকা মানুষের এই সংযোগসম্ভাবনাকে। বন্ধুত্ব এভাবেই রাজনৈতিক  হয়ে যায়। গান হয়ে ওঠে মানবশৃঙ্খল গড়ে তোলার অতলস্পর্শী ডাক।

এই আহ্বানের ভেতরে যতটা প্রেম থাকে, ততটাই থাকে রজনৈতিক প্রশিক্ষণের অঙ্গীকার: 'তোমাকে আমি পথে নামাবোই / যতই ঘরে বসে থাকো  না'। এই আহ্বানে থাকে বিশ্বাস: 'তুমি বললেই হবে'র মত কথা দিয়ে রুখে দেবার প্রত্যয়। প্রিয়তমাকে অভিবাদন জানাতে গিয়ে 'বোমা নয় গুলি নয় চকলেট, টফি রাশি রাশি' সেই প্রতিশ্রুতিই জানিয়ে যায়। যে তুমিকে শহরের অলি গলি থেকে মফস্বলের উপকন্ঠে খুঁজে ফেরে সুমনের সন্ধানী আমিকন্ঠ, সেই সর্বত্র উপস্থিত টুকরো টুকরো 'তুমি' রাজনৈতিক অভ্যুত্থান এবং প্রেমের অঙ্গীকারকে অমোঘ যুগ্মতায় মুগ্ধ করে রাখে। 'তোমার সাথেই' কেবল একা হওয়া যায় সুমনের গানে। এমনকি বাবার মৃত্যুতে লেখা গান 'তুমি তো চললেই' এর ভেতরেও চলে যাবার সমষ্টি এক অদ্ভূত প্রতিরোধের বয়ান তুলে ধরে: 'তুমি তো চললে সক্কলে যায় / থাকতে এসেছি ভাবতে ভাবতে সবাই পালায়'। তুমির দিকে এই চলন প্রেমের গানেও মানব্সমষ্টির স্বপ্ন নিয়ে আসে:

'ওই বৃষ্টি যেখানে তোমার চোখের জলে

অন্য কারুর দুঃখের কথা বলে

সেইখানে হবে দেখা

তোমার সঙ্গে একা'।

'আমি' থেকে 'তুমি' হয়ে এই ডাক যখন 'অন্য কারুর দুঃখের কথা' বলে যায় তখন তা প্রতিরোধের সমষ্টিকে স্পর্শ করে। 'হারিয়ে যেও না' গানেও 'আমি' থেকে 'তুমি' হয়ে সুমনের গান ছুটে যায় এক মানবশৃঙ্খল তৈরী করতে:

'এখনো জীবনের কোথাও না কোথাও বিরল ভরসার সাহসী সুরভি

এখনো রোদ্দুর সহসা জ্বেলে দ্যায় বিদ্রোহের রঙে রক্তকরবী

হারিয়ে যেও না হারিয়ে যেও না রক্তকিংশুক দিনের আশা

এখনো লালে লাল ভোরের আকাশে পাঠায় সুখবর ভালবাসা

এখনো কিছু হাত হতাশা রুখছে বাতাসে কাঁপছে প্রাণের স্লোগান

এখনো কিছু মুখ মুখর কন্ঠ সজীব রাখছে আগামীর গান।'

অর্থাৎ এক থেকে দুইয়ে কিম্বা 'আমি' থেকে 'তুমি'তে গিয়ে থমকে যায় না এই আহ্বান, 'মাঠঘাট বন পেরিয়ে' এই আহ্বান বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মানুষের হাতকে জুড়ে দ্যায় কামনার এককত্বে।

একাকিত্বের নেতিকরণ সুমনের সাঙ্গীতিক নন্দনজগতে যতটা রাজনৈতিক ততটাই রোম্যান্টিক। রাজনীতি আর প্রেম উভয়কে চালনা করে আদিম এক কামনাবীজ যা সুমন সলিলের গানের 'ঝুর ঝুর ঝরে গ্যাছে কামনার ফুল' থেকে 'ছত্রধরের গানে'র তীরের ফলায় খুঁজে পান, যে তীরের ফলায় কামনা লেগে থাকে। এই কামনার ডাকেই এক হয়ে যায় প্রেম আর প্রতিরোধ। 'জুয়া' গানে এই কামনা 'অনুভব' হয়ে ভালবাসার চাওয়াকে পাল্টে দেবার স্বপ্নের কাছে নিয়ে যায়: 'গ্রাম থেকে গ্রামে ডাক্তার যাবে কবে?' একদিকে যেমন রাজনৈতিক গানে প্রেম চলে আসে অবলীলায় তেমনি প্রেমের গান রাজনৈতিক হয়ে ওঠে যখন একটি মনের অন্য মনকে স্পর্শ করা 'বিস্ফোরণ' এনে দ্যায়। 'ভালবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না'র মত আদ্যন্ত প্রেমের গানেও তাই সুমন গেয়ে ওঠেন: 'একা মেয়েটার নরম গালের পাশে / প্রহরীর মত রাত জাগে ভালবাসা'। এখানে রাজনীতির ভিতর ভালবাসা নয়, বরং ভালবাসার শিকড়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তার পাহারা বসিয়ে দ্যান সুমন। রাজনীতি ও প্রেমের এই সংলাপ তাই একপাক্ষিক থাকে না।

তোমাকে ডাকা আর তোমার আসার মধ্যবর্তী ছেদবিন্দুতে সুমনের গানের বসত। সুমনের গান এখানে অপেক্ষারত। সে জানে 'উত্তর আসবে না, তুমি আসবেই আমি জানি'। এই আসার আশায় এক হাইপোথিসিস রয়েছে অনন্ত ডাক দিয়ে যাকে আঁকড়ে ধরে সুমনের গান। যে 'তুমি' এলে 'ভোরের সংলাপ' আর 'আলোর সংরাগ' 'আঁধারে মাখিয়ে দেওয়া যেত', সেই তুমি না আসলে গানের শরীরে যে বিষণ্ণতা তৈরী হয় সেই না পাওয়ার গানও ছুঁয়ে যায় সমসময়ের অন্ধকারকে: 'আঁধার কাটে  না, দশক চলে যায়', 'সুদিন আসে না, এসেছে অসময়, দিনের পরে দিন, বৃথাই অপচয়' কিন্তু তবুও এই গান আসার সম্ভাব্যতা নিয়ে উজাগর রয়ে যায়। গান বলে: 'তুমি এলে সফল হয়তো, হতো সময়, কিছুটা নয়তো, দুরাশায় ভরে দেওয়া যেত'। যেখানে 'হয়' আর 'হয়তো'র মাঝে তৈরী হয়, আবার বুজে যায় অবুঝ এক ফাঁক, সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে এই গান, তৈরী করে নেয়  একফালি সম্ভাবনা, একটুর জন্য না ক্ষয়ে যাওয়া আশার ওই অবশেষ। 'আমি' থেকে 'তুমি' হয়ে সবাইকে ছুঁয়ে যাওয়া এবং সাড়া দিতে আমন্ত্রণ জানানোর এই আহ্বান সুমনের গানে প্রেম ও রাজনীতির গভীরে কামনার বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে ওঠে। এই বিশ্বস্ততা সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে না বলেই বলা যায়, 'উত্তর আসবে না তুমি আসবেই আমি জানি'। প্রতিরোধ ব্যর্থ হলে যেমন তার গুরুত্ব এক বিন্দু কমে যায় না, তেমনি এই 'তুমি' না আসলেও তার আদর, ডাক এবং আহ্বান চলতে থাকে। যে আসবে না তার জন্য অপেক্ষা করে যাওয়াই যে প্রতিরোধের শর্ত তা স্যামুয়েল বেকেটের ভবঘুরেদের মত সুমনের গানও হাড়ে হাড়ে হারে হারে বোঝে আর তাই 'রোববার' গানটি শেষ হয় উদাত্ত এই উচ্চারণে:

'সাড়ে পাঁচটায় তুমি আসবে, ঠিক যেমনটি তুমি আসতে, প্রতি রোববার

তুমি আসবে না আর কোনদিন আর কোনদিন আর কোনদিন,

তবু ধরা যাক আজ রোববার

ধরে নিলাম আজকে রোববার, ধরা যাক আজ রোববার।'

এই গানে সব থেকে জরুরি কথাটুকু হলো ঐ 'ধরা যাক'। প্রতিশ্রুতি যেখানে প্রেম আর প্রতিরোধকে মিলিয়ে দ্যায় সেখানে সে এক বিশুদ্ধ হাইপোথিসিস হয়ে ওঠে। অসম্ভব হলেও ওই অসম্ভবকে আহ্বান করা যায়। বিপ্লব যতই অসম্ভব মনে হোক, আজন্ম একাকীর কাছে প্রেম যতই দুরূহ মনে হোক, গাণিতিকভাবে 'ধরে নেবার' মধ্যে দিয়ে সত্যিই সেই প্রতিশ্রুতিকে ধরে নেওয়া যায়, ধরে রাখা যায়।


সুমনের গানের এই আহ্বান 'আমি' থেকে 'তুমি', এক থেকে দুই হয়ে বহুর দিকে এগিয়ে যায় রাজনীতি আর প্রেমকে দুপাশে রেখে। ফরাসী দার্শনিক এল্যান বাদিউর কাছে এটাই হলো প্রেমের গতিপথ: এক থেকে দুই হয়ে প্রেম তার জগতের সম্ভাব্য অসীমত্বের দিকে যাত্রা করে। একজন মানুষের সাথে যখন আরেকজন মানুষের সহসা সাক্ষাৎ হয়
 তখন ব্যক্তি-এককের উর্দ্ধে দুজনের বিনিময়ের এক জগৎ তৈরী হয় যা ক্রমশ একার সীমানা অতিক্রম করে অনন্ত অসীমের দিকে চলে যায়। সুমনও এইভাবে তাঁর  দর্শকদের অনেক অনেক নয়নতারা দেখে নিতে চান অনুষ্ঠান চলাকালীন অডিটোরিয়ামের আলো জ্বালানোর আহ্বান করে। প্রেম এখানে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠার সাহস রাখে, ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে অসীমের আকাশে মানবসমষ্টিকে তুলে ধরতে চায়। সুমনের গানের এই ডাক বন্ধুতার আদলে রাজনৈতিক পরিসরের শিকড়টিকে ধরে রাখে তার প্রতিশ্রুতির বলিষ্ঠতায়। এই বন্ধুতার মাধ্যমে প্রেম আর রাজনীতির চুম্বন সম্পন্ন হয়। অ্যারিস্টটল তাঁর Nichomachean Ethics গ্রন্থে এই বন্ধুতাকেই রাজনীতির সমষ্টিবদ্ধতার প্রথম শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন:

'In that case, he needs to be concurrently perceiving his friend- that he exists, too- and this will come about in their living together, conversing and sharing their talk and thoughts; for this is what would seem to be meant by "living together" where human beings are concerned, not feeding in the same location as grazing animals [...] For friendship is community, and as we are in relation to ourselves, so we are in relation to a friend [...]'.

অ্যারিস্টটল এখানে অনেক পশুর একসাথে বিচরণ করার থেকে মানব কমিউনকে আলাদা করেছেন যে সক্রিয়তার মাধ্যমে তার আকর হলো বন্ধুতা। এই বন্ধুতা একাধারে প্রেম ও রাজনীতির আহ্বানে পুষ্ট আর সুমনের গানে 'তুমি'র প্রতি নিয়ত নির্দেশ এভাবে ভালোবাসাকে তার প্রতিস্পর্ধী সম্ভাবনার সাথে যুক্ত করে দেয়।