বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

হাসান মুস্তাফিজ

 

সমকালীন ছোটগল্প



৩০ সেপ্টেম্বর ‘SOS’

 

(১)

 

সো, বাংলাদেশের প্রথম আবিষ্কৃত, আলোচিত এবং জনপ্রিয় সাইকোর একমাত্র দুঃখ, সে আর মগাবাজারের ‘পুষ্প কর্নার’ নামের দোকানে যেতে পারবে না। এইজন্যেই সে বিশ্ব-সাইকোদের কাতারে পড়বে। আবার নাও পড়তে পারে,  তাকে নিয়ে যে কোনো ধর্ষণের রেকর্ড নেই! সব ঘেঁটে দেখা যায় তার সব মেয়ে বন্ধুও তাকে ঘেন্না করে। কোনো সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে সে ছিল না। এতে অবশ্য  তার নিষ্পাপত্ব প্রকাশ পায় না, বরং প্রকাশ পায়, সে একজন কাপুরুষ। সো, সে একজন সাইকো (ওহ সরি, টাইপিং মিস্টেক)।

আস্তে আস্তে প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হচ্ছে। কোনো নারী আর গৃহিণী থাকে না।  সেক্ষেত্রে প্রতিটি বাংলাদেশী ফ্যামিলির স্বামীর মাথায় সেন্স এসেছে যে, বাথরুমেও এয়ার ফ্রেশনার লাগে। এগুলো অধিকাংশই মায়ানমারের পণ্য। কিন্তু তাই বলে টিভিতে টয়লেট ক্লিনার লিকুইডের অ্যাড কমেনি। আবার এসব ইনোভেটিভ চেঞ্জও আনেনি। পিছিয়ে আছে কিছুতে।

চ্যারিটির কাজ প্রশংসনীয়। প্রাণীর খাদ্য সরবরাহ বাড়ছে। আর প্রাণী বলতে কুকুরকুলের কথা আসছে। তাদের জন্য গরুর ভুনা দিয়ে খিচুড়ি রান্না হয়। সেগুলা অবশ্যই সুস্বাদু হবে কারণ খাওয়ার পরও কুকুরগুলো পলিথিন চাটতে থাকে। সেদিক দিয়ে বলা যায়, পরিবেশ রক্ষার কমনসেন্স এদের হয়নি। কোনো কুকুর অভুক্ত থাকতে পারবে না এদেশে। হয়ত এসব স্বেচ্ছাসেবকরাও বুঝে গেছে, মানুষের চেয়ে কুকুরের ক্ষুধার্তনাদ আরও বেশি।

চাঁদমারিরা জানে, পুনরুজ্জীবন আসছে। মুখোশ বানানো লাগবে আবার, বুঝাতে হবে সবাই ভালো। সবাই স্মার্ট, আধুনিক, স্বাধীন এবং আরো কিছু.

এই দেশটায় ভালো বোটানিক্যাল গার্ডেন নেই। সরীসৃপদের ব্যাপারে কেউ জানে না।

কোনো বাংলাদেশি ফিল্ম ডাইরেক্টর এখনও ম্যানহোলের ভিতরের দৃশ্য কিংবা ম্যানহোলের তলে কীভাবে টিকটিকি বিচরণ করে সেসব তাদের সিনেমায় আনতে পারেনি।

কিন্তু ‘The Third Man’ তাদের প্রিয় সিনেমা হয়ত, কারণ তারা ওরসন  ওয়েলেসের নাম সেভাবে নেয় না। (মনোলোভা)

 

★★★

 

তিনি, সিরাজ সরকার, বেশিক্ষণ হয়নি অপেক্ষা করছেন। মেডিকেল সেন্টারটা দুই সপ্তাহের জন্য বুকিং করা হয়েছে। চেয়ারগুলো কাঠের, কোনো পেরেক নেই যেটা লুজ ফিটিং বা চাইলে খুলে হাতে লুকিয়ে রাখা যাবে। টেবিল ফ্যান আছে সাথে। সিরাজ সরকার এই প্রথম আফসোস করতে লাগলেন তার কেন কোনো ছেলেমানুষী বদভ্যাস নেই! সময় কাটতে চায় না!

ছেলেটার ফটোগ্রাফ দেখেছেন দুই বছর আগে। তখন তার বয়স ২১ বছর ছিল। ছেলের গড়ন দেখে বোঝা যায়, সে ওজন কমানোর চেষ্টা করছিল। তাই থুতনিটা বেমানান লাগছিল ফটোগ্রাফে। কিন্তু ঘাড় বা গলা স্লিম লেগেছে আর কোমর একটু ঝুলে থাকবেই, স্বাভাবিক।

বাংলাদেশে তাকে নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। এটা আসলে এই দেশটির ভাগ্য। অবশেষে তারা এমন কাউকে পেলো, মানে সে কিন্তু ভিলেন, সামাজিক ভিজিল্যান্ট কারোর মতে। এইবার বাংলাদেশ বলতে পারবে যে তাদের দেশ থেকেও সিরিয়াস একটা সাইকো এসেছে। গডফাদার বা মবগোষ্ঠী আফ্রিকাতেও থাকে। পূর্ব-পশ্চিম জনপদ ‘The Godfather’ মুভি দেখে ফেলেছে। যেসব বাংলাদেশী মানুষ আসলেই একটু রাজনীতি বুঝতে চায় যেখানে কন্সপ্যারিসি থিওরি আর মতবাদের পার্থক্য আছে, যারা কথায় কথায় বলে না ‘ইসরায়েল  ধ্বংস হয়ে যাবে’, কিংবা ফিলিস্তিনের গণহত্যার যথার্থভাবে শিশুহত্যার প্রসঙ্গ  তুলে ধরে এবং যারা Al Caponeকে চেনে, তারা এই ছেলেকে পাত্তা দেবে না।

ওর নাম হাসিন মাহবুব, সে আসছে জানা গেল।

ক্যামেরাম্যান বলল — আমরা লাইভে যাচ্ছি দশ সেকেন্ডের মধ্যে।

সিরাজ সরকার কিছু বলার আগেই হাসিন বলে উঠলো — দাঁড়ান, আমার কথা আছে।

সে ঝুঁকতে পারলো না, শিকল দিয়ে চেয়ারের সাথে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।

মাহবুব বলল — মনোলোভাতে কী বলবেন আমাকে নিয়ে?

সিরাজ সরকার মাথা নাড়লেন। কোনো মনোলোভা তিনি ভেবে আসেননি।

মাহবুব হেসে বলল — আমি বর্তমানে একজন জনপ্রিয় সাইকো, আপনার উচিত আমার ইন্টারভিউ সেভাবে নেওয়া। চাইলেই আপনি অন্যান্য সিরিয়াল কিলার বা সাইকোদের ইন্টারভিউ দেখে নিতে পারতেন

ক্যামেরাম্যান বলতে লাগল — ৩, ২, ১

মাহবুব জানতো না যে সিরাজ সরকার একজন ব্যর্থ এবং পাবলিসিস্ট কবি।

সিরাজ সরকার বলতে লাগলেন — এদেশের পবিত্রতার একমাত্র সাক্ষী আমাদের ঋতু। এইবারের বসন্ত অন্যান্য সব বসন্তের মতোই সুরভিত, আনন্দিত এবং পূর্বনির্দেশক স্পন্দিত

এভাবে সিরাজ সরকার বলে যেতে লাগলেন। ক্যামেরাম্যান ওদিকে ইশারা করছেন থামতে। ২৫ মিনিটের মধ্যে পাঁচমিনিটই এসব বলতে থাকলে বিশাল ট্রোল শুরু হয়ে যাবে। সিরাজ সরকার মোটে ৫ লাইনে মাহবুবের পরিচয় দিয়ে দিলেন। ‘চলুন দর্শক’ বলে তিনি মাহবুবের দিকে ঘুরতেই লক্ষ্য করলেন মাহবুবের মুখ হাঁ হয়ে যাচ্ছে। সে কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা না করেই বলল — ক’টা কবিতার বই ছেপেছিলেন?

গার্ডরা হেসে উঠলো। সিরাজ সরকার ফ্লোরে তাকিয়ে বললেন — তিনটি।

মাহবুব বলতে লাগল — আমার ইন্টারভিউ অনেকেই নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি শর্ত দিয়েছিলাম, বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি জার্নালিজমে পুলিৎজার জিততে পারে, তাহলে একমাত্র তাকেই ইন্টারভিউ দেব। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমার দাবির পরিসীমা কতদূর। তবে আপনাকে ভালো লেগেছে আমার।

সিরাজ সরকার সুযোগটা নিলেন। কড়া গলায় বললেন — তুমি আমাকে পছন্দ করলেও বোঝোই তো, অন্য সবার মতো আমি তোমাকে ঘেন্না করি।

মাহবুব কিছুক্ষণ থেমে বলল — আপনি এই ধরনের কথার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন, না?

হ্যাঁ, আমাকে আপনি ঘেন্না করতে পারেন। তবে এই কথাটা ভুল, সবাই আমাকে  ঘেন্না করে না। আমি অলরেডি এই দেশের একজন কাল্ট আইকন। এখন আমি  যদি সেই পর্যায়ের অমন আসামি হতাম, তাহলে হয়ত তাদের মতো এই ট্যাগটা  বাতিল করে দিতাম, কিন্তু আমি তা না। আমি সেল্ফ ডিফেন্স করতে গিয়ে খুনী হয়ে গিয়েছি।

সিরাজ সরকার এবার ক্ষেপে গেলেন এবং কথা বলার সময়ে তার মুখ থেকে থুতু  পর্যন্ত বেরিয়ে গেল। সেই অবস্থাতেই শোনা গেল ক্যামেরাম্যান বলছে — এই ফারুক, ওকে একটা টিস্যু দিয়ে আয় না, কী বিচ্ছিরি লাগছে (ধরে নেওয়া যেতে পারে, এটা একটা মিমস)

সেল্ফ ডিফেন্স মানে? তুমি হাসান মুস্তাফিজকে খুন করেছো। এটা সেল্ফ ডিফেন্স? কীভাবে সেল্ফ ডিফেন্স? ঘাড়ে একদম জায়গা বরাবর কলম দিয়ে এমন স্ট্যাব করেছো যে সে হসপিটালে নেওয়ার আগেই মারা গেছেন। কী ভাবো নিজেকে?

মাহবুব কোন ফাঁক দিয়ে গার্ডের কাছে সিগারেট চেয়েছে, সিরাজ সরকার সেটাও খেয়াল করেননি।

ভাই, শুনুনন তো!

সিরাজ সরকার বুঝলেন তাঁর এই প্রকাশভঙ্গি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়নি। এরমধ্যেই বিরতিতে চলে গেছে। ক্যারিয়ারের জন্য এটা বিরাট একটা স্ক্যান্ডাল হয়ে গেল।

মোবারক রিপন বলতে লাগল — ভাই, আপনাকে এসব কথা কে বলতে বলেছে? ২ সপ্তাহ সময় হাতে, আপনাকে এ ধরনের প্রশ্ন করতে বলা হয়নি।

সিরাজ সরকার ওয়াসার নোংরা পানির মতো বললেন — হাসান মুস্তাফিজ বাংলাদেশের প্রথম কবি যে টি.এস.এলিয়ট প্রাইজ জিতেছিল।

তো কী হয়েছে? সামনে আরও পাবে। এইসব পুরষ্কারে বাংলাদেশের কারোরই  যায় আসে না। যেসব প্রশ্নের জন্য ভালো ভিউয়ারস পাওয়া যাবে সেইসব প্রশ্ন করুন।

৩, ২, ১

-একটা প্রশ্ন করি? মাহবুব বলল।

সিরাজ সরকার তাকালেন।

মায়ানমার থেকে আর হাতি বাংলাদেশে এসেছে?

জানা নেই।

মাহবুব অপটিমিস্টিকভাবে বলতে লাগল — অন্য দেশের প্রাণীও বোঝে, এই দেশের মানুষ অতিথি ভালোবাসে। প্রাণীরা বোঝে, অন্য দেশে যা আছে, এই দেশে এসে তার কিছুই পাবে না। তাও আসে। রামপালে ওমন একটা দুর্ঘটনা হল, কিন্তু খেয়াল করুন, ভারত থেকে বাঘ আসা থামেনি। ওদের গলায় আবার  ট্র‍্যাকিং কলার পরিয়ে রাখা হয়েছে। কীসব গবেষণা যে তারা করে!

সিরাজ সরকার এবারও প্রশ্ন করতে পারলেন না, কারণ মাহবুব বলতে লাগল — মায়ানমারের সাথে যুদ্ধ হলে খারাপ হয় না।

সিরাজ সরকার মোবারকের দিকে তাকালেন। সে ইশারা দিচ্ছে চালিয়ে যান।

সিরাজ সরকার সিম্বলটা ধরতে পারলেন না। বোরিং প্রশ্ন করে ফেললেন — তোমার বাবা, মা কেমন ছিলেন?

মাহবুব এইবার পা নামিয়ে বসলো। — খুব ভালো মানুষ ছিলেন তারা, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বাবা মা। কোনো অভাবে রাখেননি আমাকে। লোয়ার মিডলক্লাস হয়েও এত শান্তিতে ছিলাম আমরা! বিশেষ করে ২০১৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত। তিনবেলার  খাবার, সপ্তাহে তিনবার মুরগি সব ছিল। বাবা আমার ওজন কমানোর জন্য একটা ইলিপটিকাল মেশিনও কিনে এনেছিলেন।

সিরাজ সরকার বললেন — বুঝতে পারছি।

এইবার মাহবুব সরাসরি তাকিয়ে বলল — আমার বাবা-মা তাদের চাকরির ক্যারিয়ারে জীবনেও একটা টাকা ঘুষ খাননি। ট্যুর করে আমার বাবা তার পুরো  শরীর ধ্বংস করে ফেলেছেন। কাজে মনের মধ্যে আমার বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাববেন, তা যেন নিষ্পাপ থাকে, সন্তানের পাপের জন্য দায়ী বাপ-মা নয় কখনো।

সিরাজ সরকার সাথে সাথে বললেন — আর তোমার বোনেরা?

মাহবুবও সময় নিল না — তারা আমার দেখা দুনিয়ার সবচেয়ে স্বার্থপর মানুষ।

সিরাজ সরকার খাতায় এই লেখাটা আন্ডারলাইন করলেন। একটা কোটেশন পাওয়া গেল অবশেষে।

এই প্রশ্ন কেন করলেন আমাকে?

সিরাজ সরকার হেসে ফেলে বললেন — সেটা জানার দরকার আছে তোমার? আর নিজের ফ্যামিলি নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তা তোমার? যেভাবে ডুবিয়ে দেওয়া দরকার, সেটা তো তুমিই ভালোমতো করে ফেলেছো। তোমার বোনদের বিয়ে ভেঙে গেছে, পুলিশি মনিটারিংয়ে তাদের জীবন পার হচ্ছে। তোমার ভক্তকুলই তো তোমার বাসায় গিয়ে ঢিল-পাটকেল ছুঁড়ে আসে।

গার্ড তার হাত ঠোঁটের উপর চেপে বোঝাতে লাগল, এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না করতে। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে।

হাসিন মাহবুব বলতে লাগল — এই হচ্ছে আপনাদের উদ্দেশ্য। আপনাদের লাইফের উদ্দেশ্যই হল, কীভাবে জনপ্রিয় হওয়া যায়! আপনার কোনো মেধাই  নেই যেটার দ্বারা আপনি আমাকে পার্সোনাল এটাক না করে পুরো ব্যাপারটা এককেন্দ্রিক করে আমাকে অন্যদের সামনে তুলে ধরবেন। আপনারা কী মনে করেন, সচেতনার জন্য আপনারা এই ইন্টারভিউ নিচ্ছেন? আমি বুঝি না কিছু? এই ইন্টারভিউ আপনারা ছাপাবেন বিনোদন পাতায়। একটা সস্তা নায়িকার পাশে এটা ছাপিয়ে দেবেন। আর সেই ধরনের মানুষ হয়ে আপনি মনে করেন আপনার   অধিকার আছে আমাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার? কী ভাবেন নিজেকে? কেন সবাই আমাকে এমন ভাবে? কেউ কি চায় না আমাকে বুঝতে? আমি কি চাইছিলাম নিজেকে গোপন রাখতে?

মাহবুব বেশি দুলছিল। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখায় সে চেয়ারসহ ফ্লোরে পড়ে গেল।  গার্ডরা এই সুযোগ ছাড়লো না। কাঠের ব্যাটন দিয়ে পেটানো শুরু করে দিল।

সিরাজ সরকার দাঁড়িয়ে বললেন — শালার মাথায় মারেন।

মোবারক খুব খুশি হল। পরেরদিন মাহবুবের মাথা বেল করে দেওয়া হল। ছ’টা সেলাই লেগেছে।

 

(ক্রমশ)

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন