বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 

সাত সাতটা বড় কলকাতা

 


বেড়াতে গিয়েছেন। দি-পু-দা-তে বা আশেপাশে। শহরের যত বন্ধু ছ’মাসে ন’মাসে দেখা হয় না এখানে ছাড়া, তাদের বাদ দিয়ে যার সঙ্গেই দেখা হবে, একই হোটেলে, ভাজা মাছের কাউন্টারে, কটকি-কাজু-নকল-কিউরিওর দোকানে,  তাকেই জিগোবেন ‘আপনি কোত্থেকে’, সে বলবে কলকাতা। আর একটু জেরা করলে কলকাতা দাঁড়াবে খড়দা, ব্যারাকপুর, নিউব্যারাকপুর, টিটাগড়, নৈহাটি, কল্যাণী, শুঁটে বারাসত — আর গোরাবাজারের আতা মহম্মদ লেন, স্বাধীনতোত্তর দুর্গাবাড়ি লেনের কি নোয়াপাড়ার কি আমতলা পৈলানের কলকাত্তাই। আপনি  ‘ওঃ তাই’ বলে মনে মনে একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে নেবেন। আমরা সবাই কি জানি কলকাতা আসলে কী, খায় না পেতে শোয়, বা কটা?

আমি গ্রামের ছেলে। আমার এতে কী যায় আসে? কলকাতার নামের সঙ্গে সংযোগ একটাই ছিল। আমাদের বাবা-কাকার কেনা বাড়ি হাওড়া জেলার  আমতা শহরে। তার অদূরে ছিল ‘কলকাতা’ নামের একটা গ্রাম। আমতা এক  নম্বর ব্লকের রসপুর গ্রামের সংলগ্ন বলে যার নাম ছিল ‘রসপুর-কলিকাতা’। বড় কলকাতার থেকে তার এই ‘namesake’-কে আলাদা করতে একে ‘ছোটো কলকাতা’-ও বলতেন অধিবাসীরা। সেখানকার দোকান-টোকানে এই নাম  এখনও জ্বলজ্বলিং। আর অধিবাসীদের মনে একটু গুমোরও ছিল। কেউ বিস্ময়ে নামের রহস্য জানতে চাইলে কেউ বলতেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এই নাম চলছে, কেউ আবার কোম্পানির আমলেও চলে যেতেন। কিন্তু টালাব্রিজের পাশে বাপের বাড়ি হওয়ায় বৌ ছিল, মানে নিজেকে ভাবতো, খাস কলকাতার মেয়ে। সেও ধাক্কা খেল।       

কারে পড়ে দমদম ক্যাণ্টনমেন্ট-এ বাসা নিয়ে ফেলে স্ত্রীর মনোকষ্ট দূর করতে বাড়ি খুঁজে ফিরে শ্বশুরের সূত্রে দীনেন্দ্র স্ট্রিটে গেছি। বাড়ির দুই হরিহরআত্মা বিপত্নীক ডিভোর্সি মালিক ভাই খাস কলকাত্তাই, আমরা দমদম ক্যাণ্ট-এ থাকি শুনে, সেখান থেকে এখানে বাড়ি দেখতে এসেছি, আর কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ঠ্যাঙাতে যাই শুনে, আঁতকে উঠলেন। স্ত্রী পরিস্থিতি সামলাতে তাদের বাড়ি টালা ব্রিজের পাশে বলেও সুবিধে হলো না। আমাদের ভাস্কো ডা গামা না হোক ফার্দিন্যান্দ ম্যাগেলানের মর্যাদা দিয়ে তখনই ঘর খুলে দেন আর কি! সবুজ পঙ্খের কাজ করা মেঝের বড় বড় ঘরের বাড়ির তিনটি ঘর তো পাবোই, ভাড়াও বেশি নয়। কেবল দু’ভাইকে মাঝে মাঝে একটু শুক্তো, ঘণ্ট রেঁধে খাওয়াতে হবে।  মধ্যচল্লিশের ডিভোর্সি চলে আসার আগে মৃদুকণ্ঠে অত দূরে কল্যাণী যাওয়াটা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতেও ভুললেন না!  

 বেরিয়ে, স্ত্রীর বিস্ময়-উষ্মা-ভস্মদৃষ্টির উত্তরে একটা কথাই বললাম,

 — এঁদের দোষ ধরো না। এঁরা খাস কলকত্তাই। অন্য কলকাতা বোঝেন না! বুঝবেনই বা কী ক’রে? কলকাতা ক’টা জানো? সাতটা।

 — বলছো কি, কলকাতা সাতটা?

 — হ্যাঁ।  

 — কেন?   

— মানে, এই সপ্তস্তর এককেন্দ্রিক বৃত্তসম কলকাতা নামক polymuclear বহুবিস্তারের কেন্দ্রে যে শাঁস আছে, মানে খাস কলকাতা, বা কলকাতা মিউনিসিপ্যাল এরিয়া বা ক্যালকাটা মেট্রোকোর, যার প্রশাসন চালায় কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। এটা ১৯২৪-এর পয়লা এপ্রিল প্রাক্-স্বাধীনতা শেষ প্রসারণের পরে ৪৯.০৮ বর্গকিমি দাঁড়ায়। এর অধিবাসীরা পায়ের তলায় সর্ষে  থাকা লোক বলতে বুঝতেন টালা-টু-টালিগঞ্জ করা পাবলিক! ১৯৫৩-র পয়লা এপ্রিল টালিগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি এর মধ্যে মিশে যাওয়ার পরে জায়গাটা দাঁড়ায় প্রায় ৫৯.৪২ বর্গকিমি। আস্তে আস্তে আরো অনেক শহরতলির মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্ভুক্তি ও সংযুক্তি জায়গাটাকে বাড়াতে বাড়াতে ১৯৮১-র  লোকগণনা অবধি ১০৪ বর্গকিমিতে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে দমদম পুরসভা ঢুকে আসায় টালা থেকে টালিগঞ্জ যাওয়া লোকদের পায়ের তলার সর্ষে  তেল হয়ে যায়।  

   ঠিকাছে। আমরা না হয় পরেই কলকাতা হয়েছি, তাও আম-কলকাতা, খাস-কলকাতা নই। কিন্তু ওই যে গতবার দার্জিলিং-এ গিয়ে দেখলাম খড়দার লোকও কলকাতা বলছে। তাদের সমান তো নই!

   সমান অসমানের কথা আসছে কোথা থেকে! ওঁরাও কলকাতার লোক, তবে গ্রেটার ক্যালকাটার।  

   সেটা কী বস্তু?

   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শহরের খাদ্যসঙ্কটের দিনে বিধিবদ্ধ রেশনিং-এর আওতায় কারা আসবেন  সেটা ঠিক করতে বৃহত্তর কলকাতার ধারণা আনে ব্রিটিশ সরকার। হুগলী নদীর উভয় পারে চল্লিশ কিমি ধরে দক্ষিণে বজবজ আর উত্তরে হালিশহরের মধ্যে সবকটি মিউনিসিপ্যালিটি এর মধ্যে আসে, আর কলকাতার আয়তনকে ঠেলে নিয়ে যায় ৪৩৪.৫২ কিমি অবধি। ফলে খড়দা কেন, ব্যারাকপুর টিটাগড়-এর লোকও তো কলকাতায় থাকে।

   বাপরে!  এটাই শেষ তো! তিরিশের ডি-তে উঠবে, নাকি দমদম গিয়ে বনগাঁ লাইন ধরবে? দমদম ক্যান্ট-এই বা নামার কী দরকার? তার পরেও তো কলকাতা আছে।   

   সে তো ধরবো! এসব কথা শুনে ওই ডিভোর্সি না হোক বিপত্নীক মূর্ছা যাবেন। কিন্তু এটাও শেষ নয়! ১৯৫১-র সেন্সাসে সরকারের কাজকর্মের প্রাসঙ্গিক একক হিসেবে ধরেছিল ক্যালকাটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিজিয়ন নামে একটি এলাকাকে যার আয়তনে ২৬৩.৯৮ বর্গকিমি এলাকার মধ্যে ছত্রিশটি মিউনিসিপ্যালিটি ছিল।

   তাহলে তো সাইজে কমলো!

   কমা-বাড়া নির্ভর করে কলকাতা সম্পর্কে পারসেপশন-এর উপর! ১৯৬৪-র  পর ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং অরগানিজেশন খাস কলকাতার চারধারে গজিয়ে ওঠা একটা এলাকাগত নিরবচ্ছিণ্ন ইঁটচুণসুরকির ঐক্য যাকে সিএমপিও ক্যালকাটা কোনার্বেশন (conurbation) নাম দেয়। হুগলী নদীর উভয় তীরে দানাবাঁধা কোঠাবাড়ির ঐক্য, কলকাতা, বালী আর নৈহাটির তিনটি রিভার ক্রসিং-এর দ্বারা সংযুক্ত, যার আয়তন আনুমানিক ৩৪৫.৭৫ বর্গকিমি।

 

তিরিশের ডি আসছে না। রোদ চড়ছে। বেলা বাড়ছে। গিয়ে রান্না চড়িয়ে খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। পায়ে পায়ে দীনেন্দ্র স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে আপার সার্কুলার থুড়ি এপিসি রোড বেরিয়ে আমরা ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত খাস কলকাতার গোলবাড়িতে ঢুকি। রুটি মাটনকষা অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে। করবী বলে — ততক্ষণ নয় আর ক’টা কলকাতা আছে জেনে  নিই! আমি বলি আর বেশি নেই! ওই সিএমপিও একটা সম্পূর্ণ ট্রাফিক-ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যানের জন্যে যে এলাকার ছবি আঁকে, যার রূপায়ন করবে ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা সিএমডিএ নামে একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা, তারা যে ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট ডিস্ট্রিক্ট-এর  কথা বলে, তার এলাকা ৮৫৭.৫৭ বর্গকিমি, যার মধ্যে ৩টি মিউনিসিপ্যাল  কর্পোরেশন, ৩১টি মিউনিসিপ্যালিটি, একটা ক্যান্টনমেন্ট, আর ৫০৭টি গ্রামীণ মৌজা পড়ে। সন ১৯৬৬তে এটা আরো বেড়ে ১২৫৫ বর্গকিমি দাঁড়ায়, আর ১৯৭১-এ ১৩৩৩ বর্গকিমি।

 

   ব্যাস! স্টক শেষ! খাবার কিন্তু এখনও আসেনি। সিএমডির মধ্যে দমদম ক্যান্টনমেন্টতো এসে গেল!

    এসে তো গেলই। তোমার হৃদয়পুর ইস্কুল, গোবরডাঙা, শুঁটে বারাসত সব এসে গেল। পরে কলকাতা একটু ছোটো হয়ে গেলেও এসে গেল।  

    ছোটো হয়ে গেল মানে?

   মানে ইয়ে, ১৯৭১-এর লোকগণনায় আরেকটা ধারণা আনা হলো, দিল্লী, কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ এইসব মহানগরের জন্য, তার নাম ‘urban agglomeration’। তাতে ক্যালকাটা আর্বান অ্যাগ্লোমারেশন-এর এলাকা হলো ৩৫৬ বর্গকিমি। সেটা বেড়ে ১৯৮১-র লোকগণনায় ৮৫২.২৩ বর্গকিমি দাঁড়ালো!

  ফিনিশ?

  না, একটা আরো আছে। ক্যালকাটা ইনফ্লুয়েন্স রিজিয়ন।

  সেটা কী?

  এই ডালহৌসি স্কোয়ারে লালদিঘিতে যদি একটা বাঁশের খুঁটি বসিয়ে তাতে একটা দড়ি বেঁধে ১০০ কিমি ব্যাসে ঘোরাও তবে ছটি দক্ষিণবঙ্গের জেলায় যে যে জায়গা পড়বে, যেখান থেকে আমাদের রোজ সকালে টাটকা আনাজপাতি, মাছমাংস আসে ট্রেনের ভেন্ডর কামরায়, বাসে, লরিতে। সেখানকার লোকরা ক্যালকাটা ইনফ্লুয়েন্স রিজিয়ন-এর বাসিন্দে!

   তারাও বলবে আমরা ক্যালকাটান?

   সবাই নয়! হাটুরে, সব্জিওয়ালা, মেছো, ফেরিওয়ালা, এরা এই নিয়ে বোধহয় চিন্তিত নয়। কিন্তু জামাপ্যান্ট পরা চাকরি করতে আসা বাবুরা কী বলবে তা জানি না।

 

খাবার এসে গেছে। খিদেও লেগেছে খুব। দুজনেই খেয়ে নিই। করবী, মানে  আমার বৌ কীসব ভাবতে ভাবতে খায়। তারপর পয়সা মিটিয়ে মুখে মৌরি  দিয়ে উদ্ভাসিত মুখে বলে, চলো ওই দীনেন্দ্র স্ট্রিটে একবার যাই। গিয়ে বলে আসি ওদের বাড়ি নেবো না। আর এই সাত কলকাতার গল্প শুনিয়ে আসি।  আমি বলি, দূর! ওঁদের এসব শুনিয়ে কী হবে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরবাসের ইতিকথা’ পড়েছো তো! তাতে নেই শহর তার, যে তাকে অর্জন  করে, যে জন্মায় সে কেবল নয়! কলকাতা আমাদেরও। আমরা কলকাতার! বাস এসে গেছে। উঠে পড়ি তাতে।   

               

 

         

 

 

    


২টি মন্তব্য: