বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

অচিন্ত্য দাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৮



কাগজের উড়োজাহাজ


লকডাউন নামটা পালটে ‘স্বাস্থ সুরক্ষা সপ্তাহ’ রাখলেও ব্যাপারটা তো সেই  একই! বাড়ি থেকে কোথাও বেরোনো যাবে না। রাস্তাঘাট খালি। সবথেকে মুশকিল ছোটছোট ছেলেমেয়েদের। ইস্কুল ছুটি, ঘরে আটকে থাকা দিনের পর দিন।

দুটো চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির মাঝখানে শুধু একটা রাস্তা, তাই এদিক থেকে ওদিকের ঘরবাড়ি দেখা যায়। চারতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটা বছর দশ-বারোর ছেলেকে সেদিন দেখা গেল, পুরনো কাগজ কেটে ভাঁজ করে ‘জেট প্লেন’ বানাচ্ছে। প্লেনের মুখটা সরু, ল্যাজের দিকটা চওড়া। হয়ে গেলে ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে তার ‘জেট প্লেন’ দু-আঙ্গুলে ধরে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিল। উড়োজাহাজ প্রথমে গোঁৎ খেয়ে ডানদিকে ঘুরল। তারপর বাতাসে ভর করে বেশ অনেকটা দূর  অবধি চিলের মত সোজা চলল। ছেলেটা খুব খুশি, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কাগজের উড়োজাহাজ তো আর দেশ-বিদেশ পার হতে পারে না, নামতে নামতে একসময় রাস্তায় এসে পড়ল। সারাদিনে যখনই ফাঁক পায় ছেলেটা কাগজের উড়োজাহাজ বানায়, আর বারান্দা থেকে ছাড়ে।

উল্টোদিকের বারান্দায় বসে থাকতে দেখা যায় শিশির রায়কে। সবে রিটায়ার করেছেন। এই বিরক্তিকর কোরোনাকাল কাটাতে একটা উপায় বার করে ফেলেছেন তিনি। কবিতা লেখা। খবরের কাগজে বা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া জিনিসের বিলের সাদা দিকটায় ছ-আট লাইনের কবিতা মক্স করেন। গাছটা, পাখিটা – চারপাশে যা দেখা যায় তাই বিষয়। আর ফুলটুল ফুটলে তো কথাই নেই। আজকাল লিখতে লিখতে তিনি অবশ্য বুঝেছেন এসবের সঙ্গে নিজের মনের ব্যাপার না থাকলে কবিতা ঠিক দাঁড়ায় না। এই যেমন কোনো একটা পুরনো কষ্ট কিংবা কখনো অনুভব করা খুশি। ঠিকমত মিশ খাওয়াতে পারলে কবিতা পড়তে বেশ লাগে।

ছেলেটা আজকাল তার উড়োজাহাজের মুখের দিকটা একটা ভাঁজ বেশি দিচ্ছে আর ল্যাজের দিকটা যতটা হয় চওড়া করছে। উড়োজাহাজ বানাতে বানাতে আর তাদের বাতাসে ভর করে ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে সে বুঝছে, এতে প্লেন অনেকটা দূর যায়। মজা লাগে দেখতে।

সেদিন সন্ধের দিকে বারান্দায় গিয়ে শিশিরবাবু দেখেন, উফ, নিচের রাস্তায় কম করে ডজন দুই কাগজের উড়োজাহাজ পড়ে রয়েছে। ছেলেটা আজ সারাদুপুর তাহলে ওই করেছে। মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে সেগুলো ভিজে ন্যাতা হয়ে আছে, নিচে থেকে কুড়িয়ে নিলেও আর উড়বে না। তবু মনে হল পড়ে থাকা প্রত্যেকটা উড়োজাহাজের গায়ে ছেলেটার আগ্রহ আর ওড়ার সময়কার মজাটুকু  লেগে রয়েছে। কাল সকালে অবশ্য ঝাড়ুদার এসে সব আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবে।

নেহাতই সময় কাটাবার জন্য হলেও কবিতা লেখার সময় মনটা বেশ খুশিখুশি লাগে। আরো ভালো লাগে কবিতাটা বারকয়েক পড়তে – রসিয়ে রসিয়ে সময় নিয়ে। ওটাই তো আসল মজা। এছাড়া টুকরো টুকরো কাগজে লেখা এসব সখের কবিতা কতদূরই বা যেতে পারে! কাগজের উড়োজাহাজের মতই।

আর যেখানেই যাক, দিন শেষ হলে ঝাড়ুদার তো আসবেই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন