কথায় কথায় হেমন্ত
“রানার
গ্রামের ডাকহরকরা। রাতের পর রাত ক্লান্তিহীন মানুষের সুখ দুঃখের খবরের বোঝা বয়ে সে
পৌঁছে দেয় দোরে দোরে। কিন্তু, তার খবর কে রাখে?” ‘লেজেণ্ড অব
গ্লোরি’, দ্বিতীয় খণ্ড, ‘রানার ছুটেছে’ গানের শুরুতে বলা কয়েকটি কথা। সেই প্রথম
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ‘কথা বলতে’ শোনা। কয়েকটি
রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ‘গাঁয়ের বধূ’ শুনে মুগ্ধতা জন্মেছিল কিছুদিন আগেই, কিন্তু
‘রানার’-এর ওই ভূমিকাটুকু সেই মুগ্ধতাকে এক ধরনের ভাবনার শরিক করে দিল। তেরো বছর
বয়সের এক অনুভূতি-প্রসঙ্গে ‘ভাবনা’ শব্দটার প্রয়োগে অনেকে হেসে উঠতেই পারেন, যে
লিখছে তারও যে হাসি পাচ্ছে না, এমন নয়। কিন্তু সত্যি এরকম একটা ভাবনা জেগেছিল, ‘ভদ্রলোকের
কথা শোনা তাহলে গান শোনার চেয়ে কম পাওয়া নয়!’ অনেক পরে তাঁর এক ঘনিষ্ঠজনের
স্মৃতিচারণায় একই ধরনের কথা পড়ে খুব ভাল লেগেছিল, তিনি লিখছেন, ওঁর সঙ্গে
কথা বলে এলে মনে হত, গান শুনে এলাম।
তারপর
থেকে একটা নেশা হয়েছিল, কোন ক্যাসেটে, সিডিতে গানের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক সংলাপ
থাকলে সেইখানটা বার বার শুনে মুখস্থ করে ফেলা, ‘ইনটোনেশন’-সমেত। ‘আমি গান গাই’-এর
মাঝে মাঝে ‘দেখুন, দেখুন সত্যিই আকাশে মেঘ করেছে’, ‘কবিদের মশাই বড্ড তাড়াতাড়ি
সর্দি হয়’, ‘ভালবেসে দিগন্ত দিয়েছ’-এর মাঝে ‘চোখ তুলে চায়’ ইত্যাদি তো সহজলভ্য;
‘লুকোচুরি’ ছবিতে ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা’ আবৃত্তি শুনে আবিষ্কারের আনন্দে লাফিয়ে
উঠতে ইচ্ছে হয়েছিল। থাক সে সব ছোটমানুষী গল্প।
তাঁর
‘কথা বলা’-র স্মারক হিসেবে পাওয়া যায় দূরদর্শনে এবং বেতারে প্রচারিত কয়েকটি বাংলা
সাক্ষাৎকার, জর্জ বিশ্বাসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য এবং মানপত্র পাঠ, উত্তমকুমারের
স্মৃতিচারণা হিসেবে বলা কিছু গানের আড়ালের গল্প-কথা, যা ক্যাসেটবন্দি করেছিল
এইচএমভি। আমিন সায়ানি এবং সি রামচন্দ্রর সঙ্গে হিন্দি আলাপচারিতা এখনও ইউটিউবের সৌজন্যে চাইলে অনেকে শুনতে পারেন। আরও বেশ কিছু অপ্রকাশিত বা একবার মাত্র সম্প্রচারিত
সাক্ষাৎকার রয়েছে, সেগুলির উল্লেখ যথাসম্ভব রয়েছে ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ঃ স্মরণে
মননে সুরস্রষ্টা শিল্পী’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে।
প্রশ্ন
করতে পারেন কেউ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘কথা’ নিয়ে এত কথা বলবার কী আছে? তিনি তো
সেই অর্থে ‘বক্তা’ ছিলেন না কোন কালেই। যেখানে বলেছেন তা ওই
সাধারণ আলাপচারিতা-গোছের, বিরাট কিছু সাংগীতিক দর্শন নিয়ে ভাষণ তো আর নয়! কিন্তু এই
আপাত-সাধারণ আলাপচারিতার মধ্যে ধরা পড়ে এক ধরনের খণ্ড-ইতিহাস, সংস্কৃতি জগতের এক ব্যক্তি বা
ব্যক্তিত্ব-কেন্দ্রিক টুকরো টুকরো ভাবনা বা ঘটনার নিরিখে আসলে বাংলা গানের ইতিহাসে
একটি যুগকে ধরতে চাওয়া। গত বছর ১৬ জুন পেরিয়ে গেল তাঁর শতবর্ষ, এতদিন পরে তাঁর
‘কথা’ নিয়ে কথা বলবার গুরুত্ব না হয় এটুকুই।
কলকাতা
দূরদর্শনে সুবীর ঘোষ সঞ্চালনা করেছিলেন তাঁর ‘কথায় ও সুরে’ অনুষ্ঠানটি। সঞ্চালক
যখন বলতে থাকেন, হেমন্ত যদি সত্যি ইঞ্জিনিয়ার হতেন, তাহলে আমরা কি কি পেতাম না...
এবং ব্রিজ, রাস্তা ইত্যাদি না বানিয়ে এই যে তিনি গানের জগতে চলে এলেন... দীর্ঘ
সঞ্চালনা শুনতে শুনতে দর্শক যখন একটু উশখুশ করছেন, ঠিক সেই সময় কথার সুর ধরে নিলেন
হেমন্ত, “এসেছি কি, ভাগ্যবিধাতা নিয়ে এলেন, যেমন নিয়ে আসেন।” এই একটি কথায় যেন
পুরো অনুষ্ঠানের সুর বাঁধা হয়ে গেল। একেবারে বৈঠকি আড্ডার ভঙ্গিতে বাঙালি
ভদ্রলোকের প্রতিমূর্তি হয়ে চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বসে থাকা মানুষটি এর পরে বলে
চলেন, কীভাবে বাংলা গানের পথচলায় বদল এল, অভিনয় করে দেখিয়ে দেন, ‘জানিতে যদি
গো তুমি’ থেকে ‘রজনীগন্ধা ঘুমাও’ হয়ে ‘কথা ক’য়ো নাকো’ পর্যন্ত উচ্চারণ, গায়নভঙ্গির
বিবর্তন স্পষ্ট ফুটে ওঠে তাঁর তিন মিনিটের কথায় ও গানে। গল্প করতে করতে শোনান,
তাঁর জীবনের প্রথম বড় অনুষ্ঠানে গান না গেয়ে ফিরে আসার কথা। “তখন আজকাল যেমন ফাংশন হচ্ছে, এরকম হত না। মোস্টলি ছাত্ররা করত, ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হল-এ। তো
ওখানে আমাকে বলল যে তোকে গাইতে হবে। আমার এক বন্ধু নিয়ে গিয়েছিল। বসে আছি বসে আছি, কিছুতেই আর আমার আইটেম আসে না। হঠাৎ
বলল যে পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন। ব্যস! হই হই করে একটা গোলমাল শুনলুম, পঙ্কজ মল্লিক
এসে গেছেন। তখন আমি পঙ্কজ মল্লিককে দেখবার জন্য দৌড়লুম। কিছুক্ষণ পরে
মনে হল, আমার গান তো হয় নি! পঙ্কজদা এসে গেলেন, আমি আর কখন গাইব! আমি তখন জিগ্যেস
করলুম, আমার গানটা এবার দিন, দাদা? – ‘দূর মশাই, এখন আপনার গান হবে না।’ এরপর মাথাটা একটু তুলে, ‘তথাস্তু’ বলার ভঙ্গিতে
বলছেন, “তাহলে হবে না। পঙ্কজদার গান শুনেই যাই।... গাওয়া হল না, না গেয়েই” বলে
একটা ব্যাখ্যার অতীত -- একটু লাজুক, একটু স্মৃতিমেদুর, সরল, অকপট হাসি দিয়ে, “তবে
লাভ হল, পঙ্কজ মল্লিকের গান শুনেছি।” ঘটনাটি হেমন্তর আত্মজীবনী বা বেলা
মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার স্বামী হেমন্ত’র মত বইয়ের সূত্রে এখন হয়ত অনেকেরই জানা,
কিন্তু তাঁর মুখে এইভাবে বলা কথাগুলো গল্প বলার ভঙ্গিতে মন্ত্রমুগ্ধ
করে রাখতে পারে আশ্চর্য মায়াজালে। মনে হয় চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে অতদিন আগের ঘটনা। সেই একই
কথা বলা যায় ‘গাঁয়ের বধূ’ নির্মাণের নেপথ্যগল্পের ক্ষেত্রে হেমন্ত বা
সলিল-অনুরাগীদের খুব চেনা কাহিনি, তবু সে গল্প স্বয়ং শিল্পীর মুখ থেকে শোনার স্বাদ
আলাদা।
বাংলা
ছায়াছবিতে তাঁর সুরে বা কণ্ঠে অধিকাংশ গানের যে বিপুল সাফল্য তার মূলে রয়েছে
‘সিচুয়েশন অনুযায়ী গান’ পরিবেশনের ক্ষমতা। এ প্রসঙ্গে হেমন্ত বলছেন, ওই
সাক্ষাৎকারেই, “সিচুয়েশনের ওপর তো গান ছায়াছবিতে করতেই হয়। ... ফিল্মে একটা
সিচুয়েশন দেওয়া থাকে। এবং শুধু সিচুয়েশন না, আমাদের কতগুলো জিনিস দেখতে হয়, যে
পাত্রপাত্রী, অর্থাৎ সে কি রকম, খুব লেখাপড়া-জানা, না গাঁয়ের, কোথায় বাস করে,
কীরকম ড্রেস পরে, ইভন সেটাও দেখতে হয়। সে কোট প্যান্ট পরে, না ধুতি পরে, সে শাড়ি
পরে, না গাউন পরে — মেয়েরা। এই অনুযায়ী তো গান করতে হয়, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে। যেমন ধরুন, আজকাল
ক্যাবারে নাচটাচ খুব হচ্ছে, তো ক্যাবারে নাচের মধ্যে তো ঠুংরি হয় না, বা গজলও হবে
না। তা ওই ক্যাবারের মতই করে দিতে হবে।
সেগুলো দেখতে হয়, ভাবতে হয়। কখনও কখনও বাংলা ছবিতে আমি প্রথম লাইনটা সুরের সঙ্গে
মিশিয়ে দিয়েও দিয়েছি অনেক গান।”
নিতান্ত
‘সাদামাটা’ মানুষটির ভাবনার গভীরতা, অনন্যতা এবং আধুনিকতা ঠিক কোথায়, সেটা যখন
তাঁকেই এইভাবে নিছক আড্ডার ছলে কয়েকটি কথায় যে বুঝিয়ে দিতে হয়, সেটাও কান পেতে
শোনার। সম্ভবত ১৯৮৪-র এই সাক্ষাৎকারের আগে, সত্তরের দশকে অভিনেতা শুভেন্দু
চট্টোপাধ্যায় যে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাঁর, সেখানে আবার একেবারে অন্য মেজাজে
পাওয়া যায় তাঁকে। স্টুডিয়োর গোছানো পরিবেশে নয়, শুভেন্দু সরাসরি শিল্পীর বাড়িতেই
যেন গান শুনতে এসেছেন ভক্ত হিসেবে। কোন তৈরি স্ক্রিপ্ট সে অর্থে নেই, শুভেন্দু
একটার পর একটা গানের কথা তুলে ‘অনুরোধের আসর’ বসিয়ে ফেলেছেন রীতিমত। হেমন্তও খোলা
মেজাজে বলছেন অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরীর কথা — ‘রানার’ তাঁর
সবচেয়ে প্রিয় কম্পোজিশন — এই কবিতায় এই সুর হতে পারে, ভাবাই যায় না, ইত্যাদি। তার
মধ্যেও কিন্তু তাঁর সময়জ্ঞান দেখার মত, “কত গান আছে, অত সময় আমি দিতে পারব না
(মানে, দূরদর্শনের সময়-বাঁধা পরিসরের ভাবনা কাজ করছে মাথায়), একটু একটু শোন।” এবং
সেই সময়-অভাবের জন্যই ‘শাপমোচন’-এর গান সুর করে রেকর্ডিং তাঁকে দুদিনের মধ্যে করতে
হয়েছে। করতে গিয়ে তাঁর নিজেরই মনে হয়েছে ‘জঘন্য হচ্ছে—শোনার মত নয়’-- সে কথা বলছেন
অদ্ভুত সততার সঙ্গে! এরকম যদি মনে হয়েও থাকে, গানগুলো অতুলনীয় সাফল্য পেয়ে যাবার
এত বছর পর সে কথা নিজে থেকে এভাবে বলে দিতে কজন শিল্পী পারেন?
সেই
একই সহজ, সপ্রতিভ ভঙ্গিতে ‘হেমন্ত কুমার’-কে কথা বলতে শুনি তাঁর হিন্দি
সাক্ষাৎকার-গুলিতেও, এবং বাঙালি শ্রোতার কানে যেটা ধরা পড়া বিচিত্র নয়, যেন বাংলায়
কথা বলার বৈঠকি ধাঁচটাকেই তিনি হিন্দিতে ফেলে বলছেন। সি রামচন্দ্রকে বোঝাচ্ছেন ‘নীল
আকাশের নীচে’ গানের তাৎপর্য,
“নীল আকাশকে নীচে ইয়ে পৃথিবী হ্যায়, পৃথিবীকে উপর ইয়ে নীল
আকাশ হ্যায়। কোই কি আঁখি খুলকে দেখতে হ্যায় কি লোগ কিতনা দুখী হ্যায়...” আরও অনেক
গানের আড়ালের গল্প উঠে আসে তাঁর কথায়, ‘ইনস্পেক্টর’ ছবিতে ‘দিল ছেড় কোই অ্যায়সা
নাগমা’ গানটি শুধু লতাজিরই গাওয়ার কথা
ছিল। কিন্তু লতাজির তখন গলা খারাপ। এদিকে ছবির প্রজেকশনের জন্য অন্তত ‘রাফ’ ভাবেও
গানটা দরকার। প্রস্তুতি ছিল না, হেমন্ত তখন শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা নিয়েই গানটি
রেকর্ড করে দিলেন। শুনে পরিচালকের এত পছন্দ হয়ে গেল, যে ছবির অন্য একটি সিচুয়েশনে
তিনি ওই গানটিই রেখে দিলেন। আবার আমিন সায়ানিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ‘নাগিন’-এর
বিরাট সাফল্যের পর একটি মজার ঘটনা। নাগিন-এ বীণ বাজিয়েছিলেন কল্যাণজি, তাঁর ডাক
পড়েছিল এক গ্রামের জলসায় নাগিন মিউজিক শোনানোর জন্য। সঙ্গে গিয়েছিলেন হেমন্তও।
কল্যাণজি তাঁর ক্ল্যাভায়োলিন বের করে বাজাতে শুরু করতেই শ্রোতারা
বিক্ষুব্ধ, এ তো বীণ নয়, সাপুড়ে বাঁশি শোনাবার নাম করে এ কী বাজানো
হচ্ছে! পরিস্থিতি সামলাতে আসরে নামতে হল মিউজিক ডিরেক্টরকে।
বুঝিয়ে বললেন তিনি, ‘নাগিন’-এ আপনারা যে মিউজিক শুনেছেন, তা
এইভাবেই বাজানো হয়েছে। তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধও ধরা পড়ে, যখন আমিন সায়ানিকে সাক্ষাৎকার
দিতে গিয়ে তিনি গীতিকার রাজিন্দর কিষণকে নিয়ে কথা বলেন। তাঁকে দিয়ে গান লেখানো ছিল
এক দুরূহ ব্যাপার। এক-একদিন কাজের জন্য এসে এক-একটা অজুহাতে কোথাও না কোথাও পালিয়ে
যাওয়া এবং সেই সফরের সঙ্গী করা সঙ্গীত পরিচালককেও কোনদিন জুহু বীচে মাছের সন্ধানে, কোনদিন কোলাবাতে মালাই খাওয়ার নাম করে বেরিয়ে
পড়া, এই ছিল তাঁর স্বভাব। শেষ পর্যন্ত রেকর্ডিং-এর আগের দিন জোর করে ঘরে বসিয়ে রেখে
তবে গান লেখানো যেত তাঁকে দিয়ে। এবার আমিন সায়ানি জানতে চাইলেন, রাজেন্দ্র
কিষণের কথা ভেবে কোন গানটি তিনি শোনাতে চান। হেমন্ত বললেন, “রাজেন্দ্র
কিষণ মুঝে ইতনা সফর করবায়য়া, তো উয়ো গীত মুঝে ইয়াদ আতা হ্যায় “কাহাঁ লে চলে হো,
বতা দো মুসাফির...” – ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছবির বিখ্যাত গান।
বিবিধ
ভারতীতে প্রচারিত আর একটি হিন্দি সাক্ষাৎকারে ‘হেমন্ত কুমার’ জানাচ্ছেন,
কিশোরকুমারকে ‘লুকোচুরি’র জুবিলি
উপলক্ষ্যে প্রথমবার তিনি কীভাবে কলকাতার পাবলিক ফাংশনে নিয়ে এসেছিলেন, সেই কথা।
কিশোর কিছুতেই এত শ্রোতার সামনে মঞ্চে উঠবেন না, হেমন্ত বললেন, “তুমি চলো,
তোমার পেছনে আমি দাঁড়িয়ে থাকব, দরকার হলে তোমার গান আমি গেয়ে দেব।” সেরকম হলে
ব্যাপারটা মজাদার হত সন্দেহ নেই, তবে শেষ পর্যন্ত মঞ্চে তুলে দেবার পর শ্রোতাদের
উৎসাহ দেখে অভিভূত কিশোর গান গাইলেন ঠিকই। হেমন্ত শেষ করছেন তৃপ্তির হাসি দিয়ে — আর্টিস্ট হ্যায় না! ওই সাক্ষাৎকারেই জানাচ্ছেন, প্রথম
ভারতীয় শিল্পী হিসেবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে বিপুল অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা,
সেই সঙ্গে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছেন ওখানকার ভাষা-সংস্কৃতি, ত্রিনিদাদ বা
জামাইকায় মানুষজন ইংরাজি বেশি বলেন, ডাচ গায়ানায় কিন্তু চলে ভোজপুরি হিন্দি অথবা
ডাচ। শেষে জানাচ্ছেন,
ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রবাসী ভারতীয়রা কেমন তাঁকে স্পর্শ করে দেশের মাটি ছোঁয়ার স্বাদ
পেতে উদ্বেল হতেন। হেমন্তর ভাষায়, “মুঝে তো রোনা আ গয়া থা। ভারতীয় হোনে
কা গৌরব উস দিন মুঝে মালুম হুয়া।”... সেই সঙ্গেই আবার যোগ করছেন, আমি তো প্রথম
ভারতীয় শিল্পী হিসেবে ওদিকে গিয়েছিলাম, সেজন্যই বোধহয় আমাকে নিয়ে ওদের এত উৎসাহ
ছিল!
সঙ্গীতের প্রগতি এবং আন্তর্জাতিকতা নিয়ে বলছেন, “সঙ্গীতের বিষয়ে আমি প্রগতিবাদী। জমানা বদলাতেই থাকে, পরিবর্তনও চলতে থাকে, তবে একটাই কথা -- সঙ্গীত যেন চিৎকার না হয় (“সংগীত শোর নহি হোনা চাহিয়ে”)। যার মধ্যে গভীরতা আছে, মেলডি যা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছতে পারে, তা-ই সঙ্গীত।... আজকাল ওয়েস্টার্ন মিউজিক নিয়ে অনেক কথা উঠছে। ওয়েস্টার্ন মিউজিক কি ভালো নয়? পৃথিবী আজ খুব ছোট হয়ে গেছে, ওরাও (পশ্চিম দুনিয়ার মানুষ) আমাদের গান শুনছে, আমরাও ওদের গান শুনছি। অবচেতনে কিছু না কিছু প্রভাব এসেই যায়... আমি নানা জায়গায় অনেক ঘুরেছি, আমাদের সঙ্গীত ওদের দেশে বেশ চলছে। সুর, মেলোডি থাকলে তা সকল মানুষকেই আনন্দ দিতে পারে।” অর্থাৎ প্রকৃত সঙ্গীত যে দেশেরই হোক, তার গভীরতা এবং সূক্ষ্মতা দিয়ে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সংবেদী মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে।
এই সব টুকরো কথার মূল্য হয়ত আর কিছুই নয়, যদি না এই কথাগুলোকে ধরতে হয় শিল্পীর স্বচ্ছ, সুন্দর হৃদয়ের দর্পণ হিসেবে। আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, “যেখানে হৃদয়ের স্পর্শ নেই, সে রাস্তায় আমি কোনদিন হাঁটি নি।” এই হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়, যখন তিনি নিজে সঞ্চালকের ভূমিকায় অন্য শিল্পীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে, তাঁর কথা বের করে আনেন সহজ আন্তরিকতায়। জর্জ বিশ্বাসের শেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন হেমন্তই, মানপত্র পাঠ ছাড়াও শুরুর দিকে যে কথাগুলো সহজ সরল অনাবিল ভঙ্গিতে বলছেন, কত কষ্টে তিনি ‘কাকা’কে রাজি করিয়েছেন, তা কান পেতে শোনার মতই। “দিনক্ষণটা বোধহয় ভালো ছিল, মঙ্গল শুক্র না বুধ কীসব বলে, এমন একটা প্রেসার দিল যে উনি ‘হ্যাঁ’ বলে ফেললেন। ‘হ্যাঁ’ বলে উনি নিজে ফেঁসে গেলেন... আমাকে রোজ গালাগাল দিচ্ছেন, ‘তুমি আমাকে খুব বিপদে ফেলেছ-- আমি এরকম জানতাম না, এরকম করতাম না, আমি ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলেছি এখন ‘না’ করতে পারি না... যা হোক, আজ আমার খুব আনন্দের দিন, যে আমি কাকাকে সম্মান দিতে পারছি।” দূরদর্শনে ‘সুর ও সুরকার’ সিরিজে ভি বালসারার অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেছেন তিনিই — কোন স্ক্রিপ্ট নেই, সোফায় বসে গল্প করার ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছেন আর নানারকমের বাজনা শুনতে চাইছেন। বালসারাজি উৎসাহের আতিশয্যে ‘তোমার হল শুরু’ গানটি পিয়ানোতে বাজাতে গিয়ে শুরুটা করলেন একটু খেলিয়ে, হেমন্ত বলে উঠলেন—“বিশ্বভারতী কিন্তু পাস করত না, তুমি যেভাবে শুরু করলে।” ম্যাণ্ডোলিন-ভায়োলিন অনেক দিন বাজানো অভ্যেস নেই বলে বালসারা একটু অপ্রস্তুত, এদিকে হেমন্ত জেদ ধরেছেন, তিনি বালসারার হাতে এ দুটো বাজনা শুনেই যাবেন। বালসারা বলছেন, “আপনি বারবার ওই দুটো বোলে ভোয় দেখাচ্ছেন কেনো!” শেষ পর্যন্ত যখন বালসারা বাজাতে বসলেন, হেমন্ত অভয় দিলেন, “তুমি এমন একটি শিল্পী, তুমি যাই বাজাও, খারাপ বাজাতে পারো না। তোমায় কি আজ থেকে চিনি?” আবার বলছেন, “এত রকম যন্ত্র তোমার হাতে, যদি একটা ছবিতে আর কাউকে না ডাকি, একলা তোমাকে দিয়েই আমার কাজ চলে যাবে।” কোন বাড়াবাড়ি বা কৃত্রিম উচ্ছ্বাস নেই, কিন্তু অন্য এক গুণী শিল্পীর প্রতিভাকে কী সরল, প্রীতিপূর্ণ স্বীকৃতি-সম্ভাষণ। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারে তো রীতিমত ‘মাস্টারমশাই’-এর ভূমিকা নিতে হয়েছে তাঁকে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় শিশুসুলভ সারল্যের প্রতিমূর্তি, স্বভাবে অন্তর্মুখী, ক্যামেরার সামনে আড়ষ্ট। দেখলে বোঝাই যায়, যেটুকু কথা তিনি বলেছেন, সেটা অগ্রজসুলভ দাবিতে কখনও মজা করে, কখনও একটু ধমক দিয়ে ‘হেমন্তদা’ তাঁর মুখ থেকে বের করে এনেছেন বলেই।
এছাড়াও অনেক অ্যালবামের শুরুতে ভূমিকা (যেমন ‘সঙ্গীতলহরী’র আরম্ভে) হিসেবে, গ্রন্থনা হিসেবে (উত্তমকুমার স্মরণে) কিছু কিছু কথা তিনি বলেছেন যার মূল্য, অন্তত খণ্ড-ইতিহাসের দৃষ্টিতে ফেলে দেবার মত নয় মোটেই। এই রকম টুকরো কথার কোলাজে আমরা পাই এমন এক হেমন্তকে, যিনি সুর ও সঙ্গীতের আলোয় উজ্জ্বল এক দেবদূত নন, সাধারণ হয়েও অসাধারণ একজন মানুষ-ই। শেষ করতে গিয়ে মনে পড়ে আবার সেই ‘কথায় ও সুরে’ অনুষ্ঠানের শেষে বলা কথাগুলো, “আমি কোনদিন ভাবিনি যে আমি একজন বিরাট শিল্পী হব — গাইয়ে হব। যেজন্য আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়ে যখন একটু আধটু গান হচ্ছে, তখন শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং শিখতে গিয়েছিলাম, যে একটা চাকরি করব, গান করব। এবং প্রতিদিন আমি যে গান করেছি, বরাবর যা করি, তার ফলের কোন আশা করি নি। রেজাল্ট কী হবে আমার জানা ছিল না বলে আশা করিনি।... আমার কাজ হচ্ছে খেটে যাওয়া, কাজ করা, সিন্সিয়ারলি কাজ করে যাওয়া, ফল কী হবে কে জানে! আমাদের হাতে তো নেই। তা যদি থাকত, তাহলে কাজের এত আনন্দ থাকত না।... আমার এই যে কণ্ঠ, এ তো আমার নয়, যাঁর দেওয়া কণ্ঠ তাঁর। ঈশ্বর আমাকে কণ্ঠ দিয়েছেন, তিনি যেমন চালাচ্ছেন আমি চলছি। যেখানে গিয়ে শেষ হবে, শেষ হবে।” এ শুধু কথার কথা নয়, এ কথা যিনি বলতে পারেন তাঁকে নিয়ে কথা বলার পক্ষে আমরা যে কত ক্ষুদ্র, সেটা বুঝতে পারাই বোধহয় অনেক বড় কথা।
এইভবে শিল্পীর সত্তার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হোক।
উত্তরমুছুনঅপূর্ব শব্দচয়ন, অনবদ্য স্মৃতিচারণ, ইতিহাসকে প্রায় দৃশ্য করে তোলার জন্য অজস্র অভিনন্দন।
উত্তরমুছুন