সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

সুকান্ত দেবনাথ

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

           

দূরত্ব




 

(পাঁচ)  

বিছানার কোণায় ছেড়ে রাখা বাসি কাপড়ের স্তূপের মধ্যে অদ্ভুত এক গন্ধ থাকে  আমি জানি। প্রতিটি সকালে প্রতিটি নারীর গা থেকে যা উঠে যায়, তার ছেড়ে ফেলা কাপড়ের সঙ্গমে। তারপর সে, তার দুহাতের আলতো আদরে সে কাপড় তুলে বাথরুমের মাঝেয় ফেলে রাখে। আমি গ্রাম দেখে ফিরে আসছি, যতটা মনে হচ্ছে এদের পূর্বপুরুষ হয়তো ওপার বাংলা থেকে উঠে এসেই এখানে বসেছিল। আমি দেখতে পাচ্ছি শাঁখা পলার শব্দে তার নিজেরই মনযোগ ছড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। এদিক ওদিক থেকে বেড়ে যাচ্ছে আরও অগোছালো কাজের চাপ। শিশুটি হয়তো কিছু পরেই উঠে পড়বে, উঠে পড়বে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আমাকে সরে পড়তে হবে তার আগেই। তার আগে কি ও মেয়ের নাম জানতে চাইবো? বা তার স্বামী কোথায় আছে?

অথচ প্রশ্ন করা আমার স্বভাব নয়, কোনোদিন ছিলও না। নিজেকেই কোনো কালে প্রশ্ন করিনি, আমিই কেন? তবে হ্যাঁ, কস্তূরীর অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি তার বাবার। অবশ্য আমার টেবিলের উপর ছড়িয়ে পড়ে থাকা এই সব নানান প্রশ্ন কিন্তু কস্তূরী গুছিয়ে রেখেছে পরের দিন ভোর হবার সাথে সাথেই। কিন্তু তার ছেড়ে রাখা বাসি কাপড়ের স্তূপ তো কোনোদিন দেখিনি। সে কি বাসি কাপড় ছাড়ে? যখন প্রথম এসেছিল মা হয়তো কিছু বলে ছিল কোনো এক বেলায়। আমিই আবার মাকে বলে দিয়েছিলাম, তুমি বেশি কিছু শেখানোর চেষ্টা কোরও না। কেননা সে এক খুবই শিক্ষিত কমরেড পরিবারের মেয়ে। সেখানে এই সব প্রাচীনত্ব কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। গভীর সঙ্গমের পরে অবশ্যই সেই প্রথম দিকে, তার গোলাপি ঠোঁটের কোণায় যে হাসি ছিল তা  ঠিক কিরকম ছিল তাই আজও পর্যন্ত নির্ধারণ করে উঠতে পারিনি। উঠে গিয়ে টেবিলের সামনে, দেয়ালের সামনে বসেছি অনেকক্ষণ।

কস্তূরী ডেকেছে – কি তোমার ঘুম পায় না?

বলেছি – না পায় না, উল্টে মনে হয় ঘুমোলেই যে হারিয়ে যাবে। 

সে বলেছে - কী হারিয়ে যাবে?

বলেছি – ভাঙাচোরা কয়েকটি কল্পনা। কারণ কল্পনা করা আমার স্বভাব, কারখানা থেকে বেরিয়ে যে গাছের তলায় আদিবাসী মহিলারা হাঁড়িয়া নিয়ে বসে থাকে তাদের দিকে তাকিয়েও, অনেক কল্পনা মাথায় আসে। 

আমার সব গরিমা বৃষ্টির জলের মতো গড়িয়ে পড়তে থাকে। বেঁচে থাকার সার্থকতাগুলি হারিয়ে যায় কোথায়? কস্তূরী এবং তার আবেশ থেকে দূরে সরে আসে পৃথিবী। ঘরের দিকে তাকাই কখনও আমারই ফেলে আসা অগোছালো টেবিলের দিকে। মাকে বলি, যখন তোমাদের বাবারা বা তাদের আগের সময়ের লোকেরা চলে এসেছিল, তখন কেমন ছিল তোমাদের জীবন? কখনও প্রশ্ন করি আবার কি যেতে চাও ওখানে? না কোনো উত্তরের জন্য নয় প্রশ্ন নিজেই তার সার্থকতা। আমাকে সেই গ্রামের মেয়েটির কাছে নিয়ে যায়। সেই রোগা শীর্ণকায় মেয়েটির স্বামী যে বাস্তবে আমারই অবচেতন, তার দিকে তাকাই। অর্থনীতি কীভাবে বেঁচে আছে ওখানে, যেখানে বেশির ভাগ পুরুষ অন্য দেশে বা অন্য  রাজ্যে কাজ খুঁজতে গিয়েছে। গ্রামের যৌবনের অর্ধেক অপূর্ণ। প্রচুর নারী রয়েছে সেখানে, বাচ্চা আছে, কিন্তু তাদের বাবারা নেই। পুরুষ নেই, যেটুকু গ্রামের রাস্তা দিয়ে আমি ঘুরেছি একজন ছেলের দেখাও পাইনি। যে মোটামুটি মরদ যোয়ান। এ মেয়েটির স্বামীও তাহলে অন্য দেশে। এত নারী, প্রোষিতভর্তৃকা। বাস্তবিক এক ছন্নছাড়া সুর গ্রামের এপ্রান্ত থেকে উঠে ও প্রান্ত হয়ে চলে যায়।  

যাকে বলে বুকের এফোঁড় ওফোঁড়, যারা অনুভব করে তারা প্রন্তিক। কারখানার এক কাহিনীর কথা মনে পড়ে এ প্রসঙ্গে। তখন ঘোর কংগ্রেসি যুগ চলছে, চারিদিক দাপিয়ে রাজত্ব তাদের। আসলে তাদের রাজত্বের শেষ সময়। প্রকাশ্যে আন্তরিক আর গোপনে আখের গুছিয়ে নিতে যারা পারে, তারা পারে। যারা পারে না, তারা কোনো দিনও কথা বলেনি, মানে কথা বলা তাদের স্বভাবেই নেই।  তারা শুধু ভালো কর্মী, কাজ চায়, সামান্য কিছু পয়সা যা দিয়ে ঘর চালাবে আর  অন্তত কাজের শেষে খানিকটা শান্তির ঘুম। যেন ঘুম থেকে উঠে নিজের ছেলে মেয়েদের জ্যান্ত দেখতে পারে বা দেহ নিয়ে কারখানা থেকে ফিরে আসতে পারে ঘরে। তেমনই এক দিনের বেলায় এক ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’ চলছে কারখানায়।  অবশ্য এ সবই আমার জন্মের অনেক অগের কথা, কিন্তু এতটাই পপুলার ছিল যে মানুষের মুখে মুখে তা আজও চলে আসছে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক  প্রজন্মের কাছে। কারখানার ভিতরেও প্রজন্ম থাকে, একদল শ্রমিকের অবসরের পরে আরেক দল শ্রমিকের জন্ম। তেমনই এক ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’, আমি শুনেছিলাম বাবার মুখে। যার অবসর তাকে কিছু বলতে বলা হচ্ছে। এবং সে বলতে নারাজ। গোটা জীবন পেরিয়ে এসেছে কিছু না বলে। আর এই শেষবেলা বলেই বা কী পাওয়া যাবে!     

তাকে অনুরোধ করা হচ্ছে, বারবার, আপনি কিছু বলুন! এত বছর কাজ করলেন  আমাদের সাথে। কেমন ছিল আপনার কর্মজীবন, কেমনই বা ছিল সব কর্মীরা। তাদের জন্য কিছু একটু, যা আপনার মনে চাইবে। সমস্ত কলিগ, গ্রুপ ডি স্টাফ, এমনকি ম্যানেজার। সবাই তার কথা শুনতে চায়। সে খুব ভালো কেবল জয়েনটার ছিল। কিন্তু সেটুকুই, আর কিছু তো নয়। যাইহোক তাকে বলতে হবে, তাই সে উঠে স্টেজের উপর রাখা পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়েছে। এবং যা কিছু উঠে আসছে তার আত্মা থেকে, কথা হয়ে উঠছে তার মনের অভিপ্রকাশ। চুপ সকলে, স্তব্ধ এতটাই যে একটি পিন পড়ার শব্দও ছন্দপতন মনে হবে। মেসমেরিজম, সম্মোহন বা মোহিত হয়ে যাওয়া।

-আমি সেই ছোটবেলায় এই কারখানার সামনেই বসে ফুলুরি বিক্রি করছি। পাশে মা। কয়েকটি পাথরের উপর একটি এনামেলের থালায় ফুলুরি রেখে তাকিয়ে আছি বাবুদের দিকে। বাবুরা আমার মায়ের দিকে। মা ছোট একটি উনুনের সামনে বসে নিজেকে গরম তেলের মাঝে সেঁকে চলেছে একটানা। অথচ আমার থালা খালি হচ্ছে, ভরে যাচ্ছে খুচরোর থলি। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ পাশেই অন্য পাথরের উপর, কেউ বা টিফিনের সামান্য ঝোলায় অসামান্য নিজেরই রক্তজলের পাশে। আমি মায়ের পাশে, প্রতিটি বাবুর মুখ চেনা হয়ে গেছে, কে ক’পয়সার খরিদ্দার, জানা হয়ে গেছে। মায়ের জানা হয়ে গেছে এরা কেউ কেউ ভাতে মুড়িতে একসাথে খেতে ভালোবাসে। আমি দেখছি কোনো বাবুর চোখে আমার জন্য করুণা, কোনো বাবুর চোখ মায়ের করুণার জন্য। মা জানতো, মা খুব ভালো বিক্রি করতে পারতো। আমিও পারতাম বাবার জন্য কষ্টে, চোখের জল আটকাতে। বাবাকে সেই ফেলে এসেছি দেশ ভাগের কালে, বাবা এখন  কোথায় আছে? নোয়াখালী, সে কি আজও আছে সেখানেই? বাবা বলছে দৌড়ও, দৌড়তে থাক, দাঁড়াবি না, থামবি না। থামলেই শেষ হয়ে যাবি। থামবি না একবারও। আমি আসছি, তোরা এগো। আমি তোদের ধরে ফেলবো। 

এরপর মাকে অনেক জিগ্যেস করেছি, মা শুধু বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কথা বলেনি। অথচ শাঁখা পলা পরেছে সারা জীবন। মাথায় সিঁদুর দিয়েছে। বলেছে আমি ভাগ্যবতী, সধবাই মারা যাবো। আমিও মায়ের সাথে সাথে ভেবে এসেছি এ  পৃথিবী হয়তো কিছুটা নিঃশ্বাস দেবে আমাকে। তাছাড়া আর কি আছে, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে এই যে সামান্য ক্ষণ কোনো মানুষের জন্য বেঁচে আছি! ভিটে  নেই মাটি নেই, কিন্তু বাঁচার ইচ্ছে তো আছে। বাঁচতেই তো এসেছি, শুধু পয়সা কামিয়ে কিছুটা অবস্থা ভালো করার জন্যই তো আসিনি। আমার পরে যারা পৃথিবীতে রয়ে গেল তাদের জন্য কিছুটা পৃথিবী। অবশ্য আমার কথা নয়, মা বলেছিল, কোনো বাবুর কাছ থেকে শুনে। আমি সে আর ভুলতে পারিনি। তারপর তেমনই এক বাবুর কৃপায় আমিও এ কারখানায় ঢুকে পড়ি। তখন আমি সতেরো, আঠেরো লিখিয়ে শ্রমিক পাড়ায় উঠে আসি। সংগ্রামটা আমার কাছে পালটে যায়। কিন্তু শেষ হয়নি। তারপরেও আমার সাথে সাথে থেকেছে, আমিও নিজেকে তৈরি করেছি। পড়াশোনা করেছি যতটা পেরেছি। কাজ করেছি প্রাণ  দিয়ে। আমার এ জীবনের জন্য মায়ের যে আত্মত্যাগ, তা শুধু জানে অন্তর্যামী। অবশ্য সে বাবুকেও ভোলার নয়। সে না থাকলে বা সে তেমন না হলে কি জীবনটা এভাবে শেষ করতে পারতাম? যে সময়ে, যে অবস্থায়, যে আবহে  মানুষের স্বপ্ন মনে হয় বিলাসিতা। লাক্সারি হয়ে ওঠে ভাত কাপড়ের চাওয়াটুকু, ভয় পায় সবাই। আমি ঠিক তখনই আমার মায়ের চোখে দেখেছিলাম বাবার সেই শেষ কয়েকটি কথা – তোরা এগো, আমি তোদের ধরে ফেলবো। আমরা বাকিটা  আর তাই বসে থাকতে পারিনি। এভাবেই দৌড়তে দৌড়তে, হাঁটতে হাঁটতে, এক গণসংগীতের সভায় এক শ্যামলা রোগা মেয়েকে দেখে মনে হয়েছিল। তার জীবনেও হয়তো তেমনই চলা আছে, থামতে বারণ আছে। তাকে কি সাথে করে চলা যেতে পারে? মাকে জিগ্যেস করেছিলাম।    

যাইহোক সবই করলাম, নিজের চারটি ছেলে। সবাইকেই কিছু না কিছু ধরিয়ে দিতে পেরেছি। শুধু আমার শেষ ছেলেটি। সে খুবই ছোট তো, আসলে একেবারে শেষের সন্তান, একটু বেশি নেওটা হয় বাবা মায়ের। সেটাকেই কিছু ধরিয়ে দেওয়ার আর সময় পেলাম না।

এরপরেও কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিল ঘর। সেদিন ছিল তার চাকরির শেষ মাস। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি ছিল। তেমনই খুব শান্ত ভাবে সেই ছোট্ট অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সকলে কেমন যেন চুপ করে গেছিল। তারপর  এক আশ্চর্য ঘটনা হল। যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কারখানার ভিতরেই এক ডাম্পারের সাথে তার সাইকেলের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সকলে ছুটেছে দেখতে। ভিড় চারদিকে ভিড়, কোন ডিপার্টমেন্ট, কোন ডিপার্টমেন্ট? অথচ সেই লোকটির ডিপার্টমেন্টের লোকেরা শুধু তাকিয়ে আছে, ডাম্পারের চাপে চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখের দিকে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। তারপর অবশ্য তার ছোটছেলে তার চাকরিটা পেয়েছিল।

       

(ক্রমশ)

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন