কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৭ |
শূন্যপুর - ৫
নেতামশায় মিথ্যা কইবে ক্যানো? হরিনাথ তাঁকে ভগবান মেনেছে। তাঁর নামে দিব্যি কাটা যায়। একগলা ব্রহ্মপুত্রে দাঁড়িয়ে বললেও হরিনাথ বিশ্বাস করবে না যে নেতামশাই মিথ্যা কয়। নেতামশায় রেডিওতে ভাষণ দেয়। তার গুরুগম্ভীর স্বরের ওঠা আর পড়া। অথচ সাদামাটা ভাষা, যা হরিনাথও সবটুকু বোঝে।
রেডিওকেই তখন ভগবান মানতে ইচ্ছে হয়। ঘরে টিভি নাই। ব্যাটার ঘরে আছে। টিভিতে নেতামশায় দেখা দেয়। নেতামশায় প্লেন উড়িয়ে গুহায় যায়। ধ্যান করে। বাগানে প্রাণায়াম। পোষা ধনেশ পাখিকে দানা খাওয়ায়। জ্যোতি বেরোয়। হাত কপালে ঠেকায় হরিনাথ। সাক্ষাৎ অবতার!
যেবার নিয়ে গেল স্ট্রেচারে তুলে, বেটি আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে কইছিল, 'বাপ নেতামশায়ের নাম করে চব্বিশ ঘণ্টা। তুমাদের প্রাণে দয়া নাই? একশ ছুঁই ছুঁই লোক, কতদিন বাঁচবে?'
নেতামশায়ের নিয়ম কড়া। কাগজ ছাড়া কী করে প্রমাণ হয়, কে প্রজা কে নয়? বেজাত কুজাত ছেঁকে ফেলে দেওয়া জায়েজ। হাওয়া জল জমিন যার তার সঙ্গে ভাগ করা মানা। ভাজক বাড়লে ভাগফল কমে, ছোটবেলার অঙ্ক। হরিনাথ ম্যাট্রিক পাস। ব্যাটা বিএ। বেটির উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিয়ে হল। এখন ফিরে এসে দাদার ভাত খায় খোঁটা মেখে।
হরিনাথ ভাবল, যা হয় ভালর জন্য। বৌমার মুখ-ঝামটা নাই। সরকারি ক্যাম্পে দুবেলা খাওয়া দিলে চিন্তা কী? তবে ঝামটা মেরেও হাগাতে মোতাতে নিয়ে যেত বৌমা, বেটি। এখানে হাজার ডাকলেও আসে না কেউ। কাপড়ে চোপড়ে হয়। ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়ায়। এক ঘরে অন্য কোণের বাসিন্দা গালি দেয়।
ক্যাম্প থেকে ট্রাইবুনালে যায় স্ট্রেচার। হরিনাথ শুয়ে থাকে। উকিল জজ কথা কয়। কত কথা! হরিনাথ শুয়ে শুয়ে ভাবে, কোথাও ভুল হয়ে গেছে। ব্যাটা এদেশী। বেটি এদেশী। বাপ কী করে বিদেশী হয়? এ তো সহজ হিসাব। দিনের পর দিন কিসের শুনানি! বড় মানুষেরও ভুলচুক হয়?
হতে পারে। ভগবানেরও ভুল হয় এমন কী! এক-আধটা ভুল হলে ভগবান কি ভগবান থাকে না? ভগবান কয়েছে, হিঁদুর ভয় নাই। একগলা ব্রহ্মপুত্রে দাঁড়িয়ে বলুক কেউ, ভগবান মিথ্যুক! তবু হরিনাথ বিশ্বাস যাবে না।
জামিন হয়। স্ট্রেচার বাড়ি ফেরে। শুনানি চলবে। স্ট্রেচার ট্রাইবুনালে গেলে হরিনাথ আবার শুনবে তার উৎসস্থল নিয়ে হরেক তরজা। কাগজের জন্য আসাম সরকার তলব পাঠায় ত্রিপুরায়, বাংলাদেশ থেকে এসে যেখানে প্রথম ঠাঁই নিয়েছিল হরিনাথ। হরিনাথ কপালে হাত ঠেকায়। ভগবান মুখ তুলেছে। এইবার বিচার হবে।
বয়স এক’শ ছোঁয় যেদিন, সেদিন হরিনাথ আনমনা হয়। বাপ কইছিল, 'অরা কাইট্যা ফ্যালাইব।' তাই পালিয়ে ত্রিপুরায়। 'অরা'-র প্রতি না-বোঝা বিতৃষ্ণা রয়ে গেল। অরা ডিটেনশন ক্যাম্পে যাইব, এমনই কথা ছিল।
ভগবানের কি ভুল হয় না? ধরিয়ে দেয় কে? ভগবান আপন ভুল শুধরাবে নিশ্চয়।
সেদিন
ভগবানের রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার দিন নয়। সেদিন গান বাজছিল ডুবাইলি রে ভাসাইলি রে। গান
শুনতে শুনতে হরিনাথ চোখ বোজে। ব্যাটা বেটি আর বৌমা ট্রাইবুনালের ধকল থেকে বাঁচে শেষমেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন