সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

পার্থপ্রতিম রায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


রেজারেকশন

 

- হ্যালো, সুশীত বলছো?

- হ্যাঁ, কে বলছেন?

- ভাই তুমি আমাকে চিনবে না। খুব বিপদে পড়ে আমি মুকুন্দপুর থেকে বন্ধন  চাকলাদার বলছি। আসলে আমার এক্ষুনি একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার। আমার পিসিমা কদিন থেকে করোনায় ভুগছেন, আজ বিকেল থেকে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে।  ভয়াবহ অবস্থা। কোথাও সিলিন্ডার পাচ্ছি না। চারিদিকে শুনছি তোমরাই খুব অনেষ্টলি এটা করছো। তাই ওয়েবসাইট থেকে তোমাদের ভলেন্টিয়ারদের লিষ্টটা নিলাম। তোমাকেই প্রথম...

- ঠিক আছে, ঠিক আছে। শুনুন, আমার বাড়ি কসবা। কাছেই অবশ্য আমাদের অফিসে সিলিন্ডার রাখা আছে, কিন্তু মুশকিল হলো আজ থেকে তো পুরো লকডাউন করে দিয়েছে সরকার। তাই আমাদের যাওয়াটাই অসুবিধা। এই কদিন ভাড়া গাড়িতে যাচ্ছিলাম। এখন থানা থেকে বলেছে নির্দিষ্ট গাড়ির নম্বর সহ  পারমিশন করাতে হবে। সেটা আজ এতো রাতে কীভাবে হবে, বুঝতে পারছি না। আমি একটু দেখি কথা বলে, তারপর আপনাকে ফোন করছি।

- খুব আর্জেন্ট কিন্তু। না হলে পিসিমাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। আর তোমরাই তো করছো ভাই। তোমাদের ছাড়া আর কাকে বলবো, বলো? হসপিটাল, নার্সিংহোম কোথাও জায়গা নেই। কিছু বড় প্রাইভেট হাসপাতাল আছে, কিন্তু ওদের টাকার খাঁই মেটাবার ক্ষমতা আমাদের মতো গরীব মানুষের নেই। তাই  একটু দেখ।

- ঠিক আছে দাদা, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আপনি বরং আপনার ঠিকানাটা  আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করুন। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে জানাবো। আমাকে তো আপনার ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থাটা করতে হবে! 

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা তো ঠিক। তবে তোমাদের ওপরেই সবাই ভরসা রাখছে। তোমরাই পারো।

- আমরা চেষ্টা করছি। আমরা তো আর সরকার চালাই না! তাই যা কিছু করতে হচ্ছে, প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই করতে হচ্ছে। এই তো আজ কতক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখেও ভাড়ার গাড়ির পারমিশন দিল না! এখন আমরা কয়েকজনের  কাছ থেকে গাড়ি যোগাড় করার চেষ্টা করছি। আপনাকে জানাচ্ছি। দেখি একটা  ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সুশীত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও, ইতিহাস ওর প্রিয় বিষয়। তাই এ'কদিনের মতো আজও দিনভর কমিউনিটি কিচেন সামলে, আশেপাশের রোগীদের যথাসম্ভব পরিষেবা দিয়ে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে স্নান  করে কিছু খেয়ে রোজকারের অভ্যেস মতো বিছানায় শুয়ে বইটা টেনে নিয়েছিল। খৃস্টীয় কাহিনির শেষ অধ্যায় বেশ এগিয়েছে। এমন সময় এই ডাক। হাতের সামনে রাখা মোবাইল ফোনের নম্বগুলো টেপার সময়ও  মাথায় ঘুরছে যীশুকে মৃত্যুদন্ড দেবার পর রোমান প্রশাসক পন্টিয়াস পিলাতির সেই উক্তি। জল দিয়ে হাত ধুয়ে তিনি বলেছিলেন, “এই ন্যয়পরায়ণ ব্যক্তিটির রক্তের ব্যপারে আমি নির্দোষ”। জুদাই-এর এই চতুর রোমান শাসকের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল হয়নি।  কিছুদিন পরেই তাঁর ওপরওয়ালা দামেস্কাসের গভর্নর এসে তাঁকে বরখাস্ত করে!  মাথায় ঘুরছে কিন্তু নানা প্রশ্ন। সেই সময়ের সামাজিক, দার্শনিক বা ধর্মীয়  ভাবনা রাজনীতিকে কতটা প্রভাবিত করতো? কেমন ছিল সেই সময়ের সেমেটিক উপজাতিদের নিজেদের লড়াই বা ইহুদি, রোমান আর নবাতিয়দের দ্বন্দ্ব? কেনই বা রাজা হেরড আনতিপাস যীশুকে শত্রু মনে করতেন, তার আগে সাধু যোহানকে কেন তিনি হত্যা করেছিলেন? যীশু আনতিপাসকে 'ধূর্ত  খেঁকশিয়াল' বলে মনে করতেন। সেই সময়ের ইহুদি শাসকেরা ছিলেন লোভী, অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী। আর কাইয়াপাসের মতো সর্বোচ্চ পুরোহিতরা ছিলেন অসৎ দূর্নীতিগ্রস্থ ও উৎকোচ গ্রাহক। আর সকলের ওপরে বিজয়ী রোমান শাসকরা কেবলমাত্র রোমান জাতি ও ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কথ খেয়াল রাখতেন। এর থেকে সামান্য বিচ্যুতি হলে অধীনস্হ রাজা-প্রজা কাউকে তাঁরা রেহাই দিতেন না। তাহলে রোমান ও ইহুদি, উভয়ের কায়েমি স্বার্থই তাঁর শত্রু হয়ে পড়েছিল? হ্যাঁ, প্রশ্নগুলো মাথা থেকে সরছিল না। আর ইহুদি ইশ্বরের বিরুদ্ধে যীশুর কোন মত থাকলে জেরুজালেমের সর্বোচ্চ পুরোহিতরাই তো তাঁর বিচার করতে পারতেন! তা না করে এই করদ রাজ্যের নৃশংস রোমান প্রশাসকের দিকে তাঁকে ঠেলে দিলেন কেন? এসবের আর্থসামাজিক কারণ বুঝে উঠতে না পারলে যেন জীবন বৃথা! আরো একটা জিনিস সুশীতের মনে হয়েছিল, যীশু তো রোমানদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি, তাহলে রোমানদের বিচারে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো কেন?

নিজেকে তিনি ইহুদীদের ত্রাণকর্তা বা মিসাইয়া বলেও দাবি করেন নি, তিনি সাধারণ মানুষের সেবার জন্য ইহুদীদের প্রার্থনার ওপরে জোর দিতেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত ইহুদি৷ তিনি কেবল এক মহাপ্রলয়ের কথা বলেছিলেন। অনাচার নিরসনে এক আাসন্ন কায়ামতের দিনের কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।তবে আতুর মানুষ প্রশাসনের চাইতেও তাঁকেই বেশি নির্ভর করতেন, তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতেন! আর তাতেই কী শঙ্কিত ছিলেন রোমান এবং অধীনস্থ ইহুদি নৃপতিরা?

ইতিমধ্যে মোবাইল ফোনে বন্ধুদের যোগাযোগের চেষ্টা চলছে, কিন্তু যোগাযোগ  করতে না করতেই আবার সেটা বেজে উঠল। সেই উৎকণ্ঠার কন্ঠস্বর। এবার জানালেন তিনিই গাড়ি যোগাড় করে নিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি পৌঁছে  যাচ্ছে। তবে গাড়িতে যেন সে একা ওঠে, কারণ ছোঁয়াচে কোভিডের ছোবলের  ভয়। তাকে আবার ফিরিয়েও দেওয়া হবে, সেটাও জানানো হলো। এমনিতেই  এতো রাতে কাউকে ডাকার ওঁর কোন ইচ্ছে ছিল না। আর সকলেই ওঁর মতো দিনব্যাপী খেটে ক্লান্ত।

মুহূর্তে জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নিল, সঙ্গে নিল অফিসের চাবি। পাড়াতেই  ভলেন্টিয়ারদের অফিস, সেখান থেকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিতে হবে। বেরুবার আগে দরজাটা ফাঁক করে দেখে নেয় সে, মা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। যাক,  সারাদিন মার সাথে দেখা হয় নি। এমনই চলছে কদিন ধরে। বুবুমাসী সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে যাবার পরে মা রাত নটা নাগাদ হাতড়ে হাতড়ে খাবারের বাটি-থালা

টেবিলে সাজিয়ে রাখেন ছেলের জন্য। দুঃখী মা আমার! সুগার আর প্রেসারের  রুগী। বছর দশেক আগে জ্ঞানেশ্বরী রেল দূর্ঘটনায় নিজের স্বামী আর চোখ দুটো হারিয়েছেন। মাস তিনেক আগে ক্যানসার ধরা পড়েছে, ফোর্থ স্টেজ! এখন তাঁর অন্তিম দিনগুলো কাটে বুবুমাসীর পড়ে দেওয়া খবরের কাগজ আর বই-এর গল্প  শুনে। কখনো কখনো এফ এম এর গান তাঁর সঙ্গী।

গাড়ি ছুটছে হু হু করে। ড্রাইভার ছেলেটি বেশ সাবধানী মনে হলো। সারা মুখ মাথা মাস্ক আার কাপড় দিয়ে আঁটোসাটো করে বাঁধা। পেছনের সিটে সিলিন্ডার  নিয়ে বসে আছে সুশীত। রোগীর বয়স, নাম, কবে থেকে আক্রান্ত ইত্যাদি জিজ্ঞেস করায় তেমন উত্তর দিতে পারলো না। বলল, গিয়েই তো দেখতে পাবেন। গাড়ি রুবির মোড় ছাড়ালো, কালীকাপুর ছাড়ালো, এস আর এফ টি  ছাড়ালো, বাঘাযতীন ব্রিজ পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেল। মেট্রো ক্যাশকারি, পাটুলি মোড়... গাড়ির গতি বাড়ছিল, তারপর…   

- ও দাদা, আপনারা যে বললেন মুকুন্দপুর!

- রোগীকে আইসোলেশনের জন্য একটু এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এক্ষুনি পৌঁছে যাবেন।

গাড়ি শহীদ ক্ষুদিরাম পেরিয়ে কামাল গাজির রাস্তা ধরলো।

- এ তো অনেকটা দূর হয়ে গেল! আমাকে আগে বললে আমি এদিকের কোন ভলেন্ট্রীয়ারকে পাঠাবার ব্যবস্হা করতে পারতাম! তাতে আপনাদের কাজটাও  অনেকটা সহজ হতো। আমার আবার সকাল থেকেই ডিউটি। আপনি আমাকে আবার পৌঁছে দেবেন কিন্তু! বন্ধনবাবু তেমনটাই বলেছেন।  

ড্রাইভার ছেলেটি চুপ করে রইলো।

গাড়ি হঠাৎ ডান দিকের কোণাকুণি রাস্তা ধরলো। এরাস্তা দিয়ে আমতলার কাছে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরা যায়। এদিকটা বেশ এমনিতেই নির্জন। তারপর এতো রাত আর লকডাউনে সব কিছু কেমন প্রাণহীন মনে হচ্ছে। গাড়িটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা প্রান্তরে একটা নির্মীয়মান বহুতলের সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রায়  অন্ধকার রাস্তায় তাকে নামিয়ে দিয়েই সিলিন্ডার সহ গাড়িটা জোরে পিক-আপ তুলে বেরিয়ে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তাঁর বিহ্বলতার মধ্যেই কয়েকটি  ছায়ামূর্তি তাঁকে ঘিরে ধরেছে, এটা সে টেরও পেল না!

একটা সময় ওর চেতনা ফিরে এলো। ও বুঝলো ওর মুখের ভেতরে নিজের নোনতা রক্ত জমে আছে। ও এটুকুই বুঝলো ঘাতকেরা তাদের কাজ সম্পন্ন করেছে। যদিও থেতলে যাওয়া তার শরীরে আর কোন যন্ত্রণা জমে নেই। যন্ত্রণার উর্ধ্বে উঠে এক আচ্ছন্নতা তকে ঘিরে রেখেছে। এটাকেই বোধহয় অন্তিম আচ্ছন্নতা বলে! তার চোখ খানিকটা খুলে আছে এখনো, তবুও সে কিছুই আর  চাক্ষুষ করতে পারছিল না। একসময় এই আচ্ছন্নতার মধ্যেই টের পেল, এক তীব্র আলো তর মুখের ওপরে এসে পড়েছে আর একজন চাপা গলায় বলছে, সে কী! ্তোরা ওকে মেরে ফেললি? আমি তো ওকে মেরে ফেলতে বলিনি! বলেছিলাম আচ্ছা করে মেরে বাড়ি পাঠিয়ে দে, আর সিলিন্ডারটা রেখে দে।  ওসব ভলেন্টিয়াগিরি যাতে আর না করতে পারে। ওদের এসব কাজ চলতে  দিলে ভবিষ্যতে আমাদের অসুবিধা আছে। লোকজন তখন দু'টাকার চালে খুশি হবে না! ওদের মতোই পরিষেবা আমাদের কাছেও চাইবে। ওহ হো! আমি সত্যিই ওকে মেরে ফেলতে চাইনি। ওরা হেরে গিয়েও হারছিল না। তাই আমি ওকে না, ওদের ইমেজকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম! যাক, মেরে যখন  ফেলেছিস তখন লাশটা টেনে রাস্তার ধারে করে দে। তবে আমি কিন্তু এই নিষ্পাপ ছেলেটার মৃত্যুর দায় নিতে পারবো না, ওর রক্তে আমি হাত লাগাবো না!

সুশীত বুঝতে পারে, এ তার কন্ঠস্বর, যে তাকে ফোনে এখানে ডেকে নিয়ে এসেছিল! পিলাতির মতো এই লোকটিও রক্তের দায় বহন করতে চায় না! হাসি পেলেও হাসতে পারে না সে। মা'র কথা মনে পড়ল। মা কি ওর রক্তমাখা শরীরটাকে শেষ আদরে ভরিয়ে দিতে পারে না, যে ভাবে ক্রুশবিদ্ধ রক্তাত যীশুর শরীরকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন মা মেরী! সে শব্দহীন অনুভূতিতে মাকে ডাকে, মা, মাগো, তুমি কোথায়? তুমি কি একবার এসে আমাকে আদর করে  যাবে! সেই যে তোমার সুন্দর চোখ দুটো দিয়ে তুমি আমাকে দেখতে! ছোটবেলায় আমাকে ভাত খাইয়ে দিতে, জামা পরিয়ে দিতে, চুল আঁচড়ে দিতে, বইমেলায় নিয়ে যেতে! মাগো তুমি কোথায়? তুমি কি একবার আসবে! চেষ্টা করে সে শব্দ করে মাকে ডাকতে, যাতে সেই শব্দ নিজের কানে শুনতে পারে সে! নাহ, কিছুতেই মা শব্দটি উচ্চারিত হয় না। অনেকক্ষণ ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় যীশু যেমন যন্ত্রণা পেতে পেতে মারা গিয়েছিলেন, তাকেও সেভাবেই মরতে হবে। যীশুর ঘাতকেরা যীশু্র মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে চায় নি। তাই ক্রুশবিদ্ধ করে  রোমান ঘাতকেরা তাঁর পা দুটো ভেঙে দেয় নি, যাতে শরীর ঝুলে গিয়ে দ্রুত মৃত্যু না হয়! ওর ঘাতেকেরাও ওর মাথার খুলিতে আঘাত না করে গোটা শরীর থেঁতলে দিয়েছে, যাতে একটু একটু করে শরীরের সব অঙ্গ প্রতঙ্গ বিকল হয়ে ওর  যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয়। এটা আসলে ওর বন্ধুদের প্রতি এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের ইংগিত দিয়ে রাখা! আরো অনেকক্ষণের  নৈঃশব্দ বেদনা ও আচ্ছন্নতার অনুভূতি। অবশেষে ভোরের সুর্য ওঠার মুখে তার সব অনুভূতি শূন্য থেকে শূন্যে ভেসে গেল!

ঘটনার তিনদিন পর সুশীতের বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা সবাই উপস্থিত। তার শহীদ হওয়ার খবর তার মা জানেন না, জানানো হয় নি। তাঁকে বলা হয়েছে রোগী পরিষেবার কারণে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে দিন কয়েকের জন্য সুশীত  কলকাতার বাইরে গেছে। কর্কট তার শেষ কামড় বসিয়েছে আজ। আজ তিনি ছটফট করছেন অন্তিম যন্ত্রণায়, শেষ স্পর্শ পেতে চাইছেন আত্মজর। ডাক্তারবাবু যাবার আাগে বলে গেলেন আর মাত্র কিছুক্ষণ সময়ের অপেক্ষা। তাঁর অন্ধকার  চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছে। ক্ষীণ কন্ঠে পুত্রের নাম নিচ্ছেন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। অসহায় সকলেই কাঁদছেন।  মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুরা। অন্তিমলগ্নে পুত্রের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হবেন উনি! এর জন্য কী তাঁরাই দায়ী!  ক্ষমতাহীন নিঃসম্বল অবস্থায় মানুষের সেবা করার দুঃসাহসি হওয়ার সিদ্ধান্তটা কী ভুল ছিল! এ সিদ্ধান্তটা তাঁরা সকলে মিলে নিয়েছি্লেন। তাই তাঁরা নিজেদেরকেও অপরাধী বলে মনে করতে লাগলেন। ওঁদের মনে হচ্ছিল ওঁরা  নিজেরই যেন এক একটা জুডাস। গোটা ঘরে নৈঃশব্দকে সঙ্গ দিচ্ছিলো সেই  বৃদ্ধার বুকের ওঠা নামার শব্দ আর ওঁদের মৌন কান্নার কম্পনধ্বনি।  হঠাৎই  ঘটনার সমাপতনে সকলে চমকে উঠল! 'মা, আমি সুশীত' বলে রজতাভ  সুশীতের মায়ের হাতদুটো ধরে নিজের মুখে বোলাতে লাগলো! এই অন্তিমদশার মধ্যেও মা ডাক শুনে  সেই বৃদ্ধার মুখে এক প্রশান্তির রেখা ফুটে উঠলো। তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন পুত্রকে কাছে পাওয়ার জন্য। যথাসম্ভব জোর দিয়ে  রজতাভর মাথাটিকে মাতৃস্নেহে নিজের বুকে লেপটে ধরলেন। মৃদু কাঁপা স্বরে যেন বললেন, "অক্সিজেন নিয়ে এলি? অক্সিজেনগুলো দিয়ে আসিস, বাবা!”  এরপর আরো কিছুটা সময় মাতা মেরির মতো আলিঙ্গনে 'পুত্রকে' আঁকড়ে রাখলেন তিনি, তারপর একসময় তাঁর বুকের  ধুকপুকানি থেমে গেল।

 


২টি মন্তব্য:

  1. ভয়ংকর সুন্দর একটি গল্প।
    অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন
  2. রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গল্পের গঠন চমকপ্রদ । ‌‌‌‌‌এক ক্ষয়হীন আশার অপমৃত্যু , আমাদের সচকিত করে। ভালো লাগলো ।আপনার গল্পের ধরন মর্যাদা আদায় করে নেবে এটা আত্মিক বিশ্বাস।
    রমাপদ কর

    উত্তরমুছুন