কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৬ |
মেঘদূত
বৃষ্টির সকালে ভিজে বাতাসে অনেক গল্প ভেসে আসে। তার কোনটা যে আবার হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো আর কোনটা কাগজে-কলমে ধরে রাখার, তা ঠিক করতে পারা যায় না। যেমন এইটা।
কলকাতার আকাশে ছেয়ে থাকা মিশকালো মেঘটা
যেন ভ্রু-কুঁচকে নিচে কিছু দেখছে। মেঘেরা এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না, তারা
দেশ-দেশান্তর সাগর-মহাসাগর-পর্বত-অরণ্য ঘুরে বেড়ায় যুগযুগ ধরে। এই কালোবরণ মেঘটি
আজ প্রায় দেড়-দুহাজার বছর পরে এই ভারত-দেশের ওপর এলো। সেবার যখন এসেছিল তখন কলকাতা
বলে কিছু ছিলই না। দেশটা ছিল কিন্তু ভারি বিচিত্র! বড় মন টেনেছিলো। পরিব্রাজক মেঘ নিচের মানুষগুলোর দিকে তাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে।
সুবর্ণা ছাতা খুলতে খুলতে আকাশের অবস্থা
দেখে বিরক্ত হয়ে বলল “উফ, বৃষ্টি আর ধরবে না! আজ আবার হাফ-ইয়ারলি শুরু হচ্ছে, না গেলেই নয়”। সুবর্ণা এম-এ পাশ করে
কদিন হল ইস্কুলে পড়াচ্ছে।
বাস থেকে নামল ময়দান-ঘেঁষা ফুটপাথে। পার্ক স্ট্রীট থেকে
মেট্রো ধরবে। আহা, ময়দানে দাঁড়ালে বর্ষার আসল ছবিটা দেখা যায়। চারিদিক সবুজ,
গাছেরা অসহায়ভাবে ভিজছে। আকাশে ঘন কালোমেঘ, অনেক গাড়ির হেড-লাইট জ্বলছে। ‘সকাল বেলার বাদল আঁধার’ একেই বলে!
এতক্ষণ তাড়াহুড়োর ভাব ছিল, কিন্তু এই মাঠ-ময়দান-শহর জোড়া বর্ষার মধ্যে দাঁড়াতেই
সুবর্ণার মনে একটা তীব্র খালিখালি ভাব যেন ছেয়ে এল। নির্ভয় এখন
কোথায়, কী করছে! নির্ভয়ের সঙ্গে বছর খানেকের চেনা। বেশ স্টেডি চলছিল, এমন সময় প্রোজেক্টের কাজে কোম্পানী ওকে
দুম করে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিল এক বছরের জন্য। হপ্তায় তিন-চারবার ফোনে কথা হয়। এই বর্ষার
মুহূর্তে
নির্ভয়কে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। খুব কাছে।
ফোন বার করল সুবর্ণা। ওদেশে ক’টা বাজে? ওদেশে এখন ভোরবেলা, নির্ভয় যা ঘুমকাতুরে,
নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে। তা হোক, হোয়াটস-অ্যাপে
লিখতে লাগল, এই তুই কী করছিস রে? জানিস এখানে সকাল থেকে বৃষ্টি, ঘন মেঘ করেছে, সবুজ মাঠে
দাঁড়িয়ে
আছি… যা দারুণ লাগছে ।।! তুই চলে আয় না রে, আর কতদিন নির্বাসনে রাখবে তোকে?
সুবর্ণাকে দেখে বোঝা যায় না ও ছাত্রী না
দিদিমণি। দুটো ছেলে যেতে যেতে বলল, “ভিজে ভিজে কাকে ফোন করা হচ্ছে, অ্যাঁ…”
আরেকজন বলল, “আওয়াজ দিস নে, একশ বারো মেরে দিলেই পুলিস-বাহিনী এসে যাবে হি হি…”
মেঘ কিন্তু সুবর্ণাকে এদের আগেই লক্ষ্য করছিল। মানুষগুলো এ যুগে কলকব্জা বানিয়েছে অনেক, রাস্তায়-ঘাটে এটা-সেটা মন্তব্য করে, তবু ভেতরে ভেতরে তো একই রয়ে গেছে। সেই কতবছর আগেও রাজার আদেশে দূর পাহাড়ে নির্বাসিত বিরহী যক্ষ ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ বর্ষা আসতে এরকমই উতলা হয়ে পড়েছিল। ফোন-হোয়াটসঅ্যাপ তো ছিল না, তাকে দিয়েই অলকাপুরীতে প্রিয়ার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলো। এখানে অবশ্য প্রিয়া বার্তা পাঠাচ্ছে। মেঘের মজা লাগছিলো, সে মুচকি হাসল।
রাস্তাঘাটের ব্যস্ত লোকজন সে হাসি ধরতে পারল না। মেঘ পাতলা হয়ে যাওয়াতে কয়েক পলের জন্য দু-একটা আলোর রশ্মি এসে আবার মিলিয়ে গেল, হয়েছে তো এই! এতে আবার দেখার কী আছে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন