সমকালীন ছোটগল্প |
জাফরানি
পান্নি ভাত রান্না করছে। গরম কাল। এক কামরার ঘর। শহরের রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই কলোনীর শুরু। সরকার থেকে বানিয়ে দিয়েছে, নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য।
আকাশে
মেঘ করে আছে। বৃষ্টি আসবে।
মা, তুমি জাফরান দেখেছো? কি রান্?
পান্নি চমকে উঠলো। মাথায় ঘুরছিল অনেক হিসেব। ঐ যে পোলাওতে দেয়, বিরিয়ানিতে দেয়, গন্ধ সুন্দর হয়, রঙ সুন্দর হয়! তুই কোথা থেকে জানলি? এই তো মা আমাদের বই-এ দিয়েছে। কাশ্মীরে সবচেয়ে বেশি জাফরান হয়। কাশ্মীরের আবহাওয়া জাফরান চাষের উপযুক্ত। জাফরান পোলাও, বিরিয়ানি, মিষ্টি প্রভৃতি খাবারে এবং ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
ও আচ্ছা। আমি কোথা থেকে জানবো বাবা? তুমি বড়ো হয়ে অনেক পড়াশোনা করে জাফরান দেখতে যেও।
দশবছরের ছেলেকে পান্নি বোঝালো। পাকু একটু চুপ করে থেকে বলল, মা একদিন পোলাও খাওয়াবে, জাফরান দিয়ে? পান্নি পাকুকে বলল, আচ্ছা বাবা, এখন ঘুমোও। আমি কাজের বাড়ির দিদির কাছ থেকে ভালো করে শিখে এসে তোমাকে রান্না করে খাওয়াব, তোমার জন্মদিনে।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা। মা স্কুল থেকে জেনে এলো পোলাও রাঁধতে হলে লম্বা সরু চাল লাগে, গন্ধ থাকে খুব, একে বলে দেরাদুন রাইস। আমাদের ক্লাসের রন্তু খেয়েছে, ওর বাবা তো বড়লোকদের ড্রাইভার, ওকে একদিন একটা নেমতন্ন বাড়ি থেকে এনে খাইয়েছে। পান্নি সবই ভুলে গিয়েছিল। আবছা মতো শুনে বলল আচ্ছা। শেষপর্যন্ত পাকুই পুরো লিস্ট তৈরি করে আনলো। এই বিষয়ে তার তৎপরতা ছিল দেখার মতো।
দেরাদুন রাইস। দুধ, ঘি, তেজপাতা, বড় এলাচ, ছোট এলাচ, শাহী জিরা, লবঙ্গ, জাফরান, গোলাপ জল, কাজুবাদাম, এমন্ড বাদাম, কিসমিস, দারচিনি, পেঁয়াজ, লবণ, চিনি। পাড়ার শিবু দোকানদার দিয়েছে, অনেক নেমতন্ন বাড়ির মাল সাপ্লাই করে তো, জানে ও। মা, তুমি আমার জন্মদিনে জাফরানি পোলাও খাওয়াবে তো? বলেছিলে কিন্তু! এই যে দেখো বইয়ে কী সুন্দর ছবি দিয়েছে। পান্নি উঁকি মেরে দেখল, কাচের প্লেটে ঝকঝক করছে সোনালি রঙের লম্বা লম্বা ভাত, হলুদ হলুদ রঙ মাঝে মাঝে, বাদাম টাদাম ছড়ানো।
জাফরান
কিন্তু থাকতেই হবে মা। জাফরানের গন্ধটাই পোলাও-এ আসল, পাকু বারবার বোঝাতে লাগল মাকে।
পাকুর জন্মদিন আরো একমাস পরে, সেদিন স্বাধীনতা দিবস। পান্নির মনে আছে, হাসপাতালে ভোরবেলায় পাকুর জন্মের পর, নার্স দিদিমণি বলেছিল, তোমার ছেলের জন্ম স্বাধীনতা দিবসের দিন হয়েছে গো, ওর নাম স্বাধীন রাখো। স্কুলের খাতায় পাকুর নাম, স্বাধীন।
পান্নি সাহস করে একদিন বাজারের বড়ো দোকানে গিয়ে জাফরানের খোঁজ করেছিল। সুতোর মতো কয়েকটি টুকরো দেখিয়ে দোকানদার বলল এর দাম দুশো টাকা। পান্নি আগামাথা কিছুই বুঝেনি। ফিরে এসেছে। পান্নি যেখানে বাসন মাজতে, ঘর মুছতে যায়, সেখানের বাচ্চা ছেলেটি এরকমই পোলাও খাচ্ছিল বোধহয়। ডিস ধুতে গিয়ে পান্নি পেলো প্রচুর কাজু বাদাম, ছেলেটি খায়নি, বেছে বেছে ফেলে দিয়েছে। পান্নি সবকটি কাজুবাদাম বেছে ধুয়ে বাড়ি নিয়ে এলো। কড়াইতে সেগুলো ভালো করে ভেজে লুকিয়ে রেখে দিল।
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন পাকু রাতের বেলা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা মনে আছে তো? পান্নি হেসে বলল, হ্যাঁ বাবা, মনে আছে।
কিন্তু
তুমি তো কিছুই কিনলে না?
কিনেছি
বাবা।
বিকেল
থেকে গুমোট করে ছিল। টিনের চালে সশব্দে বৃষ্টি
পড়া শুরু হলো। পাকু বৃষ্টির শব্দ শুনে শুনে,
জাফরানি পোলাও-এর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলা
জলভাত খেয়ে স্কুলে চলে গেলো পাকু। পান্নি ম্যাডামের
বাড়ি কাজ করতে । দুপুরে ফিরে এসে পোলাও রান্নার প্রস্তুতি।
পাকু স্কুল থেকে ফিরতেই পান্নি ওকে তাড়াতাড়ি একটু খাইয়ে খেলতে পাঠিয়ে দিল। কারণ পান্নিকে এখন বহুৎ জোড়াতালি দিতে হবে, যা পাকুর সামনে সম্ভব নয়। একটু ভালো চাল কিনে এনেছে বাজার থেকে, রেশনের চাল দিয়ে তো পোলাও হবে না, সামান্য কিসমিস, এলাচ, দারচিনি যা যা সম্ভব হয়েছে।ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করে এসেছিল, সেই অনুযায়ী আর নিজের বুদ্ধিমত পোলাও হল। নামানোর একটু আগে হলুদগোলা জল, আর অল্প ঘি কায়দা করে ছড়িয়ে দিলো। এই হতশ্রী ছোট ঘরটির পাশে পাকু একখানা গোলাপের ডাল লাগিয়ে ছিল। চরম রোদে শীর্ণ গাছটিতে একটি ভীষণ লাল গোলাপ ফুটেছে, তাকেই ছিঁড়তে হলো। সেই পাপড়ি ভেজানো জল আর কয়েকটি পাপড়ি দিয়ে সাজানো শেষ হতে না হতেই পাকু হাজির। দুটো ধবধবে সাদা মেলামাইনের প্লেট পান্নির বিয়েতে পাওয়া উপহার। যার সঙ্গে বিয়ে সে আজ না থাকলেও এই উপহারটি সযত্নে রাখা আছে। তাতেই সুন্দর করে পোলাও সাজিয়েছে পান্নি।
পাকু তো মুগ্ধ। শেষ বিকেলে মায়ে পোয়ে পোলাও খেতে বসল। পাকুর জন্মদিন। স্বাধীনতা দিবসের বিকেল।
পাকু খাচ্ছে আর একটার পর একটা প্রশ্ন করছে, মা কাশ্মীরে তো অনেক জাফরান হয়, কাশ্মীরের মানুষ প্রত্যেকদিন জাফরান দিয়ে পোলাও খায় তাই না, এই যে আজ যেমন খাচ্ছি আমরা? কী সুন্দর রেঁধেছো মা। যা স্বাদ হয়েছে না।
পান্নির
চোখের কোণ কেবলি জলে ভিজে উঠছে হলুদ ভাতের ধোঁয়ায়, পাকুর বকবকমে।
পরের বছর আবার স্বাধীনতা দিবস। আবার পাকুর জন্মদিন। নাহ্ এবার পাকু কারো কাছে আবদার করেনি জাফরানি পোলাও খাওয়ার জন্য। কারণ এ পৃথিবীতে একমাত্র আবদার করার মানুষটি আর পাকুর নেই। পাকু অনাথ হয়ে গেছে। দুদিনের প্রচন্ড জ্বরে পান্নি এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে। পাড়ার মুরুব্বিরা সাধ্য সাধনা করে একটি সরকারি অনাথ আশ্রমে পাকুর থাকার জায়গা করে দিয়েছে। সেখানে দুবার ভাত তরকারি দেয়, সামান্য টিফিন। কোনো বাচ্চার জন্মদিন পালন হয়-টয় না। তবে বছরে দুটো জন্মদিন পালন হয় সেখানে। কৃষ্ণ ঠাকুরের আর যীশু খ্রিষ্টের। একদিন পায়েস আর একদিন কেক খেতে পায় ছেলেরা।
পাকুর মাথা খুব পরিস্কার। সে বুঝে গেছে বড় তাকে হতেই হবে। অনেক বড়, অনেক টাকা। টাকা না থাকলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। তাই খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। যে স্কুলে আগে পড়ত সেখানেই পড়ছে। মাধ্যমিকেও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হলো একই স্কুলে। পাকুর ভাগ্য ভালো। তার চলার পথে অনেকের সাহায্য পেলো। দুরন্ত গতিতে, নিজের পরিশ্রম আর মেধার জোরে স্কলারশিপ অর্জন করে নিলো। একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হতে বেশি দেরী লাগলো না।
কোম্পানির হয়ে আজকাল বহু বিজনেস কিংবা পার্সোনাল পার্টিতে যেতে হয় তাকে। সেখানে জাফরানি পোলাও আর বিরিয়ানির ছড়াছড়ি। কিন্তু মিঃ স্বাধীন সেসব খেতে পারেন না। তিনি একটু সাদা ভাত খোঁজেন, অল্প ডাল, তরকারি। পাকু মনে করেছিল সে যখন বড় হবে, তখন অনেক জাফরানি পোলাও খাবে, কিন্তু আজকাল কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। জাফরান শব্দটি তার পুরো জীবন জুড়ে শুধু মরা হলুদ রঙ ছড়িয়ে দেয়।
এমনি এক পার্টিতে আলাপ হলো মেঘনার সঙ্গে। দারুণ ফর্সা, গোলাপি আভা বেরোয় এরকম একটি মেয়ে। সাদা সিল্কের শাড়ি পরে আরো দুজন মেয়ের সাথে গল্প করছিল।
পাকুর একটু দেখে মনে হলো একেই নক্ষত্র বলে, কাছে যেতে ইচ্ছে করে, যাওয়া যায় না। যেতে হলো না। সুন্দরী আশ্চর্যজনক ভাবে নিজেই পাকুর কাছে এলো। আলাপ পরিচয় হলো। সুবাসিত, সুহাস্যময়ী, কোমল, ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে।
আলাপ এগোতে লাগল। মেঘনা নিজেও একটি কোম্পানিতে চাকরি করছে। পাকুর কোন পরিবার নেই শুনে মেঘনা আরো বেশি কাছাকাছি এলো। ওকে নিয়ে গেলো ওদের বাংলোতে। মেঘনার মা বাবার সঙ্গে আলাপ পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা। এবং শেষপর্যন্ত বিবাহ প্রস্তাব, মেঘনার সম্মতিতে।
বহুবছর পর আজ পাকুর জন্মদিন পালন করা হবে। কাশ্মীরে। বিয়ের পর কাশ্মীর বেড়াতে এসেছে মেঘনার সঙ্গে। মেঘনা সারপ্রাইজ দেবে পাকুকে। পাকুর মাথায় এসব কিছুই নেই। অপরূপ কাশ্মীর। প্রিয় এক নারী সঙ্গে। একান্ত নিজের। ছবির মতো বাংলো হোটেল। স্বপ্নের মতো লাগছে সব। এতো সুন্দর হয়ে গেলো জীবন। আশ্চর্য!
দূরে হিমালয়ের সাগরকেশ, মধ্যাহ্নের সূর্যের ফিকে আলো। মেঘনা বলল, আজ সন্ধ্যায় একটি স্পেশাল ডিনার আছে, শুধু তোমার আর আমার।
পাকু বলল সবকটা ডিনারই তো আমার আর তোমার হচ্ছে, তাহলে আর স্পেশাল কেন! নাহ্ এটা একটু বেশিই স্পেশাল, মেঘনা বলল। ঝর্ণার মতো হাসি।
সন্ধ্যের সময় পাকু তো অবাক। বাংলোর একটি হল বিশেষ করে সাজানো হয়েছে শুধু ওর জন্মদিন উপলক্ষেই। সব মেঘনার প্ল্যান। আমরা যখন ডিনারে বসবো তখন পাশে কেউ থাকবে না, অনেক দূর থেকে দেখবে পাহাড়, পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা নির্জন অন্ধকার আর কুয়াশা, মেঘনার চোখে স্বপ্নেরা ভিড় করে আসছে তুষারপাতের মতো।
হোটেলের
বয় এসে টেবিলে ডিনারের আইটেমগুলো সব সাজিয়ে গেলো।
সবাই চলে গেলে মেঘনা আস্তে আস্তে বলছে, জানো আমার প্রিয় খাবার কি? জাফরানি পোলাও। আমি খুব পারফেকশনে বিশ্বাস করি। সেরকমই পোলাও হয়েছে আজ এখানে। তিলমাত্র এদিক ওদিক নেই।
হাঁড়িতে পরিমান মত শুদ্ধ ঘি, গরম হলে শাহি জিরা, তিন সেকেন্ড পর তেজপাতা, কালো হওয়ার ঠিক আগেই বড় এলাচ দু তিনটি, দারচিনি কয়েক টুকরো, দু দানা লবঙ্গ, আগে থেকে জল ঝরিয়ে রাখা দেরাদুন রাইস, স্বাদমত নুন, চিনি ঠিক ততটুকুই যাতে চিনির স্বাদ না উঠে আসে, হালকা ভাজা কিসমিস, কাজু, এমন্ড, ছোট এলাচ, একটুখানি কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, ঝাল নয়, সোনালি সৌন্দর্য হয়ে ভাসবে সদ্য ফোটা চালের গায়ে গায়ে, সামান্য টক দই আর মাপমত জল। হাঁড়ির মুখ বন্ধ, ঠিক কুড়ি মিনিট ঢাকনা খুলে দুধে ভিজিয়ে রাখা বেশ অনেকটা জাফরানের মিশ্রণ আর গোল লেবুর টুকরো দিয়ে পাঁচমিনিট ঢেকে রাখা, নামানোর পর গোলাপ জল, বেদানার রক্তিম দানা। সঙ্গে দম পনির।
তার
সঙ্গে যাকে খেতে দেবো তার জন্য সমস্ত ভালোবাসা, তবেই না জাফরানি পোলাও, কী বলো স্বাধীন?
মেঘনা
বলেই যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছো কি তুমি? এখান থেকে
ঠিক পনের কিলোমিটার দূরের জাফরান ক্ষেত থেকে
ফুল ফোটার আশ্চর্য শব্দ।
পাকু
অথবা স্বাধীন তখন কিছুই শুনছে না। তার চোখ বিস্ফারিত।
জাফরান ফুল পরাগমিলন জানে না। তিনটি কেশর তার উন্মুক্ত। লকলক করতে থাকে। অসহনীয় সুন্দর সে, দামি গন্ধ। সারা জীবন সে শুধু এই জাফরান থেকে পালিয়ে বেরিয়েছে।
হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলো পাকু, হেঁচকা টান দিয়ে মেঘনার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলো, ভিজে ভিজে রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে পাকু বলছে, চলো কোথাও রুটির দোকান খুঁজি, একটু ঘন চা, ঝাল কোনো তরকারি, পারবে না খেতে মেঘনা?
মেঘনা হতভম্ব।
পাকু চিৎকার করে বলল, জানো আমাকে যারা পোলাও খাওয়ায় তারা বাঁচে না। জাফরান ভালো না, জাফরান বিচ্ছেদ দেয় শুধু... আর তখনই কেন যেন সামান্য দূরেই হাজার হাজার বেগুনি ফুলের ক্ষেত নত হয়ে এই অপবাদ গায়ে মাখতে মাখতে কেশর ছড়িয়ে দিচ্ছে রাতের অন্ধকারে।
হৃদয়স্পর্শী লেখা ,পড়ে মনটা এক মন খারাপের দেশে পাড়ি দিলো ! অপূর্ব লেখনী !
উত্তরমুছুন