শুক্রবার, ১৪ মে, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৯০


একটা অদ্ভুত পৃথিবীতে আমরা এখন বসবাস করছি। বাস করতে বাধ্য হচ্ছি। এর আগেও এই একই পৃথিবীতে আমরা বসবাস করতাম। তখনও খুব একটা ভালো ছিলাম না কেউ। অনেক অনেক সমস্যা, অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন এবং সেইসঙ্গে মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, অনাস্থা, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বার্থপরতা, হিংসা সব কিছুই ছিল। অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখা হতো সর্বদা। জীবনের নিরাপত্তা তখনও ছিল না। কিন্তু সেই পৃথিবী বদলে গিয়ে এমন একটা অনিশ্চয়তার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, আমরা চরম অসহায় বোধ করছি। বুঝে উঠতে পারছি না, কীভাবে এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করব, কীভাবে এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাব। বিশেষত এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই, যা অদৃশ্য আমাদের কাছে। আমাদের চারপাশেই তারা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না বলে অনেক  ক্ষেত্রেই সংক্রমণের শিকার হচ্ছি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, একই সঙ্গে গোটা পৃথিবীর মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে এই সাংঘাতিক ভাইরাসের আওতায় এসে। প্রতিদিন খবর আসছে কত কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, কত কত মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, কত কত মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি একটি নিউজ পোর্টালে আমার একটি লেখা ‘গণতন্ত্র ও আমরা’ প্রকাশিত হয়েছে। সেই লেখাতেও আমি আমাদের দেশে যারা এই দুঃসময়েও নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখার জন্য সাধারণ মানুষেকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। এখানে লেখাটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি – “সারা পৃথিবী জুড়ে এখনও চলেছে করোনা ভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ। অসংখ্য মানুষের প্রতিদিন মৃত্যু ঘটে চলেছে সেই সংক্রমণে। অসহায় মানুষ নিজেদের বাঁচানোর যাবতীয় সাবধানতা অবলম্বন করেও বেঁচে থাকতে পারছে না। একে একে তাদের অনেককেই সামিল হতে হচ্ছে সেই মৃত্যুমিছিলে। কেউ কেউ বলে থাকে, সাধারণ মানুষেরা ততটা সচেতন ও সাবধানী নয়, তাই একদিকে যেমন মাস্ক সবসময় ব্যবহার করছে না, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, কথাটার মধ্যে আংশিক সত্যতা আছে। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও উল্লেখ করা দরকার, সম্প্রতি গণতন্ত্র রক্ষার নামে বিভিন্ন রাজ্যে যে ভোট উতসবের আয়োজন করা হয়েছিল, তা কি পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের সেই সচেতনতা ও সাবধানতা থেকে বিচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট নয়? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রচারে, মিছিলে, জনসভায় যেভাবে সাধারণ মানুষকে সামিল করে তাদের সাংঘাতিক বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য দায়ী কারা? অবশ্যই দায়ী সব রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতা দখলের মত্ততায় মানুষকে মারাত্মক সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিতে পারে। মাদ্রাজ হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস আঙুল তুলেছেন নির্বাচন কমিশনের দিকে। কেন তারা এই ভোটকে কেন্দ্র করে মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল! নির্বাচন কমিশন অবশ্য তাদের দায় ঝেড়ে ফেলেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলে মানুষের মৃত্যুকে কখনও রোধ করা যায় না। আর মানুষই যদি জীবিত ও সুরক্ষিত না থাকে, তবে কিসের নির্বাচন আর কিসের গণতন্ত্র?”

ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, অনেক অনেক প্রিয়জনের মুখ মনে পড়ে যাচ্ছে, যাদের মুখ আর কোনোদিন দেখতে পারব না। তাঁরা আর কোনোদিন কথা বলবেন না, লিখবেন না, নতুন কিছু সৃষ্টি করবেন না। যেমন ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকা এবং ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের জন্য কখনই আর লেখা পাঠাবেন না আমার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক অশোক তাঁতী। শুধু তাই নয়, অশোক চলে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যের কতটা ক্ষতি হলো, যাঁরা তাঁর লেখা পড়েছেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে আমাদের ছেড়ে অকালে চলে গেছেন সেই দেশে, যে দেশ থেকে আর ফিরে আসা যায় না। অশোকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। 

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


পায়েল মণ্ডল

 

জয়েস, সাংবাদিকতা, ইউলিসিসের এওলাস কাণ্ডে দ্যা ফ্রীম্যান জার্নাল…




১৯৬০ সালে আয়ারল্যান্ডের বরেণ্য সাংবাদিক পিয়ারাস বেইসলি দ্যা আইরিশ ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছাপেন। প্রতিবেদনটিতে তিনি স্মরণ করেন শতাব্দীর অন্যতম আইরিশ এক্সপেরিমেন্টাল লিখিয়ে জেমস জয়েসের সাথে তাঁর প্রথম দেখা হবার ঘটনা। তিনি প্রতিবেদনটিতে ১৯০৯ সালে জয়েসের ফ্রীম্যান জার্নাল অফিসে কিছু সময় কাটানোর স্মৃতিকথাও তুলে ধরেন। ১৯০৯ সালে পিয়ারাস বেইসলি কাজ করতেন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ড্রামা ক্রিটিকের পদে। ইভিনিং টেলিগ্রাফ ছিল ফ্রীম্যান জার্নালের সান্ধ্যকালীন পত্রিকা। ১৯০৯ সালের আগস্টে জর্জ বার্নার্ড শ-এর নাটক The Shewing-Up of Blanco Posnet এর  প্রিমিয়াম শো  চলছিল ডাবলিনের এ্যাবি থিয়েটারে। ইভিনিং টেলিগ্রাফের ড্রামা ক্রিটিক হিসেবে পিয়ারাস উপস্থিত ছিলেন সেই শো-তে।

সেই সময়ে ডাবলিনে অবস্থানরত জয়েস ভাবেন Piccolo della Sera পত্রিকায় বার্ণাড শ-এর The Shewing-Up of Blanco Posnet  নাটকের প্রিমিয়াম শো-এর উপর একটি আর্টিকেল লেখা যেতে পারে। ইংল্যান্ডে নাটকটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। লেডি গ্রেগোরি এবং ইয়েটস নাটকটির কারিগরি দিকের আইনের ফাঁককে কাজে লাগিয়ে আয়ারল্যান্ডে মঞ্চস্থ করার আয়োজন করেন। তাঁরা ভাইসরয়ের দেয়া নিষেধাজ্ঞাকে আইনি পথে মোকাবেলা করেন। জয়েস ট্রিয়েস্টে অবস্থানরত ভাই স্টানিসলাসকে লিখে অনুরোধ করেন ট্রিয়েস্টের পিকোলো ডেলা পত্রিকার সম্পাদক প্রেজিওসোর সাথে এই আর্টিকেলের ব্যাপারে কথা বলার জন্য।  জয়েস আরো লেখেন প্রজিওসোকে অনুরোধ করার জন্য তিনি যেন  জয়েসের নামে পিকোলো পত্রিকার  ডাবলিন করসপনন্ডেন্ট হিসেবে একটা পাশ ইস্যু করেন। তিনি এই পাশ ব্যবহার করে এ্যাবিতে শ’এর নাটক কভার করবেন। প্রেজিওসো জয়েসের অনুরোধ রাখেন, প্রেস কার্ড  ইস্যু করে এক্সপ্রেস ডাক যোগে পাঠিয়ে দেন ডাবলিনে। প্রেসকার্ড হাতে পেয়ে জয়েস নিজের নামে পিকোলো ডেলার ডাবলিন করসপনন্ডেন্ট পদে ভিজিটিং কার্ডও ছাপিয়ে নেন। এইভাবে জয়েস পুরো মাত্রায় পিকোলোর ডেলার ডাবলিন করসপনন্ডেন্ট বনে যান। পরে এই কার্ড ব্যবহার করে জয়েস মিডল্যান্ড রেলওয়ে তাঁর নামে বিনা পয়সায় গ্যালওয়েতে যাতায়াতের জন্য ফ্রী পাশ ইস্যু করেন। মিডল্যান্ড রেলওয়ে কতৃপক্ষ ভেবেছিল জয়েস হয়তো ইতালিয়ান পত্রিকায় গ্যালওয়ের উপর প্রতিবেদন লিখবেন।

আগস্ট ২৫ তারিখ সন্ধেয় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ব্রিটিশ সেন্সরশীপকে আক্রমণ করে জয়েস আর্টিকেল লেখেন। বার্ণার্ড শ-কে আক্রমণ করে বলেন  তিনি একজন  'a  born preacher'  আধুনিক নাটক লিখতে ব্যর্থ হয়েছেন। জয়েস অভিনয়ের প্রশংসা করেন। ইন্টারভেলের সময় ইউজেন সিহির সাথে দেখা হয়ে যায়। সিহিকে জয়েস রহস্য করে বলেন –'There will be interesting news about me in a few weeks.' জয়েস সম্ভবত ডাবলিনের প্রকাশনা নিয়ে চমক দিতে চাইছিলেন সিহিকে। নাটক শেষ হলে অন্যান্য সাংবাদিকের সাথে মত বিনিময় করার সময় বলেন পিকোলো পত্রিকা তাঁকে বার্ণার্ড শ-এর নাটক কভার করার জন্য পাঠিয়েছে। সেই  সময় অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে পিয়ারাস বেইসলির সাথেও জয়েসের আলাপ হয়। পিয়ারাস জয়েসকে ফ্রীম্যান জার্নাল অফিসে আসবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পরদিন জয়েস হাজির হন ফ্রীম্যান জার্নাল অফিসে। পিয়ারাসের স্মৃতিচারণে জয়েসের ফ্রীম্যান জার্নাল অফিস ভিজিটের বৃত্তান্ত এমন-

‘পরের দিন জয়েস আমাদের অফিসে এলেন। ইনভিং টেলিগ্রাফের সম্পাদক প্যাট মিডের সাথে তাঁর পরিচয় আগে থেকেই ছিল। আমার কলিগদের কাছে জয়েস নিজের পরিচয় দেন ট্রিয়েস্টের পকোলো ডেলার সাংবাদিক হিসেবে। দীর্ঘ সময় তিনি আমাদের পত্রিকা অফিসে সময় কাটান আড্ডা দিয়ে। আর সেই সময়েই তিনি শতাব্দীর অন্যতম উপন্যাসের গুরুত্ত্বপূর্ণ এপিসোডের রসদ যোগাড় করে ফেলেন। এপিসোডটির নাম ‘এওলাস!’ এটা অনস্বীকার্য যে জয়েস ১৯০৯ সালের ফ্রীম্যান জার্নাল অফিসের চিত্র ইউলিসিসে আঁকেননি বরং এঁকেছেন ১৯০৪ সালের ফ্রীম্যান জার্নাল অফিসের দৃশ্য। এই সময়টিতে পত্রিকাটি ছিল ডাবলিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা এবং সার্কুলেশনও ছিল আকাশচুম্বী। তবে তিনি পত্রিকাটির পতনের ইঙ্গিত দেন এওলাস এপিসোডে যেমনটা তিনি প্রত্যক্ষ করেন ১৯০৯ সালে। আর তাই ইউলিসিসের এওলাস এপিসোডে সম্পাদক ডাবলু এইচ ব্রেইডেনের মুখে ধরিয়ে দেন এই সংলাপ- ‘But can he save the circulation?’



ফ্রীম্যান পত্রিকা ১৯২৪ সালে বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু পত্রিকাটির ভাগ্য ১৯০৯ সালেই নির্ধারিত হয়। জয়েস পত্রিকাটির এই পরিণতির কথা যেন আগেই জানতে পারেন। কিন্তু ইউলিসিসের বর্ণিত গল্পের সালে (১৯০৪ সাল) ফ্রীম্যান পত্রিকার প্রভাবকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার জন্যই হয়তো জয়েস ১৯০৯ সাল থেকে অতীতে ফিরে যান। আর তাই এওলাস এপিসোডটির শুরুর বাক্যটি খুব অপ্টিমিস্টিক শোনায়। তিনি এপিসোডটি শুরু করেন- ‘In the heart of the Hibernian metropolis’ এই শব্দমালা দিয়ে। এপিসোডটিতে জয়েস ফ্রীম্যান জার্নালকে আখ্যা দেন- ‘a great daily organ’ বলে। ১৯০৪ সালের প্রেক্ষাপটে,  যে সালে ইউলিসিসের কাহিনি বর্ণিত হয়, নিঃসন্দেহে জয়েসের এই ফ্রেজ ফ্রীম্যান জার্নালকে ডাবলিনের প্রভাবশালী পত্রিকা হিসেবে পাঠকের চোখে তুলে ধরতেই বলেন। ১৭৬৩ সালে পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশের পর থেকে ১৯০৪ সাল অবধি দীর্ঘ ১৪১ বছর দাপটের সাথে পত্রিকাটি ডাবলিনে সংবাদপত্র জগতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে এসেছে। পত্রিকাটি শুধু আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন পত্রিকা নয় বরং সেটা গোটা গ্রেট ব্রিটেনের প্রাচীনতম পত্রিকা। ১৮০০ সালের এ্যাক্ট অফ ইউনিয়ন চুক্তির আগে পত্রিকাটি আইরিশ প্যাট্রিয়টিকদের স্বপক্ষে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে এসেছে বিশেষ করে চার্লস লুকাস, হেনরি গ্রাটন এবং  হেনরি ফ্লাড, যাদের প্রসঙ্গে জয়েস ইউলিসিসের এওলাস এপিসোডে ইঙ্গিত দেন।

১৭৮০ সালে ফ্রান্সিস হিগিন্স পত্রিকাটির এডিটোরিয়াল বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করেন। এওলাস এপিসোডে  জয়েস হিগিন্সকে ‘sham squire’ বলে আখ্যা দেন। ইউলিসিসের ‘ওয়ান্ডারিং রক’ এপিসোডেও জয়েস হিগিন্সকে উল্লেখ করেন ‘That ruffian, the sham squire, with his violet gloves’ বলে।  ১৮০২ সালে হিগিন্স মৃত্যুবরণ করলে পত্রিকাটি বিভিন্ন বারবার মালিকানা বদল হয় এবং সরকারী প্রভাব থেকে মুক্ত হয়। ১৮৪১ সালে স্যার জন গ্রে পত্রিকাটির কিনে নেন। এর পরের অর্ধ শতাব্দী ফ্রীম্যানের মালিকানা জন গ্রে পরিবারের অধীনে থাকে। ইউলিসিসের এওলাস এপিসোডের শেষে জয়েস ও কনেল ষ্ট্রীটে জন গ্রের মূর্তির রেফারেন্স দেন। ১৮৭৫ সালে জন গ্রের পুত্র ডয়ার গ্রে ফ্রীম্যানের মালিকানা গ্রহণ করেন। জয়েস এওলাস এপিসোডে ডয়ার গ্রের কড়া সমালোচনা করেন। এওলাস এপিসোডে একটি চরিত্র গ্রেস ডয়ারকে সমালোচনা করে মন্তব্য করে- ‘none of the Grays was any good!’

গ্রে পরিবারের হাত ধরেই ফ্রীমম্যান জার্নাল ডাবলিনের প্রথম সারির পত্রিকায় উন্নীত হয়। জন গ্রের সময়ে পত্রিকাটির সার্কুলেসন ছিল প্রতিদিন ১০০০০ কপি, পুত্র এডমন্ড ডয়ারের সময়ে পত্রিকাটির দৈনিক সার্কুলেসন দাঁড়ায় ৩০০০০ কপিতে। সেই সময়ে ফ্রীম্যানের মার্কেট শেয়ার ছিল প্রায় ৪০%। এমন রমরমা সময়ে এডমন্ড ডায়ার ফ্রীম্যানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে পরিনত করেন। ১৮৮৮ সালে ডয়ার মারা গেলে তাঁর বিধবা স্ত্রী ক্যারোলিন এঞ্জেস গ্রে পরবর্তি চার বছরের জন্য ফ্রীম্যান পত্রিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।  এঞ্জেস ছিলেন ইংরেজ ফিলথ্রপিস্ট ক্যারোলিন চেইসহোমের কন্যা। ক্যারোলিন চেইসহোম অস্ট্রেলিয়ায় মহিলা ইমিগ্রান্টদের ওয়েলফেয়ারের কাজ করার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চার্লস ডিকেন্সের  উপন্যাস Bleak House-এর মিসেস জেলিবাই ক্যারোলিন চেইসহোমের চরিত্রের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত।  মিসেস এঞ্জেস ছিলেন  আইরিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেলের একনিষ্ঠ ভক্ত। ১৮৯০ সালে ও’সেহা ডিভোর্স কেসে যখন পার্নেলকে ও’সেহার সাথে পরকীয়ার দায়ে পার্টি থেকে বহিস্কার করা হয় ফ্রীম্যান জার্নাল পার্নেলের পক্ষ অবলম্বন করে। এই সময়ে পার্নেল বিরোধী শিবির ন্যাশনাল প্রেস নামের পত্রিকা বের করলে ফ্রীম্যান জার্নালের আধিপত্যে ধ্বস নামতে থাকে। সার্কুলেশন কমে গেলে মিস গ্রে পার্নেলের পক্ষ ত্যাগ  করেন। ১৮৯১ সালে মিস গ্রে আনুষ্ঠানিক ভাবে পার্নেল শিবির ত্যাগ করার ঘোষনা দেন। ১৮৯২ সালে মিস গ্রে ফ্রীম্যানের মালিকানা প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল প্রেসের কাছে বিক্রি কতে দেন। ইউলিসিসের এওলাস এপিসোডে দেখা যায় ফ্রীম্যান পত্রিকা অফিসের গেটের সামনে নিউজ বোর্ডে ফ্রীম্যান এবং ন্যাশনাল প্রেসের পত্রিকার নিউজবোর্ড।

ফ্রীম্যান পত্রিকা পার্নেলের পক্ষ ত্যাগ করলে পার্নেলাইটসরা তাদের পক্ষে নতুন একটি পত্রিকা বের করেন যেটার নাম ছিল- Irish Daily Independent! ১৯০০ সালে ন্যাশনালিস্ট পার্টির দুটি পক্ষ এক হয়ে গেলে ফ্রীম্যান পত্রিকা এক হয়ে যাওয়া ন্যাশনালিস্ট পার্টির অংশ হয়ে যায় এবং Irish Daily Independent পত্রিকাটি বিক্রি হয়ে যায়। ডাবলিনের এক ব্যবসায়ী উইলিয়াম মার্টিন মার্ফি Irish Daily Independent কিনে নেন।  ১৯০৫ সালে মার্ফি Irish Daily Independent-কে আধুনিকায়ন করে প্রতি কপির বিনিময় মূল্য ধার্য করেন অর্ধ পেনি যেটা ছিল ফ্রীম্যান পত্রিকার বিনিময় মূল্যের আর্ধেক। মার্ফি লর্ড নর্থক্লিফের (আলফ্রেড হার্মসওয়ার্থ)  পথ অনুসরন করেছিলেন। লর্ড নর্থক্লিফ ১৮৯৬ সালে তাঁর নতুন পত্রিকা Daily Mail এর মূল্য ধার্য করেছিলেন অর্ধ পেনি। জয়েস লর্ড নর্থক্লিফকে এওলাস এপিসোডে আক্রমণ করে লিখেছেন- ‘Harmsworth of the farthing press’.

মার্ফির পত্রিকা Irish Daily Independent ডাবলিনের পত্রিকা জগতের শীর্ষে উঠে আসতে বেশি সময় নেয় না। এর প্রধান কারণ ছিল ফ্রীম্যান পত্রিকার ক্রমপতন। ১৯০৮ সালে পত্রিকাটি (ফ্রীম্যান) শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ট দিতে ব্যর্থ হয়। ইউলিসিসের গল্পের সময়কাল ১৯০৪ সাল থেকে ১৯০৯ সালে মাঝে এই সময়ে ফ্রীম্যান জার্নালের এমন ভাবেই পতন হয়। পত্রিকাটি কখনোই আধুনিকায়নে মনোনিবেশ করেনি। তারা পুরোনো ধ্যান ধারণাকে আঁকড়ে ধরে ছিল আর এর পরিণতিতে সামনের সময়ের সাথে নিজেদেরকে সম্পর্কিত করতে পারেনি।  ফ্রীম্যান জার্নালে কর্মরত সাংবাদিক কর্মচারীদের মানসিকতারও আধুনিকায়ন হয়নি। যারা ঐ সময় পত্রিকা অফিসে আড্ডা দিতেন তারা যেন আধুনিক জগত থেকে একে বারে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। উপন্যাস এওলাস এপিসোডে জয়েস নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেন সাংবাদিকদের অন্তসারশূন্যতা। জয়েস স্পেশালিস্ট মিস্টার টের‍্যান্স কিলিন, যিনি নিজেই একজন সাংবাদিক ছিলেন, বলেন-

‘এওলাস এপিসোড এমন ধারণা দেয় যে এপিসোডটিতে বর্ণিত চরিত্রগুলো যেন বাহিরের জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তারা যেন একটি বৃত্তে বন্দি এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে অক্ষম। তারা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা বুঝতে অক্ষম। তাদের কাছে জনতার মতামতের কোনই মূল্য নেই। আড্ডায় উপস্থিত সাংবাদিকরা অতীতের বিখ্যাত আইনজীবী যেমন জন ফিলিপ ক্যারেন, আইজাক বাট, এবং ও হ্যাগান প্রমুখদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাংবাদিকতার সাথে আইনকে সম্পর্কিত করেন জয়েস। অনেক আইরিশ সাংবাদিক আইনি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন।‘  

১৯০৯ সালের ফ্রীম্যান জার্নাল অফিসে দেখা ব্যাক্তিদের নাম বদলে এওলাস এপিসোডে সেই চরিত্রদের এডোপ্ট করেন জয়েস। ইনভিনিং টেলিগ্রাফের সম্পাদক প্যাট মিডের আদলে নির্মিত চরিত্র হলো মাইলস ক্রাফোর্ড। মিড ক্রাফোর্ড ১৯০৯ সালে পত্রিকাটির এডিটরের দায়িত্ব পালন করেন ১৯০৪ সালে নয়। অর্থাৎ জয়েস যে সালে ফ্রীম্যান জার্নালের অফিস ভিজিট করেছিলেন সেই বছরে মিড ইভিনিং টেলগ্রাফের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়াও এওলাস এপিসোডের অন্য চরিত্র যেমন জন ওয়েইস পাওয়ারকে নির্মাণ করেন  ফ্রীম্যানের প্রাক্তন স্টাফ এবং পরে ইভিনিং হেরাল্ডের সম্পাদক জন ওয়েস নোলানের ছায়া অবলম্বনে। প্রফেসর ম্যাকহাফ হলেন হুগো ম্যাক নেইল এওলাস এপিসোডে যাকে জার্নালিস্ট হিসেবে চিত্রিত না করে তথাকথিত স্কলার হিসেবে চিত্রায়ন করেন। কেইলিন এই চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করে- ‘A somewhat under-achieving classical scholar!’  এওলাস এপিসোডের কিছু চরিত্রদের নাম বদল করেননি জয়েস, যেমন ডাবলু এইচ ব্রেইডেন যিনি ১৮৯২ সাল থেকে ১৯১৬ সাল অবধি ফ্রীম্যানের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।  ব্রেইডেনের হাঁটাচলায় একধরণের রাজকীয়তা ছিল। ব্লুমের চোখে ব্রেইডেন ছিল ‘fat folds of neck!‘  তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে সাইমন ডেডেলাস ভাবে- ‘all his brains are in the nape of his neck!’ ব্রেইডেনের পরের ফ্রীম্যানের সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্যাট্রিক হুপার। জয়েস এই চরিত্রকেও স্বনামে এওলাস এপিসোডে এডোপ্ট করেন। ১৯০৯ সালে তিনি  ছিলেন সহকারী লন্ডন করস্পন্ডেন্ট। পাট্রিক এর  বাবা অল্ডারম্যান জন হুপারও ছিলেন ইভিনিং টেলিগ্রাফ পত্রিকার সম্পাদক। ইউলিসিসে ইঙ্গিত দেয়া হয় অল্ডার হুপার মলি ব্লুমের অসংখ্য সন্দেহভাজন প্রাক্তন প্রেমিকের একজন।  আরো দুজনকে  জয়েস স্বনামে এওলাস এপিসোডে এডোপ্ট করেন- মাস্টার প্রিন্টার জোসেপ ন্যানেতি এবং তার পুত্রকে। জয়েস ইচ্ছে করেই এই দুই চরিত্রকে মিলিয়ে ফেলেন। সিনিয়র ন্যানেতি ফ্রীম্যানের মাস্টার প্রিন্টারের চাকুরী ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং নিজেকে আয়ারল্যান্ডের অন্যতম রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।  তিনি ১৮৯৮ সালে ডাবলিন সিটি কাউন্সিলরের পদে এবং ১৯০০ সালে মেম্বার অফ পার্লামেণ্টের পদে নির্বাচিত হন। সুতরাং এটা ভেবে নেয়া যায় যে প্রটাগনিস্ট ব্লুম তার এ্যাডভার্টাইজিং ক্লায়েন্ট আলেকজান্ডার কায়েসের এ্যাড ফোরম্যান প্রিন্টার সিনিয়র ন্যানেতির কাছে পেশ করেনি যদিও ব্লুম তাকে ‘councillor‘ বলে সম্বোধন করে। জুনিয়র ন্যানেতি কখনো ডাবলিনের কাউন্সিলরের পদে নির্বাচিত হননি। ব্লুম ভাবে কাইন্সিলর বলে সম্বোধন করা ভুল হয়েছে আর তাই সে ভাবে- ‘Soon be calling him my lord mayor!’ জয়েস সময়ের ধন্ধে ফেলে দেন পাঠকদের। ১৯০৯ সালে যখন জয়েস ফ্রীম্যান জার্নালের অফিসে আড্ডা দিতে আসেন সেই সালে সিনিয়র ন্যানেতি লর্ড মেয়রের পদের সময় কাল পূর্ণ করেন। এওলাস এপিসোড হলো জয়েসের কল্পনা এবং বাস্তবতার অসাধারণ মেলন্ধন।



মহাকাব্য অডেসির চরিত্র এওলাসের নামে ইউলিসিসের এপিসোড সাতেরর নামকরণ করেন জয়েস। এওলাস ছিলেন এওলিয়া দ্বীপের রাজা যার নিয়ন্ত্রণে ছিলো ঝড়ো বায়ু। মহাকাব্যে অডিসিতে এওলাস দিকহারা ওদেসিয়াসকে বায়ু ভর্তি এক ব্যাগ উপহার দেন যে বায়ু ওডেসিয়াসের পাল তোলা জাহাজে গুলোকে বায়ু চালিত করে দেশে ফিরতে সাহায্য করবে। অডিসিতে যদিও এওলাস একজন মর্তের মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হয় কিন্তু গ্রীক মিথে তাঁকে দেবতা জ্ঞান করা হয়। ওডেসিয়াস ট্রয় যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার সময় সমুদ্রে দিকহারা হয়ে তার যোদ্ধা ও নাবিকদের নিয়ে এওলিয়া দ্বীপে এসে হাজির হয়। দ্বীপটির বায়ু শাসক রাজা এওলিয়ার আতিথ্য গ্রহণ করে তারা। প্রায় একমাস সেই দ্বীপে অবস্থানের পরে ওডেসিয়াস ও তার যোদ্ধা ও নাবিকদের নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করার সময় রাজা এওলিয়াস ওডেসিসাসকে বাতাস ভর্তি একটা ব্যাগ উপহার দেন যেন ওডেসিয়াসের কোন জাহাজ ঝড়ের কবলে না পড়ে।

ওডেসিয়াস এবং তার নাবিকেরা নিরাপদে সমুদ্র যাত্রা করে স্বদেশ ইথাকার তটভূমির কাছে চলে আসে। নাবিকেরা যখন ইথাকার তটরেখা দেখতে পায় ওডেসিয়াস ছিলেন গভীর ঘুমে। এওলিয়াসের উপহার দেয়ে ব্যাগটা ওডেসিয়াসের পাশে রাখা ছিল। নাবিকেরা দেশের কাছাকাছি আসতে পারায় খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলো। ওডেসিয়াসের পাশে রাখা থলেটা দেখে নাবিকদের মনে ইচ্ছে জাগে সেটা খুলে দেখতে যে ভেতরে কি আছে। তারা থলেটা খুলতেই মুহূর্তেই ঝড়ো বাতাসে সবকটি জাহাজকে আবারো ওরেলিয়াস দ্বীপে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ওডেসিয়াসের জাহাজ দ্বীপে ফিরে এলে এওলাস তাদের পুনরায় সাহায্য করতে অস্বীকার করেন। এওলাস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে নিয়তি তাদের দেশে ফেরার পথে বাধা দিয়েছে যার অর্থ হলো ঈশ্বর চান না তারা এখনই দেশে ফিরে যাক। আর তাই এওলাস তাদের পুনরায় সাহায্য করতে পারে না কারণ এতে ঈশ্বর বিমুখ হবেন।

জয়েস ইউলিসিসের এপিসোড সাতে ওডেসির এওলাস কাণ্ডকে এডোপ্ট করেন। থলে ভর্তি বাতাসের প্রতীকী উপস্থাপনায় এই এপিসোড এগিয়ে যায়। থলেবন্দি বাতাসকে জয়েস সাংবাদিকতা আর তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল বিতর্ক প্যারালালে উপস্থাপন করেন। সাংবাদিকতা যেন তেমনি একবার কোন কিছু প্রকাশ পেলে তা যেন সমাজে ঝড় তোলে যেমন ভাবে এওলাসের বায়ু থলে খুললে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় সব কিছুকে।

ফ্রীম্যান পত্রিকা অফিস। ডাবলিন। এপিসোড সাতের পর্দা ওঠে এই পত্রিকা অপিসে যেখানে ব্লুম বিজ্ঞাপনের দালালীর কাজ করে। অফিসটি ডাবলিনের সিটি সেন্টারের সামনে অবস্থিত। বাইরে ব্যাস্ত রাজপথ। ট্রামকার, ডাকগাড়ী, মুটে মজুর, হকার, পথচারীদের হাঁকডাকে অফিসটির সামনের রাস্তা মুখরিত। ব্লুমকে দেখা যায় অফিসের পেছনে একটা এ্যাডের কপি নিয়েটেলিগ্রাফপত্রিকার প্রিন্টিং রুমের দিকে যেতে।টেলিগ্রাফফ্রিম্যানের মালিকানাধীন আর একটা পত্রিকা অফিস। সেখানে যাবার পথে সিটি কাউন্সিলর মি. ন্যানেটির সাথে দেখা হয়ে যায়। মি. ন্যানেটি ইটালিয়ান বংশউদ্ভুত আইরিশ নাগরিক। মি. ন্যানেটি মি. ডিগন্যামের অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে হাইনের অভিজ্ঞতা ব্লুমেকে বলে। ব্লুম হাইনের কাছে তিন সিলিং পায় যা সে অনেক দিনে আগে ধার করেছিল। ব্লুম হাইনের ধার পরিশোধ না করার ব্যাপারে মি. ন্যানেটিকে আকারে ইঙ্গিতে বলে।

কোলাহলের মাঝে ব্লুম বিজ্ঞাপনের ডিজাইনের কথা আলোচনা করতে চায় যেটা ছিলো আইরিশ হোম রুলের পক্ষের প্রচারণা। মি. ন্যানেটি ব্লুমকে বলে বিজ্ঞাপনের ডিজাইন ঠিক করে পত্রিকাতে কতদিন পর পর প্রকাশ হবে তা যেন সে জানিয়ে দেয়। এর পরে সে স্টাফ রুমের দিকে এগোয়। স্টাফরুমে প্রবেশ করতেই টাইপিস্টের উপর তার চোখ পড়ে। তাঁকে দেখে ব্লুমের বাবার কথা মনে পড়ে যায়। ব্লুমের মনে হয় তার বাবা যেন হিব্রু ভাষায় কিছু একটা পাঠ করছে ডান থেকে বামে। ব্লুমে ইভিনিং টেলিগ্রাফ নিউজরুমে প্রবেশ করতেই দেখা হয় ম্যাকহাফ ও সায়মন ডেডেলাসের সাথে। তারা ড্যান ডসনের ভাষণের উপর নের্ড ল্যাম্বার্ডের সমালোচনা শুনছিলো গভীর মনযোগ দিয়ে। ডসনের এই জনপ্রিয় ভাষণ পুনঃমুদ্রিত হয়েছে আজ সকালের কাগজে। এই সময় জে জে ওমলয় প্রবেশ করে। সে একজন আইনজীবী। ব্লুম জানে জে জে ইদানিং দারুণ অর্থকষ্টে আছে।

ল্যাম্বার্ট ডসনের বক্তৃতার জোরালো সমালোচনা করেই চলে। ব্লুম তার সমালোচনার সাথে একমত হলেও তাকে জানায় যে এটা ভুললে চলবে না যে ভাষণটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। এমন সময় মি. ক্রাফোর্ড এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। সাইমন ডেডেলাস ও ল্যাম্বার্ড মদ্যপান করার জন্য বের হয়ে যায়। ব্লুম ক্রাফোর্ডের টেলিফোন ব্যবহার করে তার বিজ্ঞাপনদাতার সাথে কথা বলার জন্য। লেইনহেইনকে দৃশ্যপটে আসতে দেখা যায়। সে পত্রিকার ক্রীড়া পাতার সাংবাদিক। সে সগর্বে ঘোষণা দেয় আজকের ঘোড়দৌড়েস্পেক্টারনিঃসন্দেহে জিতবে। ব্লুম সম্পাদক ক্রাফোর্ডকে বলে যে সে বিজ্ঞাপনদাতার সাথে দেখা করতে যাবে। এর এক মিনিট পরে মি. ম্যাকহাফ জানালা দিয়ে দেখেন এক পত্রিকা বিক্রেতা বালক ব্লুমের পিছে পিছে তার হাঁটার ভঙ্গিকে নকল করে তাকে অনুসরণ করছে। লেনহ্যামকেও দেখা যায় একই কাজ করতে।

এপিসোড সাতের কাহিনী এগিয়ে চলে এমন ভাবে। ফ্রীম্যান অপিসে আজ ধুমিয়ে আড্ডা চলছে। মি. মলয় মি. হাফকে একটা সিগারেট এগিয়ে দেয়। মি. লেনহ্যাম সিগারেটটা জ্বালিয়ে দেয়। মি. হাফ পেশায় একজন ল্যাটিন প্রফেসর। মি. ক্রাফোর্ড রোমান সম্রাজ্য নিয়ে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন। মি. লেনহ্যাম তাদের মাঝে কথা বলতে চায় কিন্তু দুজন তার কথায় কান দেয় না। এসময় মি. ম্যাডেন ব্রুক প্রবেশ করে আর তার পেছনে স্টেফান ডেডেলাস। স্টেফান ডেডেলাস আসে মি. ডেইজির চিঠি মি. ক্রাফোর্ডকে দিতে। মি. ক্রাফোর্ড মি. ডেইজির মৃত স্ত্রীর বদমেজাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। স্টেফান ডেডেলাস জানে যে মি. ডেইজি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে মানুষের প্রথম পাপের জন্য নারীই দায়ী। স্টেফান মি. ডেইজির চিঠি মি. ক্রাফোর্ডকে হস্তান্তর করলে সে ওটা পত্রিকায় প্রকাশ করতে সম্মত হয়।

ওদিকে আড্ডা আরো জমে ওঠে। মি. হাফ মতামত দেয় যে গ্রীসিয়ান ও আইরিশদের মাঝে একটা মিল আছে। এই দুই জাতির সংস্কৃতি রোমান ও ব্রিটিশদের দ্বারা দারুণ ভাবে প্রভাবিত। ক্রাফোর্ড মন্তব্য করে আজ তার আড্ডা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, এ্যাড ক্যানভাসার, আইন, ও সাহিত্যের প্রতিভাবানদের নিয়ে জমজমাট হয়ে উঠেছে। ম্যাকহাফ মন্তব্য করে যে ব্লুম বিজ্ঞাপনকে শিল্পের পর্যায়ে নিতে গিয়েছে আর তার স্ত্রী মলি নিঃসন্দেহে একজন উচ্চমানের গায়িকা। সম্পাদক ক্রাফোর্ড স্টেফানকে উপদেশ দেয় পত্রিকায় উত্তেজনাকর কিছু লেখার জন্য। সে স্টেফানকে স্মরণ করিয়ে দেয় ইগনেশিয়াস গ্যালারের ফিনিক্স পার্ক মার্ডারের রিপোর্টের কথা যে রিপোর্টে ব্রিটিশ চিফ সেক্রেটারি ও আন্ডার সেক্রেটারির হত্যার কাহিনী সিরিজ আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো। মি. মলি স্টেফানকে বলে সে প্রফেসর ম্যাগেনিন্সের সাথে তার ব্যাপারে কথা হয়। সে স্টেফানকে জিজ্ঞাসা করে রহস্যময় কবি এ.র ব্যাপারে তার মূল্যায়ন কি। স্টেফানের জানতে ইচ্ছে করে ওমলি প্রফেসরের সাথে তার ব্যাপারে কি কথা বলে কিন্তু সে জানতে চাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে।

স্টেফান এবং ওমলির কথার মাঝে ম্যাকহাফ বাগড়া দেয়। ম্যাকহাফ উদাহরণ দেয় জন এফ টেলরের ট্রিনিটি কলেজে দেয়া সেই বিখ্যাত বক্তৃতার কথা যেখানে টেলর দাবী জানিয়েছিলেন আইরিশ ভাষার পুনর্জাগরনের প্রয়োজন। ম্যাকহাফ টেইলরের বক্তৃতা থেকে কোট করে আরো বলে যে বৃটিশদের অগ্রাসনে আজ আইরিশ সংস্কৃতি হুমকির মুখে। স্টেফান ওদের বলে পাবে আবার দেখা হবে। স্টেফান ও ম্যাকহাফ বের হয়ে যায়। ওমলি ক্রাফোর্ডের কাছে কিছু টাকা ধার চায়।

মি ক্রাফোর্ড ও ব্লুম ফ্রিম্যান অফিস থেকে বের হয়ে আসে। তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। ব্লুম ক্রাফোর্ডকে বলে তার বিজ্ঞাপন দুমাসের চুক্তিতে প্রকাশ করার জন্য। ক্রাফোর্ড ব্লুমের প্রস্তাবকে নাকোচ করে দেয়। ক্রাফোর্ড ব্লুমের প্রস্তাব নাকচ করে ওমলয় সাথে কথা বলতে শুরু করে। ক্রাফোর্ড ওমলিকে সাফ জানিয়ে দেয় যে তার পক্ষে মলয়কে আর অর্থ ধার দেয়া সম্ভন নয়।

স্টেফান প্রফেসর ম্যাক হাফকে একটা গল্প বলতে থাকে। গল্পটা এমন যে দুজন তরুণীর ইচ্ছে হলো ডাবলিন শহরকে উঁচু কোথাও থেকে দেখার। তারা একটা পিলারর মাথায় উঠে বড়ই খেতে শুরু করে আর থুতু সহ বিচি আশেপাশে ফেলতে শুরু করে। তারা নীচের দৃশ্যাবলী দেখার চেয়ে পিলারের মাথায় বসে বড়ই খেতে পছন্দ করছিলো। স্টেফানের এই গল্প প্রফেসর ম্যাখহাফের মাথায় ঢোকে না। স্টেফান গল্পটার নাম করণ করতে চেয় এমন ভাবে –‘পিগিস সাইট অফ প্যালেস্টাইনঅথবা- ‘দ্যা প্যারাবল অব পামস! স্টেফানের কথা শুনে ম্যাকহাফ হেসে ফেলে। রাস্তায় তখন ট্রাম আর অন্য যানবাহন পুরোদমে চলাচল করতে থাকে।

এপিসোড সাত উপন্যাসটির এমন একটি পর্ব যেখানে খবরই যেন চেতনা। সংবাদপত্রের খবর তার বিশ্লেষণ অথবা ধারা বিবরণী সবই যেন ঘটে একটা তৃতীয় কোন অস্তিত্বের উপস্থিতিতে। আমরা পাঠকরা যেন একক কোন চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত থাকতে পারিনা বরং অন্য কেউ যেন এই এপিসোডের সব তথ্য পাঠকদের পরিশ্রুত করে উপস্থাপন করে। জয়েসের ন্যারেশনের এটা আর একটা চমক।

এপিসোডটা এওলাসের কাছ থেকে বিদায় নেবার পরের ঘটনার প্যারালাল। এওলাস ঝড়ো বাতাসকে একটা থলেতে বন্দি করে ওডেসিয়াসকে দিয়েছিলো যেন সে দেশে ফিরতি যাত্রায় ঝড়ের কবলে না পড়ে। ওডেসিয়াস যখন ঘুমে ছিলো তার এক নাবিক বোকার মত থেলের মুখ খুলে দেখতে চায় কি ছিলো সেখানে। থলেটা খোলা মাত্র ঝড় তাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় এওলাসের দ্বীপে।

ঝড়ো বাতাস হলো সাংবাদিকদের অতিরঞ্জিত খবর এবং তা নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা, তর্কবিতর্কের প্রতীকী উপস্থাপনা। ফ্রীম্যান সংবাদপত্রের অফিসরুম,আড্ডায় উপস্থিত ব্যাক্তিবৃন্দ, তাদের আলোচনা, উত্তেজনা, সব মিলিয়ে জয়েস অসম্ভব সুন্দর ভাবে এওলাস স্বর্গকে এডোপ্ট করেছেন। জয়েস এই এপিসোডে বিভিন্ন শিরোনাম ও সাধারণ টেক্সটে অন্তত ষাটটি রেটোরিকাল ফিগার যেমন হাইপারবোল, মেটোনোমি, ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন।

এই এপিসোডে জয়েসের গল্পগ্রন্থ – ‘ডাবলিনার্স’এর বেশ ক’টি চরিত্রকেও আমরা দেখতে পাই যার মধ্যে মি. লেনহ্যান ও মি. গ্যালাহার হলো অন্যতম। এপিসোডটিতে দুপুরের অলসতা, হতাশা, বিব্রতবোধের চিত্র আঁকতে জয়েসডাবলিনার্স’ এর স্থবিরতা ও স্লথময়তা নিয়ে আসেনওডেসির জাহাজ যেমন থলের মুক্ত ঝড়ে আবারো ফিরে গিয়েছিলো এওলাসের দ্বীপে ঠিক তেমনই। ব্লুম বিজ্ঞাপনের চুক্তিটা পায় না, মলয় ক্রাফোর্ডের কাছে টাকা ধার চেয়ে পায় না, স্টেফান শীপ পাবে বাক মুলিগানের দেখা পায় না। জয়েস সবাইকে আশার জগত থেকে নিরাশার জগতে নিয়ে যান ঠিক ওডেসির জাহাজের মত যা দেশের খুব কাছ থেকে আবার ফিরে যায় যেখান থেকে যাত্রা করেছিলো। জয়েস নাকে এই এপিসোডে টেনে আনেন আর তার চরিত্রদের কথা বলান হাই রেটোরিকাল পিচে। ফ্রীম্যান অফিসের আড্ডা দৃশ্যে উপস্থিত চরিত্রদের কথা, আলোচনা, সমালোচনা, মতামত ব্যাস্ত পত্রিকা অফিসটির কোলাহলের সাথে মিশিয়ে জয়েস সৃষ্টি করেন এক অনন্য ক্যাকোফ্যানি ঠিক যেন এওলাসের থলে মুক্ত ঝড়োবাতাস।

এপিসোড সাতে জয়েস তার দুই নায়ককে একসাথে পাঠকদের সামনে নিয়ে আসেন। তারা সাক্ষাৎ করে না, তারা একে অপরের সাথে কথা বলে না তারা রাস্তায় পার হয় বিপরীত গন্তব্যে যাবার জন্য। স্টেফান ব্লুমকে পাত্তা দেয় না কিন্তু ব্লুম স্টেফানকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে। ব্লুম স্টেফানের নতুন জুতোয় বিষ্ঠার ছাপ দেকে বিরক্ত বোধ করে। ওদিকে জয়েস ফ্রীম্যান অফিসে ব্লুম ও স্টেফানের উপস্থিতির একটা সুক্ষ্ম তুলনা করেন। ব্লুম বিজ্ঞাপনের চুক্তি করতে ব্যার্থ হয় আর স্টেফান মি. ডেইজির চিঠি পত্রিকায় ছাপানোর ব্যাপারে ক্রাফোর্ডকে রাজী করাতে পারেন। আড্ডায় ব্লুমকেআর্ট অফ এ্যাডেরএজেন্ট আখ্যা দেয়াটা ছিলো নিছক উপহাস করার জন্য কিন্তু স্টেফানকে রগরগে লেখা পত্রিকায় দেবার প্রস্তাবটা ছিলো খুবই আন্তরিক। জয়েস তার প্রধান দুই চরিত্রকে যেন একটা ক্যানভাসে এনে তুলনা করছেন পাঠকদের মনে গেঁথে দিচ্ছেন এই ধারণা যে একজন লোটাস ইটার (ব্লুম) আর একজন ওডিসিয়াস (স্টেফান)। আর্ট, কালচার, এ্যাড, বা লেখালেখির ব্যাপারে ব্লুমের প্রথম বিবেচনা হলো এর মাধ্যমে কেমন ভাবে অর্থ উপার্জন করা যেতে পারে। এপিসোড চারে দেখা যায় যে ব্লুল চিন্তা করে একটা ফিকশন লিখে কেমন অর্থ উপার্জন করা যেতে পারে। স্টেফান যেন ঠিক তার উল্টো। পত্রিকা অফিসে সম্পাদক তাকে লেখা দেবার জন্য অনুরোধ করলে সে তা না নাকচ করে দেয়। স্টেফান ভাবে তার উচিৎ কবিতা নিয়েই থাকা।

ওডেসিয়াস দেশের কাছে এসেও তার এক নাবিকের বোকামীর জন্য তাদেরকে ফিরে যেতে হয় যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো সেখানে। অর্থাৎ ওডেসিয়াসের সমস্ত শ্রম বিফলে যায়। সারাটা এপিসোড জুড়ে আমরা দেখি নায়ক ব্লুমের পেশাগত কাজের ব্যস্ততা। সে কয়েজের বিজ্ঞাপন নিয়ে ফ্রীম্যান পত্রিকা অপিসে আসে সম্পাদক ক্রাফোর্ডকে রাজী করাতে যেন বিজ্ঞাপনটা তিন মাস ব্যাপী প্রচারিত হয়। কিন্তু কিন্তু ক্রাফোর্ড তা নাকচ করে দেন। ওডেসিয়াসের মত তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

ফ্রীম্যান পত্রিকা অফিসের আড্ডারত অতিথিদের আলোচনা যেন থলেবন্দি বাতাস যা বের হয়ে আসে তাদের অতিউৎসাহী কথাবার্তায়। জয়েস এপিসোডটির প্রতিটি সেকশন পত্রিকার হেড লাইনের মত করে লেখেন। তিনি এটা করেন একটা পারফেক্ট পত্রিকার আবহ সৃষ্টি করার জন্য। পাঠকদের ভাবান যে তারাও পত্রিকা অফিসে আছেন ওই আড্ডাবাজ দের সাথে নিঃসন্দেহে পত্রিকা অফিসের আড্ডার চরিত্ররা হলো ওডেসিয়াসের নাবিকেরা। সেই নাবিকেরা যারা দেশের তটরেখা দেখে উৎসাহে মেতে ওঠে। তারা ভুলে যায় এওলাসের সতর্কবাণী। তারা থলে খুলে মুক্ত করে দেয় ঝড়ো বাতাসকে যা এওলাস থলে বন্দি করে তুলে দিয়েছিলো ওডেসিয়াসের হাতে।

 এপিসোডের একটা প্যারার হেড লাইন এমন – ‘ ‘O’ HARP EOLIAN’এটা হলো ব্লুমের টেলিফোন কথোপকথনের দৃশ্যের। ব্লুম যখন ফোনে কথা বলছে জয়েস ফ্রীম্যান পত্রিকা অপিসের সেই কক্ষে অবস্থানরত একজন ব্যাক্তির বর্ণনা দেন যে কেমন ভাবে আয়েশ করে ফ্লস দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করছে। এখানে ফ্লস হলো এওলাসের বাদ্যযন্ত্রের (হার্প) কমিক্যাল উপস্থাপন আর তার ইঙ্গিত দেন প্যারাগ্রাফটির ক্যাপিট্যাল লেটারে লেখা হেড লাইনে।

ফীম্যান পত্রিকা অপিসের আড্ডায় প্রতিটা ব্যাক্তি সরব। তারা যেন কথার ঝড় তুলেছে। আড্ডার উপস্থিত ব্যাক্তিদের মনে জমে থাকা কথা শব্দে পরিণত হয় বাতাসের মাধ্যমে আরা বাতাসের মাধ্যমে সেই শব্দ যেন তার চারপাশের অন্য ব্যক্তিদের শ্রবণইন্দ্রিয়ে পৌঁছায়। মানুষের মনের ভাবনা যেন এওলাসের থলে বন্দি বাতাস, যা মুক্ত করে দিলে শব্দে পরিণত হয়ে শব্দে আর তাতেই প্রকাশিত হয় মানুষের মনে জমে থাকা কথা, ভাবনা, ভালোবাসা, ঘৃণা, আশা বা হতাশা। জয়েস শুধু ওডেসির বিষয়বস্তুকে তাঁর এই মহান উপন্যাসে ধারণ করেন না বরং সেই এ্যাডোপ্টেসনের মধ্য দিয়ে জীবনের গভীরতম বোধকে উন্মোচিত করেন। এমনকি তার কমিক দৃশ্যের পেছনেও জীবনের সিরিয়াস বোধের বিশ্লেষণ পাঠকদের মননে ধরা পরে। জয়েস একটি শব্দও যেন অকারণে ব্যবহার করতে চান না বা করেন না এমন কি উপন্যাসের বিভিন্ন এপিসোডের ননসেন্স ওয়ার্ড, বা রাইমও এর ব্যতিক্রম না।

প্রফেসর হাফকে বলা স্টেফানের গল্পের পেছনে জয়েস অন্যকিছু বলতে চান। এখানে জয়েস ছোট্ট একটা তুলনা করেন ফ্রীম্যান অফিসের আড্ডাবাজদের রেটোরিক্যাল কথাবার্তার সাথে স্টেফানের বলা গল্পের। আমরা ফ্রীম্যান পত্রিকা অফিসে স্টেফানকে বেশী কথা বলতে দেখি নাসে সম্পাদকের সাথে সামান্য কথা বলে মি. ডেইজির চিঠি তাকে প্রকাশের জন্য দিয়ে অফিস ত্যাগ করে। সম্পাদক তাকে লেখালেখি করার অনুরোধ জানালেও সে তাতে সম্মত হয় না। স্টেফানকে অবশ্যই গলাবাজদের শ্রেনীতে ফেলা যায়না। স্টেফান ঐ আড্ডার অন্যদের থেকে আলাদা।



পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রফেসর হাফকে স্টেফান দুই রমনীর যে গল্পটা বলে তার পেছনে জয়েস অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেন। স্টেফনের গল্পটা জয়েস এমন ভাবে ডিজাইন করেন যে তাতে প্রতীকী ভাবে শুধু অভিজ্ঞতাকেই উপস্থাপন করে যেখানে কোন প্রতিকারের কথা বলা নেই। গল্পটা নিশ্চয় ইংল্যান্ডের শাসনের নীচে আয়ারল্যান্ডের অবস্থা এবং অভিজ্ঞতার কথাই বলা হয়েছে। রমণী দুজন বিখ্যাত ব্রিটিশ সৈনিকের মূর্তির উপর ওঠে শহর ডাবলিনের বিস্তৃতি দেখার জন্য। কিন্তু তারা চূড়ায় ওঠার পরে বড়ই খেতে শুরু করে আর নীচের রাস্তায় বিচি ফেলতে থাকে। তারা ডাবলিনের বিস্তৃতি না দেখে খাওয়ায় ব্যস্ত থাকে। এই চিচি গুলো রাস্তায় বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে শুধু ডাবলিন শহরের ময়লার পরিমানই বাড়াবে কিন্তু সেই বীজ থেকে কোন চারা জন্মাবে না বা কোন বৃক্ষের জন্ম হবে না। ঠিক আইরিশরা যেমন তারা গলাবাজী করতে জানে তাদের স্বাধীনতার জন্য কিন্তু তাদেরকে সংগ্রাম করতে দেখা যায় না।

নেলসন ছিলেন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বীর সৈনিক যে নেপোলিয়নের সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। আর সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যোদ্ধার মূর্তি আজ শোভা পাচ্ছে ডাবলিনের রাস্তায় যে শহর নিজেই ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের শিকার। জয়েস আসাধারণ ভাবে আয়ারল্যান্ডের উপর ব্রিটিশ আধিপত্যের ইতিহাস খুব মজার প্রতীক দিয়ে বুঝিয়ে দেন। জয়েস শুধু মাত্র আয়ারল্যান্ডের চিত্রটা তুলে ধরেন কিন্তু তিনি এর প্রতিকারের কোন নির্দেশনা দেন না।

জয়েস সম্ভত বলতে চান যে সাহিত্য হলো উচ্চমার্গের বক্তব্য প্রস্তুত করতে পারে। সাহিত্য মানুষের জীবনে শৈল্পিক মনন সৃষ্টি করে মানুষের মনের দরজা খুলে দেয় কিন্তু কোন প্রতিকারের কথা বলে না। মনের দরজা খুলে গেলে মানুষই এই প্রতিকার বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেবে। সাহিত্য মনকে উচ্চ স্তরে নিয়ে যাবার ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে। সাহিত্যে মানুষকে বোঝাতে গলাবাজি করতে হয়না বরং সেটা মানুষের মনের গভীরে বোধের জন্ম দেয় যে বোধ মানুষকে গলাবাজী বা এওলাসের বাতাস থেকে দূরে রেখে তাদের কর্মের দ্বারা পরিণতিতে পৌঁছতে সাহায্য করে। এপিসোড সাতে জয়েস এই বক্তব্য খুব জোরের সাথেই যেন বলতে চান। ঠিক অডেসিয়াস আর তার নাবিকেরা যেমন ভাবে তাদের দেশ ঈথাকার কাছে এসেও তাদের এই দীর্ঘ কষ্টকর অভিযানের সমাপ্তি ঘটাতে পারেনি। ব্লুম সারাদিন কাজ করেও সে বিজ্ঞাপনটার কন্ট্রাক্ট পায়না। জয়েস এই প্রতীক দিয়ে বোঝান আয়ারল্যান্ড যেন এওলাসের বাতাসে আক্তান্ত। আইরিশরা যতই চায় ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্ত হতে তার যেন ফ্রীম্যান অপিসের উঁচু গলার আড্ডাবাজ। তাদের বুলি এওলাসের থলে মুক্ত বাতাস যা তাদেরকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্বাধিকার থেকে।

১৯৭৩ সালে আইরিশ নভেলিস্ট ব্রায়ান ম্যুর দ্যা আইরিশ টাইমসে এক  সাক্ষাৎকারে বলেন-‘There is a journalistic element in all of Joyce’s fiction!’  ম্যূর জয়েসের এই জার্নালিস্টিক ভাষা এবং অসাধারণ রিকন্সট্রাকশনের উপর আরো বলেন- ‘It gives Ulysses a marvellous solidity ... Something very ordinary is happening on a real level even in the midst of the most amazing verbal pyrotechnics!’

 

সুত্র-

১। Ulysses by James Joyce

২।  James Joyce’s joust with journalism: The Freeman’s Journal in Ulysses’ Aeolus chapter by Felix M Larkin

৩। James Joyce by Richard Ellmann

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৮  




আপনারা অনেকেই নিশ্চয় জানেন যে প্রতি বছর যেমন সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী, সেরা স্ক্রিন-প্লে ইত্যাদিতে অস্কার পুরষ্কার দেওয়া হয়, তেমনি প্রতি বছর সেরা অ্যানিমেশন সিনেমাকেও অস্কার দেওয়া হয়। এবং একটি বিভাগে নয় – দুটি বিভাগে। সাধারণ দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন সিনেমা ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন সিনেমা। এর ভেতর স্বল্প দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন মূলত  থিমাটিক হয়, ফলে সব সময় বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ সাধার অ্যানিমেশন সিনেমা সবার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয় – মূলত ফিকশন, এবং দেখবেন বাচ্চারা এইসব মুভি দেখতে খুব ভালবাসে। আজ আমরা প্রথমে এইরকম কিছু অ্যানিমেশন সিনেমা দিয়েই শুরু করব। মাথায় থাকবে বাচ্চাদের উপযুক্ত ছবি। তারপর এই লেখার শেষভাগে আমরা ছোটদের জন্য কয়েকটা হলিউড সিনেমার কথা তুলে ধরব।

তাহলে প্রথমে চট্‌ করে দেখে নেওয়া যাক অ্যানিমেশন ছবি জিনিষটা কী!  অ্যানিমেশনও সিনেমা, কিন্তু এখানে কোন শুটিং দরকার হয় না, অভিনেতা থাকে না, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন লাগে না। এর পুরোটাই হয় কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে। প্রতি ক্যারেকটার ও সিন কম্পিউটারে তৈরি করা, সেগুলো জুড়ে চলন্ত ভিডিও সিকোয়েন্স করা, ব্যাকগ্রাউন্ড ও কালার – পুরোটাই। এইসব হবার পর নেপথ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে প্রতি সিনে ডাবিং করে স্বর জোড়া হয়, ঠিক যে কোন সাধার সিনেমার মত। এই হল অ্যানিমেশন সিনেমা। অর্থাৎ এটাও সিনেমা,  কিন্তু এর ভেতর ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেকনিকাল কৌশল দরকার হয় সবথেকে বেশি।

গোটা পৃথিবী জুড়ে অ্যানিমেশন সিনেমা বানানোর প্রচুর প্রোডাকশন হাউস আছে। আক্ষরিক অর্থেই প্রচুর। যারা প্রতি বছর অ্যানিমেশন মুভি বানিয়েই চলেছে। তার ভেতর প্রোডাকশন ও ব্যবসা অনুযায়ী মোটামুটি প্রথম তিনটে যদি বেছে নিই, তারা হল – ১) পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিও (১৯৭৯ সালে অ্যাপ্‌ল কো-ফাউন্ডার স্টিভ জোবস এই কোম্পানি শুরু করেন), ২) ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিও (১৯২৩ সালে ওয়াল্ট ডিজনি লস এঞ্জেলসে এই স্টুডিও শুরু করেন), ৩) স্টুডিও গিব্‌লি (১৯৮৪ সালে জাপানি পরিচালক হায়াও মিয়াজাকি এই স্টুডিওয় অ্যানিমেশন সিনেমা বানানো শুরু করেন এবং জাপানি ভাষায় একে ‘গিব্‌লি’ নয়, ‘জিব্‌লি’ ডাকা হয়)। এছাড়াও যে স্টুডিওর নাম না করলে অ্যানিমেশন সিনেমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে, সেটা হল ওয়ার্নার ব্রাদার্স। কার আমরা ছোটবেলা  থেকে যত গাদাগাদা লুনি টিউনস্‌, বাগস্‌ বানি, ডাফি ডাক, আঙ্কল স্ক্রুজ, টম অ্যান্ড জেরি... দেখে এসেছি, সেই স-ম-স্ত অ্যানিমেশন এই প্রোডাকশন হাউসের। এদের প্রত্যেকের অনেক সিনেমাই অস্কার পেয়েছে। আজ আমরা এই চার বড় প্রোডাকশন হাউসের একটা করে অ্যানিমেশন বেছে নেব। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ‘দ্য আয়রন জায়েন্ট’ (১৯৯৯), গিব্‌লির ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ (২০০১), পিক্সারের ‘ওয়াল-ই’ (২০০৮) এবং ডিজনির ‘ফ্রোজেন’ (২০১৩)

ব্র্যাড বার্ড পরিচালিত ‘দ্য আয়রন জায়েন্ট’ ভিনগ্রহের বিশাল বড় রোবটের গল্প। পৃথিবীতে রকওয়েল নামক এক শহরতলীতে এসে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ছোট্ট ছেলে হোগার্থের। কিন্তু সরকার এই রোবটের কথা জানতে পেরে গিয়ে একে ধ্বংস করার জন্য এক অফিসার পাঠায়। অনেক টানাপোড়েনের পর রকওয়েল শহরতলীকে বাঁচাতে এই রোবট নিজের আত্মাহুতি দেয়। যদিও শেষ দৃশ্যে দেখা যায় রোবটের টুকরো টুকরো অংশগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে আবার আস্তে আস্তে আইসল্যান্ডে গিয়ে একত্রিত হচ্ছে। জায়েন্টের গলায় ভিন ডিজেল এবং হোগার্থের মায়ের গলায় জেনিফার অ্যানিস্টোন অনবদ্য। এই সিনেমার দুর্ভাগ্য যে ২০০০ সাল থেকে অ্যানিমেশনে অস্কার চালু হওয়ায় এর ভাগ্যে অস্কার জুটল না।

মিয়াজাকির ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ আমার দেখা এক অদ্ভুত অ্যানিমেশন। একে যদি অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের ভৌতিক সংস্করণ বলা যায়, তাহলে হয়ত খানিকটা ঠিক বলা হবে। বছর দশেকের মেয়ে চিহিরো তার বাবা মায়ের সঙ্গে এক পরিত্যক্ত পার্কে যাবার পর তার বাবা-মা শুয়োর হয়ে যায় আর চিহিরো পড়ে ভূতেদের খপ্পরে। বাকিটা দেখুন। নাহলে মজা চলে যাবে। প্রতি সিনের ডিটেলিং, রঙের ব্যবহার, গ্রাফিক্সে ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, প্রাকৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড, ফোক মিউজিক – প্রতি বিষয়েই এই অ্যানিমেশন দুর্দান্ত।

এর আগের লেখায় বলেছিলাম জাপানের গ্রাম্য/শহুরে/পাহাড়ি/সামুদ্রিক ল্যান্ডস্কেপ দেখা সম্পূর্ণ হয় না যদি জাপানি অ্যানিমেশন সিনেমার কথা না বলি। সেই সূত্রেই আজ ছোটদের ছবির কথা আলোচনা করছি। তবে স্টুডিও গিব্‌লির এই একটামাত্র ছবি ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ দেখে সেটা বুঝবেন না। তাই অনুরোধ, গিব্‌লির আরো কিছু সিনেমা দেখুন, যেমন, ‘মাই ন্যেবার টোটোরো’ (১৯৮৮), ‘হুইস্পার অব দ্য হার্ট’ (১৯৯৫), ‘দ্য উইন্ড রাইজেস’ (২০১৩) ইত্যাদি। তবেই আপনার জাপানি ল্যান্ডস্কেপ ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে।

অ্যান্ড্রু স্ট্যানটনের ‘ওয়াল-ই’ আবার এক রোবট নিয়ে গল্প। ২৯ শতকের জনবিহীন জঞ্জালে ভরা পৃথিবী। এক মেগা কর্পোরেশান ‘BnL’ যত ‘Waste Allocation Load Lifter: Earth-class (WALL-E)’ রোবট দিয়ে এই জঞ্জাল সাফ করাচ্ছিল, তার শেষ কর্মক্ষম রোবট আমাদের সিনেমার ওয়াল-ই। এই ওয়াল-ই ইভ নামক এক নজরদার উড়ন্ত ড্রোনকে একদিন জঞ্জালের ভেতর থেকে এক ছোট্ট জীবন্ত চারাগাছ দেয়। সেই চারা নিয়ে দুই রোবট স্পেসশিপ অ্যাক্সিওমে ফিরে যায়। এই সিনেমা খুব স্ট্রং এক মেসেজ দিয়েছিল। আমরা যদি প্রকৃতির যত্ন না নিই, তাহলে মানবজাতির কেউ বেঁচে থাকবে না। এই অ্যানিমেশনের পর পিক্সারের আরেকটা ছবি দেখবেন – ‘কোকো’ (২০১৭)ভালবাসা কীভাবে জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখা একাকার করে দেয়।

ক্রিস বাক ও জেনিফার লি-র ‘ফ্রোজেন’ এক রূপকথার গল্প। গানের তালে দু’বোনের ভালবাসার গল্প। একবোনের বরফ বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের দেশে আজীবন শীত ডেকে এনেছে, তাই আরেক বোন তাকে বোঝাতে চলেছে। সঙ্গে আরো কয়েকজন সাথী নিয়ে। পুরো আবহটাই দুর্দান্ত। সম্ভবত ডিজনি স্টুডিওর সেরা প্রোডাকশান। এবং এক পরিণত বার্তা – ক্ষমতার অপব্যবহার কোর না।

এবার অ্যানিমেশন ছাড়িয়ে সাধার সিনেমায় ঢোকা যাক। ছোটদের জন্য কিছু  সিনেমা। যা সর্বকালের সেরা হিসেবে বেছে নিতে কারো আপত্তি হবার কথা নয়। এইরকম ঠিক তিনটে ছবি নিয়ে আজ আলোচনা করব – ‘উইজার্ড অব অজ’ (১৯৩৯), ‘মেরি পপিন্স’ (১৯৬৪) এবং ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’ (১৯৬৫)।

এই সিরিজের ৪ নম্বর পর্বে ভিক্টর ফ্লেমিং-এর এক লিজেন্ড মুভি ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, মনে আছে? মনে পড়ছে, সেই সময়ের সাদা-কালো ছবির ভীড়ে ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ ছিল মন ভাল করে দেওয়া এক রঙিন সিনেমা? দশটা অস্কার পাওয়া ছবি। সেই ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের আরেক অসাধার রঙিন ছবি হল ‘উইজার্ড অব অজ’নিশ্চয় বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না  যে এই ছবিও আজ থেকে ৮২ বছর আগের রঙিন ছায়াছবির এক মাইলস্টোন। হ্যাঁ, এটা সহজেই অনুমেয় যে একজনের পক্ষে একসঙ্গে দুটো লিজেন্ড ছবি পরিচালনা করা কঠিন। ফলে ভিক্টর ফ্লেমিং ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’-এর চাপে শেষদিকে ‘উইজার্ড অব অজ’ সামলাতে পারেন নি। শেষ তিন সপ্তা এই সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন কিং ভিডর।

এক তের বছরের মেয়ে জুডি গারল্যান্ডের স্বপ্নের ভেতর রূপকথার অজ রাজ্যে ভ্রমণের ছবি ‘উইজার্ড অব অজ’সেখানে সে সঙ্গী হিসেবে পায় এক কাকতাড়ুয়া,  এক টিনের কাঠুরে আর এক ভীতু সিংহ। আর পায় এক দুষ্টু ডাইনি আর এক জাদুকরকে। ডাইনির শয়তানি কাটিয়ে জাদুকরের সাহায্যে জুডি অজ রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনে। স্বপ্নের ভ্রম সেরে আবার যখন সে নিজের বিছানায় জেগে ওঠে,  তার সমস্ত ঘটনাই সত্যি মনে হয়। এই সিনেমা মিউজিকের জন্য দুটো অস্কার পেয়েছিল। আর জুডি পেয়েছিল অস্কার কমিটির বিশেষ শিশুশিল্পী পুরস্কার।   

রবার্ট স্টিভেনসনের ‘মেরি পপিন্স’ ছোটদের রূপকথার মিউজিকাল সিনেমা যার মুখ্য চরিত্রে সেই সময়ের বিখ্যাত নায়িকা জুলি অ্যান্ড্রুজ। এই ছবি পাঁচখানা অস্কার পেয়েছিল। এই সিনেমায় একটা গান আছে ‘চিম চিম, চিম চিম, চিম চিম চে-রি...’, সেই গানের জন্যও এই ছবি অস্কার পেয়েছিলএই ছবিতে জুলি অ্যান্ড্রুজ এক মায়াবি জাদুকর, যে দুজন বদমাশ বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য ন্যানি হিসেবে আসে। তারপর নিজের জাদুর সাহায্যে গোটা পরিবারকে হাসিখুশি করে তোলে। এই ছবি নিয়ে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। বলার আছে এর পরের ছবি নিয়ে।

রবার্ট ওয়াইজ-এর ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’ সেই সময়ের সবথেকে সফল বক্স অফিস হিট সিনেমা যার মুখ্য চরিত্রে আবারো জুলি অ্যান্ড্রুজ। এই সিনেমাও, সেরা ছবি আর সেরা পরিচালক সমেত, পাঁচখানা অস্কার পেয়েছিল। ‘মেরি পপিন্স’-এর জন্য জুলি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেয়েছিলেন আর ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’-এর জন্য গোল্ডেন গ্লোব ও বাফটা। এখানেও জুলি এক ন্যানির ভূমিকায়। এক গানপাগল ন্যানি যে এক বিপত্নীক আর্মি ক্যাপ্টেনের সাত সন্তানের দেখাশোনার জন্য এসেছে। অস্ট্রিয়ার গ্রাম্য পটভূমিকায় এই ছবির নেপথ্য দৃশ্য দেখার মত। সঙ্গে গান আর মিউজিক তো বটেই।

তবে আমি একজন সমালোচক হিসেবে এই ছবির একটা অন্য দিক তুলে ধরতে চাই। এই ছবির ঠিক ২১ মিনিটের মাথায় একটা লং শট আছে, অন্তত ৪০ সেকেন্ডের। জুলি গান গাইতে গাইতে অ্যারোবিক্সের ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে সেই ক্যাপ্টেনের বাড়ির দিকে এগোচ্ছেন। ক্যামেরা ডায়নামিক, সম্ভবত কোন হাল্কা বাহনের ওপর কার ক্যামেরাও দুলছে। এই পুরো শটে জুলির শুধু অভিনয় পটুতা  নয়, শারীরিক সক্ষমতাও চূড়ান্তভাবে ফুটে উঠেছে। এইরকম লং শটের জন্য অভিনেতাকে নিজের ১০০% দিতে হয়। নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করতে হয়। এখন কজন পারে এইরকম শট দিতে?

এতক্ষণ যে যে সিনেমা নিয়ে ওপরে বললাম, তার বাইরেও আরো কয়েকটা ছবি আমি আপনাদের বলব বাচ্চাদের দেখাতে। এক, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (১৯৫১)। দুই, হোম অ্যালোন (১৯৯০)। ক্রিসমাসের পটভূমিকায় বাচ্চাদের সাহসিকতা যোগানোর বেশ ভাল সিনেমা। তিন, টয় স্টোরি (১৯৯৫)। চার, প্যাডিংটন ১-২ (২০১৪, ১৭) অ্যাডভেঞ্চার, অজানাকে জানার আনন্দ এবং সহবৎ শিক্ষার ছবি। প্রতি সিনেমাই সব বয়সে উপভোগ করার মত। এবং আরেকটা ছবির কথা না বললে আমার ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি অপূর্ণ রয়ে যাবে – ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৮)। ছবিতে শ্যামল মিত্রের একটা গান এখনো আমার কানে ভাসে – ‘আমি অনেক ঘুরিয়া শ্যাসে আইলাম রে কলকাত্তা’। আসলে, এখনকার বেশিরভাগ বাচ্চা (এবং তাদের অভিভাবকরা) ভাবে ছোটদের সিনেমা মানেই বুঝি ‘হ্যারি পটার’। এর বাইরে যে একটা বিশাল বড় জগৎ আছে, সেটা আমার লেখার পর আশা করছি স্পষ্ট। ব্যস্‌, বাচ্চাদের ছবি এই অব্ধিই থাক। আমরা আবার নানা দেশের সিনেমায় ফিরব।

এখনো অব্ধি আমি হলিউড, ইউরোপিয়ান, এশিয়ান, এরকম বেশ কিছু জায়গার ছবি নিয়ে আলোচনা করলেও আফ্রিকায় একেবারেই হাত ছোঁয়াইনি। তো, সামনের বার আফ্রিকা নিয়েই কচকচি হবে। 

 

(ক্রমশ)