সমকালীন ছোটগল্প |
নিশ্চিন্দিপুর
নৈঃশব্দের ভাষা আছে। সবচেয়ে জোরালো ভাষা বোধহয় সেটাই। তাই কেঁদুলির ভাষাও সব সময় সরব। শব্দহীন কিন্তু সশব্দ। ছোট থেকেই কথা বলতে পারে না কেঁদুলি। এমনকি জন্মের পর ঠিকমতো কাঁদেওনি ও। শিশু জন্মের পর সাধারণত তার চিৎকারের অপেক্ষায় থাকে পরিবার। মায়ের গর্ভের বাইরের পরিবেশ ছোট্ট প্রাণকে অস্থির করে তোলে। কেঁদুলির জন্মের পর তার বাড়ির লোকও অস্থির হয়েছিল। তবে কান্নার চোটে নয়। দিকভ্রান্ত হয়ে অস্থির হয়েছিল তারা।
ন্যাকড়ায় মোড়া ছোট্ট পুতুলটা হাত-পা নাড়ছে। উঁ-আঁ করছে। কিন্তু কাঁদে না। রতনপুরের মত এমন একটা অজ-পাড়া-গাঁয়ে ডাক্তার বেশ কয়েকটা জটিল পরীক্ষা করতে বললে কেঁদুলির বাবা সত্যিই অস্থির হয়ে পড়ল। সদ্য মা হওয়া স্ত্রী। মেয়ে কাঁদে না। আর মা কেঁদেই চলেছে। অদ্ভুত বৈপরীত্যময় এই পরিস্থিতিতে ওর বাবা কলকাতায় এসে পরীক্ষা করালো মেয়ের। শিশুর স্বরযন্ত্রে সমস্যা আছে। অপারেশন খরচসাপেক্ষ। এছাড়াও এক দিনের শিশুর শরীর সেই ধকল নিতে নারাজ। তারপর অপারেশন, 'কথা বলা' কোন এক গহীন জগতে হারিয়ে গেল। কান্নার অপেক্ষা দিয়ে জীবন শুরু হয়েছিল বলে জন্মের পরই ওর নাম কেঁদুলি রেখেছিল ঠাকুমা।
কেদুঁলির
কি তবে দুঃখ হয় না? দুঃখ হলে ও মায়ের আঁচলে গিঁট পাকাতে থাকে। চোখে মুক্ত-কণা। কেঁদুলি
বোঝে কথাদের আলাদা জগত থাকে। সেই জগতে ও বেমানান।
মা
যখন দিদির চুল আঁচড়ে দেয় চুলের জট ছাড়ালে দিদি বিরক্ত হয়। নাক মুখ কুঁচকে মায়ের
ওপর চোটপাট করে।
-'উফ!
এত যত্ন নেওয়ার কী আছে? চুলই-তো। বড় হলেই কেটে ফেলবো। খামোখা তেল, তোমার শ্রম সব নষ্ট'।
-'তা
বলে অপরিষ্কার হয়ে থাকবি'?
গজ গজ করতে করতে মা দিদির চুলের পরিচর্যা করে। কেঁদুলি কথা মোটামুটি শুনতে পায়। ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে বাকিটা বুঝতে পারে। কেঁদুলিরও চুল বেঁধে দেয় মা। ধীরে ধীরে। মা ভাবে ব্যথা লাগলেও তো এ মেয়ে প্রকাশ করতে পারবে না। কিন্তু কেঁদুলির ইচ্ছে করে মা দিদির মত করে চুল আঁচড়ে দিক। একটু লাগুক। মায়ের আঁচলে ও গিঁট পাকাবে। না-স্বাভাবিকরা স্বাভাবিকদের জগতে এত বেমানান কেন?
কেঁদুলির
স্কুলও দিদির মত নয়। 'ড্রেস' নেই। একটা এক চালার ঘরে নীল চুড়িদার পরা একটা দিদিমণি
আসে। অক্ষর শেখায়, পড়া বোঝায়। কেমন যেন অন্যরকম লাগে ওর।
একবার
দিদির স্কুলে গিয়েছিল কেঁদুলি। সারি সারি রং। লাল-সাদা পোশাক সকলেরই। হইচই। হুল্লোড়।
কত্ত কথা। কেঁদুলি কিছুই বুঝতে পারছিল না। শুধু বুঝেছিল ওই শব্দের পৃথিবীতে বড়ই বেমানান।
নৈঃশব্দেরাই ওর বন্ধু। ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে উঠলো ওর ভাষাহীন শব্দেরা।
স্কুলের গোপালকাকু যেদিন ওর সবুজ ফ্রকের ভেতর নিঃশব্দে হাত ঢোকাতে যাচ্ছিল, কেদুলির দাঁতের দাগ গোপালকাকুকেই চিৎকার করতে বাধ্য করেছিল। বাড়ি এসে একভাবে ঠায় বসেছিল ও। চোখ জলশূন্য। মা সেদিন আঁচল এগিয়ে দিয়েছিল। গিঁট পাকানোর জন্য। কেঁদুলি সেদিন ছুঁয়েও দেখেনি মায়ের আঁচল। বাড়ি এসে একা ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর ভেতরে তখন কথারা উৎসব করছে। যন্ত্রণার উৎসব। তোলপাড় হচ্ছে নৈঃশব্দ। সেই নৈঃশব্দদের কোথায় গচ্ছিত রাখবে ও?
ওর
বাড়ির সকলে ভেবেছিলো অসহায়তাই বোধহয় ওর 'প্রকাশ' কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু কেঁদুলির
ভেতরে তখন অনুভূতির ঝড় উঠেছে। বোঝা-না-বোঝার ঝড়। ওর বৃষ্টি দরকার।
একটা বৃত্ত। তাতে আটকে পড়েছে কেঁদুলি। অসহায়তা, করুণা সব যেন ওর চারপাশে নৃত্য করছে। একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের প্রয়োজন। কাঁধে কাঁধ রাখার ছায়া প্রয়োজন ওর, যেটা হবে কেঁদুলির নিশ্চিন্দিপুর। তেমন জায়গা কই? বৃষ্টিরা কোথায়?
দু'দিন
পর দরজা খুলল মেয়েটা। বাড়ির সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ওর হাতে একটা গোলাপী রঙের জামা।
হলুদ আর লাল সুতো দিয়ে তার উপর ফুলের নকশা কেটেছে কেঁদুলি। ফুলের পাশ থেকে ডাল-পালা
বেরিয়েছে। কচি-কচি পাতা তাতে। ঠিক জীবনের মত। সব সময় নতুন নকশা আঁকা হচ্ছে।
ছোট্ট গ্রামে এক অসহায়, মূক কিশোরীর প্রতি অশোভন আচরণের কথা চাপা থাকে না। 'আ-হা', 'উ-হু', 'কি হলো' এমন সব চাউনি চোখে নিয়ে অনেকেই দেখা করতে এলো কেঁদুলির সঙ্গে। ও প্রত্যেককে একটা করে রুমাল দিল। নকশা আঁকা রুমাল।
কেঁদুলির বাবা কলকাতা থেকে কাপড় এনে দেয়। তাতে নকশা আঁকে ও। তারপর নিজেই সে সব বিক্রি করে।
দিদির বিয়ে। সকলে ব্যস্ত। হইচই, হুল্লোড়। তবে কেঁদুলির আর কষ্ট হয় না কথাদের ভিড়ে। ওর চোখে-মুখে হাসি। শুধু মায়ের মুখে চিন্তার রেখা। অতিথিদের বিলাপ, ‘তোমাদের ছোট মেয়েটার যে কী হবে!’ কেঁদুলির কানে এসেছে কথাটা। মনে মনে হেসেছে ও। আয়নায় নিজেকে দেখে সে। যৌবন ঘিরে ধরেছে ওকে। ততটাই সুন্দর হয়েছে ওর নকশা আঁকার হাত। দিদির বিয়ের পর মাকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছে কেঁদুলি। একটা গাছের নকশা আঁকা। সবুজ গাছ। দৃঢ়। বলিষ্ঠ তার কান্ড। মাটির গভীরে মূল। অবিকল ও নকশায় ফুটিয়ে তুলেছে। বাবা-মা আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে। কেঁদুলি খুঁজে পেয়েছে নিশ্চিন্দিপুর। একাকীত্বে। বলিষ্ঠতায়। দৃঢ়তায়।
দারুন concept
উত্তরমুছুন