বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 

ম্যানারিজিম - স্বল্প সময়ের নির্ভীক ভাষ্য




 

ম্যানারিজম – স্টাইল না মৌলিক শিল্পশৈলী

যখন নিজেও প্রথম ম্যানারিজমের প্রতি আকৃষ্ট হই একই সঙ্গে অজস্র প্রশ্ন ভীড় করে এসেছিলো যার থেকে অবশ্যম্ভাবী মুক্তি পেয়েছিলাম ইউরোপীয় শিল্পকলার আদি পর্যায়গুলোর অধ্যয়নের মধ্য দিয়েই আর তাই এই লেখারও প্রথম খন্ডে রেনেসাঁ ও তৎপরবর্তী সময়কে সুবিন্যস্ত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। এর একমাত্র কারণই হলো কল্লোল যুগকে যেমন রবীন্দ্র যুগ ব্যতীত ধরা যায় না, সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব যেমন মহাবিদ্রোহের প্রভাব ব্যতীত একপেশে,  আবার রামপ্রসাদ, রজনীকান্ত ব্যতীত বাংলা কবিতা-গানও অসম্পূর্ণ। ঠিক তেমনি ম্যানারিজমকে কখনোই আলাদা সময়কাল হিসেবে প্রকাশ করলে তার যথার্থতাকে ধরা সম্ভব হয় না। ম্যানারিজম এমনই এক সন্ধিকালের সাক্ষ্য বহন করে যা নিয়ন্ত্রিতই হয়েছে পূর্ববর্তী রেনেসাঁ শিল্পীর চিত্রকলা দ্বারা। আবার এই ম্যানারিজমই প্রথম আঘাত এনেছিলো প্রকৃত অর্থে সুশৃঙ্খলিত চিত্র শৈলীর মনস্তত্বে এবং প্রশস্ত করেছিলো বারোক শিল্পের পথ চলাকে। যার হাত ধরেই পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপ পুনরায় চিত্রকলার ইতিহাসে আধুনিকতার নতুন সংজ্ঞা তুলে ধরতে সক্ষম হয়। রেনেসাঁ পরবর্তীকালে চিত্রকলার পথ হাঁটাটা খুব সহজ ছিলো না। পূর্ববর্তী অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পীদের কাজের সঙ্গে তাদের তুলনার সন্মুখীন হতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এই ক্রোধ, জ্বালা, আত্মগ্লানি জন্ম দিয়েছে অদম্য এক ছক ভাঙার ইচ্ছা। ‘ম্যানারিজম’- এই স্বীকৃতি বা বিশেষায়ণ তারা লাভ করেন অনেক পরে- বিংশ শতাব্দীর দোড় গোড়ায় এসে। মূলত এই সময়কাল অবহেলিত ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এক বিছিন্ন সময়ের মোড়ক। যাকে বিংশ শতাব্দী খুঁজে বের করলো কিন্তু ঠিক একই সঙ্গেই ইতিহাসের নিয়ম মেনে শুরু হয়ে গেল মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য দেওয়ার কাজটিও। কিছুদিন ধরে চলল ম্যানারিজমের স্তব,  কিন্তু এসব কিছু পেরিয়ে নানান বিতর্ক বিভ্রান্তি ঠেলে সরিয়ে ম্যানারিজমের স্বল্প  পরিধি দমকা হাওয়ার মতোই দাপুটে ও স্বকীয়।

ছবির ইতিহাস তো কখনো সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক পটভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তা মানুষের সামাজিক পথ চলার ইতিবৃত্তের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে সম্পর্কযুক্ত। চিত্রকলার পরিবর্তন, ম্যানারিজমের উৎপত্তি ও তার নিজস্বতা তাই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সামাজিক পালাবদলের চূড়ান্ত প্রকাশই হলো এই পর্যায়ের ছবিগুলো। আর তাই এবার ম্যানারিজমের নানান দিকে আলোকপাত করার আগে ঘুরে দেখা যাক তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থাটিকে।

হাই রেনেসাঁ শিল্পীদের উৎকর্ষতার পিছনে ছিলো ক্যাথলিক চার্চগুলোতে ফেস্কো আঁকার কমিশন ভিত্তিক কাজগুলো, ফলে আর্থিক সংগতির পাশাপাশি ছবিতে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ছিলো সহজসাধ্য। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপীয় সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা এক আমূল পরিবর্তনের সামনে এলো। পঞ্চদশ শতকে মানবতাবাদী চিন্তা ভাবনার প্রাধাণ্য রেনেসাঁর উন্মেষ ঘটলে তার প্রভাব খ্রীষ্টধর্মের ওপর সরাসরি আছড়ে পড়ে। মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে (১৫১৭ খ্রীঃ) ক্যাথলিক মতবাদের পাশাপাশি উঠে আসে প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ। একইভাবে প্রটেস্ট্যান্টদের বর্ধিত প্রভাবের মুখে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ১৫৪৫ খ্রীঃ থেকে ক্যাথলিক সমাজও তৎপর হয়ে ওঠে ফলে খ্রীষ্টধর্মে আধাত্মিকতা ও ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে দুটি সুস্পষ্ট বিভাজন স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয় - ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট নামে। একই সঙ্গে এই সময় মানবতাবাদের প্রসারের ফলে উন্মুক্ত চিন্তাভাবনা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নতুন দেশ আবিষ্কারকে যেমন উৎসাহিত করে, তেমনি বিজ্ঞান ও আবিষ্কার পূর্ববর্তী  ধারণার গোড়ায় আঘাত আনে। যার অন্যতম, এ সময়ে কোপারনিকাসের তত্ত্ব। ক্যাথলিক প্রভাব ক্ষুণ্ণ হওয়ায় চার্চের প্রতিপত্তি হ্রাস পায় ফলে ভাবনায় মুক্তি আসলে ও ছবি আঁকার ব্যবহারিক দিকটি কিন্তু পড়ল চরম সঙ্কটের মুখে। এরই মধ্যে ১৫২৭ খ্রীঃ মেডিসি বংশের আধিপত্য চালর্স পঞ্চম অধিগ্রহণ করেন এবং এই নতুন রাজবংশ চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক না হওয়ায় শিল্পের জগতে প্রথম ব্যক্তিগত উদ্বেগের যুগ সূচিত হলো। যার ফলে একদিকে যেমন ভাবনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা প্রকট হলো তেমনি কল্পনা ও ট্রিটমেন্ট খুঁজে নিলো অবসম্ভাবী মুক্তির পথ।

সময়টা ছিলো বিংশ শতকের প্রথম দিকে, যখন খুব গভীরভাবে অধ্যয়ন শুরু হয় এল গ্রেকোর কাজের। আর তাঁর হাত ধরেই চিত্রে যে সুপ্ত আধুনিকতার বীজ রয়েছে তা ম্যানারিজমের মধ্য দিয়ে পুর্নরাবিষ্কার করেন চিত্রসমালোচকরা। ম্যানারিজম  শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ইটালীয়ান শব্দ ‘Maniera’- থেকে, যার ইংরাজী প্রতিশব্দ হলো ‘স্টাইল’। মূলত ম্যানারিজম সাহিত্যের থেকে আহৃত হলেও চিত্রকলায় যখন এর উল্লেখ হয় তখন তা ইতিহাসের সেই ‘প্যাচ অব টাইম’-কে চিহ্নিত করে যা প্রাথমিকভাবে Anti-Classical বা ধ্রুপদী বিরুদ্ধ অথবা Anti Renaissance বা নবজাগরণ পরিপন্থী বলা হলেও, যত বিষয়টির গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেছি, অধ্যয়ন ও তুলনামূলক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে আমার মনে হয়েছে যে ইউরোপীয় আর্টের অবজেকটিভিটির প্রচলিত ঘরানাকে নতুনভাবে ম্যানারিজম যে সকল  বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত করেছে এবং নির্দিষ্ট প্রবণতার দিকে সঞ্চালিত করেছে, তা পাশ্চাত্য শিল্পের গভীরতাকে উপলদ্ধি করতে অধিক কার্যকরী হয়।

 ১৫২০ খ্রীঃ রাফায়েলের মৃত্যুর বছর থেকে ১৬০০খ্রীঃ পর্যন্ত বারোক শৈলীর উৎপত্তির সময়কালের মধ্যবর্তী আশি বছরের সময়কালকে ম্যানারিজমের অর্ন্তভুক্ত করা হয়। রেনেসাঁর সায়াহ্নে চিত্রশিল্পে, স্থাপত্যে ও ভাস্কর্যে যে অভিনব আকর্ষক  পদ্ধতির প্রকাশ ঘটতে শুরু করে যা পরবর্তী শিল্পরীতিকে আঘাত করার মাধ্যমেই অধিক প্রকাশিত তাকে প্রারম্ভিক ম্যানারিজম বলে। সময়টা মোটামুটিভাবে ১৫২০-৩৫ খ্রীঃ। এরপর ১৫৩৫-১৫৮০ খ্রীঃ- এ যখন স্টাইল আরো স্পষ্টভাবে যুক্ত হয় তখন তাকে সনাক্ত করা হয় উচ্চ ম্যানারিজম নামে। ম্যানারিজমের সর্বাধিক গুরুত্ব এই যে তখনকার অস্থির সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় পরিমন্ডলে ন্যাচারালিজমের বিচ্যুতি ছিলো অবসম্ভাবী আর ম্যানারিজম সেখানে খুঁজে নিয়েছিলো স্পষ্ট স্টাইল, অর্ন্তদৃষ্টির গভীরতা ও সম্ভ্রান্ত প্রকরণব্যঞ্জনা।

বিংশ শতকে জার্মান চিত্র গবেষক হাইনরিক উলফলিন ‘ম্যানারিজম’- এই অধ্যায়টিকে সনাক্ত করেন যার প্রথম বিকাশ হয়েছিলো ফোরেন্সে। এরপর রোম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইতালীতে এবং মাত্র আশি বছরেই তা ইউরোপব্যাপী নিজের জায়গাকে পরিপুষ্ট করে। ১৫৩০- এ ম্যানারিজম ‘ফেঞ্চ কোর্ট আর্ট’ হিসেবে প্রাধান্য  পায়। রেনেসাঁ ও বারোকের পলির ভাঁজে পড়ে থাকা এই অধ্যায়ের সৃষ্টির আনন্দ সম্পূর্ণ বিজাতীয়। সচরাচর শিল্পে কোনো শৈলী তখনই ব্যাপকতা পায় যখন পূর্ববর্তী সময় মননে কোনো প্রভাব সঞ্চারে ব্যর্থ হয়কিন্তু এক্ষেত্রে যখন হাই রেনেসাঁ ছবিকে প্রায় সকল কিছুই দিতে পেরেছে বলে সকলেই মেনে নিয়েছেন অর্থাৎ নতুন শিল্পীদের কাছে উচ্চতার আর কোনো ফলক নির্মাণের তাগিদ থাকল না - তখনই মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো শিল্পীর ব্যক্তিগত ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ। আর এখানেই প্রথম ঘটে গেল শিল্পের দুনিয়ায় সেই আদমের নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ঘটনাটি। ক্যানভাসগুলো আধ্যাত্মিক সঙ্কটের মূর্ততার সঙ্গে বিমূর্ত মননের আশা আকাঙ্খা, ভ্রমের যাপনের, সময়ের কল্পের আদর্শ মাধ্যম স্বরূপ ধরা পড়ে গেল। যে  পাপের থেকে মানুষের নিস্তার পরবর্তীতে আর কখনোই হয় নি বা বলা ভালো মানুষ নিজেও তা কখনো চায়নি।

ম্যানারিজমের প্রাধান্য দেখা যায় ভেনিস শহরকে কেন্দ্র করে। মূলত ভেনিসে স্থাপত্যের ওপর অধিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই সময় ক্যাথলিক চার্চের প্রাধান্য  কমতে থাকায় উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কমিশন ভিত্তিক কাজের দায়িত্ব প্রাসাদে বা প্রশাসনিক কার্যালয়ের পাবলিক আর্ট হিসেবে ম্যানারিস্টদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ভেনিস শহরের আর্দ্র জলবায়ুর জন্য এখানে ফেস্কোর কাজ বেশী প্রচলিত ছিল না। টেম্পেরার বদলে এক বিশেষ পদ্ধতির মিশ্র মাধ্যম এখানে প্রচলিত হয়, যাতে চাপ চাপ করে তেল রঙের আংশিক শুকিয়ে আসা পরতের ওপর নতুন রঙ চাপিয়ে উজ্জ্বল ও অধিক তীব্র আলোর প্রতিফলন যোগ্য পদ্ধতিকে ব্যবহার করতে শুরু করেন যা অ্যাল্যাপ্রিমা (allaprima) নামে পরিচিত। সরাসরি ক্যানভাসে রঙের ট্রিটমেন্ট ছবিগুলোকে রেনেসাঁর নরম মনোরম রঙের ছবিগুলো থেকে আলাদা করে তোলে। এছাড়া স্থাপত্যে ম্যানারিজম ভেনিস শহরের প্রসাদ্গুলিতে নতুন পরিপ্রেক্ষিত যুক্ত করতে সফল হয়েছিলো, ফলে রোম ও ফ্লোরেন্সের স্বেচ্ছাকৃত আঘাত সঞ্চারকারী কাজগুলোর থেকে ভেনিসীয়ান রীতি ছিলো অনেক বেশী স্বতঃফূর্ত এবং স্বাধীনচেতা।

 

1 টি মন্তব্য: