রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


ঘুম আসছে কিন্তু আসছে না                       

ঘুম সছে না বেশ নেকদিন ধরেই ঘুম আসছে না প্রতিরাতে বালিশ মাথায় বাইরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকছি জানলার ওপাশে অন্ধকার, তার ওপাশে আরো বাড়ি, ছোট বড় বাড়ির ভিতরে লোকজন, সবাই ঘুমাচ্ছে শুধু আমার চোখ দুটো খোলা ঘড়ি দেখতে হবে, কিন্তু সব ঘড়িগুলো তো বন্ধতার মানে কি এবার শেয়ালের ডাকের আশায় বসে থাকতে হবে, এক প্রহর, দু’প্রহর? পাশের বাড়ির গাজুর মা কি এখন উঠে পড়েছে? যদি ভোরের দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে তাহলে তার উঠে যাবারই কথা। না হলে শুয়ে থাকবে। মোড়ের মাথায় কয়েকদিন আগেই একটা মোমবাতি জ্বেলে কয়েকজন তাস খেলছিল। পুলিশ এসে পিটিয়ে ঘরে পাঠায়। ভোর হয়ে গেলেই তো গাজুর মায়ের দরজায় লাইন পড়ে যায় একে একে সব হানাদার এসে ভিড় করে, তাদের সবার বাড়িতে পরিবার আছে, বৌ আছে, তাও গাজুর মায়ের গায়ের গন্ধ না পেলে ওদের চায়ের স্বাদ আসে না

-গাজুর মা তো বিধবা, তাও লাইন?

লাইন বলে লাইন, প্রথমে দিলু ঘোষ, তারপর অনিল কামার, তারপর মুখার্জী

-মুখার্জী কিন্তু অনেকদিন ধরেই ওর পিছনে পড়েছিল, তখন গাজুর বাবা বেঁচে ছিল এমনকি জলকলের মাঠে পাড়ার অনেকেই ওদের দুজনকে হাত ধরে ঘুরতে দেখেছে

সেই কষ্ট পুষে রেখেই তো মুখার্জীর বউটা অকালে মরল, গাজুর বাবা মরল, অথচ মুখার্জী ও গাজুর মা বেশ বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে  

-তার মানে বেঁচে থাকবার জন্যে এরকম এক্সট্রা ম্যারাইটাল কিছু প্রেম লাগবে, অন্তত পক্ষে এই বেশি বয়সে বুঝলে ভায়া, ‘ন পুণ্যাং ন পাপং ন সৌখ্যনং ন দুঃখনং, ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা না যজ্ঞাঃঅনলি প্রেমাং কথাগুলো ক্লাবের খগেনদা দিব্যি একভাবে বলে গেলআমি শুনে ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘তাহলে তো কোন ঝামেলাই থাকল না গাজুর মা, বা মুখার্জী কেউই কোন খারাপ কাজ করে নি

কিন্তু তার জন্যে আমার কেন ঘুম এল না বুঝতে পারছি না।

উল্টোদিকের মানসীদির ঘরটা অন্ধকার।এইতো মাত্র কয়েকবছর আগে আমার আর  দিদির রাত জাগার প্রতিযোগিতা চলত। একবার আমি জানলা সরিয়ে দেখতাম, একবার দিদি। ব্যাপারটা অবশ্য জেনেছিলাম বেশ কয়েকটা মাস পরে। সেদিন রাস্তাতে দেখা হতেই আমাকে রাত জাগার কথাগুলো বলে। আর কিছু কথা বলা হয় নি। পিছনে রূপম ছিল, দিদিটার পিছনে লেগে ছিল। একবার স্কুল থেকে আসার সময় মারামারিও হয়ে গেছিল। আমাকে সাক্ষী রেখে অনেক কিছুর সমীকরণ হল।  কিন্তু শেষপর্যন্ত স্কুলের বাইরে চটপটি বিক্রি করত সেই বাবুলাল আমাকে এই সব থেকে সরে থাকতে বলেছিল। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আমি সরে গেছিলাম, কারণ কিছু সময় সরে থাকলেই ভালো থাকা যায়।

–তুমি আবার কি আরম্ভ করলে বলো তো, আবার জেগে বসে আছো? 

-বৌয়ের কথাগুলো অন্ধকারের মতই পাশ থেকে কানে ঢুকল। জেগে গেছে নাকি? তার মানে একটা অর্ধনগ্ন অন্ধকার আমার পাশে, ঠিক যেন ঐ আকাশটা। আচ্ছা আকাশের ঘুম হয় না, নাকি আমার মতই ইনসোমেনিয়াতে ভুগছে? কয়েকদিন  আগেই ডাক্তার দেখাতে গেছিলাম। ‘বেশ তো আছেন, কেন শুধু রোগ রোগ করেন?’

ধমকে দিলেন আমায়। তার মানে কি আমি মেজ জ্যেঠিমার মত হয়ে যাচ্ছি। সারা জীবন একটা অদ্ভুত ও উদ্ভট জীবন যাত্রার মধ্যে দিয়ে গেল। সারা বছর ঠিক আটটার সময় ঘুম থেকে উঠত, তারপর শুতে শুতেও সেই বারোটা। তাও সব সময় রোগ রোগ ভাব। এক্কেবারে মারা যাবার আগে পর্যন্ত একভাবে চালালো। কেউ বলবার ছিল না। শেষকালে বিকাল পাঁচটার সময় ভাত খেত। কিন্তু জীবনটা তো চালিয়ে নিল।

‘জীবন চালানো মানেই বেঁচে থাকা নয়, যে জীবন শুধু খাবো আর ঘুমাবো সেটা মানুষের না, পশুর জীবন।’ 

কথাগুলো একবার স্কুলে পড়তে এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন। আমি শুধু শুনে গেছিলাম তা নয়, আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম কীভাবে সময়টাকে জীবন করা যায়।  অনেক রাত জেগে পড়তাম। ঘুম পেলে চোখে তেল লাগাতাম, জল দিতাম, চা খেতাম, তারপর দুটো আড়াইটে তিনটে।

–পড় পড়, বেশি করে পড়, তোর বাপের টাকা নেই, কোন সরকারি কবজও শরীরে ঝুলিয়ে রাখিস নি যাতে ভর্তির সময় কম নাম্বার লাগবে, কম টাকা লাগবে। লড়াই করেই দাঁড়াতে হবে।

মায়ের কথাগুলো যত মনে পড়ত তত পড়তাম, কিন্তু লাভ হল না। আমার এক সরকারি কবজ ধরা বন্ধু কী সুন্দর একই রেজাল্ট করবার পরেও ভালো জায়গায়  পড়তে সুযোগ পেল, এখন আবার একটা সরকারি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। কয়েকদিন  আগেই কথা হচ্ছিল। অনেক কথার মধ্যে বলল, ‘বুঝলি, লোনের একটা পারসেনটেজ পাই, তা সে যে লোন হোক, আর অ্যাপ্লিকেন্ট কোন মেয়ে হলে তাকে একটু বেশিবার আসতে হয়।’

আমি শুধু শুনে গেলাম, আমার তো সে সুযোগ নেই। সুযোগের অভাব মানুষকে চরিত্রবান তৈরী করে, সৎ করে, এবং ভীতুও করে।

মাথা নিচু, ঘাস ফুসের জীবন। না এবার ঘুমাতে হবে, আর দেরি করলে কাল সকালে উঠতে পারবো না। এমনিতেই কাজের খুব চাপ। দুপুরবেলার দিকে এমনিতেই ঘুম আসে, তারপর রাত জাগলে তো কথাই থাকবে না। তার থেকে ভালোয় ভালোয় শুয়ে পড়ি। কিন্তু চোখ দুটো দু’ হাত দিয়ে বন্ধ করতেই কারা যেন সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল।

বন্ধ চোখেই জিজ্ঞেস করলাম,‘তোমরা কারা? তোমরা কি হাঁটছো, তোমাদেরই দেহ কি রেল লাইনে, তোমাদের শরীরে ঘাম আর ভাতের গন্ধ মিশে আছে, তোমাদের পায়ের নিচে এই দেশের মানচিত্র আঁকা রয়েছে?’

কোন উত্তর নেই, কেই বা উত্তর দেবে? সবাই ছুটছে, একমুঠো ভাত, কয়েকটা পোড়ারুটি, একটু বাসি তরকারি।  কয়েকদিন আগেই দেখলাম মৃত মায়ের দেহের চাদর সরিয়ে মৃত্যু দেখছে একটা বাচ্চাছেলে। মেয়ে মারা যাবার জন্যে অপেক্ষায় বসে আছে বাবা মা, একটা পেট তো কমে যাবে। চোখে ঘুম থাকলেও দুটো কানে আসছে, ‘একটু ভাত দেবে, একটু ফ্যান দেবে?’

মামার বাড়িতে সরস্বতী পুজোর পরের দিন গোটা সেদ্ধ, সকাল থেকে বাড়ির  দরজায় দরজায় বড় বড় হাঁড়ি নিয়ে সবাই চলে আসত। সকাল থেকেই শুনতে পেতাম, ‘একটু গোটা দেবে...’ 

আচ্ছা পেটের এই ক্ষিধের কোন ব্যাকরণ হয়? কোন বাক্যরচনা, পদ পরিবর্তন?

–তুমি আলো বন্ধ করে জেগে শুয়ে থাকো। আমাকে ভোর থাকতে উঠতে হবে, তোমার এই খ্যাপামির জন্যে আমার ছেলে মেয়েগুলোতো আর সাফার করবে না।

-হ্যাঁ, কথাগুলো আমার মিসেসই বলল। আমি বলতে পারলাম কই, ‘নিঃশব্দ হও, নিস্তরঙ্গ হও, নিস্পন্দ হও।’

‘যে নারীর হুল নেই, কাঁটা ফোটাতে পারে না, তার রূপ যতই থাকুক না কেন, দুদিনেই সে পুরুষের চোখে পুরনো হয়ে যায়।’

একবার একটা লেখাতে পড়েছিলাম। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। এমনকি নিজের ঘুমটাকেও না। আচ্ছা ঘুমটাকে কি নারী হিসাবে ধরা যায়? যেমন ভাবে কোলে নিয়ে মায়ের মতন শান্তি দেয়, অথবা বউয়ের মত তৃপ্তি? শোষণ করা চৈতন্য শক্তি, চিৎ শক্তি।

এই যে শরীর দুর্বল হচ্ছে, আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, তার মানে কি আমি ঘুমাবো? আমার শরীরের সাথেই গুটি বাঁধা, সেই একটা দ্বীপ, আমি একা। ঘুমের জন্যে একাকিত্বের প্রয়োজন। এবার ঘুমাচ্ছি। তোমরা যারা হাঁটছো, খেতে পাচ্ছো না, অথবা বেশি খাচ্ছো, ছিনিয়ে নিচ্ছো সব কিছু, তাদের সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েই ঘুমাচ্ছি, কারণ এখন সরে থাকলেই ভালো থাকা যায়, ঘুম তো জেগেও হয়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন