ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(১৬)
কয়েকদিন বেশ বিমনা ছিল শোভন, যেন অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। কিন্তু ক্লেশ ছিল না। খাওয়া-ঘুম
এসব নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়নি। লিপিকা হাউস-ফিজিশিয়ানকে ফোন করেছিল। উনি এসে পরীক্ষা
করে অভয় দিয়েছিলেন,
--সবই মোটামুটি নর্মাল দেখছি। যেমন আছেন থাকতে দিন। চিন্তার কিছু নেই। চাইলে সাইকোলজিস্ট
কন্সাল্ট করতে পারেন। অবশ্য কিছুদিন ওয়েট করে দেখুন।
‘চিন্তা নেই’ বললেই কি চিন্তা থেমে থাকে? অদৃশ্য সুতোর মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে। কী এমন বয়স হয়েছে মানুষটার? উঠতে, বসতে, কাজের মধ্যে থেকেও অশান্তি খোঁচা মারে লিপিকার বুকের মধ্যে—কিছুতে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। বাবুল ফোন করে খবর নেয়। মায়া হয় ছেলেটার জন্যে। সংক্ষেপে কুশল জানায়, কাজে মন দিতে বলে। বর-ছেলে দুজনেই বড়ো নরম, বড়ো ভালোমানুষ, রাগ করা যায় না। ইদানিং তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এমন কেউ নেই যার কাছে মনের ভার নামিয়ে দেওয়া যায়। মা-র কথা মনে পড়লে মন হু-হু করতে থাকে। জীবনে তেমন জটিল সমস্যা কখনো আসে নি। মা-কে সংসারের হাবিজাবি বলে ব্যতিব্যস্ত করে নি কোনোদিন। তবু মায়ের পাশে গিয়ে বসলে আরাম লাগত। মা রান্নাঘরে ঢুকে নিজের হাতে চা বানিয়ে এনে দিত। সচল মানুষ কেমন আচমকা ‘নেই’ হয়ে গেল। চোখ মুছে লিপিকা সংসারে প্রবৃত্ত হতে চায়। দীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবেছে, মন থেকে সায় পায় না।
শোভন শিশুর মতো আঁকড়ে থাকে বাবুলের দেওয়া ড্রইংখাতা আর রঙের বাক্স। লিপিকা পাতাগুলো খুলে দেখেছে। সেই ছবিটার পরে কীযেন অসম্পূর্ণ স্কেচ—সে বুঝতে না পেরে রেখে দিয়েছে।
দুপুরশেষে কাপড়-জামা ভাঁজ করছিল লিপিকা, হঠাৎই শ্রুতি এসে হাজির। ওবাড়িতে যাওয়া দূরের কথা, ফোন করাও বন্ধ করে দিয়েছে লিপিকা। দরজা খুলে ভীষণ চমকে ওঠে, বিশেষ স্বস্তিও পায় না। শ্রুতি! শেষ কবে এবাড়িতে এসেছে মনে নেই। সঙ্গে একটি ছেলে, মাথায় ঝুঁটি। কেমন যেন চেহারাটা, পছন্দ হয় না। জোর করে ঈষৎ হাসে লিপিকা। আবেগ না দেখিয়ে বলে,
--আয় মাম্পি, বোস। বাড়িতে সব খবর ভালো তো?
শ্রুতি এসে সোফায় বসে, জল চেয়ে খায়। ঘরের চারপাশে নজর বুলিয়ে দুঃখীমুখে হাসে,
--ঈস, কী নীটলি সাজিয়েছো!
লিপিকা পাশে-বসা ছেলেটিকে অনুপুঙ্খ লক্ষ করে। কেমন অস্থির চাউনি, ভালো লাগে না।
সে নিজেকে প্রবোধ দেয়, কতক্ষণ আর বসবে ওরা? প্রায় একইসঙ্গে ভাবনা আসে, বাড়ি চিনে গেল
যে! আবার আসে যদি? সে তখন দেখা যাবে ভেবে, আপাতত চিন্তা চাপা দিয়ে শ্রুতিকে বলে,
--কী খাবি চা না কফি?
শ্রুতির চোখে সজল ছায়ার মতো ভেসে যায়। কুণ্ঠিতস্বরে বলে,
--যা খুশি দাও। আর—,
--কী হয়েছে?
--ঘরে কিছু থাকলে খেতে দাওনা মাসিমণি। বাড়িতে ক-দিন—।
গলা ধরে আসে, নাক টেনে চুপ করে যায়। বিস্মিত হয়ে তাকায় লিপিকা, প্রশ্ন করে না।
বেশ রোগা হয়েছে মেয়েটা, মুখখানাও শুকনো। সঙ্গী ছেলেটা মাথা নীচু করে বসে হাঁটুদুটো
জোরে জোরে নাড়াচ্ছে। লিপিকা কিচেনে ঢুকতে গিয়ে থেমে জিজ্ঞেস করে,
--তুমিও খাবে তো? কী নাম, জানা হয়নি।
--অর্জুন, অর্জুন মণ্ডল। না না মাসি আমি খাবো না।
মাম্পিকে পরোটা ভেজে সকালের বানিয়ে রাখা তরকারি গরম করে দেয় লিপিকা। সঙ্গে দুজনের
জন্যে চা আর ওমলেট। শ্রুতির একমনে খাওয়া দেখে মায়া হয়। কে জানে এমন কী ঘটেছে যে মেয়েটা
খাওয়া-দাওয়া করছে না। চা দিয়ে আসে শোভনকে। শোভন বলে,
--ড্রইংরুমে বসি চলো।
--বোসো না এখানেই!
শোভন বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে। চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
--গলা পাচ্ছি। কেউ এসেছে নাকি?
--হ্যাঁ মাম্পি।
--কে? মাম্-পি! দেবীর মেয়ে? দেখা করবো না?
সে জবাব দেওয়ার আগে ঠুকঠুক করে দরজায় টোকা দেয় শ্রুতি। ভেতরে আসার অনুমতি চায়।
অনিচ্ছাতেই লিপিকা সম্মতি দেয়। সে ভেতরে এসে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। মেশোকে দেখে, পাতলা
চেহারার শান্ত মানুষ। কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, গায়ে পাতলা চাদর। শ্রুতির কেমন বড্ড
আপন লাগে। জানতে চায়,
--ভালো আছো মেশো? কতোদিন পরে দেখলাম তোমায়।
--ভালো আছি। তুমি—তুই—তোরা সকলে ভালো তো? আয় বোস।
শোভন আগ্রহ করে সরে বসে বিছানায় বসার জায়গা করে দেয়। শ্রুতির চোখ আবেগে ছলছল করে
ওঠে, বাবুল কী লাকি! এমন মা-বাবা পেয়েছে।
--তোর বন্ধু একা বোর হবে না?
লিপিকার স্বরে যেন আপত্তি। শ্রুতি মাসির মুখের দিকে তাকায়, খানিক সন্ত্রস্ত গলায়
বলে,
--আমরা বেশীক্ষণ থাকবো না মাসিমণি।
বিব্রতবোধ করে লিপিকা, দোলাচলে পড়ে যায়। কী বলবে ভেবে গুছিয়ে বলে,
--তোর এদিকেই অফিস? সেক্টর ফাইভে?
--হ্যাঁ কন্ট্রাক্ট-বেসিসে কাজ করছি কয়েকমাস। আমার পেইন্টিং-এর একজিবিশন-এর ব্যাপারও—এদিকে
কয়েকজন বন্ধু মানে কলীগস্ আছে আর কী।
মন দিয়ে শুনছিল শোভন। হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে বলে ওঠে,
--তাই নাকি? একজিবিশন? এতো ভালো আঁকিস তুই? আমাকেও না বাবুল খাতা-রঙ কিনে দিয়ে
গেছে। একটু আঁকি। তবে—,
--কোই দেখাও।
--দ্যাখ তুই, আমি ওঘরে গেলাম।
লিপিকা বেরিয়ে গেলে বালিশের তলা থেকে খাতাটা টেনে বের করে দেয় শোভন। পরম যত্নে রাখা খাতা। শ্রুতি সাবধানে পাতা ওলটাতে থাকে, মন দিয়ে দেখতে থাকে। হোটেলের ছবিটা পুরোপুরি আঁকা হয়েছে। বাকি দুতিনটে অর্ধসমাপ্ত স্কেচ। একটাতে শুধু গোটাকয়েক লাইন-টানা। শ্রুতি দেখতে দেখতে উৎসাহ দেয়,
--প্রথম ছবিটা সুন্দর হয়েছে মেশো। কালার-কম্বিনেশনও ভালো। লাল ইটের দেওয়াল, নীল
জানালা, ব্রাউন আর সবুজ ব্যাকগ্রাউণ্ড চমৎকার ইউজ করেছো। কিন্তু বাকিগুলো শেষ করো নি
কেন?
শোভন আচমকা চুপ হয়ে যায়, চোখ স্থির হয়ে যায় দেওয়ালে। সে হারিয়ে যেতে থাকে। শ্রুতি
কিছু না বুঝে বেশ অবাক হয়ে তার হাতে ছোট্ট ঠেলা দিয়ে ডেকে ওঠে,
--কী হলো! বাকিগুলো শেষ কোরো, কেমন? আমি যাই এবারে?
অর্জুনকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে ড্রইংরুমে বসে লিপিকা। দু-একটা সাধারণ কথা বলতে গিয়ে মনে হয় ছেলেটা হয়তো খারাপ নয়। বয়সে হয়তো মাম্পি বা বাবুলের চেয়ে কিছুটা ছোটোই হবে। মাম্পির বয়ফ্রেণ্ড কি? জিজ্ঞেস করা যায়না। অর্জুন বলে,
--একটা কথা বলবো মাসি?
--হ্যাঁ, কী?
--মাম্পি আপনাদের বাড়িতে থাকতে পারে?
--এখানে!?
--হ্যাঁ অন্তত—ক-টা সপ্তাহ যদি—!
স্পষ্টতঃই লিপিকার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। ঠোঁট টিপে রাখে, মন্তব্য করে না। মাথার মধ্যে
নানারকমে হিসেব-নিকেশ চলতে থাকে। মাম্পি এখানে থাকলে ছেলেটার আসতে সুবিধা হয় হয়তো!
এরপর একদিন দেবিকা, তারপরে কৌশিক—এক এক করে—! ভেতরে শিউরে ওঠে সে, একটু রুক্ষভাবে জিজ্ঞেস
করে,
--তুমি কোথায় থাকো?
--আমি কেষ্টপুরের দিকে।
--ও!
--আপনি যা ভাবছেন তা নয় মাসি, আমি আর এখানে আসব না। আজ ওকে জোর করে নিয়ে এলাম।
আসলে শ্রুতির বাড়িতে—ওর বাবা-মাকে তো আপনি জানেন—! ও ভীষণ মেন্টাল প্রেশারে আছে। খুব
চাপা তো, কারো কাছে ওপন-আপ করে না। উল্টোপালটা কী করে ফেলবে সেটাই ভয়। সেজন্যেই আর
কী—!
ছেলেটা মাথা নীচু করে ফেলে। বলি-বলি ভেবেও বলা হয় না লিপিকার। শ্রুতি এসে দাঁড়ায়,
ভীষণ তাড়াহুড়োয় বলে,
--এ্যাই ওঠ ওঠ! অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কী ভ্যাজাচ্ছিলি রে? বোর করছিলি মাসিমণিকে?
আচ্ছা মাসিমণি, মেশোর শরীর ঠিক আছে তো?
--মাম্পি শোন—!
--আজ আসি গো। অনেকটা যেতে হবে। পরে ফোনে কথা বলবো। অর্জুন চল।
বলার সুযোগ না দিয়ে ছেলেটার হাত ধরে প্রায় ওঠায় শ্রুতি। ছেলেটা মিনতি-মাখানো দুচোখ
লিপিকার মুখের ওপরে ফেলে দরজা শ্রুতির পেছন-পেছন বেরিয়ে যায়।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন