সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

রাজেন্দ্র দানী

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

 

রাজেন্দ্র দানীর গল্প   

                        

(অনুবাদ : মিতা দাশ)




 

লেখক পরিচিতিঃ রাজেন্দ্র দানীর জন্ম ১৯৫৩ সালের ১১ফেব্রুয়ারী। তিনি থাকেন মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। তিনি ইতিমধ্যেই হিন্দি গল্পকার রূপে বিভিন্ন স্থানে সম্মানিত হয়েছেন। তেরোটি গল্পের বই এবং একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।

 

এইভাবে বলে না  

কালিদাস বেশ গম্ভীর ও ভরা মন নিয়ে কমরেড বর্ধনের শোক সভা থেকে ফিরে এসেও দুঃখিত ছিল। সেই তখন থেকেই কালিদাসের পুরো পরিবেশটাই কেমন যেন ধোঁয়ায় ভরা ভরা মনে হয়েছিল। উনি ঠিক বুঝতে পারছিল না যে এটা কি  ওর বয়সের ছাপ বা সত্যি অন্য কিছু? কাল তো তার এইরকম কিছু মনে হয়নি তো! ওরা কেউ তো বর্ধনের বয়স অব্দি এখনো পৌঁছায়নি। কিন্তু বেশ সক্রিয় সময়েও ওদের আপসে মেলা মিশা বজায় ছিল। প্রৌঢ় বর্ধনের সঙ্গে প্রথমবার নিজের যৌবনে দেখা হয়েছিল। সে সব সময় আশ্চর্যে পড়ে যায় বর্ধনের সক্রিয়তা, যুক্তি-তর্ক, আন্দোলনে ও যাত্রায় যুবকদের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিমান ও তেজস্বিতা দেখে। এটা কোনো চোখের ভুল নয় বাস্তব, সে যেন একটা আশ্চর্য।  এখন তাঁর বয়সও প্রায় বাহাত্তর পার করছে তাই বোধহয় নিজের বিচারধারা ও সেইখান থেকে প্রেরণা পেয়ে তাঁর জিজিবিষা তাঁকে এখন অব্দি চলাফেরা করার মত সামর্থ জুগিয়েছিল। কিন্তু এ কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব, চারিদিক কেমন যেন ধূসর? সে বুঝতেই পারছেন। সময় ও বয়সের এই দ্বন্দ যা তাঁর ভেতর কেন নেই যেরকম তিনি বর্ধনের ভেতর দেখেছিলেন?

সেইসময় তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বয়স যখন কুড়ি তখন দেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা পরলোক গমন করেন। কিন্তু স্বাধীনতার মোহভঙ্গ জারি ছিল। গন্তব্য এখনো দূরে কিন্তু সেই পথে অনেক বাধা ও বিপদ বাসা বাঁধছে। সেই বাধা  বিপদ কাটিয়ে রক্তে মাখো মাখো হয়েও কেউ কোনোদিন কোনো সাথীদের মাথায় দোষ চাপায়নি। জানা নেই কত ভয়ানক বাধা বিপত্তি পার করেও ওদের বিচারধারা থেকে মোহভঙ্গ হয়ন। এই রকম দৃঢ়তা ও সংকল্প সেই সময় সবাইকার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। এ সব তখনও টিকে আছে যখন সব দিকে প্রতিবদ্ধতার অর্থ প্রায় ঘুচেই গেছে। তিনি বুঝতেই পারছেন না যে এটা ভ্রম নাকি ধোঁয়া বা বয়সে চোখ ধাঁধাচ্ছে। চশমা তো সেই কবে থেকে ব্যবহার করছেন, নম্বর কি এক দিনেই বেড়ে গেল! তিনি নিজেকে নিজেই উপহাস করলেন আর নিজেকেই সম্বোধন করে বললে্ন - না না, এটা শুধুমাত্র ভ্রম, আর কিছুই না।

নিজের বিচারধারা প্রতি তিনি যত সচেতন ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে কিন্তু তাই বলে তিনি নিজের পরিবারের কারুর উপর সেই বিচারধারাকে মানার জন্য জোরও করেননি বা চাপিয়েও দেয়নি। কিন্তু পরোক্ষ ভাবে তাঁর জীবনের সব অনুশাসন, বিচার বা চিন্তাধারা পরিবারের সদস্যদের মাঝে অজানা ভাবেই বয়ে যেতে লাগলো। ওদের এই অনুসরণ করাটাও স্বাভাবিক ছিল আর তিনি সেটা মানতেনও। 

তিনি এই সময়েও দুই ছেলে ও পরিবার সঙ্গে নিয়ে সংসার করতেন। লোকেরা আশ্চর্য হতো, কিন্তু তাঁর একটুও আশ্চর্যবোধ হত না। তিনি এইসব ভেবে বেশ শান্তি পেতেন ও তিনি নিজের সামন্তবাদী পূর্বজদের যুগকে পেছন ঠেলে দিয়ে নিজের পরিবার নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। খুশির এত বড় কারণ আজকাল কোথাও খুঁজে পাওয়াই যায় না। যখন বাইরের মানুষেরা তাঁদের পরিবারকে আদর্শ পরিবার বলে সম্বোধন করে, তখন তিনি বেশ গর্বিত বোধ করেন। আসলে তিনি কখনো এই আদর্শকে গড়ে তোলার জন্য কোনো প্রচেষ্টাই করেননি, কিন্তু এই রকমটা নিজে নিজেই হয়ে উঠেছিল। তাতে কোনো সন্দেহের কারণ নেই যে এর পেছনে একটি বিচারধারা কাজ করছিল, তাই এই পরিবার একটি আদর্শ পরিবার হয়ে উঠেছিল।  

এই রকম অনেক অনুভব তিনি নিজের জীবনে করেছেন তাই তাঁর নিজের বিচারধারার উপর যথেষ্ট ভরসা ও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এই যে কী একটা হল,  তিনি নিজের চোখ কচলাতে কচলাতে নিজেকেই উদ্দেশ্য করে বিড়বিড় করলেন "এ কেমন সব ঝাপসা ঝাপসা কেন? কিছুই সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছিনা কেন?" উনি একটু চিন্তিত হয়ে উঠলেন। "কাল অব্দি তো সবটাই ভালো স্পষ্ট দেখছিলাম ও ভাবনাচিন্তা ঠিক ছিল, আজ যেন সব ঝাপসা।" উনি বলে চলেছেন,  "আজব খেলা রে বাবা হঠাৎ এই ঝাপসা ভাব এলো কোত্থেকে, কাল অব্দি তো সব ঠিকঠাক দেখছিলাম চোখে। এই ঝাপসা চোখে দেখতে সব পাই,  কিন্তু কিছু ঠাহর করতে পাচ্ছি না! কোনো কিছু বুঝতেও পারছিনা, তাহলে কি এই বুঝতে না পারার জন্যই এই ঝাপসা ভাব চোখে?"

কিছুই বুঝতে না পেরে উনি বাড়িতে ঢুকেই নিজের বড়ছেলেকে নিজের কষ্টের কথা বললেন ও জিজ্ঞাসা ও করলেন,  "এক দিনেই চোখ এত খারাপ হয়ে যাওয়াটা সম্ভব কী? চশমা চোখে দিয়েও সঠিক দেখতে পাচ্ছিনা, সব যেন ঝাপসা ঝাপসা! কেন?”

ছেলে হঠাৎ কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে আশ্চর্য হয়ে উঠল। বলল, "এই ব্যাপারে ডাক্তার ভালো বলতে পারবে। তবে একদিনেই চোখে ঝাপসা ভাব আসতেই পারে, এক দিনেই তো না জানি কত কি হতে পারে।"

জবাব শুনে উনি ছেলেকে আর কিছুই বললেন না। কিন্তু উনি এক রকমের ধাক্কা পেলেন। কিন্তু ছেলে তো নিজের সামান্য বিবেক বুদ্ধি ও নিজের অনুভবেই এই কথা বলেছে। তাই বলে উনি এই কথাটা সামান্য বলে মনে করতে পাচ্ছিলেন না। উনার মনে সারা বিশ্বের ইতিহাসের কিছু ঝাপসা কথা মনে পড়ল। এমন এক দৃশ্য যেখানে নাজিরা যখন ক্রান্তিকারীদের শুট করার জন্য সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে ছিল, ওদের চুল ক্ষণিকের মধ্যেই পেকে সাদা হয়ে গিয়েছিল। সেটা হল একটি অবিশ্বাসযোগ্য সত্য ঘটনা। সেই কথাগুলো মনে করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মন ও প্রাণ কেঁপে উঠল। সেই ভাবটা কাটানোর জন্য উনি নিজের চোখের চশমা ও চেহারা অনেকক্ষণ ধরেই রুমাল দিয়ে মুছলেন।

চশমা নামানোর পরে ঝাপসা ভাব আরো গভীর হয়ে গেল। জানি না কেন উনি আর চশমা চোখে পড়লেন না। কত ভাবনাই না ঘুরঘুর করছিল, জীবন তো কেটে গেল, কিন্তু ওনাকে কখনও বিন্দুমাত্র কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়নি। শুধু দু’ চারটে কিছু ছোটবড় আন্দোলনের জন্য কিছুদিন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে জেলযাত্রা করতে হয়েছে। সেইসব জেলযাত্রা বেশ সম্মানজনক হত। বয়সের সঙ্গে এই রকমের সম্মান আরো বৃদ্ধি পেল। কখনো কখনো এই বয়সে আসার পর জানিনা কেন এই সম্মান স্বপ্নের পথে বাধাগুলি নিরন্তর বেড়ে উঠার জন্য আর কর্তব্যবিমূঢ়তার স্থায়িত্বের পর উনি লজ্জায় ভরে যান।  

এখন শুধু চাপা কান্না রয়েছে, সেই কান্না বাইরে আসতে দ্বিধা বোধ করে। কারণ বিচারধারা অনুমতি দেয়না। এই বছরখানেক আগেই আমরা কবি মুক্তিবোধের প্রসিদ্ধ কবিতা "অন্ধেরে মে" পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি পালন করেছি। সেই কবিতার লাইনগুলি ... "অব তক ক্যা কিয়া। জীবন ক্যা জিয়া। জ্যাদা লিয়া, আউর দিয়া বহুত বহুত কম। মর গয়া দেশ, অরে জীবিত রহ গয়ে তুম!" এই কবিতার কলিগুলি এতো প্রাসঙ্গিক কেন হয়ে উঠল। বা এই কথা উনার মনে হয়েছে। ওনার বয়েসের জন্য বোধহয় এর প্রাসঙ্গিকতা বেড়ে উঠেছে, বা আরো অন্য কিছু? 

কিন্তু জানিনা কাকে জিজ্ঞাসা করবেন, কি এই প্রাসঙ্গিকতা কেবল উনার জন্য বা এখন কোনো সার্বজনিক সত্য হয়ে উঠেছে? আগে তো কখন সত্য এতো জটিল ছিল না! ওনার বা ওনার মত প্রতিবদ্ধতা সমাজে কেন দেখা যায়না? বলার সময় বলা হয় যারা সত্যের সঙ্গে ও মিথ্যে, ছলনা, ধাপ্পাবাজি, অত্যাচার, শোষণ, অসমানতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, তারই উনার মত প্রতিবদ্ধ। তাহলে রাজনৈতিকতায় পিছিয়ে যাওয়ার কারণটা কী? আমাদের স্বপ্নগুলি এখনো স্বপ্নই কেন রয়ে গেছে? আর অন্যদের সব প্রতিক্রিয়াবাদী স্বপ্ন কেন ওদের বেঁচে থাকতে থাকতেই পুরো হয়ে যায়? আর ওদের সেই স্বপ্নগুলি দেখার জন্য আমরা অভিশপ্ত। এই অভিশাপ আমাদের সঙ্গে কতদিন অব্দি থাকবে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন কালিদাসকে ঘিরে ধরতে লাগল আর কালিদাসেরও উদ্বিগ্নতা বাড়তে লাগল। উনি এই সময়েও ভাবছিলেন ও ওনার কান গরম হয়ে উঠছিল। ভাবছিলেন যে বুদ্ধিজীবীরা ও বিচারকেররাও এখন এই বলছেন যে আমাদের জন্য জঙ্গল আরও বেড়ে উঠেছে, রাস্তা আরো জটিল হয়েছে। এইসব ভাবতেই ওনার আরো কিছু কথা মনে পড়ল, উনি নিজের ঘরে তীব্র গতিতে ঢুকে পড়লেন। ওনার ঘরে  বইয়ের আলমারিতে কাচ দেয়া, যেন বাইরে থেকেও বইগুলি দেখা যায়। সেই বইয়ের আলমারিকে পাশ কাটিয়ে যেতেই উনি বিড়বিড় করে উঠলেন  ... কোথায় রয়েছে  ... কোথায়? কিছুক্ষণ পরেই উনি একখানা আলমারির সামনে  দাঁড়িয়ে পড়লেন, তারপর একটি কপাট খুলে একখানা বই বার করে বইটির পৃষ্ঠা তাড়াতাড়ি করে উল্টাতে লাগলেন। বেমালুমের মত চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে যাওয়াতে ওনাকে চোখের খুব কাছে নিয়ে আসতে হল বইটি। হঠাৎ একটি পৃষ্ঠায় ওনার আঙ্গুল থেমে গেল আর উনি জোর গলায় পাঠ করতে শুরু করলেন  ...  

"সত্য আজকাল এতো ঝিলিক দেয়

কি সত্যের সঙ্গে চোখে চোখ রাখাও মুশকিল,

আমি ওকে ধরার জন্য এগিয়ে যাই

তো সে একটা হিংস্র জানোয়ারের মত হামলা করে চলে যায়

শুধু কোথাও কোথাও ওর চিহ্ন চোখে পড়ে।  

কোনো রাস্তায় জঙ্গলে গাছের তলায়

একটি ঝুপড়ির ভেতর একখানা ভাঙা উনুন

একটি ভেঙে যাওয়া ছাদ

ছেড়ে চলে গেছে মানুষেরা এমন সুনসান। " .

মঙ্গলেশ ডাবরালের কবিতার পংক্তিগুলি সে আজ প্রথমবার পাঠ করার পরেও উনি সেই অক্ষরগুলি হতে নিজের চোখ সরাতে পারলেননা। আর না জানি কতক্ষণ উনি মনে মনে বারবার সেই কবিতাটি পাঠ করতে থাকলেন।

অনেকক্ষণ পরে উনার চোখ বই থেকে সরলো। উনি দেখলেন উনি নিজের এই ঘরে একা। উনি যখন এই ঘরে আসেন তারপর থেকে একাই এই ঘরে কিন্তু  এতক্ষণ উনি নিজেকে একা বোধ করেননি। ঘরে দুপুর গড়িয়ে পড়া রোদের আমেজ জানলা থেকে ঘরে ঢুকছে। সেই রোদের আমেজে ওনার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। উনি নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর নিজের চোখের সামনে ঘিরে আসা অন্ধকারের পরেও কোনোমতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

একটি ভীষণ অশান্তি ও অস্থিরতায় মন ও শরীরে সঞ্চারিত হয়ে উঠল। উনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে মোকাবিলা করছেন যে এ রকম অস্থিরতায় ভরে উঠেছেন। উনি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেননা। এমন তো নয় যে হাজার হাজার মিথ্যার চাপে পড়া কোনো সত্যি বেরিয়ে আসার জন্য ব্যাকুল? আশ্চর্য ব্যাপার যে এতো পুরনো এতো দিনের পেছনে চাপা পড়ে থাকাকে কি করে দেখতে পারছেন উনি? জানিনা কেন এই অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা ওনাকে এই বেড়া থেকে বেরিয়ে আসার জন্যও প্রেরিত করছেনা।

নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়, এটা ওনাদের পূর্বপুরুষদের ভিটা। বেশ লম্বা বারান্দা। এখানে লাইন করে বেতের চেয়ার সাজানো ও সেই চেয়ারে বসে রয়েছেন ওনার পরিবারের লোকেরা। বারান্দার এক কোণে রয়েছে রান্নাঘর আর এক কোণে পশ্চিমের দিকে একটি ছোট্ট দরজা। সেখান বাইরের দিকে সবুজে ঘেরা জায়গা ও লম্বাকার রূপে বাড়ির কম্পাউন্ড ওয়াল দিয়ে ঘেরা। আর শেষে একটি লোহার পুরনো গেট।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় গড়িয়ে গেল। চোখের সামনে অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেল এক ঝটকায়। চোখের সামনে থেকে অন্ধকার দূর হতেই উনি খালি একটি চেয়ারে বসে পড়লেন। বাড়ির অনেক সদস্যরা থাকায় বেশ জমজমাট অবস্থা, একটু আধটু শোরগোলও রয়েছে। কিন্তু এইসব ওনার কাছে  অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে, এমন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো একটা ভীষণ চাপ উনাকে চেপে ধরে রেখেছে। উনার মনে হল উনি শুধু বাইরে নয় ভেতর থেকেও অন্যমনস্ক। এটা একটা ব্যাকুল করে তোলার মত অন্যমনস্কত। উনি এইসব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারছেন কই?

ওনার তন্দ্রা এক ঝটকায় ভেঙে গেল, পাশের চেয়ারে উনার বড়ছেলে নিজের বড়ছেলেকে আদেশ করল ... "বাবা এখানে, ওনার চায়ের কাপ এখানেই নিয়ে এসো”।

বোধহয় বিকেল চারটা বা পাঁচটা বাজছে, সেই সময় পশ্চিমের দিকে যে ছোট দরজাখান রয়েছে সেখান থেকে জোরালো রোদ্দুর বারান্দায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মনে হয় আজ কোন ছুটির দিন তাই বাড়িতে এতো হইচই। উনি যখন ঠিক করে তাকিয়ে দেখলেন উনার পাশে বড়ছেলে বসে ও তার পাশেই বড়ছেলের ছোটছেলেও বসে আছে। বয়স হবে সতেরো বা আঠারো। তার সামনের চেয়ারে ওর কাকা, যার বয়স এখন পঁইত্রিশ বা ছত্রিশ হবে। ওরা বর্তমান রাজনৈতিক পরিদৃশ্যের উপরে বেশ জোরালো তর্ক বিতর্কে মেতে আছে। বড় ছেলের বড়ছেলে  পুনা থেকে এম বি এ করছে। বড়ছেলের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, সে এখানে উপস্থিত ছিলোনা। বাকি সবাই ছিল। ছোটছেলের মেয়ে প্রীতি যার বয়স এখন সাত বছর এবং তার ছোটছেলে যার বয়স চার বছর সুযোগ, সে উপস্থিত ছিল।  ওরা দুজনেই গোটা ঘরে দৌড়ঝাঁপ, হাসি ঠাট্টা ও হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি নিয়ে মাতিয়ে রেখেছে। ওদের মায়েরাও রান্নাঘর ও বাইরে দৌড়ঝাঁপ নিয়ে ব্যস্ত। ও মাঝে মধ্যেই ঝগড়াঝাটি না করার উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিল। বারান্দার এই হাসিখুশীর জোয়ার দেখে উনার মনটা একটু বদলে গেল, মনে হয় একটু খুশিই হয়েছিলেন। উনার মুখে হাসির ভাব দেখে উনার বড় ছেলে প্রশ্ন করল - "বাবা এখনো কি সব ঝাপসা ঝাপসা মনে হচ্ছে? আমি কোনো পত্রিকায় পড়েছিলাম এরকম কখনো  কখনো বেশি চিন্তা করলেও বেড়ে যায় ... কিন্তু আপনার কিসের চিন্তা? সবই তো ভালোই চলছে ঘরে”।

উনি বুঝতেই পারলেননা যে এটা প্রশ্ন ছিল না সান্ত্বন!  উনি জবাব দিলেন - "হতে পারে তোর কথা ঠিক, কিন্তু আমি শুধু বাড়ির জন্যই চিন্তা করিনা। এটা তো আমার নিজের বাড়ি আর আমি নিজের বাড়িতে বেশ খুশিতেই থাকি”।  তারপর নাক অব্দি গড়িয়ে আসা চশমা তুলতে তুলতে বললেন - "তাও জানিনা,  কেন আজকাল সব ঝাপসা ঝাপসা লাগছে”। উনার চেয়ারের হাতলে রাখা হাতের উপর হাত রেখে ছেলে বলে উঠল - "আরে সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা, আজ ডাক্তারের কাছে তোমার নম্বর রেজিস্টার করে দিচ্ছি, কাল দেখিয়ে আসবো”।  

এই কথা শুনে উনি একটু স্বস্তি বোধ করলেন। নিজের মনে একটু খুশিও অনুভব করলেন। যখন এই খুশিটিকে নিজের ছেলের কাছে প্রকট করতে চাইলেন,  তক্ষুনি একটি তীব্র হাসির শব্দ গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ওই দিকে তাকিয়ে দেখল প্রীতি সুযোগকে ‘মোটুরাম – মোটুরাম’ বলে ওকে কাতুকুতু দিছিলো ও সে খুব জোরে জোরে হাসির জোয়ারে ভাসাচ্ছিলো গোটা বাড়িটা। খুশি ও হাসির মাঝে মাঝেই সে নিজের দিদিকে জড়িয়ে নিচ্ছিল। আসলে সুযোগ  অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে একটু গোলগাল ছিল তাই বাড়ির সবাই ওকে মোটুরাম  - মোটুরাম বলে ডাকতো আর সেও রাগ না করে মুচকি মুচকি হাসতো। কালিদাসের কিন্তু চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই ওনার বেশ একটা ভালো স্বস্তির আনন্দ পেলেন। শোরগোল বেশি হতেই বড়ছেলে একটু রাগের সুরে বাচ্চাদের নির্দেশ দিল - "আচ্ছা এবার তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসো। কত শোরগোল বাধিয়েছো বল তো? এখন চুপটি করে বসো ও যে চা খাবে শান্তিতে বসে চা খেয়ে নাও”।

নির্দেশ শুনে বাচ্চারা শান্ত হয়ে গেল আর নিজের বাবার কাছে এসে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওদের বাবা ওদের মাথায় স্নেহভরা হাত বুলিয়ে দিলেন। তক্ষুনি পশ্চিমের ছোট্ট দরজা দিয়ে বাসন মাজতে ঝি রেবতীমাসি ঢুকলো, আর আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে ডাক দিল – “মোটুরামভাই তুমি কোথায়? ও মোটুরামভাই শুয়ে পড়লে নাকি?” সেও বাড়ির সবাইকার মত ওকে সোহাগ করে মোটুরাম বলেই  ডাকতো। হঠাৎ সুযোগ ডাক শুনে এক্কেবারে চটে গেল আর এক দৌড়ে  ঠাকুরমার লাঠি নিয়ে দরজার দিকে ছুটে গিয়ে রেবতীমাসিকে লাঠি দেখিয়ে বলল -"আবার যদি মোটুরাম বলবি, তো আমি তোকে এই লাঠি দিয়ে লাঠিপেটা করব”।  

"আরে বাপ রে" রেবতীমাসি হেসে বাড়ির পেছন দিকে বাসন তুলে চলে গেল। কালিদাস সুযোগের এই ব্যবহারে আশ্চর্য হলেন। উনি ভাবলেন যে বর্গভেদের বিরুদ্ধে উনি আজীবন লড়াই করে এসেছেন, সেই লড়াইয়ের পরেও এই রোগটা ওনার বাড়িতে কীভাবে জন্মালো? মোটুরাম ডাক শুনতেই সুযোগের বোনের উপর একটা অন্যরকম ভাব, কিন্তু রেবতীমাসির ডাকে সুযোগের চটে যাওয়াকে কালিদাস মেনে নিতে পারলেননা। উনি বাড়ির সব সদস্যদের দিকে রাগের চোখে তাকালেন। ওরাও সুযোগের ব্যবহার ও কালিদাসের রেগে যাওয়াকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সবার চোখে এক রকমের ক্ষমার ভাষা ছিল। কিন্তু এইভাবে  তো চলার কথা নয়। তাই উনি এই ঘটনার পরে আরো ঘন নিরাশায় ডুবে গেলেন। গোটা বাড়িটাকে লোকজন থাকতেও ঘন শান্তি ঘিরে ধরল। হঠাৎ উনি নিজের ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতেই রাগ চেপে দরজার কাছে দাঁড়ানো সুযোগের দিকে এগিয়ে গেলেন আর ওর গালে স্নেহময় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন -"এমন করতে নেই, এইভাবে কাউকে বলতেও নেই সোনা ছেলে ... কি বুঝলি তো?"

‘এমনভাবে বলতে নেই, বলতে নেই’ আওড়াতে আওড়াতে সুযোগ খুশিতে গোটা বাড়িতে চক্কর কাটতে লাগলো।

কালিদাসের হঠাৎ মনে হল, সেই ছোট্ট দরজা দিয়ে গড়িয়ে আসা রোদ্দুর সুযোগের পেছন হতে অনন্ত অব্দি ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেখানে তিনি অনেক অনেক সুযোগকে দেখতে পাচ্ছেন।

উনি অনেকক্ষণ সেই দিকে বহু দূর অব্দি তাকিয়ে রইলেন। উনার মুখে এখন একটা সান্ত্বনালিপ্তহাসি ফুটে উঠেছে , সঙ্গে একটা অজানা আবেগও। উনার পা হঠাৎ ঠকঠক করে কেঁপে উঠল, উনি চট করে দরজার চৌখাট ধরে নিলেন। তারপর তীব্র সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে নিলেনদ। একটা অদ্ভুত শান্তিতে ডুবে গেলেন। সূর্যের কিরণ এখন সেখানে সেইভাবেই ছিল, দিন এখনও অস্ত যায়নি।

 


৪টি মন্তব্য: