ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(১৪)
এবারে বিদায় নেওয়ার সময়ে খুব মন খারাপ ছিল হর্ষর। মা-র চোখ জলে ভরা, বাবা কথা বলতে পারছিল না। ভারী বাষ্প হালকা করতে লিপিকা বলেছিল,
--পৌঁছেই ফোন কোরো কিন্তু মৌনীবাবা।
এক চিলতে রোদের ঝলক – হর্ষ হেসে ফেলেছিল। ছোট্টবেলায় গোমড়া হয়ে থাকলে তাকে ওই নামে
ডাকত শোভন আর লিপিকা। শব্দটা সে শিখে নিয়েছিল। রাগ হলে গাল ফুলিয়ে বলত, ‘আমি মৌনীবাবা।‘
সময় এগিয়ে যায় নিজের ধারায়। সংসারের হাজারো ব্যস্ততায় আপাতভাবে ভুলে থাকা চোরা
ব্যথা একা হলেই ঠাণ্ডা কনকনে ঢেউ হয়ে বুকের মধ্যে ওঠা-পড়া করে। বাবার বাড়ি বলতে যা
বেঁচে ছিল মা চলে যাওয়ার সাথে পাকাপাকি শেষ হয়ে গেল। আর ওবাড়ি যাবে না লিপিকা। দিদি
লতিকা খবর পেয়েও আসেনি, দূর থেকে বুঝি আসা সম্ভব হয়নি। বাড়ির উইলে কী আছে জানার আগ্রহ
নেই। শিবতোষের অংশ বাদে বাকিটায় তাদের দুবোনের অংশ থাকার কথা। ওই দাবী নিয়ে জলঘোলা
করার প্রবৃত্তি লিপিকার নেই। বাড়তি মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও না। বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলতে
জোরে নিঃশ্বাস ফেলে লিপিকা। শোভনকে বলে না কিছু। বললে হয়ত বুঝত, কিন্তু তাকে বিব্রত
করতে চায়না বলেই বলে না। শোভন ঘোরের মধ্যেই থাকে। ইদানিং বাবুলের কিনে দেওয়া ড্রইংখাতা,
রঙপেন্সিলের বাক্স নিয়ে মেতে আছে।
এ্যাকোয়ারিয়ামের পাশে বসেছে শোভন। স্কেচ করছে। সলমন লেজের ঝাপট মেরে হালকা আওয়াজ
তুলে এদিকওদিক করছে। গত ক’দিনের অনিচ্ছাকৃত অবহেলায় পটাপট মরে গেছে একটা এঞ্জেল, একটা
গোল্ডফিশ, চারটে মলি। কষ্ট পেয়েছে শোভন, লিপিকা অপরাধবোধে ভুগেছে। শোভন আবারও এ্যাকোয়ারিয়াম
বিক্রি করে দেওয়ার কথা তুলেছিল। মন্দের ভালো যে সলমন ঠিক আছে।
শোভন খাতা থেকে মাথা তুলে তুলে জলাধার দেখে মুচকী হাসে। কিচেনের কাজ মোটামুটি সেরে
ফেলে হাত মুছে বেরিয়ে আসে লিপিকা। পিটিপিটে স্বভাবের কারণে তার কিচেন নতুনের মতো চকচকে।
বিকেলের দিকে সুপার মার্কেটে যাওয়া আছে। এদিকে হুট্ করে কিছু পাওয়া যায় না, স্টক রাখতে
হয়। সামনে ছায়া পড়াতে চোখ তুলে তাকায় শোভন। অপ্রস্তুত হয়ে খাতা আড়াল করার চেষ্টা করে।
লিপিকা গা-ঘেঁষে ঘন হয়ে বসে, আদরের স্পর্শ দেয় পিঠে, গালে, মাথায়। তাদের যৌনঘনিষ্ঠতা
দুতিনবছর ধরে অত্যন্ত অনিয়মিত। শোভন কোণায় সরে গিয়ে আড়ষ্টভাবে জিজ্ঞেস করে,
--কী?
--আঁকছ?
--ওই—! বলো?
--দেখি—?
শোভন লাজুক মুখে খাতা এগিয়ে দেয়। লিপিকা উলটে পালটে দেখে ফেরত দেয়। বাচ্চাকে প্রবোধ
দেওয়ার মতো করে বলে,
--আঁকো মন দিয়ে। আমি স্নানে গেলাম।
শোভন খাতা মেলে বসে থাকে – হোটেলের সেই ছবিটা। তখন হোটেল বলতে রেস্টুরেন্টও বোঝানো
হত।
লাল পেইন্ট করা ইঁটের বিল্ডিং, নীলরঙের দরজা-জানালা, অ্যাসবেস্টসের ছাদ। পেছনে
ডালপাতা মেলে বিশাল আমগাছ ছাতা ধরে আছে। অদূরে সরকারি দপ্তরের মস্ত লালরঙের বিল্ডিং।
এটা অফিসের পেছনদিক। পীচের পাকা রাস্তা গড়িয়ে চলে গেছে আরো। একধারে কাঁচামাটির চত্বর
ইঁট বিছানো, গাছগাছালিতে ঘেরা মনোরম ছায়াময় – বাইরে গরম বোঝা যায় না। হরেকরকম পাখি
ডাকে, শোভনের মন ভালো লাগে। জায়গাটা জুড়ে বাঁশের তৈরি খুপরি খুপরি ঘর আয়তাকারে ছড়িয়ে
আছে। উপার্জনের ধান্দায় যারা এসে বসে, তারা এই অফিসের কেউ না। তাদের টাইপ-রাইটারের
দ্রুত খটাখট ব্যস্ততার প্রমাণ দাখিল করে। খানদুই খুপরিতে তোলা উনুনে কেটলিতে চা ফুটতে
থাকে। কোণায় ডাঁই করে রাখা মাটির ভাঁড়, কাচের বয়ামে বেকারির বিস্কিট। ইংরেজ আমলের দুএকটা
বেকারি টিকে আছে— দারুণ চিকেন প্যাটিস, কেক-বিস্কিট স্বাদে-সুগন্ধে একঘর। চায়ের দোকানে
ভীড়, উস্-উস্ আওয়াজে চা খায় লোকে। কড়া, ঘন দুধ-চায়ের গন্ধ বনজ গন্ধের মধ্যে মিশে
যায়। দেড়-দুই কিলোমিটার দূরত্বে লোক্যাল থানা। কাজে-অকাজে মানুষ জমায়েত হয়। অল্প দূরে
রেল-স্টেশন। হুইসল অথবা ট্রেন চলার আবছা গুমগুম আওয়াজ বাতাসে ভর দিয়ে এসে পৌঁছায়। শোভন
চুপিচুপি ভীড়ে মিশে যায়। সামনের টাইপিং-ম্যানের সামনে ধুতি-পরা রোগা ভদ্রলোক বাবা ভুবনচন্দ্রের
মতো। পেছন থেকে লম্বা ঘাড় দেখতে পায় শোভন। একটু এগিয়ে শাড়ি-পরা মহিলা, হাতে-ধরা হাফপ্যাণ্ট
পরিহিত ছোট্ট ছেলে। সুষমা আর রঞ্জন – মা আর ভাই। হোটেলের ধাপিটাতে দাঁড়িয়ে চোঙা প্যান্ট,
চেক-কাটা শার্ট, লম্বা রোগা আবছা বছর তেরো-চোদ্দর কিশোর ভাঙা মোটা গলায় উদ্গ্রীব হয়ে
ডাকে, ‘মা! বাবা! শুভো! সব সীট ভরে গেল কিন্তু!’ দাদা বিজনের গলা স্পষ্ট শোনা যায়।
ব্যস্ত মানুষজনের মধ্যেখান দিয়ে সে দৌড়ে ওদিকে এগোতে থাকে।
হোটেলে খেতে বসার কাঠের সীট ইশকুলের বেঞ্চের মতো টানা লম্বা। টেবিলও তাই – শুধু
অনেকটা উঁচু। সার দিয়ে পংতিভোজনে বসেছে কাস্টমার, মহিলা প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যস্ততার
সঙ্গে সঙ্গে হাঁকডাক চলছে। সুষমা মাথায় কাপড় দিয়ে নিয়েছে এক ফাঁকে। একপাশে রঞ্জু, অন্যপাশে
হাত দিয়ে জায়গা রেখেছে মেজো ছেলের। শোভন গিয়ে বসে। উলটোদিকের বেঞ্চে জাল-লাগানো জানালা
পেছনে রেখে বসা ভুবনবাবু আর বিজন। অর্ডার নিতে আসে একজন, তার কাঁধে গামছা। বিজন উত্তেজিত
হয়ে বলে,
--মুরগীর মাংসের ঝোল হবে?
--হবে। কষা মাংস।
--আর?
--সরু চালের ভাত, বড়ি দিয়ে শুকতুনি, মুগডাল মাছের মাথা, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, পাঁচমেশালি
ঘন্টো, জলপাইয়ের চাটনি—।
শ্বাস না ফেলে বলে যায় লোকটি। অর্ডার দেওয়ামাত্র ঘাড় উঁচু করে চেঁচায়,
--ছ’নম্বর টেবিলে পাঁচটা চিকেনমিল—।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যালান্স করে থালার ওপরে থালা এনে টেবিলে রাখে। পেতলের থালা,
পাশে নুন আর লেবুর টুকরো। অ্যালুমিনিয়মের জলের জগ আর গেলাস। সুষমা ভুবনবাবুকে বলে,
--চিকেন চারটে বললে ভালো হত। রঞ্জু কি গোটা পিস খেতে পারবে?
--বিজু খেয়ে নেবে।
বাটিতে বাটিতে খাবার আসে। লঙ্কাবাটা, তেল-ভাসা লাল মাংসের ঝোল। সুষমা রঞ্জুর থালায়
শুকনো করে ডালভাত মেখে দিতে গিয়ে বলে,
--কত কিলো তেল ঢেলেছে! ডালটাও ঝাল নাকি কে জানে?
ভুবনবাবু হাত তুলে ডাকে,
--ওভাই, বাচ্চা ছেলের ঝাল লাগবে না কিছু দিতে পারেন?
হাপুস-হুপুস করে খায় দুভাই। শোভনের হাতের চেটো বেয়ে গড়িয়ে ডাল-ঝোল নামে। ঝিরিঝিরি
আলুভাজা মুঠো করে মুখে দেয়। খানিক পাতের পাশে ছড়িয়ে পড়ে। ভুবনবাবু সুষমাকে বলে,
--ওকেও মেখে দাও দেখি। পারে না কি নিজে?
প্রবল মাথা নাড়ে শোভন, দরকার নেই। সে ক্লাস ফোরের ছাত্র, সামনের বছরে বড়ো ইস্কুলে
যাবে। ঝালে তার জিভ জ্বালা করে, চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। ঢকঢক করে জল খায়। খেয়ে হাত
ধুতে যায় সকলে। দোকানের মেঝে খাবার আর জল পড়ে পড়ে কাদাকাদা মতো। সুষমা শাড়ির কুচি উঁচু
করে কোমরে গুঁজে বাঁহাতে ছোটো ছেলেকে সামলায়। রঞ্জু বড্ড দুরন্ত, শুভোর মতো মোটেই শান্তশিষ্ট
নয়। যাওয়ার পথেই মস্ত রান্নাঘর আর ভাঁড়ার। প্রকাণ্ড উনুন জ্বলছে। বিরাট বড়ো শিলে সাদা-সাদা
কী যেন বাটা হচ্ছে। খিড়কী দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে খোলা জায়গায় বালতি আর মগ রাখা। ওখানে
হাতমুখ ধোওয়ার ব্যবস্থা।
হোটেলের বাইরে এসে বিজন বলে,
--সাদা-সাদা কী বাটছিল গো মা?
--পোস্ত। বড়ো বড়ো পোস্তর বড়া খাচ্ছিল লোকে, দেখিস নি? হ্যাঁগো, পরের বার এলে আমরাও
খাবো।
ভুবনচন্দ্র লম্বা ঘাড় হেলিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে,
--আচ্ছা। বড়োখোকা মুরগীর মাংস ভালো খেলি? হোটেলে খাবো হোটেলে খাবো, হলো তো খাওয়া?
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন