অনন্ত খুঁজে ফিরি স্বপনের কেবিনে
অনেকক্ষণ থেকে একটা দৃশ্য আঁকতে চাইছি। ক্যানভাসে ফুটছে বাইরের গোল পৃথিবী। অথচ আমার ভেতর অন্য পৃথিবী। রূপ দিতে চাইছি সেই জলজ ভাস্কর্যের। কিন্তু সে কেবলই গড়িয়ে যায় আঙুলের ফাঁকে। রক্তে দানা বাঁধে অনিবার্য অভিমান। অহর্নিশ মন্থনে সে পৃথিবীর তাপ বাড়ে। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নিজস্ব দর্শনে। আমার দৃশ্যরচনাকে নির্মম বিদ্রুপে ভাঙতে থাকে। অনায়াস কৌতুকে টুকরো টুকরো করে আমার অজস্র আমিকে। আর সেই খণ্ড খণ্ড আমি ছড়িয়ে পড়ে বাইরের দৃশ্যমান পৃথিবীতে। প্রতিটা খণ্ডে আলাদা আমি। আমিকে আলবিদা দিলে পড়ে থাকে কোয়ার্কের কুহু। কোয়েলিয়া তরঙ্গ ভেসে উঠছে দৃশ্যে। কুয়াশা ফুটছে ক্যানভাসে। খুব ধীর গতির চাকা। গড়াতে গড়াতে ক্রমশ আমার ভেতর মগ্ন হয়ে পড়ে। আর আমি অনন্ত খুঁজে ফিরি স্বপনের কেবিনে।
স্বপনের প্রতিটা রূপয়েন্টে আমি নোঙর ফেলে বসি। ভ্রূমধ্যে জেগে ওঠে ভ্রমণডানার শব্দ। শব্দমুগ্ধ আমিকে ডেকে তুলি দার্জিলিং এর গম মেশানো ভোরবেলার রঙে। ভোর থেকে ভোরাজের নির্মাণ সংকেত লিখে রাখি তামসবিলাসী আঙুলে। জলদিগন্তের গল্পে গড়ানো ফিনিক্স উড়ে আসে আলোসারি আঁচলে। মুহূর্তগুলো যখন অস্থির বিনির্মাণে এলোমেলো হয়ে ওঠে, দূরপাল্লার মাল্লাডাক আসে। অথচ সমস্ত পোস্টকার্ড ফিরে আসে বেয়ারিং হয়ে। তাই কুয়াশা কেবিনে বসে এলাচ রঙের পৃথিবী দেখতে দেখতে পশমপ্রাণাদের হাসি বাজতে বাজতে শ্রমপরীদের নরমরেখা শুনতে শুনতে আমি ভাবি হৃদয়ঙ্গমপুর আর কতদূর। পাহাড়ি বাঁকগুলো দেখে ফেলি আমারই আঙুলে। ভাবি পাহাড়ের ব্যাখ্যা যদি ভিজলোই দার্জিলিং চার হলো না কেন? আঙুল পাল্টে পাল্টে আমি সবকটা রূপয়েন্ট ঘুরে আসি। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক জায়গায় জিপ দাঁড়াবার কৌশল শিখে ফেলি। ভালোবাসলেই সব দূর ছুঁয়ে ফেলা যায় – একথা এমন করে কেউ বললো না কোনদিন
শুধু
একটু ভালোবাসার জন্য
আমি
একজীবন ভ্রমণে যেতে পারি
আড়বাঁশির
ঠোঁটে রাখা বিশুদ্ধ চুমু
খুলে
নিজেকে দেখি
খুলতে
খুলতে উপচে উঠছে
মণিবন্ধের
দাসত্ব
ফোঁটা
ফোঁটা রক্তের নেশা
আত্মহত্যার
বনৌষধি নিংড়ে
তোমার
মুখ আঁকি
চোখ
ফুটলে রসকলি মনে পড়ে
ভ্রূমধ্যে
জেগে ওঠে
ভ্রূণলাগা
স্বর
বাঁকানো
গ্রীবায় মায়াব্যঞ্জন
সারি
সারি অবাক বসে ব্যঞ্জনায়
বারীন বলেন আস্তে, এখানে সরস্বতীর স্বর আলোমতির আলো। বীণা
থেকে শব্দধ্বনি উঠছে। জিভেতে জড়াও আর কান পেতে শোনো ওই অর্থপারের সঙ্গীত। অর্থের
কথা আমি ভাবিনি তেমন। শুধু পারাপারে ওই আকাশভ্রমণ ওই চাঁপা রং কষ্টের খোঁজ আমাকে
হাজির করে তোমার কুয়াশাতলায়। খোয়া যায় না খোয়াইও। তার আদিগন্ত লিখিত লু-থর। আর ওই
নীল কম্পার্টমেন্ট। কখন খুলবে কখন খুলবে না এটা তো কেউ বলে দিতে পারল না। শুধু
মুখর হয়ে যাওয়ার আশা। কেবিন কুড়োনো কুয়াশা
আশা আর
কুয়াশার ঘোরে
রোদ্দুর
দেখিনি
টানা
দেড়মাস
আমার
ভেতরে জটপাকানো ভ্রম
খুলে
বেরিয়ে পড়ি
ভ্রমণে
তোমার
কেবিনে স্টার্ট নেওয়ার শব্দ হতেই
হাতে
রোদের তাপ
নিমঝিম
জানলায় ঋতুদের স্বপ্ন
জলভেজা
কাচে
রোদের
মুকুট পরে হেসে উঠবে
খিলখিল
আর
অনন্ত লিখতে বসবে
তোমার
নাম
একটু
কমন্ বলে
একটু
থমকাবে
তবু
দেনাপাওনার পাট চুকিয়ে
দিন
হবেনা প্রতিদিন
ব্লিচিং-এর একটা কেমিস্ট্রি আছে। শুধু ওপরের রঙটুকুই বদলাবে এমন তো নয়। কিছুটা মায়াও লোপাট হয়ে যায়। আর মায়া
যদি নাই থাকে, দুঃখের কী নাম দেবো? অথচ স্বপনে ব্লিচিং বসলেই অন্য কেমিস্ট্রি।
চুড়িমেশা গরম দুধ উথলে ওঠে চোখের সামনে। দৃশ্য আর দৃশ্য থাকে না। রঙরোদের মায়া ছড়িয়ে
পড়ে চেনা দুঃখের মাদুরে। বারীন যখন খবর হলো নিজের দুঃখ হাতড়ে ডাঙার শোক গেলো না
এখনো। অভিমান হতেই পারে জলের ভেতর যাপন যখন। তোমার টুপির কথাও ভাবি। ভাবনারা দেদার
হলেই আঙুলে ধুপের তাপ শহরের গান। কেন যে এখনো খুড়ো অবিশ্রান্ত গান। কীভাবে এখনো
সুর ভিতরবাহির। আর সেই সুরে তোমার টুপির ছায়া
পড়লে পঙ্ক্তি জুড়ে নতুনের নৃত্য। বরফ তখন গলনাঙ্ক থেকে ঝরিয়ে ফেলে সমস্ত অঙ্ক।
যোগের নিয়মগুলো এধার ওধার। বিয়োগের ব্যথারা গলে গলে পড়ে। ওঁ ধ্বনি ওঠে শান্তির
মর্মরে। ভেসে ভেসে পাড়ি দেয় অনন্তে। মহাশূন্যের ডাক আসে
মনে
পড়ে ব্রজবল্লভ রায়
ফুল
পর্যন্ত প্রসারণে তুমি
ফলে
তুমি নিরাধিকার
আমি যে
মানতে পারিনা প্রভু
বিনির্মাণের
ভিতের ওপর
নির্মাণ
ফুটছে
অসম্ভবের
চিলেকোঠায় সম্ভাব্য পূর্ণতা
পূর্বেই
যে নির্ধারণে গেছে
তার
সঙ্গে যাবো কেন
আমি
অনিশ্চিতের পায়রা দেখেছি
পালকে
তার সম্প্রসারণ প্রথা
বিন্দু
বিন্দু অধিকারে
চলন
বাজছে
আঙুলে
তার কুরুশকাঁটা
এমন
নিপুণ বুনন
অনন্তও
হারিয়ে বসে আদি
শেষের
পাতা উল্টে দেখে
প্রথমের
কিশলয়
ভাঙা
জলের ঢেউ ভেঙে
উড়ে
আসে উড়োভ্রূণ
নিরুদ্দেশ
পত্র লেখে চতুর্দশপদে
শ্রুতি অর্থে শব্দের ধ্বনি ধরে দেখো শ্রুতিমায় অপার নিরাময়।
টায়রায় বচন উঠলে ওড়নারহস্য নীচু হয়ে কুড়িয়ে নেয় জলরোল। কথারঙের অপলক চিক তাকিয়ে ফেলার
মুহূর্তে বানভাসি হয় ত্বরণের না মেলা সরণে। আমি স্তরগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। আঙুলে
উঠে আসে কিছু আলো কিছু রং। সন্ধ্যাভেজা
রঙে স্বালংকারে আলো আঁকি। আলোর বৃত্তে প্রথম চুমু। চমকে ওঠার মুহূর্ত সম্মোহন
লিখছে অন্তর্বর্তী পঙ্ক্তিতে। একটু অবসরের মৃদু হাওয়ায় দুলছে বারান্দা। চুলের
কুয়াশা জড়ানো চিঠি থেকে নেমে আসছে কুমারী হরিণ। তাকানোর সুষমায় বেজে উঠল
কোমলগান্ধার। অবস্থানের প্রশ্ন উসকে দিচ্ছে দুপুরবিরহী স্টেশন। আদুরে পলাশের গা ঘেঁষে বেহুঁশ হু হু। দুপুরের দীর্ঘসূত্রতা
বাহিত হচ্ছে গতিমগ্ন ট্রেন আর স্থিতিউদাস স্টেশনের বিস্মিত বিভ্রমে
অবস্থান
সম্পর্কিত ভাবনাগুলোয়
তোমার
চিরকালীন অঙ্কখেলা
ফিবোনাচি
নৃত্য বলো
মজলিসি
শূন্য বলো
অনন্ত
অঙ্কযাপন
আমি যে
মানতে পারিনা প্রভু
আমার
গুহায় কোনো ক্যালকুলেশান রাখিনি
হিসেবের
খাতায় করেছি ক্যাম্পফায়ার
আলো
নেই
অন্ধকারও
শুধু
অস্থির কুয়াশার তোলপাড়
রীতি
নেই
নীতিও
কোথায়
রাখবো বলো ধর্মের ধ্বজা
কোথাই
বা সত্যের বোঝা
শুধু
মহীনের ঘোড়াগুলো রাতভোর
ঠুক
ঠুক
ঠুক
ঠুক
খুরের নীচে
অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণ
কেন্দ্রাভিগ
মুদ্রা ভেঙে ডাক দিয়েছে
অনন্তের
মুক্তিমণ্ডল
আহ্!
লাগাম খুলে দাও প্লিজ
আমি চলে যাবো
তোমাকে
বিষয়হীনে রেখে
নিশ্চিন্তে
চলে যাবো নিমগ্ন নির্মাণে
স্বীকারে
এনো না প্লিজ
বলেছি
তো চলে যাবো
তোমাকে
অস্বীকারে রেখে
নিশ্চিন্তে
চলে যাবো হ থেকে রিণে
যে কবির কেবিন থেকে এই নতুনের খোঁজ শুরু
তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়-
জন্ম: জামশেদপুর, ১৯৫৬।
স্কুলজীবন: ইস্পাতনগরী রাউরকেলা। কলেজজীবন:
খড়গ্পুর, বি.কম। ১৯৯৭ পর্যন্ত বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারপর রাজনীতির সঙ্গে
যোগাযোগ ছিন্ন হলেও জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রের স্বপ্ন কবি এখনও
দেখেন। লেখার শুরু প্রাইমারি স্কুল থেকেই। কবিতার কাছে আসা
হাইস্কুলে। নাটক, পথ-নাটক লেখা আর অভিনয়ে সক্রিয় বহুদিন।
কবিতা লিখতে লিখতে নিজের ৩০/৩২ বছর বয়সে কবির মনে হয় “কবিতা লিখছি, কিন্তু এর ভাষা তো ধার করা। আমি কোথায়?” খড়গ্পুরে
একা থাকার সময়ে আবার গীতাঞ্জলি পড়তে আরম্ভ করেন। দিনরাত্রি এক
করে কবিতার স্রোত। একেকটি গানের শিরোনামে একেকটি কবিতা, যা ‘ধুপ-শহর’ নামে ‘কবিতা ক্যাম্পাসের’ দীর্ঘ কবিতার সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। অতিচেতনার পুরোধা কবি বারীন ঘোষাল
জানান এই কবিতাই অতিচেতনার কবিতা। কবির খড়গ্পুরের
বাড়ি আর জামশেদপুরে বারীনদার ফ্ল্যাটে নিয়মিত কবিতার ওয়ার্কশপ, যা পরে কবিতার
ট্রেকিং-এ রূপ নেয়। পত্রিকা সংপৃক্তি: দ্রিদিম, কবিতা ক্যাম্পাস, নতুন কবিতা। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: আমি আসছি (সংস্কৃতি
খবর, ১৯৮৪), চে (সংস্কৃতি খবর, ১৯৯০), লেনিন নগরী (কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯২), ডুরে কমনরুম (কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯৭), মেঘান্তারা (নতুন কবিতা, ২০০৩), হ থেকে রিণ (নতুন
কবিতা, ২০০৯), স্বপনে বানানো একা (সঙ্কলন,
কৌরব, ২০১০), দেশরাগ (নতুন কবিতা, ২০১১), সিনেমা সিনেমা
(নতুন কবিতা, ২০১৫)। প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ: স্বর্গের ফোকাস (কবিতা ক্যাম্পাস), রুয়ামের
সঙ্গে (কবিতা ক্যাম্পাস), একশো
সূর্যে (নতুন কবিতা, ২০০৯), কুঁচবাহার (ঐহিক, ২০১৭), শ্বাসাবরী জংশন (এখন বাংলা
কবিতার কাগজ, ২০১৯)। স্বপন রায়ের কুয়াশা কেবিন
বইটিই আমার এই কবিতার সূত্র। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৫
সালে নতুন কবিতা প্রকাশনী থেকে। ২০১২ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রচ্ছদ করেছিলেন অতনু
বন্দ্যোপাধ্যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন