ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৪)
একদিন একটা
ঘটনা ঘটল। দুই বন্ধু মিলে বেরিয়েছিল। ওরা ঢুকেছিল একটা ফুলের দোকানে। সবই প্লাস্টিকের।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনে ফুলগুলো দেখছিল। হঠাৎ আগ্নেয় বলল, বাইরে চল। পরে দেখিস। একটা
জরুরি কথা মনে পড়ে গেছে হঠাৎ...
অবাক হয়ে
গেছিল হৃদয়। আরও অবাক হয়েছিল, বাইরে বেরিয়ে আগ্নেয়র হাসিমুখ দেখে। একটু আগের উদ্বেগের
ছিটেফোঁটা ছাপও তার মুখে নেই। খুশিতে ঝলমল করছে সেই মুখ। হৃদয়ের দিকে একটা দুর্লভ দৃষ্টিনন্দন
ফুল সে বাড়িয়ে দিল।
তুই চুরি করলি? হৃদয় চমকে উঠেছিল।
কী করব!
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আগ্নেয় বলল।
তোর অভাব
কি এতদূর গিয়ে পৌঁছেছে?
অভাবের
তুই কি বুঝবি! আগ্নেয় বলেছিল।
এরপর আর কথা বলা চলে না। প্রথমটায় খুব রাগ হয়েছিল ওর। কিন্তু পরে কেন জানি বন্ধুর প্রতি সহানুভূতিই হয়েছিল। ছেলেটা শেষে চুরি করল! ফুলটার জন্য ও এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিল!
একদিন বিকেলে হৃদয় আর আগ্নেয় সমুদ্রের ধারে ঘুরছিল। সেই সময়ে হঠাৎ ওদের আলাপ হল বেদপর্ণার সঙ্গে। সুন্দরী, মেধাবী, মিষ্টি স্বভাবের একটি মেয়ে। গলার স্বরটাও খুব মধুর। দিন পনেরোর ছুটিতে বেদপর্ণা হৃদয়পুর দ্বীপে বেড়াতে এসেছে। হৃদয়ের বুকে যেন ঝড় উঠল। সেদিন ফেরার সময়ে আগ্নেয়কে সে বলল, মেয়েটিকে ভুলতে পারছি না রে। তুই আমার বন্ধু। একটু সাহায্য করবি?
আগ্নেয়
একটু যেন চমকে উঠল। তারপর বলল, নিশ্চয়ই। তারপর একটু থেমে বলল, বেদপর্ণা খুব ধনী পরিবারের
মেয়ে। ওর বাবা ফুল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
তাই নাকি?
হৃদয় বলল, এত খবর পেলি কোথায়?
নিয়েছি।
কেন? একটু
অবাক হয় হৃদয়। তারপর বলে, আমার এসবে কিছু যায় আসে না...
তোর কোনো
কৌতূহল নেই?
নাঃ।
আশ্চর্য!
আগ্নেয় হাসে। শুধু মেয়েটিকে পেয়েই তুই খুশি! যাইহোক, আমি তোর পাশে আছি।
প্রিয় বন্ধুর আশ্বাস পেয়ে হৃদয়ের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আগ্নেয় তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। প্রিয়তম বন্ধু। তার ওপর আস্থা রাখাই যায়। অথচ কোনোরকম বিপদের আশঙ্কাও নেই। আগ্নেয়কে সঙ্গে নিয়েই বেদপর্ণার সঙ্গে মেলামেশা করে হৃদয়। হৃদয়ের পাশাপাশি হাঁটে আগ্নেয়। কখনও ওরা একসঙ্গে বালিতে বসে পড়ে। সমুদ্রের দিকে মুখ করে গল্প করে। হৃদয় বুঝতে পারে বেদপর্ণারও ওকে ভালো লেগেছে। আর আগ্নেয় সত্যিই ওকে সাহায্য করছে। হৃদয়ের বন্ধু হিসেবেই বেদপর্ণার সঙ্গে মেশে সে। নিজে আলাদা করে কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না। কিন্তু কখনও কখনও অস্বস্তি হয় হৃদয়ের। বন্ধুর ছদ্মবেশে শত্রু মনে হয় আগ্নেয়কে। তিনজনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন হারিয়ে যায় হৃদয়। আর কথার জাদুতে বেদপর্ণাকে মাতিয়ে তুলতে থাকে আগ্নেয়। নানা চমকপ্রদ কথা দিয়ে সে মুগ্ধ করে দেয় বেদপর্ণাকে। সেইসব কথায় মিশিয়ে দিতে থাকে নিজের মেধার ঐশ্বর্যকে। তার কথার জাদুতে বেদপর্ণা যেন মোহিত হয়ে যায়। হাসিতে হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য দুজনেই যেন ভুলে যায় হৃদয়ের কথা। একদিকে ওদের দুজনের ঘনিষ্ঠতা হৃদয়ের ভালো লাগে। ওরা দুজনেই তো ওর খুব প্রিয় মানুষ। ওদের মধ্যে সহজ বন্ধুত্বে সম্পর্ক সে একান্তভাবেই চায়। অন্যদিকে সে বুঝতে পারে, ওদের মধ্যে যে বিনিময় চলছে তাতে তার কোনও জায়গাই নেই। আগ্নেয় সচেতনভাবে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টী করেছে, যেখানে বেদপর্ণাই একমাত্র শ্রোতা এবং হৃদয়ের সেখানে ঢোকার কোনো সুযোগই নেই। আগ্নেয় ওকে ছাপিয়ে যেতে চাইছে এবং সেটা বেদপর্ণার কথা ভেবেই। আগ্নেয়কে তবু সন্দেহ করতে ইচ্ছা করে না হৃদয়ের। বন্ধুর প্রতি নিখাদ ওর ভালোবাসা। এই বন্ধুত্বের দাম ওর কাছে অনেক।
এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটে, যেটা হৃদয়কে রীতিমতো ভাবাতে শুরু করে। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় আগ্নেয়। সে বাড়িতে যায় নি। হৃদয়পুরেও নেই। টানা দুদিন কোনও খবর নেই। ফোন সুচড অফ। আগ্নেয়র বাবা ফোন করে হৃদয়কে বলেন, ওর মা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। রাতে ঘুমোচ্ছে না। পুলিশে খবর দিলে তুমি জড়িয়ে যাবে, তাই আমরা অপেক্ষা করছি। যে ভাবে হোক ওকে খুঁজে পেতেই হবে...
কিন্তু আগ্নেয় কোথায় যেতে পারে, সে ব্যাপারে হৃদয়ের কোনও ধারণাই নেই। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে সে। বিকেলে বেদপর্ণার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ছটফট করে। সব কথা জানায়। বেদপর্ণাকে দেখে কিন্তু শান্তই মনে হয়। মুখে বরং কৌতুকের ভাব। বিশেষ কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করে না সে। শুধু বলে, একটু ধৈর্য ধর। ঠিক ফিরে আসবে।
হৃদয় একটু
অবাকই হয়। ও এত নিশ্চিত হচ্ছে কী করে? বলে, আগ্নেয়র বাড়ির যা অবস্থা, তাতে শান্ত থাকা
যায় কী?
বেদপর্ণা
কিছু বলে না। আগ্নেয় ফিরে আসে তৃতীয়দিন সকালে। সরাসরি হৃদয়পুরে আসে। ফোন করে বাবা-মাকে
আশ্বস্ত করে। দূরের একটা দ্বীপে গেছিল সে। সেখানে রয়েছে অনুচ্চ এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব মনোরম। সারারাত সেই পাহাড়ের চূড়ায় কাটিয়েছে আগ্নেয়। সে রাতে
ছিল জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নার অপূর্ব শোভা সে উপভোগ করে এসেছে।
কিন্তু
কথাটা তো বলে গেলেই হত। হৃদয় হাঁফ ছেড়ে বলে ওঠে।
গেছিলাম
তো।
গেছিলি?
কাকে? হৃদয় অবাক হয়।
আগ্নেয় আর কিছু বলে না। রহস্যময়ভাবে চুপ করে যায়। বিকেলে বেদপর্ণার সঙ্গে দেখা হয় ওদের। আগ্নেয় ওকে সবিস্তারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনায়। বেদপর্ণা মুগ্ধ হয়ে শোনে। তারপর হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কিন্তু ওকেও কিছু বলিনি! এইভাবেই নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেয় সে।
তাহলে বেদপর্ণা
সবই জানত। একমাত্র সে-ই জানত, আর কেউ জানত না? ওর জন্যেই এত কিছু? নিজের মা-বাবার কথাও
ভাবল না আগ্নেয়? কিন্তু কেন সে এত কিছু করল? কী পেল এর বিনিময়ে? এই জায়গাতেই খটকা লাগল
হৃদয়ের। বেদপর্ণাকে তাক লাগিয়ে দিতেই এত কাণ্ড আগ্নেয়র! কিন্তু কেন এই তাক লাগিয়ে দেওয়ার
চেষ্টা? কেন এই গোপনতা? কেন শুধু ওদের দুজনের মধ্যেই এরকম একটা বোঝাপড়া? এ কী কোনও
বন্ধুর মতো কাজ?
হৃদয়ের কাছে গোটা ব্যাপারটাই খুব দুর্বোধ্য মনে হল। সবকিছুই আগের মতোই রয়েছে। আগ্নেয় হৃদয়ের বন্ধু হিসাবেই বেদপর্ণার সঙ্গে মিশেছে। বেদপর্ণাও হৃদয়কে মাঝখানে রেখেই আগ্নেয়র সঙ্গে মিশেছে। তবু সব কিছু যেন আগের মতো নেই। ওদের মধ্যে একটা গোপন বোঝাপড়া রয়েছে যেখানে হৃদয় বাইরের লোক। এই কথাটা ওকে ভুলতে দেয় না ওরা। ওদের উপস্থিতিই হৃদয়কে ওকথা মনে করিয়ে দেয়।
পনেরো দিন পরে বেদপর্ণা চলে যায়। কয়েকদিনের মধ্যেই ফোনে সে হৃদয়কে জানায়, সে বিদেশে চলে যাচ্ছে। হৃদয় যেন তাকে ভুলে যায়।
হঠাৎ করেই
আগ্নেয় যেন বেদপর্ণার তীব্র সমালোচক হয়ে ওঠে। সমস্ত রোষ উগড়ে দিয়ে সে বলে ওঠে,
মেয়েটি
তোকে ঠকিয়েছে। খুবই চালাক মেয়ে একটি...
হৃদয় কিন্তু
বেদপর্ণার ওপর রাগ করতে পারে না। বরং সহানুভূতির সুরেই বলে, না, না, ঠকাবে কেন? তেমন
করে তো আমাদের সম্পর্ক দানাই বাঁধেনি। এই তো সামান্য ক’টা দিনের ব্যাপার, তার চেয়ে
এই বরং ভালো হয়েছে, ও সৎভাবে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে, ও সৎ বলেই আমাকে মিথ্যা আশা দিয়ে
প্রতারিত করতে চায় নি...
আগ্নেয় কিন্তু কিছুতেই শান্ত হয় না। হৃদয়ের সঙ্গে কিছুতেই একমত হতে পারে না সে। বেশ কিছুদিন ধরে বেদপর্ণার নামে বিষোদ্গার করতেই থাকে। আর এতেই যেন আরও বেশি করে অবাক হয়ে যায় হৃদয়। সে ভাবতে থাকে, বেদপর্ণার প্রতি এত বিষ কোথায় জমিয়ে রেখেছিল আগ্নেয়? বেদপর্ণা যখন ছিল, তখন তো এই বিষের সামান্য আভাসও টের পাওয়া যায়নি। তখন বরং মধুরই একটু বাড়াবাড়ি ছিল! নিজেকে একটু বিভ্রান্তই লাগে হৃদয়ের। মধু না বিষ কোনটা সত্যি, কেন মধুর এই হঠাৎ বিষে বদলে যাওয়া, ঠিক বুঝতে পারে না সে। কিন্তু আগ্নেয়র কথাগুলোকে মেনেও নেয় না। বেদপর্ণার প্রতি অনুকূল মনোভাবই স্থায়ী থাকে।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন