শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জি

 

সমকালীন ছোটগল্প 


‘আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো’    

   

“তুমি এই ক’দিন বাথরুম যাওয়ার আগে আমায় বোলো, আমি ফ্লাশ করার  ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেবো। আসলে বাবা মাঝে মাঝে আমাদের বাথরুমটা  ব্যবহার করে তো!” এই ক'দিন মানে চারদিন। ঋতুস্রাবের সময়টা। রঞ্জিতা কি আজও এই সময়টার বিশেষত্ব বোঝে? রক্ত দেখলে শুভর অস্বস্তি হয়। ও শুধু এটুকু বোঝে। অ্যাকিউট ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন। কাউন্সিলর বলেছে রঞ্জিতাকে। সব ভুলে যাচ্ছে ও ইদানিং। এমন কী ওয়াশরুম ব্যবহারের পর ফ্লাশের কথাটাও।  ওদের যৌথ পরিবার। কখনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। জলে রক্ত ভাসে। এসব নিয়ে কথা বলা যায় না। “তোমার মাসিকের কোন সমস্যা নেই তো,  আসলে বিয়ের দু’বছর হয়ে গেলো, এখনো বাচ্চাকাচ্চা হলো না!” শাশুড়ি শুধু  একদিন বলেছিল। শুভ এই মুহূর্তে এসব চায় না। রঞ্জিতা বোঝে। কিন্তু এসব মনে থাকে না ওর।

রঞ্জিতা অন্তর্মুখী। শুভর সঙ্গে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। বেশ কয়েকবার বাইরে দেখা করেছে ওরা বিয়ের আগে। ওই টুকটাক। রেস্তোরাঁ, সিনেমাহল, অন্ধকার, আলগোছে ছোঁয়াছুঁয়ি। রঞ্জিতা সিঁটিয়ে ছিল। সহজ হতে সময় লাগে ওর। শুভ যে খুব তাড়াহুড়ো করেছিল তা নয়। ‘এসব ব্যাপারে ছেলেরা কত দিন ধৈর্য ধরবে!’ রঞ্জিতার বোন বলেছিল। ‘ছেলেরা’ আর ‘মেয়েরা’ শব্দ দুটো ছোট থেকেই শুনে  আসছে। স্কুল-কলেজ, পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের কাছেই। দুটো শব্দ। অথচ কী তফাৎ! যোজন-যোজন দূরত্ব। একটা বেশ ভারী, সব সময় খানিকটা  জায়গা দখল করে থাকে। আরেকটা হালকা, পালকের মতো। শুধু নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তার অস্তিত্ব। রঞ্জিতা এসব কাউকে বোঝাতে পারে না। আর এইসব তফাৎ একটা ফুলশয্যায় মিটিয়ে ফেলতে হবে? “তোমার সহজ হতে কতদিন সময় লাগবে?” শুভ জিজ্ঞেস করেছিল। রঞ্জিতার খারাপ লাগছিল। সহজ হওয়ার পথে কী আছে? বন্ধুত্ব? একটা লক্ষ্যহীন রাস্তা? অপেক্ষা? আর সেই পথে  সাজানো রামধনুর রং। সব রং ছুঁয়ে যাবে ওদের সম্পর্ক। প্রেম থেকে ভালোবাসা। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি। কথাগুলো শোনার পর শুভর ফ্যাকাশে মুখটা দেখে  বড় মায়া হয়েছিল রঞ্জিতার। কয়েক মাসের মধ্যেই ‘সহজ’ হয়ে গিয়েছিল ইচ্ছে- অনিচ্ছের মাঝের অনুভূতিগুলো। আস্তে আস্তে একটা অদ্ভূত হিমশীতলতা গ্রাস করেছিল রঞ্জিতাকে। ডালে নুন কম, চা’য়ে চিনির পরিমাণ এসব আর মনে  থাকতো না ওর। কিন্তু গানের স্বরলিপি বেশ মনে থাকতো। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গুনগুন করত। “বৌমা একটা কাজ করার সময় অন্য কিছু চিন্তা না করাই ভালো”। রান্নাঘর এখন নিস্তব্ধ। হারমোনিয়ামটা দেওয়ালের বাঙ্কারে তোলা।  বাঙ্কারটা বেশি নাড়াচাড়া পছন্দ করে না শুভ। রঞ্জিতা কি পছন্দ করে? ওর সহজ হওয়ার পথে পথে পাথর ছড়ানো?

সময়, পথ, সম্পর্ক। শুধু এগিয়েছে। আর গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ যোগ হয়েছে। “স্বামীর সঙ্গে সুখে-শান্তিতে কোথায় ঘর করবি, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, তা নয়, যত হাবিজাবি!” রঞ্জিতার মা ওকে বোঝায়। “এখানে এতদিন নিজের মত  থেকেছিস!” এবার তবে কার মতো হতে হবে? মনের ছাঁচটা পাল্টে ফেলতে হবে?

ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহার করা ন্যাপকিনগুলো একদিন ডাস্টবিনে ফেলতে ভুলে  গিয়েছিল রঞ্জিতা। কেউ বোধহয় বাথরুমে ঢুকেছিল পরে। রঞ্জিতার আবছা মনে পড়ে, তারপরই বাড়ির দেওয়াল, আনাচে-কানাচে গুনগুন। রঞ্জিতা বোধহয় অসুস্থ, নইলে এমন জিনিসও কেউ ভুলে যায়! ‘এমন জিনিস’। কথাটা অনেকদিন মনে ছিল রঞ্জিতার। তাহলে স্বাভাবিক কোনটা? রঞ্জিতা কি এমন জিনিস আর স্বাভাবিকের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছে? ও নিশ্চয়ই অসুস্থ। তাই রাজি হয়েছিল মনোবিদের কাছে যেতে।

শুভ একজন আয়া রেখেছে রঞ্জিতার জন্য। ওষুধপত্র, কমোডের ফ্লাশ সব মনে করিয়ে দেয়। রঞ্জিতার মা শুভর কাছে কৃতজ্ঞ। “তুই অসুস্থ, তাও ওরা ওকে মেনে নিয়েছে'”। রঞ্জিতার নাকি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ওই পরিবারের কাছে। কৃতজ্ঞতার  ভারে ওর মাথা নুইয়ে পড়ে। মাথা তুলতে পারে না।

আয়া মেয়েটি রোজ নিজের বাড়ির গল্প শোনায় রঞ্জিতাকে। ওর আপনজনেদের গল্প। রঞ্জিতা হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে। ওর বাড়ি কই? আপনজনের গল্প নেই কেন? সন্ধ্যেবেলায় শুভ ফিরলে আয়া চলে যায়। ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। রঞ্জিতা তখন কড়িকাঠ গোনে। কড়িবরগা ওর প্রিয়। যেমন ওর প্রিয় রক্ত। মনের রক্ত। ও দেখতে পায় না। তাই ঋতুস্রাবের রক্তের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকে। তখনই ভুলে যেত ফ্লাশ করতে।

শুভ এখন রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। রঞ্জিতা তখন ফুলদানিটা বাঁদিকের জানালায় রাখে। হলুদ ছবিটা টিভির পাশে সাজিয়ে রাখে। সারারাত ঘরে খুটখাট।  সকাল হওয়ার আগেই আবার সব আগের মত করে দেয়। শুভর মনের মতো ঘর করে দিতে হয়। রঞ্জিতার সঙ্গী হয় তখন গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ। ওর মনের জানালায় লেগে থাকা বরফ। উষ্ণতা খুঁজে ফেরা বরফ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন