সমকালীন ছোটগল্প |
আমিনুলের দিন
একটু আগেই ভাষণ চলার সময়ে এলইডির পর্দায় ভেসে আসছিল তার মুখ ও শরীর। লম্বা জোব্বা পরিহিত একজন রাষ্ট্রনায়কের বিশাল চেহারা, তার প্রতিশ্রুতিময় আশীর্বাদ বাণী! কী ভীড়, কী ভীড়! এইমাত্র দু’ঘন্টার মিটিং শেষ হলো, এর জন্যে রাজ্য জুড়ে চলেছিলো চার সপ্তাহের প্রশাসনিক প্রস্তুতি।
বিশাল মঞ্চ। লোকজনদের জন্যে বিশাল বিশাল সামিয়ানা, তাতে গেরুয়া রঙের আচ্ছাদন। সামিয়ানাগুলোর ভেতর বড় বড় এলইডি-টিভির ব্যবস্থা। মঞ্চে দাঁড়ানো রাষ্ট্রনায়কের চেহারাটা তাই দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল!
এটা ছিল দু’ঘন্টার ব্যাপক প্রাদেশিক সমাবেশ। রাস্তার দু’ধারে গাছের সবুজগুলোকে ঢেকে দেয়া হয়েছিলো অগুন্তি নিশানের গৈরিক চিহ্ণে। মোতায়েন ছিল অসংখ্য ভলান্টিয়ার, উর্দি পরা নিরাপত্তা কর্মীদের দল। ল্যাম্পপোষ্টের প্লাকার্ডে লটকে ছিল নেতাদের ছোটো বড়ো চেহারা। দম বন্ধ করা ভীড়।
সমাবেশ শেষ হতেই মন্ডপ ছেড়ে একে একে ফিরে যাচ্ছে ক্যাডারেরা, শ্রোতা, সাধারণ পাবলিকের দল। ফিরে যাচ্ছে দূর দূরান্ত থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা মানুষজন। যারা যারা মিটিং-এ এসেছিলো তাদের সবাইকে বিনা পয়সায় ধরিয়ে দেয়া হয়েছিলো সুদৃশ্য গেরুয়া টুপি, নানা কিসিমের রঙ্গীন রঙ্গীন লিফলেট।
এখান থেকে যারা এখন ফিরে যাচ্ছে, তাদের সবারই মাথায় টুপি! রাস্তায় ঢল নেমেছে গেরুয়া টুপির স্রোত।
ফিরছে আমিনুলও, নতুন দিনের লিফলেটটা ওর বুক পকেটে গোঁজা, এই দাদনের দিনেও হতাশাময় ওর বিকেল। আমিনুলেরা থাকে একটা গাঁয়ে - প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে। কয়েকদিন ধরে ওর তেমনকিছু রোজগারপাতি হয় নি। কেউ বলেছিল মিটিংএ গেলে খাওয়া আর ষাটটা টাকা নগদ মিলবে। দূর গ্রামের রাস্তা থেকে এই লোকটাকেও ট্রাকে ভরে গোরু মোষের মতো এখানে নিয়ে এসেছিলো এক দালাল।
রাজকীয় মিটিংএর শেষে খাবার প্যাকেটটা তো মিলেছে, কিন্তু টাকা দেবে বলেছিলো যে লোকটা, তার দেখা নেই। ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে থাকে দালালটাকে, আর খোঁজে সেই ট্রাকটাকে যেটায় করে সকালবেলায় ওরা এখানে এসে পৌঁছেছিল। মিটিং শেষের উত্তাল ভীড়ে কিছুই খুঁজে পায় না সে। নিজেকে একটা অবাঞ্ছিত মানুষ মনে হয় আমিনুলের। ফাঁফা পকেটে মিটিং-ফেরত ওর শরীরটায় একটা বিমারী জিন ভর করে।
‘শালা ঠগবাজেরা!’- চেঁচানোটা কি জোরে হয়েছিলো? মুখ ভর্তি সূচালু দাঁড়ি, বিরক্তিকর মুখ আমিনুলের। নিজের মাথার গেরুয়া টুপিটাকে খেলার বলের মতো করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল সে, আবার সেটাকেই ক্যাচ করে লুফে নিল, এটা একটা পাগল পাগল মেহের আলির খেলা! এটা এই ভীড়ের মধ্যে একটা অদ্ভূত দৃশ্য! অনেকেরই নজর ওর দিকে।
আমিনুল আবার বলে ওঠে – ‘আমার দিনভরের ষাটটা টাকা মজুরী হাপিশ করে দিল রে! শালা ঠগবাজ কোথাকার!’
সূচালো দাঁড়ি, আমিনুলের চেহারায় কিছু বিশেষত্ব আছে কি? ওকে কয়েকজন লোক অনেকক্ষণ ধরে সন্দেহের চোখে দেখছিল। মুখ থেকে চ্যাঁচানিটা বেরুতেই লোকগুলো ওকে ঘিরে ধরলো। -‘শালা কাটুয়া! এখানে ঝামেলা পাকাতে এসেছিস!’
কথায় কথা বাড়ে। গেরুয়া টুপিটাকে মেহের আলির মতো আকাশে ছোঁড়া? এটা তো এই সমাবেশেরই অপমান! আচমকাই জনা তিনেক লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে আমিনুলের উপর। হঠাৎই শুরু হয় ধোলাই। আক্রান্ত আমিনুল পড়ে যায় মাটিতে।
ধোলাই বেশী এগোনোর আগেই সৎ বুদ্ধির কয়েকজন লোক ওকে তুলে দেয় পুলিশের হাতে! ততক্ষণে মার খেয়ে হাত পা ছড়ে গেছে, গালে রক্তের ছোপ!
এই ঘটনার ঘন্টা খানেক পরে আমিনুলকে নিয়ে জীপগাড়ী ছোটে থানার দিকে। রাজকীয় সমাবেশে শান্তি ভঙ্গের জন্যে ওকে কি শোধনাগারে পাঠানো হবে?
মাথায় টুপি। আমিনুল দেখে, এই প্রাদেশিক সমাবেশের দিনে সামনের কালো পীচের রাস্তাগুলোকেও কারা যেন গেরুয়া রঙ দিয়ে লেপে গেছে।
পুলিশের জীপে আসতে আসতে আমিনুলের চোখে পড়ে, একটা রাস্তার পাশে এঁদো পুকুরের মরা জল। জঞ্জাল শ্যাওলা কচুরিপানা। সেখানে ঠ্যাং ডুবিয়ে মুন্ডু উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো বিশিষ্ট পদ্মফুল!
রাজকীয় জমায়েতে দাঙ্গা বাঁধানো – আপাততঃ এই অভিযোগে বেচারা আমিনুল এখন আটকে আছে থানার লকআপে! ঠিক সেই মুহূর্তেই আমিনুলের ঘরে দানাপানির অপেক্ষায় হা পিত্যেশ করে বসে আছে একটা শতছিন্ন বর্ণহীন ধর্মহীন ক্ষুধার্ত পরিবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন