মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

লাল-নীল-পেন্সিল

 


 (১১)

সময় বের করে আশপাশ ঘুরে দেখে হর্ষ, ভালোই লাগে। এ শহর তার নয়, আপন বলে মনেও হয় না। এখানে সে মোটে দিনকয়েকের ট্যুরিস্ট। সাজানো-গোছানো নিউ-টাউন এরিয়া চওড়া রাস্তার ক্রিসক্রস, ধারে ধারে প্ল্যানমাফিক সবুজসজ্জা, অসংখ্য আবাসন, এবং আবাসনের কাঠামো এসময়ে রাস্তা প্রায় খালি। তবু তার বেশ ভয় করে, সন্তর্পনে ড্রাইভ করে। এদিককার রাস্তার নিয়মবিধি প্রায় কিছু সে জানেনা। লিপিকা বারবার সাবধান করে দিয়েছে ছেলেকে। উদ্দেশ্যহীন চলতে চলতে সল্ট লেক সেক্টর ফাইভ—, প্রাণবন্ত অফিস-পাড়া। অনেক ছেলেমেয়ের ভীড়, ব্যস্ততা, আড্ডা, পথের পাশের দোকানে খাওয়া। সে ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়ে এসেছে। কলকাতায় ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ কতটা চালু তার ধারণা নেই। গাড়ি মোড়ে সুবিধেমতো পার্ক করে রেখে সে ঘড়ি দেখে দুপুরের গরম বাতাস বইছে।

সারি সারি খাবার দোকান কলকাতার বৈশিষ্ট্যফাস্ট ফুডের স্টলগুলো থেকে মিশ্র গন্ধ উড়ে আসছেতেলতেলে চাওমিন-চিলি চিকেন থেকে চটজলদির বিরিয়ানি-মাটন কষাসে তেমন ভোজনরসিক নয়, খিদের সময়ে পেট ভরলেই হল মা’র ক্যান্টিন এখন যথারীতি তার জন্যই চারবেলা ব্যস্ত। সকালে স্নান সেরে পেট ঠেসে জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছেফুটপাথ ধরে সোজা হাল্কা পায়ে অনুদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকে হর্ষ। কাউকে চেনে না এখানে, তাকেও কেউ না। তাসত্বেও বেশ লাগে, সমপ্রজন্মের উষ্ণতার আঁচ স্পর্শ করা যায়একটা ছোটো খাবার দোকানের সামনে ভীড়। ঝড়ের গতিতে হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে খাবারের প্লেট। হর্ষ সেখানে থামে, নিঃশব্দে অদূরে দাঁড়ায়। ইচ্ছে করে কিছু কিনে খেতে। অথচ অস্বস্তি হয়, যেন সে বহিরাগত কেউদোকানের অল্পবয়সী কর্মচারী কাউন্টার থেকে মাথা উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,

-কী খাবেন দাদা?

-কী কী মিলবে এখানে আই মিন্‌ পাওয়া যায়?

-বাঁদিকে বোর্ড পড়ে নিন।

-ও, আচ্ছা।

ছেলেটি আর তার দিকে মন দেয় না। সামনে কিউ থেকে খানিক সরে দাঁড়ানো লম্বা এক মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। দুজনে চোখাচুখি হয় সে চমকায়, মুখখানা খুব চেনা অথচ—! মেয়েটি এবারে পুরোপুরি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। রহস্যময় চোখ সরু করে নির্লিপ্ত মুখে হাসি টেনে এনে বলে,

-কবে এসেছিস?

চিনতে আরও কয়েকমুহূর্ত সময় লাগে হর্ষর, তাকিয়ে থাকে কুর্তি-লেগিং পরা মেয়েটির দিকেচেহারায় বদল এসেছে— মাথায় যথেষ্ট লম্বা, ছড়ানো কাঁধ, সব মিলিয়ে অন্যরকম। মেয়েটি ব্যঙ্গের সুরে বলে,

-চিনতেও পারছিস না? বাহ্‌!

-মাম্‌-পি—শ্রুতি!?

লাইন থেকে একটি ছেলে দুহাতে খাবারভর্তি দুটো প্লেট সাবধানে ব্যাল্যান্স করে বেরিয়ে এসে উঁচু গলায় শ্রুতিকে ডাকে,

-নে ধর। বিন্দাস আড্ডা মারছিস— আর আমি লাইন দিয়ে— ধর জলদি।

-বাঃরে তুই তো নিজেই বললি--!

-ধর ধর— প্রচুর গরম

হর্ষ ছেলেটিকে দেখে— মাঝারি লম্বা, রোগা, কালো, চুলে ছোটো পনিটেল। হাল্কারঙের টী-শার্ট আর পকেটওয়ালা থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরেছে। পায়ে ফ্লিপফ্লপ। হর্ষ ভাবে, এখানে এত ক্যাসুয়্যাল পোশাকে অফিস করে লোকে? ছেলেটি চোখে প্রশ্ন নিয়ে ভ্রূভঙ্গি করে জানতে চায় শ্রুতির কাছে। শ্রুতি হর্ষর দিকে চোখ রেখে বলে,

-এ হর্ষ, আমার বন্ধু।

-ও-কে— তুমিও শেয়ার কর—?

ছেলেটি প্লেট বাড়িয়ে দেয়। হর্ষ সঙ্কোচের হাসি হেসে এক টুকরো আলু তুলে বলে,

-থ্যাঙ্কস্‌ আ লট্‌

-এর জন্যে থ্যাঙ্কস্‌? টু ফর্মাল্‌ ইয়ার!

-আমি ঘর থেকে খাবার খেয়ে বের হয়েছি। শ্রুতি, আমি এবার যাচ্ছি। গাড়িটা পিছে ছেড়ে এসেছি।

-গাড়ি? কিরে শ্রুতি, যাবি? কাজ আছে বলছিলি?

ছেলেটি মাম্‌পির দিকে তাকায়। মামপি মাথা নেড়ে না বলেপরস্পরে কী ইশারা হয় হর্ষ বুঝতে পারে না। আর না দাঁড়িয়ে উলটোদিকে হাঁটতে থাকে। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিয়ে মনে হয় মামপিকে বাড়িতে আসার রিকোয়েস্ট করা হল না। অন্তত দরকারমতো ড্রপ করে দেওয়া যেত যদিও সঙ্গী ছেলেটিকে পছন্দ হচ্ছিল না, কেমন চিপকু—

বাড়ি ফিরে খেয়ে নিয়ে সারা দুপুর ধরে ঘুমোয় হর্ষ। সন্ধ্যের পরে ডেকে তুলে চা দেয় লিপিকা। গরম পকোড়াও  ভেজে এনেছেহর্ষ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে হাসে,

-এত কী বানিয়েছ!

-খুব ঘুম দিলি। গরম লাগে নি? এঘরে এবারে এ-সি লাগিয়ে দেব।

-আমি টের পাই নি। বাবা ভাজি খাবে না?

-দিই না, গ্যাস হয়। আমদের একবার চা খাওয়া হয়ে গেছে। তুই ঘুমোচ্ছিলি বলে ডাকলাম না।

-আচ্ছা মা, আমি শেষ কবে দিদিমার বাড়িতে গেছি মনে আছে তোমার?

-কেন রে হঠাৎ?

-ঘুরে এলে হয় না?

লিপিকার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে চেয়ে সহজভাবে বলে,

-কেমন লাগল এজায়গা, বললি না?

-নট্‌ ব্যাড, ভালোই। তবু—!

-তবু কি?

-নট্‌ এ্যাজ্‌ গুড এ্যাজ্‌ ডেল্‌হি। আমরা ওখানে সেট্‌ল্‌ করতে পারতাম।

-তোর বাবার রুট্‌ এই শহরে, আমারও। তুই নাহয় বউ নিয়ে দিল্লীতে সেট্‌ল্‌ করিস। কদ্দূর গেছিলি?

-সেক্টর ফাইভ অবধি— অফিস এরিয়া।

-বাবা, অতখানি? পুলিশে ধরলে বুঝতিস।

-সেটা খুবই ভয় লাগছিল। জানো মা, ওখানে শ্রুতির সঙ্গে দেখা হল। শ্রুতি মানে মামপি— ছোটোমাসির মেয়ে।

-বুঝেছি।

-ও কি ওখানে চাকরি করে কোনো অফিসে?

-আমি জানি না। পেইন্টিং নিয়ে কাজকর্ম করে শুনি।

-কমার্শিয়াল আর্ট?

-এত জানি না।

হর্ষ মায়ের বিরাগ বুঝতে পেরে চুপ করে যায়। ঘড়ি দেখে, নিজের কাজের বিষয় ভাবে। মাঝরাত অবধি কাজ করতে হবে। বিরস মুখে বলে,

-এখন এত ফ্রাই খেলে, ডিনার করব কখন?

-দেরি করে খাস।

-সাড়ে ন’টা নাগাদ কিন্তু কাজে বসব— চলবে টানা রাত সাড়ে-বারোটা একটা অবধি।

-ও, আচ্ছা।

হর্ষর চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাপ-প্লেট গুছিয়ে উঠে যাওয়ার সময়ে লিপিকা বলে,

-পরশু মামপির একটা একজিবিশন ছিল, সেখানেই যাচ্ছিলাম

-তাই নাকি? কোথায়?

-ওই ওদের কাছাকাছি হল ভাড়া করে— আরো তিনজনের সঙ্গে।

-ও, বাঃ।

লিপিকা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, ইতস্তত করে। বলবে কি বলবে না দোনামনা করে বলে,

-বাবুল!

-হ্যাঁ বলো?

-ফিরে যাওয়ার আগে তোর বাবার কাছে বসিস। সম্ভব হলে গাড়িতে করে কাছাকাছি ঘুরিয়ে আনিস।

-হ্যাঁ শিওর। ওঃহো বাবার জন্যে রঙ-পেন্সিল আর খাতা কিনেছি। দেওয়া হয় নি।

গরমের দুপুর যাই যাই করেও দাঁড়ি টানে না। লিপিকা ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীর তেমন বশে নেই। শোভনের ঘুম ভাঙল, উঠে লাগোয়া টয়লেটে গেল। কত সময়ে আজকাল ফ্ল্যাশ টানার কথা মনে পড়ে না। লিপিকা অসন্তুষ্ট হয়। সে বাথরুমে ঢুকছে দেখলে মনে করিয়ে দেয়। শোভন সতর্কভাবে ফ্ল্যাশ টানে। বাইরে এসে পাপোষে পা মুছে চটি পড়ে। অসহায়মুখে লিপিকার দিকে তাকিয়ে দেখে। বেশি পরিশ্রম হচ্ছে, মুখ ফুটে বলে না কোনওদিন। ছেলেকে ভালোমন্দ খাওয়ানোর ইচ্ছেয় প্রায় সারাদিন কিচেনের গরমে। অথচ বাবুলের বায়না-ঝক্কি কিচ্ছু নেই, ভোলাভালা সরল। নিজেকে একেবারে অকর্মণ্য বলে মনে হয় শোভনের। দুঃখ হয়, দুশ্চিন্তাও— সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ক্রমে লিপিকার ওপরে গিয়ে পড়েছে। এমনকী অনেক সময়ে তার ব্যক্তিগত কাজগুলো পর্যন্ত তালগোল পাকিয়ে যায়। খাতা আর রঙ-পেন্সিলের বাক্স এনে দিয়েছে বাবুল— খুব খুশি হয়েছে সে। বাচ্চাদের মতো সঙ্গে রাখছে।

আর দিনদুয়েক আছে হর্ষখেয়ে-ঘুমিয়ে আর অফিসের কাজ করে কেটে গেল ছোট্ট ছুটিটা। ল্যাপটপ কোলে সোফার ওপরে বসে সে কাজ করছিল। খুব গরম। ঘাম হচ্ছে কপালে, পিঠে, হাতে। মন বসানোর চেষ্টা করছে। বাবার অসুখের বিষয় মাথায় ঢুকে পড়ছে। তার মা খানিক বললেও সে বোঝেনিআসলে বাবার মধ্যে যে ধরণের পরিবর্তন নিয়ে মা উদ্বিগ্ন, তেমন খুঁজে পায় নি। অবশ্য শোভন আগের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে চুপচাপ, অন্যমনস্ক। কিন্তু অস্বাভাবিকতা আছে বলে মনে হয়নি। এমনিতে বরাবরের শান্ত মানুষ, কথাবার্তা কম বলেনিঃশব্দে অফিস গেছে, এসেছেসুনাম নিয়ে রিটায়ার করেছে। বিপুল সংখ্যক বন্ধু-বান্ধব, হৈচৈ, আড্ডা তাদের বাড়িতে ছিল না।

ধীর পায়ে খাতা পেন্সিল বগলে শোভন এসে হর্ষর পাশের সোফায় বসে। চোখে তৃপ্তির হাসি। উৎসুক স্বরে বলে,

-বাবুল, তুই কি খুব বিজি এখন?

-হ্যাঁ বাবা। কাজটা শেষ হলে কথা বলি?

-তুই কাজ কর। আমি বিরক্ত করব না, বসে থাকব।

-আচ্ছা।

হর্ষ হেসে কাজে মন দেয় এবং পারিপার্শ্বিক ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ একভাবে ঝুঁকে ঘাড় টনটন করতে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে সে সোজা হয়, নড়েচড়ে বসে। নিশ্চিন্ত লাগছে, কাজটার আর সামান্য বাকি। রাতে শেষ করে মেইল করে দিলেই চলবে। কালকের দিনটা ফ্রি রাখবে, বাবা-মাকে নিয়ে কাছাকাছি ঘুরে আসবে।

দুপুর ঢলে বিকেল গড়িয়ে এসেছে খেয়ালই হয়নি হর্ষর। ঘাড় তুলে দেখে, পাশের সোফায় একভাবে শোভন বসে আছে। খুব মায়া হয়, ‘বাবা’ বলে ডাকতে গিয়ে শোভনের দিকে তাকিয়ে সে থমকে যায়।

শোভনের চোখ কোন একদিকে নিবিষ্ট হয়ে আছে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে হর্ষ—। দেওয়ালের গায়ে আর  এ্যাকোয়ারিয়মে কাচের জানালার গা-ঘেঁষে আসা পশ্চিমী রোদ। সেই আলোর শেষ রেখা মাছের বাক্সের জলে পড়ে অলৌকিক সুন্দর রামধনুর রঙে আঁকিবুকি কেটেছে। পাশে ছোটো টেবিলের ওপরে তার দেওয়া উপহার সেই সোনালি পাথরের ছোটো টবে কীযেন গাছ বাড়ছে। রোদ ছুঁয়ে তার গা থেকে সোনারঙ ঝিলিক দিচ্ছে। মনের মধ্যে নরম উত্তাপের প্রবাহ অনুভব করে হর্ষ। আলতো করে শোভনকে ছুঁয়ে ডাকে,

-বাবা! কী ভাবছ বাবা?

শোভন মুখ ঘুরিয়ে ছেলের দিকে তাকায়। থরথর করে অস্থির চোখের পলক। যেন ডুব দিয়েছিল কোনো চেনা পুকুরের শান্ত অন্ধকারে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে দ্বিধায় পড়ে গেছে। অজান্তে হর্ষর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে বাবা?

-কী? কই? কিছু না তো!

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একমুখ হাসে শোভন। নিজের দুহাত বাড়িয়ে ছেলের হাত জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলে, আমি তোর দেওয়া ড্রইংখাতার সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করছি, বুঝলি বেটু? কাজ শেষ হলে দেখাব।

(ক্রমশঃ)

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন