মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সিঁড়ি সম্পর্কিত কথকতার স্বপ্নপাগলের শব্দলিখন

 


কোথাও যাওয়া হয় না আর। কোথায় যেন যাওয়ার ছিল। কে যেন ডেকেছিল। বারবার। পিছু ফিরে ফিরে তার কথা ভাবি। কে সে? হয়তো কেউ। হয়তো কেউ না। হয়তো আমারই একান্ত আমি। ডাক দিয়েছিল। ভেতরবাড়ি। অনায়াস অবতরণ সেখানে। তোমার ঘর, ঘরের ভেতর পুতুলসমূহ আর প্রাচীন দরজা। আমার চৌকাঠে পড়ে থাকে খননের গল্পগুলো। সিঁড়ির সান্ধ্যকথা রুমালের ভ্রান্তি জড়ো হয় মনখারাপের পকেটে। তোতার কাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। যেকোনো বাদ এক সীমান্তরেখার ন্যায়। অসময়ে অন্ধকারের প্রমাদ যেমন। পাখিনাশক শব্দগুলো সমস্তই সংবাদ হবে এমন তো নয়। বার্তার কাটা দাগে তোমার আঙুলের ছাপ। আঁক কষা অঙ্কের খাতা অপেক্ষা করে থাকে নতুন সূত্রের। তুমি এক উপপাদ্যের হাত ধরে ধারাপাতে যাবে। শঙ্খধ্বনি অপেক্ষায় থাকে। আমিও। প্রত্যাবর্তনের মুহূর্ত ডেকে ওঠে, পাখি পাখি। ফেরা হয়না আর। যাওয়াও। সম্ভাবনার মোহন মঞ্চ থেকে তুমি গান গেয়ে ওঠো, বেতালা বেভুল।

প্রশান্ত গুহমজুমদারের ‘কাহাদের কথা’ বইটি কেমন লাগল? এককথায় বলতে হলে বলি ভালো লেগেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভালো লেগেছে এই কথাটা ঠিক মতো বলতে পারাই যথার্থ সমালোচনা। এর বেশি কোনো কথা নেই।

বইটি হাতে পেয়ে প্রথম যেখানে চমক লাগল তা এর ভাষা। বইটি আগাগোড়া সাধুভাষায় লেখা। বাংলাভাষার প্রধান সমস্যাই ক্রিয়াপদ। একে তো তারা সংখ্যায় বেশি নয়, তার ওপর যদি সাধুভাষা বেছে নেওয়া হয়, যেখানে চলতিভাষার মতো ইচ্ছেমতো বাঁকানো চোরানো ঘোরানো ফেরানোর স্বাধীনতা কম, তবে তার খুঁড়িয়ে চলার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু এখানেই প্রশান্ত গুহমজুমদার ছাড়িয়ে গেছেন সাধুভাষার সংকট। কবির ব্যবহার এমনই সংযত ও সহজ যে বইটি শেষ করার পর হঠাৎ মনে পড়ে এতক্ষণ সাধুভাষায় কবিতা পড়ছিলাম! চেহারায় সাধুভাষা রেখে ছত্রে ছত্রে চলতিভাষার আত্মিকগুণ সঞ্চারিত করে দিয়েছেন।

কবি বলেন, বলিবার ছিল গাথা। সে কাহাদের কথা? সে কি এই যে “বাতাবিলেবু হইতে আলো চলিয়া গেল, আর ফিরিবে না”-এদের কথা? হয়তোবা। কবির অন্তরে আছে সান্ধ্যকালের নাতিদীর্ঘ দুঃখকাহিনি। তীব্র তার উপলব্ধি। ঝমঝম করে বেজে যায় মনের গহিনে, তীব্র অথচ অস্পষ্ট। হোক সে অস্পষ্ট তবু কবির প্রত্যয় ধ্বনিত হয়েছে তোমরা থাকো, স্পষ্ট হও। অন্ধকারের প্রমাদ, সে তো দোষ নয়, সে কেবল অসময়ের সমাপ্তিরেখা। কবি একটি গল্প বলিতে চান। গাঢ় অন্ধকারের নয়, সামান্য সন্ধ্যার, যেখানে মাঠ একা একা, যেখানে প্রাচীন দরজা খুলে অরণ্য, বৃষ্টির মাতাল বাতাস, সেখানে শরীর আনন্দভবন। বাক্য গেঁথে যে প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল সেই হেমন্তসন্ধ্যা আজ উত্তীর্ণ হয় বোধের আলোয়।

ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন

আমার মধ্যে যে দুটো প্রাণী আছে আমি এবং আমার অন্তঃপুরবাসী আত্মা এই দুটিতে মিলে সমস্ত ঘরটি দখল করে বসে থাকি। এই দৃশ্যের মধ্যগত সমস্ত পশুপক্ষী প্রাণী আমাদের দুজনের অন্তর্গত হয়ে যায়।

প্রশান্ত গুহমজুমদারের কাব্যগ্রন্থটি পড়তে গিয়ে যেন এই দুটিতে মিলে এক জীবনের সন্ধান চলে, অবিরাম আলোর খোঁজ। অনুভব করেন, দুয়ার আসিয়া দাঁড়াইল দুয়ারে এবং সে দুয়ার খুলেছে। কিন্তু কোথায় সেই আলো? এ তো গহন রাত্রির অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবির মনে পড়ে বিকেলের পথ। যে পথ রৌদ্রদগ্ধ নয়, নয় সে কুটিল অন্ধকারে আবৃত। সেখানে শুধু গোধূলির ম্লান আলো। মনে হয়েছিল সে পথের বুঝি শেষ নেই। কিন্তু না, সব পথ একদিন শেষ হয় নিগূঢ় অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে যেখানে শৃগালেরা শুধু তৎপর। তবু কবি প্রতীক্ষা করেন। কেহ নামিয়া যাইতেছে পথে কোথা থেকে অবতরণ? যখন গরাদসকল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন বিষণ্ণ আত্মমগ্নতা থেকে তীব্র আকাঙ্ক্ষায় কবির প্রত্যয় উচ্চারিত হয় কেহ একজন থাকিবে কোথাও দূর পথে। তাঁর অন্তরে আছে বন্ধনমুক্তির নিশ্চিত প্রত্যয়। তারই তরে চলে তাঁর অন্তহীন প্রতীক্ষার অভ্যাস

এবংবিধ আয়াসে তোমাকে দেখিনা। সাদা, কেহ নামিয়া যাইতেছে পথে। মনে পড়িতে পারে দরজার কথা, জল হইতে আসিয়াছে, খুব নৈঃশব্দ শাসন করিতেছে সকালবাতাস। স্পষ্ট হইতেছে গরাদসকল। মনে পড়ে একজন ছিল। বোধ হয়, থাকিবে কোথাও দূর পথে। ক্রমশ আবার, যেরূপ প্রতীতি হয়, ফিরিয়া আসিবে ওই গোলাপ উঠোন। এবং এ প্রকারে স্পর্শ নয় কেবল অপেক্ষার অভ্যাস করি।   [অবতরণ]

বইটির শুরুতে প্রশান্ত গুহমজুমদার নিজের কবিতা ভাবনা নিয়ে বলছেন

কবিতা লিখি না, এক খোঁড়া প্রতিবন্ধী স্বপ্নপাগলের মতো শব্দ লিখি আমি। যে শব্দ মাসিপিসির আশ্রয় ছেড়েছিল একদিন, তারা আজ খেলা করে নবান্নের আশেপাশে। হোক সে প্রত্যয় অসমান তবু তারা নেমে আসে পথে। 

শব্দ ও তার অর্থ আর ধ্বনি নিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছিলেন

গদ্যের বক্তব্য পাঠক বুঝে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেই অর্থের বাহন যে ধ্বনিপুঞ্জ তা নিস্প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেন বক্তার তীর থেকে নদীর ওপারে শ্রোতার তীরে একটি রেলগাড়িকে পার করে দেওয়ার দরকার পড়েছিল বলে আলাদিনের জিন মুহূর্তের মধ্যে ঠিক মাপের একটি সাঁকো তৈরি করে ফেলল। তারপর রেলগাড়িটি যেই ওপারে নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেল, অমনি সাঁকোটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। [আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ আবু সয়ীদ আইয়ুব]

কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে তা হবার নয়। অর্থ বোঝানোর পরও শব্দ ও ধ্বনি পাঠকের চেতনায় আবার একবার নবজন্ম লাভ করে। সেখানে সাঁকোটা মিলিয়ে যায় না। বরং অপেক্ষায় থাকে। সেখানে তো শুধু যাওয়া নয়, সেখানে যাতায়াত। নিরন্তর যাওয়া আর ফিরে ফিরে আসা।

আমার কথায় ক্ষান্তি দিয়ে বরং কবির একটা কবিতা পড়ি

এইরূপে একজন চেয়ারে আসিয়া বসে। টেবিলে, এইরূপে প্রতীতি হয়। সাদা হাত, যেন মধ্যরাত্রি, ধরে বলি সুজনেরা আছে, সামান্য কেবল জলের প্রভেদ। আপেক্ষিকতার গল্প বলি তাকে। দুপুরের প্রচুর রৌদ্রে বনভোজনের। এবং এক নারীর, অপেক্ষা করিয়া আছে, স্তন জুড়ে তার অপরূপ ব্যথা। এ রূপ বলিলে দেখি নতমাথা ক্রমশ তীব্র, বহুদিন আরকের পরে যেন, বহুদিন ঘুমের পরের দিন। তার শুধু মনে পড়ে সুস্থির একটি বিছানা। যেন তার খুব তৃষ্ণা পায়। [তৃষ্ণা]

এমনই নিখুঁত শব্দচয়ন, ঘন সন্নিবিষ্ট বাক্যনির্মাণ কবির কাব্যসৃষ্টিকে করেছে অতুলনীয়। তিনি পঙ্‌ক্তি সাজিয়ে পদ্য রচনা করেননি। গদ্য ও পদ্যের দুই বিভাগের মাঝখানে তো কোনও অলঙ্ঘ্য কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া নেই। এপারে ওপারে তার অনায়াস আনাগোনা। সীমানা রদবদল চলেছে অবিরাম। এ যেন জীবনের অনুকরণ করে না। বরং জীবনের একটা প্রতিরূপ আর প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করে চলে।

কবি আছেন ‘তুমি’র খোঁজে। নিরন্তর নিরবধি সেই খোঁজ। গান বাজতেই থাকে। খুব সহজ গান, আলোর মতো ভেসে যায় বিশ্বচরাচরে। প্রভাতবেলার কাছে হাত পেতে কবির অন্তহীন প্রতীক্ষা কখন তোমাদের অসময় হবে। কবি তো জানেন পদ্মঅতিরিক্ত তুমি নাই এ মোহনমঞ্চে, ভ্রমরের গুঞ্জনহীন শুধু দুটি পদ্ম আছে। কার্যকারণ সহ গণিতের সমাধান সম্ভব। যেখানে থাকে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। তবু সেই দলবদ্ধতা থেকে গোষ্টী থেকে কেউ কেউ একা হয়ে যায়। রোদ্দুর আর বৃষ্টির মধ্যে বসত করে। হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তপাত

বাক্স বলিতে যে রূপকথা, সেইখানে তোমাকে খুঁজিতে থাকি। অপরূপ সে সুদর্শনে। দেখি অর্গলহীন সে প্রতিভার কোলে বিলাস করিতেছে শুধু দুইটি পদ্ম। আর কেহ নাই। এবং ভ্রমর নাই দৃশ্যত। খুব বাল্যকালের মত হাত রাখি সে কৃষ্ণকোমলে। সঙ্গীত বাজিতে থাকে। জলসবে দেখি হাসিতেছে আলো। আর ভয় করে। এ প্রকার যোগ্যতাহীন, মর্মরগাত্রে এতখানি! রাক্ষস ভয় করি। এক অসম যুদ্ধের। অথচ তুমি নাই। বস্তুত পদ্মঅতিরিক্ত তুমি নাই এ মোহনমঞ্চে! [এ মোহন মঞ্চে]

ছন্দ অস্বীকারের স্পর্ধা করেন কবি। করতেই পারেন। কারণ শব্দস্ফটিক নির্মিত এই কথকতা অপরূপ গূঢ় ছন্দে বাজতে থাকে অন্তরমহলে। দেয়াল ঘড়ির সময়ের কলকাঠি উপেক্ষা করে মুছে দেয় দেশ-কালের পদছাপ। উত্তীর্ণ হয়ে যায় দশকের গণ্ডি। নির্দিষ্ট আয়তক্ষেত্র অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কবির পথচলা। সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে কোথায় যেন পৌঁছতে চান। কীসের যেন উন্মোচনের অপেক্ষায় কবি চক্ষু হইতে চক্ষু খুলিয়া রাখেন। চোখ দিয়ে আমরা কতটুকু দেখি? অনুভবে গ্রাস করি। আপন স্বপ্নফেরি নিয়ে ছুটে যাই অসময় হতে। সময়কে ফেলে যাই দূর বিস্মরণে। তবু কিছু রয়ে যায় বাকি। স্মৃতিকোটরে। তাই কবি বলেন যাদের স্মৃতি নেই তাদের সিঁড়ি আছে, আরোহণের। কিন্তু দরজা তো সকলের থাকে না। অন্ধকারের পথ চলতে চলতে আমরা উত্তরণের পথের অপেক্ষায় থাকি।

পুষ্পচন্দনে শোভিত প্রণয়ের গান, একটা পারম্পর্যহীন সিঁড়ি নেমে আসছে এই দৃশ্যের মাঝখানে বসেও কবির প্রার্থনা “কেহ আমাকে বলুক, এই দৃশ্য আমি রচনা করি নাই” কার কাছে এই প্রার্থনা? সে কি অলখপুরীর কেউ? জীবনে পূর্ণতার স্বাদ কখনও মেলে না। মানবজীবনের এই নিরন্তর স্রোতধারায় কেবলই হা-অমৃত হা-অমৃত করে ফেরা। বহুতর আশা আকঙ্ক্ষার প্রার্থনা নিয়ে মানুষ চলেছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আর সেই চলনের কথকতা কবির কাব্যে। সিঁড়ি আর দরজা সম্পর্কিত কথকতা সমস্ত বইটি জুড়ে। যে সিঁড়ি বেয়ে আমাদের অবতরণ আর আরোহণের গল্প। যে দরজার ওইপারে কেউ যেন অপেক্ষায়, অন্তহীন

সিঁড়িসম্পর্কিত কথকতায় ইদানীং আমি আছি। সুতরাং পিপিলিকাসকল, মেঘবৃষ্টির গল্প এখন বলিতে পারো। টিকাকার আসিবে না। তাহাদের নকশীকাঁথা আছে। পরিত্যক্ত চেয়ার হইতে বর্তমানে কি প্রকার ছায়া যেন উঠিয়া আসে। তাহাদের ঐতিহ্য নাই। কথকতায় সুতরাং রেলগাড়ি ঝমাঝম মেধাবিক্রয় এবং কামিনী আসিবে। সাদার সহিত কুঝিকঝিক বেদনা, ঈষৎ চুম্বন, তোমরা আপত্তি করিও না, একজনকে একারণে দেখিয়াছি অঙ্ক হইতে চলিয়া গিয়াছে একাঘরে। হে শ্রমজীবিসকল, মনে রাখিও, তোমাদের ও পথে সামান্য শর্করা হয়ত বিদ্যমান, অভিমান এবং অশ্রু ততোধিক।   [মেঘবৃষ্টির গল্প]

কবির অলখ ইঙ্গিতে বিনয় মজুমদার, যিনি জ্যামিতির স্তরে স্তরে পুঞ্জীভূত করেছিলেন অভিমান আর অশ্রুর কথামালা। যিনি মনে করতেন কবিতাই একমাত্র সেই অসীমের দিকে নিয়ে যেতে পারে যে অসীমে আছে ম্যাথস। হাসপাতালের গরাদ পেরিয়ে তাঁর প্রত্যয়ী অসম আঁক কষা। গণিতের মমতা নিয়ে জটিল মনন রোদ্দুরস্বপ্নে পথ হেঁটেছিল একাকী। প্রেমের অন্তর্নিহিত অঙ্কটা বোঝা হয়নি। কোনো অঙ্কের সূত্রই কি বাইরে থেকে আসে? বোধহয় না। আসে মানুষের ভেতরের জটিল আবর্তের উদ্ঘাটন থেকে। বাইরে থেকে কেউ যাত্রা করে না, ভিতর থেকে যাত্রা করতে হয়। তাই প্রশ্ন ওঠে, কেন তাঁর এই একাকী ভ্রমণ? তবে কি নিজের ভিতরের জটিল আবর্তের জটটা খুলতে পারে না মানুষ? আর সেই না পারার বেদনাই একাকিত্বের কারণ?

কবি ফেরার কথা বলেন। লাল পিঁপড়ের ঘরে ফেরার কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু কোথায় সে ঘর? খোয়াই শাল মহুয়া কোন দিকনির্দেশ? যৌথতা ভেঙে একক যাপন, একা একা। প্রাচীন শাল মহুয়ার ছত্রছায়া ছেড়ে শুধু কদমনির্জনে রাধাকৃষ্ণ যাপন। সেই ঘর আর ঘরের মধ্যে পুতুল দেখেন কবি। মানুষ বুঝি দেখেন না। তাই গৃহত্যাগের সাধ হয়। কিন্তু সাধ পূরণ হয় না। মন যেতে চায় অন্যকোথা অন্য কোনোখানে। কিন্তু যাওয়া হয় না। সংসারে জন্মমুহূর্তেই বিধাতার হাত ধরে আমমোক্তারনামা লেখা হয়ে যায়। আর সেই অলিখিত দলিলের অলিখিত নিয়ম মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় পুতুলের হাত ধরে অনন্ত যাত্রা। প্রাত্যহিকতার নৈরাশ্য তাকে গ্রাস করে ক্রমশ। মনে প্রশ্ন ওঠে “এমন আঙুলে কি আগুন সম্ভব”। তবু কবির মননে থাকে অশ্রুময় সংগীতের অনুলিপি। আলাপের অর্বাচিনতা স্বীকার করেও কবি অপেক্ষা করেন তুমুল বৃষ্টির নৈঃশব্দ্যের। সেটুকু নিয়েই কবি পাড়ি দিতে চান। বাধ্যতামূলক দিনযাপনের মধ্যেও অপেক্ষা করে থাকেন। কীসের অপেক্ষা? স্বপ্নপাড়ির?

লাল পিঁপড়ের কথা শুনি। ঘুমোই স্বপ্ন পিঁপড়ে লাল দেখে। পড়িতে পারে মনে পথ ঘরে যাওয়ার। ঘুমোই। অতীব বিশ্বাস লব্জে আমার। ওঠে নামে দোহারীর আপেলখণ্ড। কদমনির্জনে রাধাকৃষ্ণ। ধারাপাতের অভাবে ফুলে তেমন হলুদ কই! এ কারণে খোয়াই হইতে যুবতী ফিরিয়া আসিতেছে, বিষণ্ণ। স্তনযুগল অনর্থক রাত্রি জাগিল। লাল পিঁপড়ে একটু একটু অনটনের কথা বলে। একা একা। শালমহুয়ায় আর যৌথযাপন নাই। অন্ধ প্রদীপে কি যোগাযোগ সম্ভব! সাদা বিছানা রাখিয়াছি। ঘুমোই। লাল পিঁপড়ে সামান্য ঘুমোক। খ্যাপা পাগলে গান গাহিতেছে। [ঘরের কথা]

 

 

কবির সহজাত শব্দ প্রয়োগে অনুপম সংকেতময়তা। কবিকথনের এই ভাষাই নতুন কবিতার নতুন ভাষা, যা ধ্বনিময়, দৃশ্যময়। কবি সম্ভাবনার কথা বলেন। যেমন বাক্যবিনিময়ের সুতো, যখন লাটিম থেকে খুলে খুলে যায় তার সম্ভাবনার পথ বহুদিকে বিস্তৃত হয়। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। কিছু আলোর কথা, কিছু বা অন্ধকারের ব্যথা জড়িয়ে যায় পায়ে পায়ে। শুধু বুঝি রয়ে যায় অসংবদ্ধ প্রলাপগাথা। এ যেন বস্তু আর বিষয়ের কেন্দ্র থেকে ভাবনা শুরু করে ছড়িয়ে পড়া। এ যেন অন্ধকার নাভিকুণ্ডল থেকে আলোকমণ্ডলে যাত্রা। যে আলোকযাত্রা বর্ণময় উজ্জ্বল ও সচল। 

যে কবির কথকতা থেকে আমার এইসব কথা ও গাথা তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় :


 

প্রশান্ত গুহমজুমদার : জন্ম ও বাস পশ্চিমবঙ্গ। সত্তরের দশক থেকে লেখালিখির শুরু। ২০০৮ সালে কৌরব থেকে প্রকাশিত হয় “কাহাদের কথা”, যার ভূমিকায় বারীন ঘোষাল লিখছেন প্রশান্ত গুহমজুমদার সেই ব্যতিক্রমী কবি যিনি প্রবীণ ভাষার ধ্রুপদী আচরণ অন্যথা করে তাকে ব্যবহার করেছেন নতুন কবিতা রচনায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জলে রাখো, শুদ্ধতায়” (অভিষেক, ১৯৮২)। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা আট “যাত্রা পুস্তক”(কবিতা পাক্ষিক, ১৯৯৮), “রম্যরচনা” (কবিতা ক্যাম্পাস) “কাহাদের কথা”(কৌরব, ২০০৮), “এইখানে যত শব্দ” (এখন বাংলা কবিতার কাগজ, ২০১৬), “ইতিবৃত্তের বেলুন (কৌরব, ২০১৭) ইত্যাদি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন