মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

সুষমা ভট্টাচার্য

 

প্রেমের রক্তাক্ত আন্দোলন




গত প্রতিবেদনে একটি গয়না নির্মাণ সংস্থার বিজ্ঞাপন নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক  আবহ তৈরি হয়েছিল, সেই নিরিখে একটা অভিমত তুলে ধরা হয়েছিল। তবে সেই প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার মধ্যে আরও একটা বিষয় উঠে এসেছিল, লাভ-জিহাদ।

লাভ-জিহাদকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়, যখন দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, তখন সেই সম্পর্ককে বলা হয় লাভ-জিহাদ। লাভ-জিহাদ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে যে অর্থ উন্মোচিত হয়, সেটা  অনেকটা এরকম। লাভ = প্রেম এবং জিহাদ = বিদ্রোহ। অর্থাৎ যে প্রেম বিদ্রোহী, সেই প্রেমকেই বলা হয় লাভ-জিহাদ।

এখানে মজার বিষয় হল, যে প্রেম মানুষকে উদার করে, শান্তির পথে হাঁটতে  শেখায়, এখানে সেই প্রেমকেই বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। বিদ্রোহ শব্দ উচ্চারণ করলে প্রথমেই হিংসা, রক্তপাত, হানাহানির চিত্র চোখের সামনে আসে।   এখন প্রশ্ন হল, এরকম বিপ্রতীপ অবস্থান একটি পন্থায় হতে পারে কী করে?

যারা এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত তারা অবগত যে, এই শব্দটি কেবল তখনই  ব্যবহৃত হয়, যখন দুই বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রেম সম্পর্কিত প্রসঙ্গ ওঠে। হিন্দু ঘরের নারী/পুরুষ শিখ, বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান ধর্মে প্রেম করলে এই তকমা তার জোটে না, কিন্তু বিশেষ ধর্মে প্রেম করলেই তাকেই বলা হয় লাভ জিহাদ। এর বড়ো কারণ হল, দুই ধর্মের মধ্যে স্পর্শকাতর সম্পর্ক। আর এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। এই সম্পর্ক এতটাই স্পর্শকাতর যে, এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়েছিল। গভীরে গিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে গেলে হয়তো দেখা যাবে যে, দুই ধর্মের মূল  কথা এক, কিন্তু প্রাথমিকভাবে দেখতে গেলে কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে যেগুলো মেনে নেওয়া হয়তো সকলের পক্ষে সম্ভব হয় নয়। তাই কোনো ফিল্ম-এ এই ধরনের সম্পর্ক দেখালে কখনো দাঙ্গা লাগে, কখনো অভিনেত্রীর নামে  ফতোয়া জারি হয়। এই বিষয়টি এতটাই আবেগের উপর নির্ভর করে যে, এটা নিয়ে আমাদের দেশে ভোটব্যাঙ্ক-এর রাজনীতি হয়। ধর্মের নামে গঠিত হয়  রাজনৌতিক দল, সেই দলের আইটি সেলের মানুষরা একে অপরকে গালাগালি দেন আর কিছু লোক কমেন্ট-এর sub threadএ গালাগালি দিয়ে মনে করেন যে, নিজের ধর্মের প্রতি ও জাতির প্রতি তাঁরা বিশেষ দায়িত্ব পালন করছেন।

তনিষ্ক-এর বিতর্কিত বিজ্ঞাপনটি যখন সম্প্রচার হয় তখন অনেকেই এই  বিজ্ঞাপনের বিরোধিতা করেছিলেন লাভ-জেহাদের যুক্তি দেখিয়ে। যতই  সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করা হোক না কেন, আসলে আজও ভারতবর্ষের নানান  জায়গায় নির্মমভাবে  বলি হয় কিশোর-কিশোরী এই লাভ-জিহাদের নামে। ভাবতে অবাক লাগে যে, যারা ব্যক্তিগত জীবনে লাভ-জিহাদের মতো  বিষয়টি  সমর্থন করে না, তারাই সোশ্যাল মিডিয়াতে ধর্ম সহিষ্ণুতার মতো বিষয় নিয়ে  লম্বা প্রতিবেদন লেখে। বা তারা এমন কোনো চিত্র তারকার অন্ধ ভক্ত যিনি এই  নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভিন্ন ধর্মে বিবাহ করেছেন। তাদের যদি আপনি এই কথা বলেন, তাহলে তারা একটা কথাই বলেন, ওসব ওদের মধ্যে হয়। ওদের জগৎ আলাদা। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের জীবনে ওসব হয় না। কিন্তু সত্যিই কি তাই?




বিরল হলেও এমন উদাহরণ আছে যেখানে বিয়ের পর একই গৃহে দুই ধর্মের শান্তিপূর্ণ এবং সাবলীল অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। আসল বিষয় হল অন্য জায়গায় এ দেশে সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ব্যক্তি নির্ভর নয়, গোষ্ঠী নির্ভর। অর্থাৎ অন্যে কী ভাববে? অন্যে কী চাইবে? অন্যের  কথা ভাবতে হয় ঠিকই, না হলে সমাজ চলে না, জীবন চলে না। কিন্তু যে সামাজিক বা ধর্মীয় আদর্শ দুজন মানুষের  প্রাণের আহুতি দাবি করে, নিজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সে আদর্শের পতন যত শীঘ্র ঘটানো যায় ততই মঙ্গল।

সব শেষে কেবল একটা কথা বলার আছে, সবার যে সব বিষয় মতামত একই  হবে এর কোনো মানে নেই, কিন্তু যে মতামত বা আদর্শ প্রমাণ করতে গেলে মানুষের রক্তে রাঙা আতশ কাচের নিচে ফেলে দেখতে হয়, সেই আদর্শ বর্জনই শ্রেয়। কারণ প্রকৃত প্রেম রক্ত পাতের মধ্যে দিয়ে নয়, ক্ষমা আর উদারতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। যারা মানুষকে তার ধর্ম, জাত এই সবের উর্দ্ধে উঠে আপন করে নেন, তারা সমালোচনা নয়, উচ্চ সন্মানে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন