ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(১০)
শাড়ি পরছিল লিপিকা, ইঁটরঙের মুর্শিদাবাদ সিল্ক। চেহারা সামান্য ভারী হলেও ছিপছিপে। বয়স ধরা যায় না। শোভন বিছানায় উবু হয়ে বসেছিল। জানতে চাইল,
-কখন ফিরবে?
-গেলামই
না!
-তাই তো।
-তাড়াতাড়ি
ফেরার চেষ্টা করব। এখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা তো জানো! আর ওই সাইডে কী যে ভীড়—।
-কিসে যাবে?
গাড়ি নিচ্ছ?
-পাগল!
ক্যাব কল্ করেছি। এসে যাবে।
লিপিকা হাল্কা লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট একটা আরেকটার সঙ্গে ঘষে নেয়। আয়না দেখে চিরুনিটা মাথার ওপরে বুলিয়ে নেয়। শোভন সেদিকে তাকিয়েছিল এতক্ষণ। স্বাভাবিক স্বরে বলে,
-ভালো দেখাচ্ছে।
-তাই? শোনো
চা ফ্লাস্কে রেখেছি। কিচেনে ঢুকতে যেও না। আসি আমি।
কুঁচি গুছিয়ে
ওয়ালেট হাতে তুলে নেয়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ায়। জলে ছলাৎ
করে ঘাই মারে শার্কটা। লিপিকার বুকে শব্দ ধাক্কা মারে। মনে মনে বলে,
-কি রে?
যাব না বলছিস?
শোভন পেছনে
এসে দাঁড়িয়েছে। লিপিকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বলে,
-বললাম
যে আমি ল্যাচ টেনে দিয়ে যাব, ভেতর থেকে বন্ধ করবে না।
-তুমি আজকাল
কথায় কথায় রাগ কর। আমি দরজা বন্ধ করতে আসিনি।
লিপিকার
অনুতাপ হয়, আজকাল অকারণে সে শোভনকে প্রায়ই বেশ বকাবকি করে। আসলে ভেতরের উদ্বেগ চাপতে
পারে না অনেক সময়ে। শোভনকে বেশিক্ষণ একা রাখতে ভরসা পায় না। শুধরে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তবে?
-জানলা
দিয়ে দেখলাম একটা ক্যাব—।
-ও-মা,
এসে গেল? ফোন করল না তো? অন্ দা ওয়ে দেখলাম একটু আগে— দেখাচ্ছিল টেন মিনিটস্।
-সেটা না।
মনে হল বাবুল নামল।
-কী? সত্যি
তুমি দেখেছ? আবোলতাবোল বল বলে বকা খাও—।
লিপিকার
ফোন বেজে ওঠে – ক্যাব ড্রাইভারের নম্বর। ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে
ডিংডং করে ডোরবেল্। অনলাইন ক্যুরিয়ার, সিক্যুরিটি কিম্বা ওরকম কেউ — অসহিষ্ণু হয়ে
ওঠে লিপিকা। বেরনোর মুখে আবার বাধা। এখনই আসার দরকার পড়ল কেন কে জানে? আজ না গেলে দেবিকা
অনেক অপ্রিয় কথা শোনাবে। সহ্য হয় না লিপিকার। সংসারের অসমান ভাঁজগুলো কোনোদিন সমান
করা যাবে না। মা’র মুখ চেয়ে এখনও সে ওবাড়িতে দেখা করতে যায়। মা না থাকলে আর যাওয়ার নাম করবে না।
অস্ফুট বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলে,
-কি ব্যাপার?
হর্ষ উন্মুক্ত
হাসিমুখ নিয়ে গলা তুলে বলে,
-মা—!
লিপিকা
খুশি হওয়ার বদলে চমকে উঠে পিছিয়ে যায়,
-তুই! এরকম
ফোন-টোন না করে?
-ভাবো নি
তো! সার্প্রাইজ—।
লিপিকার
চোখ ভিজে ওঠে। সামলে নিয়ে কোনোরকমে বলে,
-আয়।
বেরনো ছাড়া
বাড়িতে মাকে সাজতে, শাড়ি পরতে বিশেষ দেখেনি হর্ষ। হেসে বলে,
-সেজেছ
কেন মা?
-এমনি।
তুই একটু বস। আমি তোর ঘরটা গুছিয়ে আসি। আগে জানলে—!
ফোনে ক্যাব
ক্যান্সেল করে লিপিকা। হর্ষ অনুমান করে,
-কোথায়
যাচ্ছিলে? যাও না, ঘুরে এস। আমি তো থাকব।
-মাথা খারাপ
নাকি?
-বাবা!
কেমন আছ?
শোভন আস্তে
আস্তে এসে ছেলের হাত ধরে দুর্বলভাবে ঘাড় নেড়ে বলে,
-ফাই-ন।
শাড়ি বদলে ঘরোয়া ম্যাক্সি পরে নিয়েছে লিপিকা, ছেলের ঘর গুছিয়ে ফেলেছে তাড়াতাড়ি। খাওয়ার টেবিলে তিনজন বসে চা নিয়ে। সন্ধ্যে ঘনাচ্ছে। জানালা খুলে দেওয়ায় গরম হাওয়া এপার-ওপার করছে। খানিক আগে দেবিকা ফোন করেছিল। লিপিকার সঙ্গে একপ্রস্থ বচসা হয়ে গেছে। লিপিকার মুখে এসেছিল, তোর মতো এত অবুঝ আর স্বার্থপরের সঙ্গে কথা বলতেও জঘন্য লাগে।
কিন্তু
কিছু না বলে ফোন কেটে দিয়েছে। মুখের ওপরে অশান্তির ছাপ নজর করে শোভন শান্তভাবে বলে,
-ঘুরে এলে
ভালো করতে। বাবুল আছে যখন—।
জবাব না
দিয়ে অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় লিপিকা। বাবুলের জন্যে যত্ন করে জলখাবার
বানায়। রাতে ফ্রায়েড রাইস করবে, চিলি পনীর। তারা কালেভদ্রে মাংস খায়। গলা তুলে ছেলেকে
বলে,
-একটা ফোন
করে দিতিস, ভালো করে বানিয়ে রাখতাম।
-অন্যদিন
করবে। আমি আছি মা।
-এটাই ভালো
হয়েছে, না বলে এসে বেশ করেছিস।
শোভনের
গলায় খুশির অভিব্যক্তি। বাচ্চাদের মতো ভারী আনন্দ হয়েছে তার—। বেশিক্ষণ একা থাকতে নার্ভাস লাগে সেটা কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। লিপিকাকে কোনোদিন
বেরতে বাধা দেয় না। লিপিকার অসম্ভব দায়িত্ববোধ, নিপুণ করে আগলে রেখেছে সংসার। কিচেনে
সবজি কুচোতে কুচোতে লিপিকা অশান্তিটুকু নিঃশ্বাস ফেলে উড়িয়ে দেয়। শুধু শুধু নিশ্ছিদ্র
উষ্ণতাময় আরামের ঘেরাটোপে সাধ করে বাইরের অশান্তি ডেকে আনা। হর্ষর খুব ভালো লাগে, মা
বাবা আর সে — কতদিন পরে একসাথে এক টেবিলে। বাবার পাশে বসে দিল্লীর গল্প শোনায়। জানতে
চায়,
-তোমার
শরীর ভালো নেই নাকি বাবা?
-কে বলেছে?
ভালো আছি।
-মা ফোনে
বলছিল।
শোভন সস্নেহে
ছেলেকে দেখে। ত্রিশ পেরিয়েও সরল বালকসুলভ মুখখানা। টেবিলে রাখা ছেলের বলিষ্ঠ হাত তুলে
নেয়,
-বাঃ! জিম্
করিস তুই এখন?
-রেগুলার
হয় না। কাজের চাপ খুব।
লিপিকা অন্য জিনিসপত্র সরিয়ে যতটা সম্ভব যত্ন করে ছেলের ঘর গুছিয়ে দিয়েছে। রাতে খেতে বসে গল্প করছিল বাবুল — ফুরোতেই চায় না। অবশেষে মা বাবাকে ঠেলে পাঠিয়েছে, শরীর খারাপ হবে দোহাই দিয়ে। বাবা শুতে গেলে মা’র কাছে সে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবার অসুখের বিষয়ে। মা আলগা উত্তর দিয়েছিল, সে ঠিক বুঝতে পারে নি। ল্যাপটপ-এ অফিস-সংক্রান্ত কাজ সেরে আধশোয়া হয়ে ভাবে বাবুল। কলকাতার ওপরে তার ভালো-লাগা কিম্বা টান নেই। ছোটোবেলায় আত্মীয়দের বাড়ি আসা ছাড়া বরাবর সে বাবার চাকরির দৌলতে কলকাতার বাইরের মানুষ। এয়ারপোর্টে নেমে ক্যাব ধরে আসার রাস্তা অচেনা লাগে প্রতিবার। তাদের ফ্ল্যাট থেকে এয়ারপোর্ট বিশেষ দূর নয়। এবারে নেমে ভালোই লাগল, বেশ সাজানো। দিল্লীর মতো না হলেও ভীড় ও ব্যস্ততা আছে। ক্যাব ধরে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতে শহরটা অন্যরকম হয়ে যায়। তার মনে হয়, বাবা অন্য কোথাও ফ্ল্যাট কিনতে পারত।
ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে, দক্ষিণের জানালা খোলা। তবু গ্রীষ্মের দিন বলে প্যাচপ্যাচে গরম। দিল্লীর গরম অনেক বেশি কিন্তু ধরন আলাদা। হর্ষ ছটফট করে, ঘুম আসতে চাইছে না। এঘরে এসি নেই। কষ্ট হবে বুঝে মা তাকে অনেকবার বাবার সঙ্গে ওঘরে শুতে বলেছিল। সে রাজি হয়নি, বাবার নিশ্চিন্ত ঘুম দরকার। বাবার বলা কথা মাথায় ঘুরছে। কেমন যেন অসংলগ্ন, এলোমেলো।
-একবার
যেতে হবে, জানিস বেটু?
-কোথায়?
-মরার আগে
অন্তত যাব বুঝেছিস — না হলে মরেও শান্তি নেই।
-আমি এলাম
আর তুমি — কীসব?
-তোর দাদুও
যেতে চেয়ে শেষে—। হয় না।
বাবার চোখ
অস্থির দেখাচ্ছিল। সে আশ্বস্ত করতে চেয়ে বলেছিল,
-ঠিক আছে
জায়গাটা কোথায় বল। যাব আমরা তিনজনে।
-আমার একটা
রঙের বাক্স লাগবে। এনে দিবি?
-কাল বেরিয়ে
এনে দেব বাবা। ওয়াটার কালার?
-না পেন্সিল
রঙ। লাল-নীল-হলুদ-কালো সব থাকে।
হর্ষ চোখ
খুলে শুয়ে থাকে, ভাবে। কোথায় যেতে চায় বাবা সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। না হলে নিজে ব্যবস্থা
করে নিয়ে যেত বাবা-মাকে। সপ্তাহখানেক আছে সে, যদিও অফিসের একগাদা কাজ নিয়ে এসেছে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন