কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯০ |
নিশাচর
রাত গভীর হলে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো নির্জনের অনেকদিনের অভ্যেস। সেই কিশোরবেলা থেকেই। তারপর যুবকবেলা, প্রৌঢ়বেলা পেরিয়ে নির্জন এখন বৃদ্ধবেলায়। অবশ্য যারা তাকে অন্তরঙ্গভাবে চেনে জানে, তারা বলে, নির্জন বয়সের বিচারে ষাট অতিক্রম করেছে, তাই সে বৃদ্ধ, নতুবা নির্জনের মনটা এখনও সেই কিশোরবেলাতেই থেকে গেছে। কখনও কখনও যুবকবেলাও উসকে ওঠে। কিন্তু প্রৌঢ়বেলা বা বৃদ্ধবেলার কোনো লক্ষণ লক্ষ্য করা যায় না।
নির্জন যখন কিশোরবেলায় ছিল, তখন সে গভীর রাতে পথে যতটা পায়চারি করত, তার থেকে বেশি দৌড়ে বেড়াত অ্যাথেলে্টিক্স ক্লাবের মাঠে। সারাটা বছর সেই মাঠে চলত দৌড়-ফুটবল-ক্রিকেট প্র্যাকটিস ও প্রতিযোগিতা। নির্জন সব খেলাতেই খুব উৎসাহী এবং পারদর্শী ছিল। আর তাই প্র্যাকটিস করাটাও জরুরি ছিল। শুধু দিনে প্র্যাকটিস করলে কি আর হয়? হয় না। বেটার পারফরমেন্সের জন্য তাই রাতেও প্র্যাকটিস করতেই হয়। নির্জন মাঝরাতে একাই পৌঁছে যেত মাঠে। শূন্যমাঠে নির্জন একা একাই দৌড়াত, ড্রিবল করতে করতে এগিয়ে যেত বিপক্ষের গোলপোস্টের দিকে, সপাটে মারা ক্রিকেট বল বাউন্ডারী হবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচাতে চেষ্টা করত লং অফ বা লং অন পজিশনে ফিল্ডিং করতে করতে।
কিশোরবেলা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে নির্জন যখন যুবকবেলায় পদার্পণ করল, তখন তার গভীর রাতে বিচরণের জায়গাটাও পরিবর্তিত হলো। নির্জন তখনও মাঝরাতে মাঠে যায় ঠিকই, কিন্তু সেখানে অল্প কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে পড়ে অন্যত্র। তাকে বেশ কয়েকটি জায়গাতেই যেতে হয়, যেমন কলেজ ক্যান্টিন, লেকের ধারে একটা গাছের তলায়, পার্কে একটা ঘন ঝোপের পেছন দিকে, এইরকম আর কী। এই জায়গাগুলোতে দিনের আলোতেও সে যায়। তখন সে একা যায় না, সঙ্গে থাকে দেবাঙ্কিকা। দেবাঙ্কিকা ও নির্জন কলেজে একই ইয়ারে একই ক্লাসে পড়ে। সহপাঠী বন্ধু। কিন্তু যারা তাদের ঘনিষ্ঠ, তারা জানে, সম্পর্কটা বন্ধুত্ব ছাপিয়ে প্রেমের ঘেরাটোপে ঢুকব ঢুকব করছে। কিন্তু যেহেতু দুজনেই এ ব্যাপারে নিতান্তই আনকোরা, তাই আসল কথাটাই কেউ কাউকে বলে উঠতে পারছে না। কথাটা বলি বলি ভেবেই তারা কলেজ ক্যান্টিনে পাশাপাশি বসে সিঙারা খায়, লেকের ধারে একটা গাছের তলায় বসে নির্জন আর দেবাঙ্কিকা শেয়ার করে সিগারেট খায়, পার্কে একটা ঘন ঝোপের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে তাদের অন্য বন্ধু বান্ধবীরা কে কার পেছনে লাইন মারছে সেই গল্প করে আর আলতো ভাবে পরস্পরের শরীর ছোঁয়ার জন্য উশখুশ করে। কিন্তু আসল কথাটা, মানে ভালোবাসার কথাটা কেউ আর জড়তা কাটিয়ে উচ্চারণ করতে পারে না। আর শুধুমাত্র এই জন্যই রাতের গভীরে নির্জনকে অ্যাথেলেটিক্স ক্লাবের মাঠ ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে হয় কলেজ ক্যান্টিনে, লেকে, পার্কে। দেবাঙ্কিকা অবশ্য সঙ্গে থাকে না। নাই বা থাকল, দেবাঙ্কিকাকে উদ্দেশ্য করে ভালোবাসার কথা তো বলা যায়!
বয়সটা গড়াতে গড়াতে কখন যে ষাট পেরিয়ে গেল! নির্জন অবশ্য বয়সের কোনো তোয়াক্কা করে না। বউ মালা তার পাশেই শুয়ে ঘুমোয়। নির্জনের ঘুম আসে না। সে মাঝরাতে ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন