অখিলবন্ধু ঘোষ
অতিমারী, মহামারী কি কেবল মৃত্যুই নিয়ে আসে? শুধুই কি ধ্বংসলীলা থাকে এর গহ্বরে? নাকি সেই ধ্বংসস্তূপের ছাইয়ের ভেতর দিয়েও সুর শোনা যায় নতুন সৃষ্টির? বিশ্বকবির উক্তি মেনে, “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো”, কেন বলছি? কারণ ২০২০র মতো ১৯২০ও ছিল মহামারীর বছর। সে বছর ও ছিল সারা বিশ্ব জুড়ে মৃত্যুর তান্ডব। সারা বিশ্ব জুড়ে সেই অন্ধকারের গান থেকেই এমন অনেক সুর জন্ম নিয়েছিল যা রেখে গেল পদচিহ্ন, রেখে গেল সময়ের খাতায় স্বাক্ষর। বাংলা গানের শ্রোতারা পেয়েছিল একজন দুজন নয়, তিনজন এমনই শিল্পীকে যাঁদের নাম বাংলা গানের জগতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, থাকবে আজীবন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী ও অখিলবন্ধু ঘোষ।
অখিলবন্ধু ঘোষের জন্ম ১৯২০র ২০শে অক্টোবর। মা বাবার সঙ্গীতে অনুরাগ বা অবদানের কথা বিশেষ জানা যায় না, বড় হয়েছিলেন ভবানীপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই মামা কালীদাস গুহর কাছে সঙ্গীতশিক্ষা। সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন নিরাপদ মুখোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী ও চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে।
অখিলবন্ধু ঘোষ সম্বন্ধে এই তথ্য আসলে কিছুই নয়। এ শুধুই এক শিল্পীর আগামী দিনের প্রস্তুতির কাহিনী। যে কথা সত্যিই বলার তা কিন্তু বড়ো লজ্জার। লজ্জা আমাদের অর্থাৎ বাংলাগানের শ্রোতাদের। লজ্জা, কারণ একজন শিল্পীকে আমরা চিনলাম তার গানের রিমেকের হাত ধরে। হ্যাঁ একথা বলতে দ্বিধা নেই যে নিজের দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে শিল্পী যত না খ্যাতি পেয়েছেন, বঞ্চনা পেয়েছেন অনেক বেশি। অর্থাভাবের কথা বলাই বাহুল্য। মোমবাতি জ্বেলেই গান শেখাতেন ছাত্র ছাত্রীদের, ইলেকট্রিক বিল দিতে পারতেন না বলে তাঁর ঘরে আলো জ্বলতো না। দাঁত না থাকায় উচ্চারণে অসুবিধে হতো, তবু শুধু সুর দিয়ে ভরাট করে রেখেছিলেন তাঁর সব না পাওয়া। মোমবাতির আলোতে বসেই সৃষ্টি হয়েছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় তাঁর নিজের সুরে বাংলা গানে একটি অমর গীতি-
“আজি চাঁদনী রাতি রাতি গো, মালাখানি গাঁথি
ফিরে যেও না যেও না যেও না”
তাঁর বেশির ভাগ গানই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, তাই তাতে শব্দের আড়ম্বর থাকত না একেবারেই। গল্প করতে করতে গাওয়া মনে হতো সেসব গান। এমনই একটি গান-
“সেদিন চাঁদের আলো চেয়েছিল জানতে
ওর চেয়ে সুন্দর কেউ আছে কি?
আমি তোমার কথা বলেছি।
একদম সহজ সরল কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে যেন খুব কাছের কারুর সঙ্গে মনের কথা বলছেন। একটি রোমান্টিক গানকে শব্দতরঙ্গে বেশি না খেলিয়ে কোথায় পৌঁছে দেওয়া যায়, এই গানটি তার উদাহরণ।
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলতেন ওনার দেখা সেরা পাঁচজন গায়কের মধ্যে একজন অখিলবন্ধু ঘোষ। একটা সাক্ষাৎকারে বলে ছিলেন, “মায়ামৃগ সম তুমি কি দূরে রবে সাথী গো” গানটিতে “অশ্রুমুকুলে মালাখানি মোর গাঁথি গো” বলার সময় দুটো পর্দা এমন সহজ সুন্দর ভাবে বলতে লাগলেন যে মনে হল এমন ভাবেও গান কে প্রকাশ করা যায়? শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন সঙ্গীতাচার্য্ শ্রীতারাপদ চক্রবর্তীর কাছে, কিন্তু তাই বলে তাঁর গান কখোনোই হয়ে ওঠেনি শুধুই রাগ সঙ্গীতের মীড় গমকের কারিকুরি। এব্যাপারে তাঁর পরিমিতি জ্ঞান ছিল অসামান্য। ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই মীড় ও গমকের ব্যবহার করে কোনো গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতেন। এই প্রসঙ্গে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, তাঁর নিজের সুরে “শিপ্রা নদীর তীরে সন্ধ্যা নামে গো /অন্তর হল দিশাহারা” গানটির উল্লেখ করা যায়। কতটা জানলে এত পরিমিত ব্যবহার এত সফল ভাবে সম্ভব, তার পরিচয় এই গানটি।
এই বিষয়ে একবার কথা বলেছিলাম বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীশংকরলাল ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে। ওঁর একবার শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যেহেতু শিল্পীর বাড়িতে কোন টেলিফোন ছিল না তাই উনি তাঁকে জানাতেও পারেন নি, আর তার ২/১ দিনের মধ্যেই শিল্পী আমাদের ছেড়ে চলে যান। আক্ষেপ ঝরে পড়ছিল শংকরলাল ভট্টাচার্য্যের গলায়। আক্ষেপ আমাদেরও রয়ে গেল। সেই সাক্ষাৎকারটা হলে আমরাও জানতে পারতাম এরকম একজন গুণী শিল্পী সম্বন্ধে আরও অনেক কথা।
বাংলা গানে অখিলবন্ধু ঘোষকে মনে করিয়ে দেওয়ার শ্রেয় অনেকাংশেই সুমন চট্টোপাধ্যায়ের। ১৯৯১ সালে যখন ‘তোমাকে চাই’ বেরোল, নতুন জোয়ার এল বাংলা সমকালীন গানের জগতে। তার আগে ছিল না, তা নয়। বাংলা গানের স্বর্ণযুগ চলেছে প্রায় চার দশক ধরে। তবে সব নদীর বহমান জলেই তো কিছুটা পলি পড়ে। তখনও হয়তো তাই হয়েছিল। তাতে জোয়ারের ঢেউ এসে লাগল, নতুন প্রজন্মের শ্রোতারা ভেসে গেলেন ‘তোমাকে চাই’এর লিরিক আর সুরে। আর প্রবীণরা খুঁজে পেলেন তাঁদের ফেলে আসা দিন সেই গানের কথায়, উল্লেখে। “ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তের সুরে” বা “তারই ফাঁকে কোথায় যেন অখিলবন্ধু ঘোষের গলা” - এই লাইন দুটি বোধকরি ঐতিহাসিক লাইন হয়ে থাকল! নবীনরা খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, কারা এরা? আর প্রবীণদের মনে পড়ল, আহা কী সুর ছিল, কী কথা ছিল! কিন্তু আজ কোথায় পাই সেই সুর সেই কথা? ওঁর রেকর্ড প্রায় পাওয়াই যায় না। সেই সুর সেই কথা ফিরে এল রিমেকের হাত ধরে। এটাই আমাদের, বাংলা গানের শ্রোতাদের লজ্জা। যে অখিলবন্ধু ঘোষের মতো শিল্পীকে পরবর্তীকালে কোনো অনুষ্ঠানে নিজের গান করতে গিয়ে শুনতে হয়েছে, “ইন্দ্রনীলের গান বা শ্রীকান্তর গান আপনি গাইছেন কেন? নিজের গান করুন না!” বিশিষ্ট সাহিত্যিক শংকরলাল ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে তাঁর ছিল স্নেহের অগ্রজ অনুজের সম্পর্ক। তাঁকেই শিল্পী বলেছিলেন, “এখন নিজের গান গাইতে গেলে প্রমাণ দিতে হবে?”
শিল্পীর যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন তাঁরই ছাত্রী দীপালি ঘোষ। পরবর্তীকালে বহু গানে সুর দিয়েছেন তিনি, তার মধ্যে একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় গান - “যেন কিছু মনে কোর না কেউ যদি কিছু বলে”। সারাজীবনে বহু গান গেয়ে গেছেন শিল্পী এবং বেশির ভাগই নিজের সুরে। সেসব সুর ঘুরে ফিরে এসেছে শ্রোতাদের মনে, আপ্লুত করেছে কিন্তু বেশির ভাগই রিমেকের হাত ধরে। সাহিত্যিক শংকরলাল ভট্টাচার্য্যের কথায়, “রিমেকের স্টোরহাউস ছিলেন অখিলদা”। আক্ষেপ আছে, থাকবেও, তবু মনে হয়, এভাবেও যদি তাঁকে আমরা মনে রাখতে পারি! রিমেক অন্তত অনুসন্ধান তো করিয়েছে! এবার শ্রোতাদের ওপর এই দায়িত্ব বর্তায় তাঁরা কীভাবে রাখবেন তাঁদের অমুল্য রতন ভাণ্ডারকে!
খুব মনোগ্রাহী রচনা। লেখিকা অর্পিতা পোদ্দার কে অনেক ধন্যবাদ এমন একজন বিস্মৃত গায়কের কথা অনেক দিন বাদে মনে করিয়ে দেবার জন্য।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। এই কৃতিত্ব অনেকটাই আকাশবাণীর প্রাপ্য।ওখানে কাজের সুবাদেই খোঁজ শুরু। বড় কষ্ট হয় যখন দেখি এরকম শিল্পীদের আমরা হারিয়েই ফেলেছি।
মুছুন