বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

শুভঙ্কর

 

যা কিছু বলতে পারিনি




 

পাঁয়তারা


ইদানিং আমার যে নিরেটত্ব, যা আমি অহরহ, যত্রতত্র টের পাই; অথচ তবুও তা অস্বীকার করে নিজেকে বেশ চকচকে দেখানোর চাপা ইচ্ছের পায়ে তেল মেরে সকাল-সন্ধ্যেগুলো ফুরিয়ে ফেলা – এক অবধারিত স্ববিরোধ, আত্মপ্রবঞ্চনা বলব না একে। নগ্ন আমাকে পিঠের দিক থেকে ঠিক কেমন দেখায় সেকথা যদিও জানি না এখনও – কে না জানে, সামনে থেকে আয়না সব সময় মিথ্যে কথাই বলে।

শেষপর্যন্ত আবার পাঁয়তারা শুরু করলুম। পাঁয়তারাই। বিস্তর খোঁচাখুঁচির পরে ঘুম ভেঙে রঙীন জগৎ থেকে সাদাকালোয় ফেরা। তাকিয়ে দেখা গেল অধিকতর গুলিয়েছে পুরনো বিস্তার। এ কি ঘুমঘোরে মনোহরের আগমন? আমি তো অনিদ্রা  রোগী নই। তাহলে নিদ্রার গভীরতর স্তর থেকে উঠেই কি এহেন প্রতিক্রিয়া?

 

মরুভূমি, মৃত্যু ইত্যাদি


তুমি বলেছিলে: “তবে মরুভূমি হতে দাও। আজন্মের তৃষ্ণা বুকে ভরে দিয়ে  আকাশের দিকে চেয়ে মৃত্যুকে দেখতে দাও”।

মানুষ-মানুষী তৃষ্ণার্ত থাকে। এটা কখনও অস্বাভাবিক নয়। তোমার একার যাপনই তৃষ্ণার্ত নয়। মরুভূমি, মৃত্যু এগুলো আবার কী কথা? মরুভূমি কি  অতুলনীয়, বা মৃত্যু? মরুভূমিই কি শুধু দুঃখ কষ্টের প্রতীক হয়ে থাকবে? শ্যামল প্রান্তরে, বর্ষার মেঘে, সজীব বনানীতে, বিপুল জলধারায় কত অসীম দুঃখের বাস সম্ভব, জান? রুক্ষ প্রান্তরে, তপ্ত বালির ঘূর্ণিতে কত সৌন্দর্যায়িত জীবন বহমান,   ভেবেছ? মরুভূমি জান না, আমিই কি জানি? অথবা মৃত্যুকে? যা অবধারিত, যার জন্য অবিরাম প্রতীক্ষারত এই জীবন, তার সঙ্গে দুঃখকে সততই যোগ করা আমাদের ভাববিলাস। মৃত্যু মানে তো দুঃখেরও অবসান। ধর, এই মাখামাখি অস্তিত্ব নিয়ে যে আমার অবস্থান। মুহূর্ত পরেই যদি অনস্তিত্বে থাকি! তবে কোথায় আমার ল্যাজ আর কোথায়ই বা গোবর? মৃত্যু মানে তো চেতনা সমৃদ্ধ বস্তু থেকে আপাত-অচেতনে এক উত্তরণ।

 

অপ্রেম


সেই অর্থে কখনও প্রেমপত্তর লিখিনি, পাইওনি। লিখিনি বলে পাইনি, নাকি পাইনি বলে লিখিনি তা নিয়েও ভেবে দেখিনি ঠিক। তাহলে কি প্রেম’-এর ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কখনও?  

আঃ, কেন আমি এই ভুলটা করলাম! কোনো চারা নেই এসব ভুলের। সঙ্গে  পিস্তল থাকলে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে চালানো যেত।

কেন আমি আমার ক্ষোভের কথা বলতে গেলাম ঐভাবে? হাসিঠাট্টার মধ্যে কি ঝলমলে লাগছিল তোমায়? তখনই বলে ফেললাম। কিন্তু সত্যি বলছি, সচেতনে অপমান করতে চাইনি একেবারেই। কেন আমি চুপ করে থাকতে পারি না?  কেন আমার বিশ্বাসঘাতক জিভকে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারছি না এখনো?  কেন, যত রক্তক্ষরণ আমারই বুকে বা মাথায় ঘটলে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না? অন্যকেও, তোমাকেও, তোমাদেরও কেন তার শরিক করতে চাই? কেন?  যার শান্তিতে ঘুমের ব্যবস্থা করতে পারি না, তাকে অশান্ত নির্ঘুম জাগিয়ে রাখা কেন? আমি কী জঘন্য!

 

অপৌরুষেয়


পুরুষমানুষ’? কিসের পুরুষমানুষ? আমি পুরুষমানুষনই। জান! এই সমাজ, আমাকে পুরুষহতে দেয় না, তোমাকে নারীহতে দেয় না – লিঙ্গ নির্মাণ চলে  আমাদের – সমাজের মত করে। নিজেদের মত করে নয়, বুদ্ধির মত করে নয়, জ্ঞানের মত করে নয়, চেতনার মত করে নয়, সুচেতনার মত নয়। মানুষ-ই হতে পারলাম না... তার আবার পুরুষ আর নারী, হুঁ! আবার এই সমাজেরই নাম-সুনাম-বদনাম নিয়ে আমরা আমরাও চিন্তিত থাকি। আমার বদনাম হওয়ার বিষয় নেই একথা তোমাকে কে বললো? হাটে হাঁড়ি ভাঙলেই দেখবে কত ধানে কত চাল!

যা চলছে তাকে নষ্টামি বলতে পার হয়তো, বা ধ্যাষ্টামিও বলতে পার। প্রেম ভালবাসা নয় কিছুতেই। আমার প্রেম-ভালবাসা হতে নেই। সাধারণ্যের সেই স্তরে পৌঁছতে পারলে হত।

 

পরিশিষ্টাচার


যে লোকেরা মূর্খ বলে, যে লোকেরা বলে সামাজিক নয়, সেই লোকজনের সমাজে আমি বরাবরই নষ্ট চরিত্রের। মুখোশের আড়ালে সব্বাই – মুখোশের রঙ, আকার, প্রকারের রকমফের হয় প্রয়োজন মত। কখনও আবার মুখোশ সরিয়ে রাখতেও হয়, খুলে ফেলতেও হয়। ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয় না কি? ছিঁড়েখুঁড়ে সমস্ত মুখোশের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া যায় না কি? পারলাম কই? আর পারবও না বোধহয় কক্ষনো। এখন তো দিন গুনি। এখন তো ক্লান্ত লাগে। উৎসাহে এত ঘাটতি নিয়ে কাজের কাজ কিস্যু করা যায় না। তাই সময় কাটাই। মাঝ থেকে সুযোগ নিয়ে ফেলি কখনো সখনো।

হায় আমার অপ্রেম - হায় আমার নষ্টামি!

তবু, এই লেখাটা তো আসলে উত্তর নয়, উত্তরের একটা দায় থাকে। দায় শব্দের সঙ্গে দায়বদ্ধতাও জড়িত। নষ্ট, ধ্বস্ত মানুষের কি দায় থাকবে কোনো, বা দায়বদ্ধতা?


৪টি মন্তব্য:

  1. কালিমাটিতে এর আগে আপনার লেখা পড়িনি। ভাল লাগল।বলা ভাল চমকে গেলাম। আরো গদ্য লিখুন। আপনার হাতে শক্তি আছে।

    উত্তরমুছুন
  2. কবিতা, গল্প বা মুক্ত গদ্য! যাই পড়লাম না কেন, ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম

    তাপস

    উত্তরমুছুন
  3. সাহিত্যে আত্মচিন্তা একজন প্রকৃত মগ্ন লেখকের জন্ম দেয় , আজ আর একবার সেই প্রকৃত লেখকের সাক্ষাৎ পেলাম ।

    উত্তরমুছুন
  4. যারা পড়েন নি, তারা এবার মিস করবেন অনেক কিছু। আমি এখনো বিশ্বাস করি, যারা গান জানেন তাদের রোজ ভোরে উঠে গলার রেয়াজের দরকার নেই। ভিতরে গান থাকলেই তা জীবনে আসবে। উচ্চকিত শোনা যাবে। আপনার লেখাও সেই কথাই বলে - SB

    উত্তরমুছুন