বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল 

 


                 

(৯)  

ঠকাস করে শব্দ হল বাইরে জানালার কাচে। পাখি বা বাদুড়-চামচিকে এসে ধাক্কা খেয়েছে সম্ভবত। এই আবাসনে অনেক বড়ো গাছপালা আছে। সকাল-সন্ধ্যায় প্রচুর পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায়। হর্যর ঘুম এবার পুরোপুরি কেটে গেছে। আবার সজোরে শব্দ কী যেন পড়ে গেল। ঠকাঠক করে আরো শব্দ হচ্ছে বাড়ির মধ্যেই। এধার-ওধার থেকে কী সব পড়ে যাচ্ছে। সে জানালার বাইরের দিকে তাকাল। বিদ্যতের ঝলকানি কালো আকাশ চিরে দিয়ে চলে যাচ্ছে। গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে। মানে বেশ জোরে ঝড় উঠেছে। বৃষ্টি হয়ে গেলে তাত কমবে খানিকটা। তার ফ্ল্যাটের ঠিক ওপরে ছাদ বলে বাড়িটা অস্বাভাবিক তেতে থাকে। দমকা হাওয়া এলোপাথাড়ি ঢুকে পড়ছে ঘরে। হর্ষর মনে পড়ল, সে রাতে ফিরে লিভিংরুমের জানালা খুলে দিয়েছিল। এ-সির কনকনে আরাম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। আপনমনে সে বলে — পড়ুক গে!

 

প্রচণ্ড বেগে চড়বড় করে বৃষ্টি নেমেছে ছাতের ওপরে। একটানা আওয়াজ শুনে খুশি হয় হর্ষ। বন্ধ ঘরেও যেন সোঁদা গন্ধ আসছে। ছোটো বয়সে গরমের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে দিদিমার বাড়িতে যেত সে আর তার মা। বৃষ্টি নামলে ঠাণ্ডা ভেজা-ভেজা এরকম একটা গন্ধ আসত। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সব গন্ধ নাকের মধ্যে ভরে নিতে চাইত। ছোটোমাসির মেয়ে মাম্পি, যার ভালোনাম শ্রুতি, পাশে এসে দাঁড়াত। এমনিই বলত,

-তোর বুঝি খুব ভালো লাগছে গন্ধটা?

-হ্যাঁ, লাগে তো!

 

মাম্পি প্রায়ই কেমন একরকম চোখে তার দিকে তাকাত। একদিন বলেছিল,

-বল তো বাবুল, কে বড়ো? তুই না আমি?

হর্ষ বোকার মতো তাকিয়েছিল,

-আমরা সমান তো! একই ক্লাসে পড়ি না?

মাম্পি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল,

-সেটাতে সমান হলেও জানিস, আমি আসলে তোর চেয়ে চারমাসের বড়ো।

-তাতে কী?

-কিছুই না, এমনি বললাম। আবার তোর মা আমার মায়ের দিদি হয়।

সে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলেছিল,

-ও হ্যাঁ।

-ও হ্যাঁ? তুই না সত্যি একটা ভোঁদা। মাথার গোবর শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে।

হর্ষর অপমানবোধ হয়েছিল, কারণ লেখাপড়াতে সে যথেষ্ট ভালো। কিন্তু এসব জটিল আর কঠিন ধাঁধাঁ তার মাথাতে ঢোকে না। আজও মেয়েদের অনেক কথা-বার্তা সে বুঝতে পারে না। শ্রুতির ধাঁধাঁর জবাবে সেও নিজের মতো করে চেষ্টা করত,

-আচ্ছা এটা বল, একটা মেয়ে আছে যার ডাকনাম ম দিয়ে আর যে তার ভালোনাম ধরে বাড়িতে ডাকলে রেগে যায়?

মাম্পি জবাব না দিয়ে মুখভঙ্গি করে হাসত। নিজের আঁকার খাতা এনে হর্ষর গা ঘেঁষে বসত, খুলে ছবি দেখাত। হর্ষ চোখ গোল করে বলত,

-আরেব্বাস! গ্র্যাণ্ড! দারুণ আঁকিস তো তুই।

-তাই? আরো কত আছে

-দেখা দেখা

-না আর না। আমি দরজা বন্ধ করে আঁকি, জানিস? 

-কেন?

শ্রুতি উত্তর দেওয়ার আগেই ছোটোমাসি সরু গলায় চীৎকার করে ‘মাম্‌-পিই বলে হাঁক দিত আর সে বেজার মুখে উঠে চলে যেত। হর্ষও ভয় পেত ছোটোমাসি খুব রাগী আর ভীষণই জোরে কথা বলে। মাম্পির জন্যে বুকের মধ্যে দুঃখ-দুঃখ হত। ক্লাস এইট না নাইনে উঠলে মা তাকে দিদিমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। বলত, উঁচু ক্লাস, পড়া নষ্ট হবে। মা একা কলকাতা চলে যেত তাকে বাবার জিম্মায় রেখে। তিনজনে একসঙ্গে যাওয়া হলে তারা লেকটাউনে জ্যাঠার বাড়িতে থাকত। মা তখন দু’একদিনের জন্যে দিদার সঙ্গে দেখা করতে যেত, হর্ষকে  নিত না। হর্ষ বরাবর মায়ের খুব বাধ্য, মা কোনোদিন কড়া শাসন করেনি। দরকার পড়েনি।

 

মাকে কি সে বোঝে? আজকাল কেন যেন প্রশ্নটা খুব মাথায় আসছে। নিজের মতো সমাধান খুঁজে নিয়েছে হর্ষ মা তো মা-মা-ই! আলাদা করে বোঝার কী আছে? তার আর বাবার সমস্ত দায়িত্ব মায়ের ওপরে

অদিতি কেন মুখ গোমড়া করে সে বুঝে উঠতে পারে না। আলাদা করে ভাবার অথবা গুরুত্ব দেওয়ার কথাও হর্ষর মনে হয় না। বেশ ক’বার অদিতি তাকে অনুরোধ  করেছে তাদের কথা হর্ষর মাকে জানাতে। সে জানায় নি। অদিতি তার বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। এর চেয়ে গাঢ় কোনো সম্পর্ক আছে বলে হর্ষর মনে হয় না। অথচ লক্ষ্য করছে অদিতি তার ওপরে নির্ভর করতে শুরু করেছে বেশ ক’মাস ধরে। অদিতির কয়েকটা পারিবারিক সমস্যা আছে। সেসব কথা হর্ষকে বলতে চায়, বলেও। হর্ষ স্বস্তি পায় না। অদিতিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

 

বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে এগুলো মাথায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। ভাবে, মা মাম্পি আর অদিতির স্বভাবে ও আচরণে কোথাও মিল আছে? তিনজনেই দুর্বোধ্য! হেড-বোর্ড থেকে রিস্টওয়াচ টেনে আনে, পাঁচটা সাত। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে বলে আলো ফোটেনি, না হলে এতক্ষণে সকাল হয়ে যাওয়ার কথা। মোবাইল ফোন খুলে দেখে – আর কোনো কল্‌ বা মেসেজ আসে নি। সে স্থির করে আপাতত বেশ কিছুদিন অদিতির সঙ্গে আর যোগাযোগ করবে না। অদিতি দেখা করতে চাইলেও না। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা দরকার। মায়ের সঙ্গে কাল কথা হয়নি। কয়েকদিন আগে বলছিল, বাবার শরীর বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। কী হয়েছে খুলে বলে নি। এখন নির্জন ঘরে শুয়ে বাবাকে মনে পড়ে মনখারাপ লাগে হর্ষর। কলকাতা যাওয়া হয়নি ক’মাস যেন হল! উৎসুকভাবে ফোন ঘেঁটে সে পছন্দমতো ফ্লাইটের সম্ভাব্যতা  আর টিকিটের দাম দেখতে থাকে। না জানিয়ে গেলে বাবা-মাকে দারুণ একটা সার্প্রাইজ দেওয়া যাবে।

(ক্রমশঃ)

   

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন