বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

সুষমা ভট্টাচাৰ্য

 

একাকিত্বের অন্তর্জাল




‘ইন্টারনেট’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়, এরকম মানুষের সন্ধান পাওয়া বর্তমান যুগে একরকম অসম্ভব। ইন্টারনেট ছাড়া বর্তমান জীবন কল্পনাই করাই যায় না। কর্মক্ষেত্র থেকে ব্যক্তিগত সময়, প্রতি ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের অবাধ্  আনাগোনা । বিশেষ করে করোনার মতো স্পর্শকাতর মহামারীতে ইন্টারনেট আরও বেশী প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সকলের জীবনে।

দেশবাসীকে কোভিড ১৯-এর হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার  দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। এই লকডাউনের ফলে করোনা কতটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে সেটা বিতর্কিত বিষয়, কিন্তু এই  লকডাউনে সবাই গৃহবন্দী হয়ে নিজের অবসর সময় কাটানোর জন্য ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হলেন। অনলাইন লুডো খেলা হোক বা প্রিয়জনদের সাথে গ্রুপ ভিডিও কল করে সৌজন্যে বিনিময় হোক। সবই সম্ভব হচ্ছিল ইন্টারনেটের কল্যাণে। প্রথম বেশ কটা দিন ভালো  কাটলেও পরে সমস্যা শুরু হল।

যে অবসরটা কয়েকদিনে শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হয়েছিল, সেটা মাসের পর মাস দীর্ঘায়িত হতে শুরু করে। এর সঙ্গে চাকরিক্ষেত্রে বেতন হ্রাস, বেকারত্ব, মানসিক অবসাদ এই সব মিলেমিশে সবার মনেই এক অদ্ভুত খারাপ লাগা জন্মায়।

লকডাউন এর অগ্রভাগ এ বিরিয়ানি, ডালগোনা কফি, ফুচকার ছবি দেখে যারা অন্যের রান্নার প্রশংসা করেছিলেন লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে এদের এই ছবি পোষ্ট করার জন্য একদল মানুষ এদের মানবিকতা বিহীন মানুষ বলে দোষারোপ করেছেন। কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ কী? শুধুই কি কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন, নাকি অন্য কিছু?

কোভিডের আবির্ভাব এর আগেও ইন্টারনেটের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের প্রভাব/ কুপ্রভাব সম্পর্কে পূর্বে অনেক আলোচনা  হয়েছে, তাই এখানে সেই আলোচনা না করে একটু অন্যদিক নিয়ে ভেবে দেখা দরকার।

লকডাউনের শুরুতে আমাজন, নেটফ্লিক্স বিনোদন জোগালেও, একটু সময়  অতিবাহিত হলে এই অ্যাপগুলি আর অবসর সময়ের সঙ্গী রইল না, পরিণত হল  এক বিড়ম্বনায়। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তাদের ক্ষেত্রে বইয়ের পাতার  মধ্যে আর মুক্তির বার্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছিল। বিভিন্ন পুস্তকপ্রেমীদের গ্রুপে যারা এক সপ্তাহে দশটা বই পড়ে ফেলেছিলেন, তাদেরও সাহিত্যপ্রেমে ইতি না হলেও, প্রেমের উদ্দামতা হ্রাস পেয়ে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়ল। কিন্তু এমনটা  হওয়ার কারণ কী? লকডাউন, নাকি অন্য কিছু?

লকডাউনে গৃহবন্দী হওয়ার ফলে একদিকে যেমন পরিবারের সদস্যদের সাথে  সময় কাটিয়ে তাদের জানার সুযোগ পাওয়া গেছে, তেমনই হয়েছে এক অন্য সমস্যা। সেই সমস্যা হচ্ছে মূল্যায়নের। দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে মূল্যায়নের সময় ঠিক করে ওঠা হয় না। কিন্তু লকডাউনের কল্যাণে লাভ হল অখণ্ড অবসর। এই অবসর যখন দীর্ঘায়িত হল তখন শুরু হল মূল্যায়ন।  প্রথমে নিজের, নিজের পারিপার্শ্বিকের। এরপর অন্যের। আর এর থেকেই শুরু হল সমস্যার। অন্যের  মূল্যায়ন আগেও ছিল, কিন্তু এখন যেন সেটা আক্রমণের আকার ধারণ করল।  সেই আক্রমণ যেখানে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের আড়ালে শুরু হল অন্যেকে  আঘাত করা। এমন ভাবেই আঘাত করা যাতে মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। এ এক অদ্ভুত প্রতিশোধ স্পৃহা। আমার জীবনে শান্তি নেই, তুমি শান্তিতে  থাকবে কেন? আমি আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে দিন কাটাচ্ছি, তুমি মাংস ভাত খাবে কেন? খাচ্ছ খা্‌ও, ফেসবুকে ছবি দিচ্ছ, লজ্জা করে না?  কেউ এই ধরনের কথায়  কান দিচ্ছেন না। আবার কেউ হয়ে উঠছেন আক্রমণাত্মক। বেশ করছি। পয়সা আছে, তাই খাচ্ছি। যত অভুক্ত মানুষ আছে, সবার দায় কি আমার? আমাকে  বলছেন, অথচ নিজে ভিখারিকে ক’টা পায়েস দেন? যতসব বড় বড় কথা!

আসলে এই মহামারী সবার জীবনের সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গি্তেও পরিবর্তন  এসেছে। কিছু ইতিবাচক কিছু নেতিবাচক। মানুষ জীবনকে মূল্য দিতে শুরু করেছে।  একদিকে যেমন বেড়েছে ব্যক্তিগত পরিছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা (যা প্রায় শুচিবায়ুগ্রস্থতার রূপ ধারণ করেছে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে),  অন্যদিকে তেমনই বেড়েছে অন্যের সাথে নিজের তুলনা। পাওয়া না পাওয়ার তুলনা। যা কর্মহীন মস্তিষ্কে বারবার অনুরণিত হয়ে এক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। এমন যন্ত্রণা যা মস্তিস্ক থেকে মনে প্রবেশ করে এবং ক্রমশ বিকারের আকার ধারণ করে। যা কোভিডের থেকে কম ক্ষতিকারক নয়।




তাহলে কী করা যায়? ইন্টারনেট ব্যান করে দেওয়া উচিৎ? না, সেটা সম্ভব নয়।  চিকিৎসা, ব্যাঙ্কিং, আইন প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের ছাড়া কাজ চলে না।  তাই এই ধরনের চিন্তা কেবল অবাস্তব নয়, উন্নয়নবিরোধী। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার একটু নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ইন্টারনেট বিনোদনের অনেকগুলো  মাধ্যমের একটা হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু একমাত্র সঙ্গী হলে বিপদ। চারজন মানুষ এক জায়গায় বসে নিজের স্মার্ট ফোনের দিকে না তাকিয়ে একটু সামনের মানুষটার সাথে কথা বলুন। নেটফ্লিক্স-এর টপ টেন শো নয়, নিজের মনের কথা  বলুন অন্যের কথা শুনুন। দেখবেন বাস্তব জগৎ কিছু কম আকর্ষণীয় বা কম শিক্ষণীয় নয়। অনলাইন ভাবের আদানপ্রদান তো হল, এবার ফোন আর  কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে সামনের মানুষটার সঙ্গে কথা বলুন। ডিজিটাল স্মাইলি না পাঠিয়ে ফোন করে দেখুন। নিজের প্রিয়জনের হাস্যময় কণ্ঠ শুনতে পাওয়ার যা আনন্দ, তা কোনো স্মাইলি আপনাকে দিতে পারবেন না। মনে  রাখবেন ইন্টারনেট বিজ্ঞানের আবিষ্কার যাতে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য সহজে স্বল্প সময় জোগাড় করতে পারি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছি। যে আসক্তি ডেকে আনছে সার্বিক সর্বনাশ ও অবক্ষয়। তাই  নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন নিজেকেও এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারেও( বাকস্বাধীনতা বিঘ্নিত  না করে।) প্রয়োজন আর আসক্তির মধ্যে একটাই সূক্ষ্ম সীমারেখা আছে। এই  সীমারেখা লঙ্ঘন করলেই সর্বনাশ, আর এই সর্বনাশকে ঠেকাতে হলে সবাইকেই উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেটা যত দ্রুত সম্ভব। না হলে এই একাকিত্ব আর ইন্টারনেটের জাল একটু একটু করে মানুষকে গ্রাস করবে। আর দুঃখের বিষয়,  এটা আমরা বুঝতেই পারছি না!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন