সমকালীন ছোটগল্প |
বিজ্ঞান ভৈরব এ্যাপার্টমেন্ট
গ্রাউন্ড ফ্লোর (কামাদি কুসুম)
বিশাল বেসমেন্ট। ঢালাও বিছানা ফ্যান ও কুলারের ব্যবস্থা। মাঝরাত। সারি সারি মানুষ মানুষী শুয়ে।
- কাম
তুমি দেখছো?
কেমন নিজের নিজের পার্টনার খুঁজে ওরা সব যৌন মিলনে মত্ত? গায়ে ঢাকাও আর রাখছে না। বেহায়া সব। যেন, লোকে
দ্যাহে ত দেহুক,
আমরা ত দেহাইবারেই চাই, এমন
ভাব। এইভাবে নিজের প্রাইভেট পার্ট সবার কাছে না দেখালেই নয়? নির্লজ্জ মানুষ সব। আমি একবার এক নির্জন পুকুর
ঘাটে স্নান করতে নেমেছিলাম। চারপাশে খুব ভালো করে তাকিয়ে
ব্লাউজ খুলে ফেলেছিলাম। শীতল জলের স্পর্শে আরামে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে
এলো। বুকের আঁচল সরিয়ে জলে ডুব দিতে যাওয়ার আগে হঠাত্ সারা দেহ গরম হয়ে উঠলো। মন ভীষণ অশান্ত। কান দুটো গরম হয়ে উঠলো। আমার
অজান্তেই চোখ দুটো ধেয়ে গেল পুকুর পাড়ের উপর ঘন ঝোপের উপর। ঝোপের
আড়ালে দুজন আমার দেহ লেহন করছে। আমি দৃশ্যত দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু মনশ্চক্ষে ঠিক ধরে ফেলেছিলাম। এই ছিলাম আমি সেকালে। আর এই এখন...। কাম তুমি দেখছো না? ওরা
কেমন গা ছাড়া গা সওয়া? - ঠিক বলছো রতি। এখন আর মেয়েদের সেই স্পর্শকাতরতা আর লজ্জা হায়া আর নেই বুঝি। সেইসময় আমাদের উঠতি যৌবনকালে হামেশাই আমরা একটা খেলতাম। কোন
মেয়ে কতোটা স্পর্শকাতর তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় কত তেজ আমরা পরীক্ষা করতাম। কোনো মেয়ের পিছু নিতাম। ওর নিতম্বের আন্দোলনে চোখ
রাখতাম। বেশিরভাগ মেয়েই কয়েক মুহূর্ত পরই কোমর আঁচলে ঢেকে নিত। অবাক
হয়ে যেতাম। সে আমাকে পিছু ফিরে দেখলো না পর্যন্ত। কিকরে বুঝলো আমি ওর অঙ্গে চোখ
রাখছি? অবশ্য এখন আর এখানে ওসব কথা অবান্তর। এই জায়গাটার মাহাত্ম্যই এমন। এখানে পশু মৈথুন ও বিকৃতকামও হয়, আমি দেখেছি। আচ্ছা রতি? তোমার
উত্তেজনা হচ্ছে না তো ? বলো তো আমরা বিছানায় যাই?
- না
কাম। যৌনতা পবিত্র। তাই চাই পরিবেশ নিজস্ব বাস সময় ও সংগীতময় মন প্রাণ দেহ। তবেই প্রেম উর্ধ্বগামী হয়। এখনও আমাদের আত্ম চেতনা আসেনি। তাই শরীর ও মনে বোধ নেই। এই বোধ আনতে এখন তো আমাদের ছাদে যেতে হবে। তাই না?
ফার্স্ট ফ্লোর (রসনা)
বিশাল ডাইনিং হলে পরিত্যক্ত টেবিল কুর্সি এঁটো কাঁটা বেঁচে যাওয়া বিরিয়ানি মাছ মাংসের ভ্যারাইটি পদ ও যাবতীয় নিরামিষ লোভনীয় গন্ধ। এই গন্ধে এখন বমি পায়। ক্লান্তি আসে। কেননা পেট ভরা আছে। পেট ও ইচ্ছে খালি থাকলে এই গন্ধ তখন স্বর্গীয়। এই এপার্টমেন্ট তো ছেড়ে দিয়েছি,তবে আর মায়া কিসের? আগে এই ডাইনিং হলটি ছিল আমার আস্তানা। হলের মাঝে ছিল দেওয়াল। একটা ঘর বড়,সেটায় পার্টিশন করে ছিল রান্নাঘর। এই রান্নাঘরে ঢুকলেই কেন যে আমার ক্ষিদে পেত! ভয়ানক আগ্রাসী ক্ষিদে। বিয়ে করেই বউটাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলাম। হোটেল ম্যানেজমেণ্ট পড়া ছেলে আমি। কিন্তু রান্নাঘরের কোনো উপযোগিতা জানতাম না। যত কামাতাম সব হোটেলবাজিতে শেষ হয়ে যেত। মাস ফুরোনোর আগেই সুদখোরের কাছে হাত পাতা। জিভ আর পাকস্থলী যে আমার চরম শত্রু হয়ে উঠবে একথা যদি আগে জানতাম! প্রথম প্রথম বউটাকে নিয়ে চুটিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্টবাজি করেছি। পরে দেনায় যখন গলাঅব্দি ডুবে গেলাম, তখন হোটেল থেকে কাঁচা মাল চুরি করতে লাগলাম। কাঁচা মাংস এনে বউকে দিয়ে রান্না করাতাম। বসে থাকতাম রান্নাঘরে। রান্না শেষ হতেই কড়াইশুদ্দু বসে পড়তাম সাবাড় করতে। ও খেল কি না খেল আমার কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকতো না। একদিন হোটেল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বউ নেই। বিস্তর খুঁজেছি। পাইনি। একদিন হোটেল থেকেও তাড়িয়ে দিলো হায়ার ম্যানেজমেণ্ট। দেনার দায়ে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে একদিন সত্যিকারের নিস্ক্রমন হলো আমার।
এইসব
একাই বসে ভাবছিল অনীহা নামের লোকটা। এখন তার পরিমিত আহার। রসনায় এখন
আর আসক্তি নেই বলেই এইসব ভাবতে পারছে। ভাবতে অবাক লাগে কিকরে মানুষ উদর সর্বস্ব হয়। অনেক মানুষকে দেখেছে ব্রেকফাস্ট গিলতে গিলতে ডিনারের মেনু নিয়ে বিশাল আলোচনা
করে। শনিবারের রাতে রবিবারের জম্পেশ আহারের কথা ভেবে রাতে ঘুম আসে না। কিন্ত না। এখন তো আমি আমার মধ্যপ্রদেশের রসনার চিন্তা থেকে
স্বতন্ত্র হয়ে নাভিকুণ্ডে । আমি
এখন নির্বাধ। নির্বিকল্প। এখন ছাদে যাওয়ার সময় হয়েছে। সেখানে আসল দেখা জানা।
সেকেন্ড ফ্লোর (অনাহত আবেগ)
মালিকের আদেশ। ননস্টপ অটো স্টিরিওফোনিক ড্রাম বাজবে। ঢিম ঢিপ ডিম ডিপ ঢিম ঢিপ...। এখানে মুক্ত পানশালা। ঢালাও মদ। আকন্ঠ নেশা করে ফুর্তি গান প্রেম গালাগালি না পাওয়ার দুঃখ লুকোনো আবেগ ঠেলে বাইরে বের করা এই সব অনেক কিছু। মাঝরাতে এখন সব ঝিমিয়ে। কেবল বাজনার শব্দ ঢিম ঢিপ...। হৃদয়হরণ জেগে রয়েছে। না সে নেশা করেনি। কিন্তু পানাসক্তদের আবেগ নেশা সে ভালোই জানে। একসময় বিদেশে একটা বিদেশী ওয়াইন বারের সে ছিল ম্যানেজার। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তার সে ছিল উঁচুমানের ব্লেণ্ডার। ভীষণ ভালো ককটেল করতে পারতো। দু পেগ খাইয়ে মানুষের ভিতরে কোমল গোপন আবেগ সে টেনে বার করতে পারতো। এভাবেই একটা রোমান মেয়ের সাথে খুব ঘনিষ্টতা হলো। একসময় হৃদয়হরণ জানতে পারলো ওই মেয়েটি মানুষের বুকের শব্দ শুনে বলে দিতে পারতো তার ভিতরে কতোটা ক্রূরতা ছলকপট আছে কিংবা কতোটা নিষ্কাম প্রেমভাব ও সমর্পণ রয়েছে। হৃদয়হরণ মেয়েটার সাথে কেবল ভোগ বিলসের জন্য ঘনিষ্টতা করতে চাইছিল। অনেকদুর এগিয়েছিল হৃদয়হরণ। কিন্তু একদিন তুমুল আনন্দঘন সময়ের শেষে হৃদয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আশ্চর্য! সে বলেই দিল, হৃদয় ইউ আর আ চিটার আ ফ্রড। হার্টলেস গাই। ডোন্ট ট্রাই টু মিট মি এগেইন ফর এভার। তারপর কি যে হলো হৃদয়হরণের। দেশে ফিরে এসে মাল খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতো। কপর্দকহীন। তারপর একদিন একজন দিব্যপুরুষ এসে তাকে দৈহিক মানসিক আত্মিক সব পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে সাফ করে ঘরে তুললো। সে মানুষটা কোনো বিখ্যাত নামী দামী মানুষ না। একজন হৃদয়বান রিক্সাচালক। হৃদয়হরণ নড়ে চড়ে উঠে দাঁড়াল। বাজনা ঢিমেতালে ঢিপ ঢিপ ঢিপ। ক্লান্ত। হৃদয়হরণ হাসলো। এখন যেখানে যাই ঘটুক না কেন তার চিত্ত এখন শান্ত। অনাহত নাদ এখন নিয়মিত পর্যাবৃত্তে। তার এবার সময় হয়েছে। ছাদে যেতে হবে।
থার্ড ফ্লোর (মুর্ছনা)
এখানে সবরকমের বাদ্যযন্ত্র। এখন মূক। সন্ধে থেকে মাঝরাত অব্দি একটানা সংগীতময় কনসার্ট। ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা, সিম্ফনী,মোজার্ট, বিটোফেন। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি তার সাথে শিবকুমারের সন্তুরের যুগলবন্দি। সেই আবেগ স্মৃতি কোটরে আজীবন গাঁথা থাকবে। যখনই কষ্ট অশান্তি তখনই এই সুর সঙ্গম মাথার ভিতরে ভেসে উঠবে। জীবনযুদ্ধে লড়াই করার সাহস যোগাবে। দুজন মানুষ এখনো জেগে। সুর তরঙ্গের রেশে ভাসছে। ওদের নাম লয় ও ঝঙ্কার। ওরা বিশুদ্ধ ভাব তরঙ্গে ভাসছে। যদিও এই এপার্টমেণ্টের নিচ থেকে ওপরতলা অব্দি নানান মত ও নানা আসক্তির মিশ্র বসবাস। তবু কখনো সখনো সবাইকে এই কম্যুনিটি হলে আসতে হয়। কামাসক্ত পানাসক্ত খাদ্যরসিক সবাইকে এই উত্তরণে আসতে হয়। কণ্ঠ ও তার আবেগ যে সবারই রযেছে। কেউ কেউ এই আবেগে নিবিড় একাত্ম হয়ে থাকতে চায়। অখিল জগত্ যে এই তরঙ্গ আবেশেই ভাসছে! এই অনুভবেই তো লয় বিয়ে করেছিল ঝঙ্কারকে। ওরা দুজন কনসার্টের সাথে ব্যালে নচিয়ে। সুরের ঝঙ্কারের সাথে নানা রঙের আলোর নাচনের সাথে তাল মিলিয়ে ওরা নাচে। কখন কোথায় কি পরিবেশে জন্ম হয়েছিল ওদের কিচ্ছু মনে নেই। সুর সৃজনের উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে থাকে সর্বক্ষন। তবে আজের রাত যেন ভিন্ন। আজ কনসার্টে আনন্দ নয় এক দুঃখের মুর্ছনা ছিল। সব হারানোর ব্যথা। এই আবেগ ব্যালে নৃত্যে দৃশ্যত ফুটিয়ে তুলতে আজ ভীষণ পরিশ্রম হয়েছে। দুজনারই। মনে হয়েছে এইরকম অর্ডারি নৃত্য পরিবেশন করা যেন দাসত্ব স্বীকার করা। কিন্তু তাছাড়া ওরা কিই বা করতে পারে? জীবনযাপনের জন্য এটাও যে প্রয়োজন? এই দোটানায় ক্লান্ত ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাত্ কেউ যেন বলল,এর সমাধান চাও তো ওপরে ছাদে এসো। মীমাংসা হবেই। তাই এবার উত্তোরন। ছাদে যেতে হবে।
ফোর্থ ফ্লোর (আদেশ)
বিশাল হল। একদিকের দেওয়াল জুড়ে নানা বর্ণের চিত্রিত সাইকেডেলিক ট্যাপেস্ট্রি। বিশাল গোলটেবিল। এখানে ম্যানেজমেন্ট কমিটির গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়। এই বিশাল কর্মকান্ডের চালনা ও ডিসিশন মেকিং গোলটেবিলটি এখন ফাঁকা সুনসান। অনুষ্ঠান চালানোর যাবতীয় আদেশ ও আদেশ পালন শেষ। এবার কর্মকর্তাটির নিজস্ব কাজ। উনি দেওয়াল জুড়ে মস্ত আয়নাতে নিজেকে দেখলেন। এই সৌম শান্ত প্রতিবিম্বটিকে লোকেরা প্রাণসাহেব বলে ডাকে। মিটিং চলাকালীন সদস্যদের ভিতরে কচকচি মন কষাকষি চলতে থাকে। আদিম রিপুগুলি বড়ই অবাধ্য। জানিনা ওদের এই শোষণতন্ত্রকে কেন রাজনীতি আখ্যা দেয়। কেউ কেউ সুবিধাবাদী। হৈ হট্টগোলের মাঝে যদি টেণ্ডার বা বিল পাস করিয়ে নেওয়া যায়। তবে প্রাণসাহেব খুব সচেতন। ঠান্ডা মাথায় নিপুণ কৃষকের মত উপজ শস্য চারাগাছের চারপাশে ক্ষতিকর উইডসগুলি তুলে ফেলার মত ফাইল থেকে ক্ষতিকর কাগজগুলি ছেটে ফেলেন। উনি মহত্ কাজে বিশ্বাসী। যা করব মানুষের ও প্রকৃতির ভালোর জন্যেই করব তাই যা হবে তার পরিণাম ভালো হবেই,এই বিশ্বাস। তবে এই বিশ্বাসের হননকারীও কখনো কখনো শক্তিশালী হয়ে ঘা মারে। তাই তিনি তাঁর একটি পা ও একটি চোখ হারিয়েছেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করেন। তিনি জানেন, মাথার উপর অসীম আকাশ অনন্ত ব্রহ্মান্ড। সেখানে অর্বুদ অর্বুদ ধ্বংসকান্ড চলছে কিন্তু সৃষ্টির নিয়মের কোনও বিকার নেই। মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যদি বিগড়ে যায়, মাথা ঠান্ডা রেখে সয়ে নিয়ে তার উপচার তো বুদ্ধি দিয়ে মাথাই করে? কিন্তু আজ মিটিং এ একটু বেশিই ঝামেলা হয়েছে। কমিটি ডিসল্ভ করতে বেশিই স্বার্থপর স্বতন্ত্রকামী মানুষ আজ জোরজুলুম করছিল। এমনি পরিস্থিতিতে প্রাণসাহেব ছাদে গিয়ে একমনে ধ্যান করেন আর সঠিক নির্ণয় পেয়ে যান। উনি উঠে দাঁড়ালেন। স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে উনি দরজা খুলে ওপরে যাবার সিঁড়ির ধাপে পা রাখলেন।
ছাদের উপর মুক্ত আকাশ (হাজার তারার আলো)
ছাদের ঠিক মাঝখানে একটি স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময় কমলা রঙের আলো। তার চারপাশ ঘিরে প্রচুর টুনিবাল্ব। জ্বলছে নিভছে...। যেন সহস্র পদ্ম পাপড়ি খুলছে বন্ধ হচ্ছে...। তারও ওপরে নক্ষত্র খচিত আকাশ যে আরও উজ্জ্বল দীপ্তময়। সেই আলোর পিছনে শ্বেতশুভ্র বেদীর উপরে পদ্মাসনে বসে একজন কথা বলতে শুরু করলেন।
-এখানে মুক্তি প্রশান্তি ব্যাপ্তি। সবকিছু নিচে ছেড়ে এখানে যে দাঁড়াবে মাথার
উপরে অসীম অন্তরীক্ষ তারই অধিকার। তোমরা পাকদন্ডি সিঁড়ি বেয়ে এসেছো তো? কাম রতি? নিচে যা দেখেছ ভুলে থেকো। কাছে
এসো প্রাণ হৃদয় লয় ঝঙ্কার। তোমরা নিজেরা নিজেদের স্তরের বিবশতা নোংরামি জটিলতা
কাটিয়ে উঠেছো বলেই তো এই উত্তরণ। এসো তবে এখানে অসীম জ্যোতিহীন জ্যোতিতে একক
মানুষ হয়ে এসো এসো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া যাক।
ভিন্নস্বাদের গল্প। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন