সমকালীন ছোটগল্প |
সুখ-অসুখ
খুব নিচু দিয়ে পশ্চিম্মুখো উড়ে যাচ্ছিল এরোপ্লেনটা। ঘরের ভেতর থেকেই আমি দেখতে পাচ্ছিল এরোপ্লেনটার রূপোলী রং আর বম্ব শেলের মতো সরু ছুঁচালো আগা। ঘরের মেঝেয় অপর্ণার সামনে রাশীকৃত পোশাক আর চেনখোলা বড় জ্ঞানী ব্যাগ রাখা। কিছুটা ব্যস্ত অপর্ণা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে চলেছে, যদিও অপর্ণার হাতের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। প্রথম এরোপ্লেনটা উড়ে চলে যাওয়ার পরই আমি অপর্ণার দিকে তাকিয়ে দেখল তখনও অপর্ণা তার জ্ঞানী ব্যাগ গুছিয়েই চলেছে। ব্যাগ গুছাতে গুছাতেই উঠে গিয়ে বিছানার গদি তোষক উলটে ফেলল, আর আমাকে একটু কী বলল ভাল শোনা গেল না। তারপর কী একটা জিনিস হাতে নিয়ে ফিরে গেল আবার ব্যাগের সামনে। ব্যাগ গুছাতে দেখলে আমার কোথাও তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথা মনে হয়। এরোপ্লেন চলে গেলে আর ব্যাগ গুছানোর কী দরকার? আকাশ পরিষ্কার। আরও একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে তেমনি নিচু দিয়ে। এইটার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দেখে গা থেকে চাদর সরে গিয়ে মেঝেয় লুটোচ্ছে। শরীরে তার সাত দিনের জেটল্যাগ।
আমাকে বিছানায় উঠে বসতে হল। বাইরে সেপ্টেম্বরের আমেজ। আজ পাঁচ তারিখ। জাফরি কাটা লোহার জানলা, জানলার বাইরে একটু দূরে বট নিম অশথের ঘন ডালপালা। নিচের বস্তি থেকে উঠে আসছে শিশুর কান্না, ধোঁয়া, গেরস্থালির শব্দ আর গোবরের তীব্র গন্ধ। চেয়ারের ওপর তার ল্যাপটপটা রাখা। মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখল কাল রাতে শোয়ার সময় নেটটা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল। হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক মেসেনজার সব চলছে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি ফলে। তোমাকে ছেড়ে অপর্ণা কি সত্যি কোথাও চলে যাচ্ছে? একটু বেখেয়াল হয়ে যায় আমির মাথার ভেতরটা। তারপরই আমার মনে হয় অপর্ণাকে তুমি মনের থেকে কতটা পছন্দ করে? অপর্ণাকে না জানিয়েই তো তুমি আগে আগে কতবার এদিক সেদিক কাটিয়ে এসেছে। রাতে বাড়িই ফেরেনি। একটু বেলায় এসে বাজার গেছে তারপর। শাকসবজি মাছ কিনে এনে কিচেনে ফ্রিজের সামনে চুপচাপ নামিয়ে রেখে দিয়েছে। তারপর চান করে সোজা অফিস। ব্রেকফাস্ট না করেই। দুপুরে ভাত খেতে এসেছে, নিয়ম মাফিক, তখনও অপর্ণার সংগে নিতান্ত প্রয়োজনের কথা ছাড়া তুমির অন্য কথা হয় নি। ভাতের এঁটোথালা বেসিনে নামিয়ে দিয়ে অপর্ণা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। সাড়ে তিনটে নাগাদ গাড়ি এলে আবার অফিস বেরিয়ে গেছে। বেরোবার সময় খুচরো দুশো টাকা পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে গেছে। ওদিকে অপর্ণা ততক্ষণে বাইরে বেরোবার জন্য প্রায় রেডি। চারটে থেকে তার গানের ক্লাশ, সপ্তাহে তিনদিন এমন যায় ও। অপর্ণার থেকে যাওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার পর অপর্ণার ওপরে রাগ হয় আমার। এই ভালমানুষী সেজে থাকা আসলে বদমায়শীর নামান্তর। আর তোমাকে ছাড়া বদমায়শী ফলাবেই বা কোথায়? দরজায় কলিংএর জোর শব্দ, বিছানা থেকে দ্রুত নামতে নামতে আমার মনে হল কী ব্যাপার? অপর্ণা চলে এল নাকি? চলে যাবার আগে আমার সংগে বোঝাপড়া করে নিতে চাইছে। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজাটা খোলে আমি আর তার সামনে পনেরো বাই সতেরো লম্বা বারান্দা। একপাশে সার সার পাঁচখানা গারবেজ বক্স। পাঁচটাই গারবেজে ওপচানো মাঝারি ধরনের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জায়গাটা এত অন্ধকার যে সকালেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়েছে। এসবের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বেঁটে মেয়েটা। পরনে হাতকাটা পাতলা গেঞ্জি আর একদম ছোট হাফপ্যান্ট। তেলতেলে ফর্সা উরুর ওপরে নীল ট্যাটু।
প্লিজ কাম ডাউন্সটেয়ার…! দেয়ার উদ বি অ্যাক্সিডেন্ট।
মণিপুরি বা মিজো বা অরুণাচলি মেয়েটার ওঁয়াও মোঁয়াও উচ্চারণ
আমির কানে অতি বিচ্ছিরি শোনায়।
তার মনে হয় অপর্ণার পক্ষে কলকাতা
থেকে এত দূর আসা কতটা অসম্ভব।
কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
আই ডোন্ট নো… মকান মালিক সব কো বুলা রহে হে! সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত
নিচে চলে গেল মেয়েটা। এত সুন্দর মেয়ের ভোকাল কর্ডটা যে কেন এত জঘন্য! ঘরে ঢুকে ফোনটায়
চারটে গুড মর্নিং মেসেজ এসেছে দেখল আমি। এই বাড়িটা ছ’তলা। দোতলার ঘরটা তার। বাড়িওলা থাকে একতলায়। বাকি তলাগুলোয় কারা থাকে আমার জানা নেই। বেঁটে অতি ফর্সা মেয়েটাকে
এই বাড়িরই সিঁড়িতে দেখেছে দুই কি তিনবার। মেয়েটার গাল ভাঙা, চুল্ কানের পাশ দিয়ে ঘাড়ে লেপটানো। গা হাত পায়ের চামড়া অতিশয় মসৃণ আর তেলতেলে। ব্রাশে অনেকখানি টুথপেস্ট লাগিয়ে কমোডে গিয়ে বসে আমি। আমি ভেবেছিল যে, খুব সামনে থেকে অপর্ণার দুঃখী চোখ
জোড়া আর একটু দেখে।
নাজির তাকে ডাকে, বলে আপনে এদিকে আসুন। নাজিরের ডাকে আমার বুকে ভূতুড়ে শব্দ হয়। নাজিরকে চেনে আমি। এই বাড়ির মকান মালিকের কী রকম ভাগ্নে। মকান মালিক কোথাও ব্যস্ত থাকলে নাজিরের হাতেই ভাড়ার টাকাটা তুলে দিতে হয়। আমি অনেকবার অনলাইন পেমেন্ট করে দিতে চেয়েছে, কিন্তু ওরা ওতে রাজ়ি হয়নি। কাল রাতে হাড্ডি খিজির ঘুমের মধ্যে মরে গেছে। নাজিরের কতগুলো সিএনজি আছে। সেইগুলোই দেখাশোনা করত খিজির। থাকত এই বাড়িরই গ্যরাজে। বাড়িটা এক্কেবারে হোপলেস। সামনে পেছনে কোথাও খোলা নেই। ড্রেনের পরেই বাড়ি শুরু হয়ে গেল। সাইবার হাবে নতুন চাকরিটা লাগার পর প্রথমে সেক্টর এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল আমি। কিন্তু শেষ অব্দি খরচা কুলানো মুশকিল হয়ে উঠছিল। তার ওপর ঘন ঘন পাওয়ার কাট, জল নেই এসবের ঝামেলায় জেরবার হয়ে এক দালাল মারফত এই বাড়ির খোঁজ পেয়ে জিনিষপত্র সমেত রাতারাতি এখানে শিফট করে নেয়। আগের বাড়িটা ছিল গুরগাঁও। এটা দিল্লী। দিল্লীতে জল পাওয়ারের তেমন কষ্ট নেই। কিন্তু এ বাড়ির মুশিকল হল এখানে যখন তখন রাস্তার কুকুর ঢুকে সিঁড়ি বারান্দা সব নোংরা করে রাখে। দুর্গন্ধে চলা দায় হয়ে যায়। নতুন বাড়ির খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত এমনই চলবে। রোজ ড্রেন পেরিয়ে বাড়ির বারান্দায় পা দেওয়ার সময় আমির চোখে পড়ে স্টীল প্লেটের ফলক, তাতে বাড়ির নাম লেখা- ‘সপনা-মনজিল’।
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাহা – বলতে বলতে কেউ
একজন হাড্ডি খিজিরের বুকের ওপরে সবুজ
রঙের চাদর বিছিয়ে দিল। অস্থিসর্বস্ব চেহারার
জন্য সে এই উপাধি লাভ করেছিল। জ্যান্ত অবস্থায় খিজির দুই
হাতে স্ক্রু ড্রাইভার আর প্লায়ার নিয়ে ঘোরাফেরা
করত, কিন্তু
এখন তার হাতে ধরা একটি টুটা ফুটা ময়ূরের পালক। দারোগা সবাইকে
বলল, আপনারা
ঐ দিকটায় একটু অপেক্ষা করুন, আধ ঘন্টার মধ্যে সবাইকে ছেড়ে দেব।
বেঁটে মত চশমা পরা একজন লোক বলল, কি মুশকিল এইভাবে
কেউ পাবলিককে আটকে রাখতে পারে
নাকি? সংগে সংগে পাশ থেকে আর একজন বলে উঠল, এইটা হল এখনের নিয়ম। ধরে নিন এক ধরনের হরতাল, স্ট্রাইক। আজ সারাদিন সব কাজ কম্মো বন্ধ। বেঁটে ফুঁসে উঠে বলল, স্ট্রাইক হলেই হল? এমনি করে বলছেন ডেভলপমেন্ট আসবে? কে কবে ঘুমের মধ্যে
হার্ট ফেল করে মরে গেল আর তার কুফল ভুগবে আম জনতা?
লোকটা বলেই চলেছে, ঘরের অন্য কারুর মুখে কোনো সাড়া শব্দ নেই। মুখে সবার কুলুপ। বাড়িঅলার মাথায় কালো টুপি। চেহারা গম্ভীর। বাড়িওলার ভাগ্নে নাজির আর দারোগা পরস্পর
কথোপকথন হচ্ছে। - স্যর হাসপাতাল থানা থানা হাসপাতাল করতে করতে তো দাফনের সময় বেবাক পার হয়ে যাবে। মুর্দাকে স্যর অত টাইম দেওয়া যাবে না।
দারোগার মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে ধ্বনি বের হয় যা
দিয়ে নানা ধরনের বাক্য গঠিত হতে পারে। চশমা পরা বেঁটে নতুন ভাড়াটে, যার সংগে আমার কোনও দিনই ভাল করে আলাপ হবে না, আমিকে সে ফিসফিস করে বলে, কাল রাতে যে এ বাড়ির নিচের তলায় লোক মরেছে আপনি জানতেন?
আমি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল। এই ভঙ্গি দেখে লোকটা আরও কিছু উত্তেজিত হয়ে বলল, স্টেডিয়াম চত্বরে আজ জমায়েত আছে, একটু পরে, যাচ্ছেন নাকি?
আমি এবারেও ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঘোরালো। লোকটা মনে হয় উত্তেজিত না হয়ে কথা বলতে পারে না, বলল ওখানে আর একটা খেল হবে। লিডার পাবলিককে স্বপ্ন দেখাবে। তারপর সেই স্বপ্ন দেখে আম আদমি
হয় জেল খাটবে, নয় রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মরবে, নয় ভুয়ো আধার নিয়ে
জালিয়াতির মামলায় জড়াবে। আচ্ছা ঐ টিপিকাল লিডারগুলো ঘুমের মধ্যে মরেছে এমন শুনেছেন কোনও দিন? শুনবেন না…
হঠাৎ দুজন কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে ঘরে ঢোকে। দারোগা তাদের বলে, দেখুন আপনারা এডুকেডেট
লোক, বেফালতু
ঝামেলা করবেন না…
ছেলে দুটো বলে, আমরা বাড়িওলাকে হেল্প করতে এসেছি। ইতিমধ্যেই আমরা অ্যানাউন্স
করে দিয়েছি বডি আজ দাফন হচ্ছে না... লোকজন বাইরে আছে, বলে নাজিরের দিকে চেয়ে ঘোষণা
করে, আজ আর গ্যারেজ খুলবেন না।
নাজির হ্যাঁ বা না কোনও কিছুই জবাব দেয় না। তার অটোর ব্যবসা তিন বছরের। দুজনের এই
তরুণ সমাজ গাড়ি চেসিস অটো কিছুই বোঝে না।
চশমা পরা বেঁটে বলল, দেখছেন কেমন
পলিটিক্স শুরু হল..., এত ভিড় হট্টগোলের
মধ্যে আমি হট প্যান্ট পরা মণিপুরি মেয়েটাকে দেখতে পেল না।
একনিষ্ঠ মনোযোগ নিয়ে আমি মেয়েটাকে খুঁজতে
চাইল কিন্তু মেয়েটা এখানে নেই। ইতিমধ্যে ঘরের ভেতর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে। হাড্ডি খিজিরের
বউ ও আরও কেউ কেউ। একটা ন দশ বছরের ছেলে আছে খিজিরের, সে শুকনো মুখ চোখ নিয়ে
দারোগা ও বাকিদের পর্যায় ক্রমে দেখে যাচ্ছিল। ছেলেটাকেই অনুসরণ করে আমি দেখতে পেল
বারান্দার এক কোণে একটা মাঝারি সাইজের চেন
খোলা জ্ঞানী ব্যাগ, পাশেই মেঝের ওপর কিছু জামাকাপড় ময়লা শার্ট ডাঁই করা। কেন? ওখানে অপর্ণা ছিল?
ভোররাতের স্বপ্ন ও এখন এই দৃশ্যের মাঝে আমি অনিশ্চিত
দাঁড়িয়ে থাকে।
বলাকা সিনেমার পেছনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফালু মিস্ত্রী আর হাড্ডি খিজির
বহুবার পেচ্ছাপ করেছে। তখন থেকেই খিজিরকে চেনে ফালু। উঁচু খাড়া নাক, তোবড়ানো গাল আর খড়ি ওঠা চামড়ায় এদিক সেদিক কিছু গর্ত। মৃতদেহের
মত কোটরে ঢোকা দুই চোখ। পরপর আঠারোটা অটোর নাম্বার
তার মুখস্থ। অটোগুলোর মাথায় মাডগাডে সিটে রডে
হাত বুলাতে বুলাতে চলে তার অবিরাম বাক্য বিলাস… খানকির পুত না হলে কেউ অটো চালায়? ইসস্! তিনশো পঞ্চাশটারে
এক্কেরে শেষ করে দিছে! মাডগাডের ওপর দাঁড়িয়ে
হোগা মারা দিচ্ছিলি তর কোন বাপকে রে? ড্রাইভারেরা একে একে অটো নিয়ে চলতে শুরু করে, এক এক জনের এক
এক দিকে গন্তব্য। সবকটা অটো বেরিয়ে গেলে হাড্ডি
খিজির ডাইনে বাঁয়ে হেলতে দুলতে রাস্তা ক্রশ
করে রহমতুল্লার দোকানে ঢুকে যায়। এই দোকানেও ফালু আর খিজির দু চার দিন
একসংগে সকালের নাস্তা করেছে।
ফালুর চোখ ছলছলে - বহুত গজব পড়ছে! তামামটা জিন্দেগী
কাটল মহাজনের গোলামি কইর্যা
! আমি আর
অটো চালাব না!
হাড্ডি সর্বস্ব হাত ওঠানো খিজির চোখ ঘুরিয়ে বলে, এইটা কি কস চুতমারানি? খামোস মাইর্যা থাক! বেব্যাক জিন্দেগী খাইবি কী?
ক্যান? দ্যাশে যাইব! ধান বানব, কামলা খাটব! কাজ আছে!
তো যা! এখনই যা! মাহাজনরে কেমনে ঠকাইব শুদু সেই ফোকর! - বলতে বলতে কে কম ঠকায়, কে কম চুতমারানি এই হিসেব করতে আধাঘন্টা সময় কাবার করে দেয়। কিন্তু ফালুর মুখ যে কে সেই। ফালু কি আর ইচ্ছে করে এ কাজ ছেড়ে দিতে চায়? কোনও কোনও দিন
কাজের ফাঁকে পেঁপে কাটা কি ছোলার ঘুঘ্নি খেতে গেছে, ব্যস অম্নি কোথা থেকে নাজির এসে হাজির। - দেখি কত পাইছস? সোজা গাড়ি থেকে নেমে তারপর ফালুর আপাদমস্তক তল্লাসি।
ঈদের দিন অটোওলাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার
নিয়ম নেই। নাজির অবশ্য সেদিন
সব অটোগুলোকে রাস্তায় ছাড়ে না। এমনিতেই তাদের ওপর সে ভয়ানক চটা। ফালুর মনে
হয় তার ওপরে যেন নাজির দ্বিগুন চটা। মেহেরৌলীতে একবার একটা বড় গাড়িকে ফালু ওভারটেক করতে গেছিল। আর
তারপর যা হয়। চাকা মাডগাড সব পাল্টাতে হয়েছিল নাজিরকে।
কিন্তু এসবের দাম তাকেই দিতে হবে জেনে একেবারে মিইয়ে
গেছিল ফালু। শেষ চেষ্টা করেছিল – তহন তো কিছু কইলেন
না!
তহন কইলে তহন এর দাম দিতে পারতি হারামজাদা? তহন তোকে ম্যাহারবানি করেছি।
এদিকে ঈদের জামাতের সময় হয়ে গেছে। মহাজনের হাতে পায়ে ধরে নতুন মাডগাডের যা দাম হয় তার বেশির ভাগটা দিয়ে ফালু ছোটে হাওয়াই আড্ডার দিকে। সেখান থেকে কোনও মালদার আদমী জুটে গেলে এর দ্বিগুণ রোজগার।
এই ঘটনার সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যেই আজ সকালের এই
ঘটনা। ফালু অবশ্য হাড্ডি খিজিরের ইন্তেকালের খবর জানে না। নিজের ঘরে খুবই ব্যস্ত ফালু। ঘরের জিনিষপত্র তোলপাড় করে ফেলেছে, কিন্তু ইপ্সিত
বস্তুটি বেবাক উধাও। ইঁট সুরকির একটা পনেরো ইঞ্চির দেওয়াল। এই দেওয়ালেরই কয়েকটা ইঁট খসিয়ে ঘরের দরজা বানিয়েছে ফালু। ভেতরটা টিন আর
বেড়া দেওয়া। কিন্তু এমন ঘরে
ছোটলোকের বাচ্চাগুলো যখন তখন ঢুকে চুরি চামারি করে নেয় বলে
দরজার পাশে আরও কটা ইঁট খসিয়ে আলগা করে রেখেছে। তাতে প্রয়োজনমত জিনিষপত্র লুকিয়ে রাখা যায়। একটা খোপে তেলের একটা টিন
রাখা। আর একটায় সাইকেলের অচল চেন। আর একটা
খোপে হাত ঢোকালো, নতুন একটা বল বেয়ারিং। চোরা বাজারে
একবার ঘুরছিল, হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে যায়। সেই সুযোগে
হাতিয়ে নিয়েছিল জিনিষটা। খুব চকচকে, বিক্রি করতে মন হয় নি।
কিন্তু সে না হয় হল, আসল জিনিষটা গেল কই?
অপর্ণার অঙ্কে মাথা খুব ভাল। ভাল অঙ্ক জানে বলে তার কাছে রোজ পনেরো ষোলো জন অঙ্ক করতে আসে। এটা দিনে। আর বিকেলে আরও জনা সাতেক আসে। তারা সব কলেজের ফাইনাল ইয়ারের স্টূডেন্ট। কিন্তু ভাল ইংরেজী জানে না বলে অপর্ণা কোনওদিন স্কুলে টীচার হতে পারল না। ড্রইংএর যেখানে বসে অপর্ণা স্টুডেন্ট পড়ায়, সেই দেওয়ালের ওপরে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় গড়ানো তোমার মায়ের ছবি। ছবি শূন্যতায়ও ভাসতে পারে। ঊনিশ বছর – নাইন্টী এইট, মারা গেছে মা। এই ছবির ঠিক নিচেই ছিল জানলা। জানলার বাইরে পেয়ারা গাছের পাতা। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক সীমানা ও এতগুলো বছর ডিঙিয়ে আসা দৃশ্য, ধ্বনি ও গন্ধের ভেতরেই স্বপ্নটা দেখেছিল তুমি। জেগে এবং অফিসে, বস-এর সাথে মিটিং-এ, আলুবাজারের মোড়ে অপর্ণার ইসিজি করাতে গিয়ে। আর ঘুমিয়ে তুমি একবারই স্বপ্ন দেখেছিল গত বছর। দিনটা ছিল ছুটির দিন, বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল। না ঘুমিয়ে উপায় ছিল না। দেখেছিল সে আর আমি হাত ধরাধরি করে নাম না জানা এক নদীর ধারে দাঁড়িয়ে।
অপর্ণা বলল, একা যে?
তুমি জবাব দিল, আজকেরটা আমার
একারই কাজ। পরশু মিটিং হয় যদি, তো
তখন ওরা আসতে পারে।
পরশু সকালে ছবি কাজে আসবে না। সুতরাং কালকের ভেতরেই রান্নাঘর সাফ সুতরো করিয়ে রাখবে।
কেন? কাল কি আছে?
উত্তর দিল না অপর্ণা। চলে গেল। আগে তুমি অপর্ণা কখন প্রতিকূল
প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেই ভয়ে একটু সংকুচিত থাকত। যদিও থালা বাসন ছোঁড়া, ভাত না খাওয়া, ইত্যাদি কখনও হয় নি। আমিকে যখন
গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেছিল তুমি, তখনও এসব না। ইদানীং একটা ভোঁতা আর ক্লান্ত ধরনের অনুভূতি তোমাকে আচ্ছন্ন
করে রাখে। বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা। তাও একটানা নয়। ডাক্তারকেও বুঝিয়ে বলা যায়
না, কারণ কিছুক্ষণ
পরেই ব্যথা বুক থেকে সরে গিয়ে ডান দিকের পাঁজরে অনুভূত হয়। সেখানে ভাল করে জিরোতে না জিরোতেই ব্যথা আবার একটু ঢেউ খেলিয়ে অ্যাবডমেনে নেমে আসে। আচ্ছা দীপচাঁদেরও
কি এমনি ব্যথাই হত? ব্যথা নিয়ে খুব
ভুগেছিল লোকটা। আজ ভোর রাত্রে দীপচাঁদকে স্বপ্নে দেখেছিল তুমি। দীপচাঁদ মাইতি। যে কোনও স্বপ্নের
ভাল ব্যাখ্যা করে দিত দীপচাঁদ। তুমির অবশ্য কোনওদিনই
এসব ব্যাখ্যার দরকার হয়নি। অফিস থেকে ফিরে
একান্তে বসে বসে আমিকে হোয়াটসঅ্যাপে
রাতের দেখা মিষ্টি স্বপ্ন হুবহু লিখে পাঠিয়ে দিত। আমিও লিখত - আমিও তোমায় কাল স্বপ্নে দেখেছি জানো তো? বলতো কি দেখেছি? বলতে পারলে একটা…
রাত্রে খেতে বসে শুনল অপর্ণা কাল বাপের বাড়ি যাচ্ছে। ভোরের ট্রেনে যাচ্ছে। দুদিন বাদ ফিরবে। এই দুদিন ছেলের স্কুল ছুটি। কিন্তু এমন তো কথা ছিল না। ক্লাবের পুজোয় অপর্ণা প্রতিবার সক্রিয় অংশ নেয়। চারদিনের কালচারাল প্রোগ্রামের সেক্রেটারী সে। ব্যাপারটা
কী? ছেলেই পরিষ্কার করল ব্যাপারটা। অপর্ণা না কি রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন
দেখেছে বাবার খুব শরীর খারাপ। দীপচাঁদ থাকলে এর কী ব্যাখ্যা দিত কে জানে। কিন্তু দীপচাঁদ তো কবেই মরে গেছে, আর মরার এতদিন পর তুমির স্বপ্নে এসে তুমিকে নিয়ে কোথায় যাত্রা
করেছিল কে জানে। কাল রাতে বিছানায়
শোয়ার পরও তুমির অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি। ভাবল একটু মাস্টারবেশন করবে, কিন্তু হোয়্যাটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার সব
আজকাল রাত্রে বন্ধ করে শোয়। অনেককাল আগেই আমির সঙ্গে তার
গান্ধর্ব মতে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তুমি এখন একা।
দুপুরে ভরপেট মাছভাত খেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল তুমি। স্বপ্নে দেখল সেপ্টেম্বরের নীল নীল আকাশ। এখানে ওখানে ছিটেফোঁটা মেঘ। সংগে ফ্রীতে ঝকঝকে রোদ্দুর। সে আর তুমি হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে সোজা উত্তরমুখো। একটু এগোলেই সামনে চাঁদনী চক পুলিশ স্টেশন। সামান্য তফাতে শাহজাদা খুরমের বানানো দুর্গ। একটা রিক্সা ডাকল, ডেকে চড়ে বসল দুজনে। রিক্সাওলা বলল, কাঁহা জানা হ্যায়? তুমি বলল, খাড়ি-বাওলী। সংগে সংগে চেঁচাল আমি, এই ন্না—! পহেলে পরাঠেবালা গলি চলো!
চতুর্দিকে কাতারে কাতারে লোক, অজস্র কেমিকাল আর মেডিসিন শপ। ঠেলাঅলা
মুটেঅলা হকার পিলপিলে পাবলিকের মধ্যে দিয়ে রিক্সা আকাশে উড়ল। নিচে পড়ে রইল
সদর বাজার আর তার যাবতীয় জনতা। রিক্সা নিজামুদ্দীনের কাছে পৌঁছতেই দেখল কখন মিটিং
শুরু হয়ে গেছে। ফুলার রোড থেকে একটা বড়
মিছিল এসে এইমাত্র এসে মঞ্চের সামনে জমায়েত হল। তুমুল চিৎকারে কানে কিচ্ছু
শোনা যাচ্ছে না। সমস্ত জায়গাটা পুলিশ ও আধা মিলিটারীর ট্রাক দখল নিয়ে নিচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে আমি তাকে ডেকে তার হাতে একটা কিছু দিল। কিন্তু গুঁতোগুতি আর লোকের চাপাচাপিতে সেটা হাত থেকে পড়ে গেল কোথায়।
রিক্সাওলা দুজনকেই বলল, হাত থেকে ময়ূরের পালক মাটিতে পড়ে গেলে বুঝতে হবে বিচ্ছিন্নতা আসন্ন। এটা
একটা পার্সি প্রবাদ।
-এই হালার চুতমারানি ডেরাইভার! তরে লাইসেন দিল ক্যাঠায়? ঠিক করে গাড়ি চালাবারে পারস না? —এর প্রত্তুতরে হাড্ডি খিজিরের মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না। সে ড্রেনে পড়ে গেছে। বাঁ পায়ের কোনও সম্বিত নেই। ফালুর এই ইঁট সুরকির ঘরে লুকিয়ে সে অনেকবার এসেছে , কিন্তু আজ সব কেমন অচেনা ঠেকছে।। অন্ধকার গাঢ়তর হয়, সারা মহল্লায় কি কারেন্ট চলে গেছে? চুরি করা জিনিষটা তার বুক পকেটে। কিন্তু সিধে হতে না পারলে সে আস্তানায় পৌছবে কেমন করে? শুনেছিল ময়ূরের পালক সংগে রাখলে নাকি লোকের নজর বদলে যায়। তক্কে তক্কে ছিল খিজির বহুদিন, আজ সুযোগ বুঝে ঝেঁপে দিয়েছে মালটা। কিন্তু ফেরবার পথে হঠাৎ এই বিপত্তি। ড্রেনএর ভেতর থেকেই খিজির তার রাস্তায় ঊল্টে পড়ে থাকা অটোটাকে দেখতে পাচ্ছে। চাকা খুলে গেছে, বেঁকে চুরে গেছে মাডগাড। ওপর দিয়ে মিলিটারী কনভয় চলে যাচ্ছে দ্রুত। গুঁড়িয়ে গেল অটোটা, ছয়শো তিন নম্বর… ইসসসসস! পুলিশ মিটিং করছে, চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। বাড়ির ছাদে, বড় বড় গাছের ডালে হাতে অটোমেটিক নিয়ে মিলিটারী দাঁড়িয়ে। স্টেজে বক্তৃতা হচ্ছে , - ভাইসব শহরে অটোওলাদের দৌরাত্ম খুব বেড়েছে। ...দমবন্ধ লাগে খিজিরের। কিছুতেই ড্রেন থেকে বেরোতে পারে না। তার মুখে নাকে হুড়হুড় করে হাইড্রেনের নোংরা জল ঢুকে যাচ্ছে। হাড্ডি খিজির কি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? না কি এসব সত্যিই ঘটছে? স্টেজে এবার ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার ভাষণ দিচ্ছে -- বন্ধুগণ আপনারা দেখবেন যেন গুলিবিদ্ধ অটোওলার দেহ নিয়ে রাজনীতি না হয়! আপনারা আমরা আমি এই সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই...। কেউ চেঁচাল - কই শালা? ধর ধর! ড্রেনের মধ্যে খিজির কাউকে দেখতে পেল না, এদিকে জলে তার কলিজা ভর্তি হয়ে উঠেছে। গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে মুখ দিয়ে।
মুর্দা খিজিরকে ঘিরে অজস্র সংলাপকে নিচের তলায় ফেলে ওপরে নিজের ঘরে উঠে আসে আমি। তার খুব ক্লান্ত আর বিরক্ত লাগছিল। তবে একটা সুবিধাও খুব বুঝতে পারল, এই ঘরটায় চট করে কেউ তাকে অযথা বিরক্ত করতে আসবে না। বেশ নিজের মত একলা থাকা যায়। লোকজন দেখার ইচ্ছে হলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেই হল। এসব ভাবছে এমন সময় দরজায় আবার তীব্র কলিংএর শব্দ। বেশিক্ষণ একলা থাকা গেল না। কে এল কে জানে! দরজা খুললে দেখা গেল সেই বেঁটে অতি ফর্সা মণিপুরি মেয়েটা।
হোয়াট হ্যাপেন্ড?
প্লিজ তেক দিস! - একটা রঙ বেরঙের পালক লাগানো
শো-পিস।
এটা দিয়ে কী হবে?
একটু হেসে মেয়েটা জবাব দেয়, এটা ড্রিম ক্যাচার। ঘরের কোণায় ঝুলিয়ে রাখতে হয়। তাহলে রাতে আর কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে না। বরং মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্নে বেবাক রাত কাবার! - হাঁফাচ্ছে মেয়েটা। ওর গায়ের গেঞ্জিটা গরমে ঘেমে ভিজে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে এই রকম একটা তাজ্জব জিনিষ খুঁজে আনতে মেয়েটাকে
এতক্ষণ অনেক সময় দিতে
হয়েছে। কারণ আজই এ বাড়িতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে একজন মারা গেছে।
ড্রিম ক্যাচারটা নিয়ে নিল আমি। নিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিল তক্ষুনি। তারপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ঘরের দরজা জানলা এখন সব বন্ধ। আজ আর রান্নাবান্নার ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করছে না। অনলাইন কিছু একটা অর্ডার করে দেবে পরে। সেজন্য কাফি সময় আছে হাতে। আমির গায়ে এখন নতুন ধরনের দাগ। সবুজ বলো সবুজ, কালো বলো কালো …কারুর সাধ্য নেই আমাকে কেউ আলাদা করে চেনে। আপাতত আমি
একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখতে চায়। এক্ষুনি চায়। কেমন হবে স্বপ্নটা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন