শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পায়েল চ্যাটার্জী

 

সমকালীন ছোটগল্প


কাঁটা-চামচ

(১)

কাঁটা আর চামচটা রোজ আমার স্বপ্নে ঘুরে বেড়ায়। দুটো চোখকে যেন কাঁটা আর চামচটা ক্ষতবিক্ষত করতে উদ্যত হচ্ছে। চোখ দুটো দেখতে পাই। জুলু জুলু চোখ। ভিকুর। এমন সময় স্বপ্নটা ভেঙে যায়। ভিকু রাকেশদের বাড়ি জল দিত। রাকেশের মায়ের অস্টিও আর্থারাইটিস আছে। তাই বাড়ির প্রয়োজনীয় জল ভিকু এনে দেয়। আমি রাকেশকে টিউশন পড়াতে যেতাম। প্রথম যেদিন ভিকুকে দেখি ওর হাতে পায়ে কাদা, বড় বড় দুটো পাত্রে জল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমার সিসিফাসের কথা মনে পড়ছিল ওকে দেখে। ওর চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল জীবনের ওজন যে কতখানি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এই বয়সেই।  জল পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকেশকে ‘আসছি’ বলে চলে গেল। ওর কাদা পায়ের  ছাপগুলো মোছা হচ্ছিল কিছু বিরক্তিসূচক বিশেষণ উচ্চারণের সঙ্গে। রাকেশের বয়স পনেরো-ষোলো। ভিকু বোধহয় তার থেকে একটু বড় ‌বা সমবয়সী। ঠিক টের পাই না, জীবনের ভারে ওর কোমলতা হারিয়ে গেছে, নাকি স্বাভাবিক বয়সের গতিপথে কৈশোর বিদায় জানিয়েছে? ওকে দেখার পর থেকে মনের  ভিতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তিকর খচখচ করছিল। ‌রাকেশকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোরা জল আনার অন্য ব্যবস্থা করতে পারিস না?

-আগে তো এই ব্যবস্থা ছিল না। ভিকুর মা অসুস্থ। বাবা নেই। এদিক সেদিক কাজের খোঁজ করে। আমাদের বাড়িতে এসেও কাজ চাইছিল। তাই মা ওকে জল আনার জন্য রেখেছে।

আমার প্লেটে তখন একটা ‘চিজি ওমলেট’ উঁকি দিচ্ছে।‌ সঙ্গে একটা কাঁটা-চামচ,  যেটা ক'দিন পর থেকে আমি স্বপ্নে দেখা শুরু করেছিলাম। রাকেশের মা তার একমাত্র সন্তানের গৃহশিক্ষকের বিষয়ে বড়ই যত্নবান। মাঝেমধ্যেই এটা-সেটা তৈরি করে প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে যায়। স্বাদে গন্ধে নেহাত মন্দ হয় না। পেটে খিদে থাকলে জিহ্বা, মন দুই তৃপ্ত হয়। সেদিন এক টুকরো ওমলেট মুখে দিতেই কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠলো। ‌নোনতা স্বাদ। পেটে খিদে থাকা সত্ত্বেও প্রথমবার জিহ্বা আর মন পরস্পর বিরোধিতায় লিপ্ত হল।

(২)

ভিকুর সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হতো রাকেশদের বাড়িতে। দু'একদিন কথাও হয়েছে। ‘পড়ালেখার খুব শখ ছিল আমার, বাপ ফাঁকি দিল, মা সেই যে বিছানায়  শুলো আর উঠলোই না, এত এত ওষুধ গেলে শুধু’। ভিকু ওর মায়ের ওপর  বিরক্ত। মা ওর পড়াশোনার শখ পূরণ করতে পারেনি। কোনমতে ওর পেটের খালি জায়গা ভরিয়ে দেবার চেষ্টা করত এক সময়।‌ সেই মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায়, মা ও ভিকুর দু'বেলা কোনমতে পেটকে শান্ত করার দুরূহ দায়িত্ব ভিকুকেই নিতে হয়েছে। তাই পড়াশোনা করার শখ থেকে কাছে অধরা। ভিকুর ভাষায় এটা নাকি ‘হেব্বি শখ’।‌ এই যেমন রাকেশের শখ উচ্চ প্রযুক্তির  কম্পিউটার গেমসে নিজেকে পারদর্শী করে তোলা। নূন্যতম শিক্ষা যে কোন শখের বস্তু নয়, তা বুঝতে গেলেও জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সময়মতো  পেতে হয়।

একদিন শুনলাম ভিকু নাকি রাকেশদের খুব দামী কাটলারি সেট থেকে একটা কাঁটা আর চামচ চুরি করেছে। সেটটা টেবিলেই ছিল। ভিকু টাকা নিতে এসেছিল। ‌রাকেশ তখন ভাত খেয়ে হাত ধুতে গিয়েছিল বেসিনে। সেই ফাঁকেই চুরি করেছে ভিকু। তারপর থেকে আর আসেওনি। ‌‘শয়তানটা একেবারে বুদ্ধি করে এসেছিল, টাকাও নিল, চুরিও করলো, তারপর তিনদিন ধরে আর পাত্তা নেই। পেটে পেটে যে এত শয়তানি কে জানতো?’ রাকেশের মায়ের আক্ষেপ।

ভিকুর বাড়িটা কোথায় আমি জানতাম। ওর বাড়ি পৌঁছে দেখি অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখ দুটো শুকনো। চোখের জলের অতিরিক্ত ধারায় শুকনো, নাকি জীবনের জোয়াল টানতে টানতে ক্লান্ত এক  কিশোরের প্রয়োজনীয় চোখের জলটুকুর মৃত্যুতে শুকনো, ঠিক বুঝলাম না।  আমায় দেখে বলল, ‘তিনদিন হল মা মারা গেছে। মা একবার ছোটবেলায়  বলেছিল, মড়া পোড়ানোর সময় সঙ্গে তার কোনো আশার জিনিস দিতে হয়। আমার মায়ের খুব কাঁটা চামচে খাওয়ার শখ ছিল। বাড়িতে মড়া পড়েছিল অনেকক্ষণ। ওদের থেকে টাকা নিয়ে আসার সময় টেবিলের কাঁটা চামচটা দেখে  মায়ের কথাটা মনে পড়ল। তাড়াহুড়োতে চেয়ে নেওয়ার সময় পায়নি আর’।  আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জুলু জুলু চোখ। সেখানে কোন বিরক্তি নেই মায়ের প্রতি।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন