শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস


ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল 

                   

(৭)  

গনগনে গরম পড়েছে দিল্লীতে, এখানে এই ঋতুতে এই স্বাভাবিক। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অপেক্ষায় বসেছিল অদিতি, অদিতি শর্মা। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল হর্ষ। ধপ করে বসে রুমাল বের করে কপাল মুছল।  

-স্যরি, লেট হয়ে গেল। ক্যাব পাচ্ছিলাম না।

পাতলা হাসল মেয়েটি, সোজাসুজি তাকায় হর্ষর দিকে। ওর ক্রু-কাট ঘন চুল, ফর্সা রঙ, সরলরেখার মতো লম্বা, সহজ হাসিমুখ বড্ড ভালো লাগে অদিতির! হর্ষ বলে, ওর চেহারা নাকি বাবা-মায়ের মেলানো আইডিয়াল ভার্শন। হর্ষর বাবা-মাকে সে দেখেনি। হর্ষ দুহাত জুড়ে ছদ্ম ভয়ার্তমুখে আবার বলে,

-গুসসা মৎ হোনা, প্লিজ।

-রাগ করেছি কে বলল? কী খাবে অর্ডার করি। স্ন্যাক্স না ডিনার?

-হুঁ জোর খিদে পেয়েছে। ডিনার বলে দাও। জলদি যা খুশি – এরা দিতে অনেক দেরি করে। 

অদিতি মন দিয়ে মেনুকার্ডে পছন্দমতো আইটেম বাছে। হর্ষ রিলাক্স করে পিঠ টান করে, ক্লান্ত লাগছে। অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে। অলসচোখে তাকায় অদিতির দিকে। হলুদ রঙের স্লিভলেস নী-লেন্থ্‌ ফ্রক পরেছে। চুল চূড়ো করে বাঁধা। সোনালি গমরঙ ত্বক উজ্জ্বল, গ্রেসফুল। কাজল বাদে অন্য প্রসাধনী ব্যবহার করে না। দেহের ভাষাতে উগ্রতা নেই। বরং কখনো যেন আনমনা বেদনার অস্পষ্ট ছায়া ভেসে যায়। চোখদুটি কাজল ছাড়াও বাড়তি কালো। হর্ষ ঠিক বুঝতে পারে না অগোচরে মনের মধ্যে কী যেন জমতে থাকে।

শ্রান্তিতে চোখ বুজে ফেলেছিল, খুলে দেখল উল্টোদিকের আয়ত স্নিগ্ধ চোখ একদৃষ্টে মুখের ওপরে ন্যস্ত। সে অপ্রস্তুত হাসে,

-সো গয়া—! স্যরি। আজ কুছ জ্যাদা হী টায়ার্ড।

-জানিএতখানি কম্যুট কর রোজ।

রোজ হর্ষ প্রায় পনেরো-পনেরো ত্রিশ কিলোমিটার যাতায়াত করে। দিল্লী-হরিয়ানার বর্ডার পেরিয়ে অফিস। অফিসের কাছে ফ্ল্যাট নিতে পারত, কিন্তু দিল্লী তার ভালো লাগে। এমনিতে রাজধানীতে থাকার বিবিধ সুবিধে, বন্ধুবান্ধবও হয়েছে। ভালোবাসে হৈচৈ করে সময় কাটাতে। অদিতি ইন্টিরিয়র ডিজাইনার। প্রাইভেট কম্পানিতে বছর চারেক চাকরি করার পরে ছেড়ে দিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে ছোট্ট স্টার্ট-আপ্‌ বিজনেস শুরু করেছে। হর্ষর দিকে তাকিয়ে বলে,

-তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।

-বল।

-এখন না। শনিবার ফ্রী?

-ফ্রী, বাট্‌ চারটের পরে। সকালে কল্‌-এ থাকতে হবে। 

-শনিবারেও! এনিওয়ে কোথায় মীট্‌ করব? দিল্লী হাট?

-নাঃ কোথাও যাব না, রেস্ট। আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো।

-ও-কে!

-আসোনি কখনো, বন্ধুরা অকেশনালি আসে এন্‌ ফ্রীক্‌-আউট। দেড়-কামরার জাস্ট ব্যাচেলার্স্‌ ডেন্‌। য়্যু মে নট্‌ লাইক।

-হুঁ, দেখা যাবে

-খাবার আনিয়ে নেব। তোমার ফ্রেণ্ডদের ডেকে নাও। ওপন টু অল্‌।

-মানে? জোকিং?

অদিতি গুম হয়ে যায়। গাড়ির চাবি তুলে নিয়ে বলে,

-আমি যাচ্ছি।

-আরে! কী হল? বসো।

-নো।

সে উঠে পড়ে। তখনই উল্টোদিক থেকে ওয়েটার ট্রে-সমেত আসে তাদের টেবলের দিকে। হর্ষ হাত ধরে টেনে অদিতিকে বসায়। বলে,

-হোয়াটস্‌আপ ডিয়ার?

সামনে সাজানো খাবার। হর্ষ খেতে শুরু করে দেয়। অদিতির মুখের ছায়াটা সরে  যায়। হেসে ফেলে।

-সো মাচ্‌ হাংরি? অফারও করলে না আমাকে?

-ওঃ স্যরি, নেভার মাইণ্ড! সিরিয়াসলি ভেরি হাংরি, খাওয়া শুরু করে দিয়েছি। স্টার্ট কর।

-মাইণ্ড করলেও বা কি?

সে সামান্য তুলে নেয় নিজের প্লেটে। টুকটাক দুয়েকটা অনর্থক কথা হয় — হর্ষর শোনায় মন নেই, খেতে ব্যস্ত। গোগ্রাসে খানিক খেয়ে মুখ তুলে হাসে, ন্যাপকিনে ঠোঁট মোছে। রেস্টুরেন্টটায় ভীড় বাড়ছে। দরজার কাছে একটি পাগড়িধারী দীর্ঘকায় বলশালী চেহারার ছেলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জায়গা খুঁজছে। সঙ্গে একটি মেয়ে। হর্ষ দেখতে পেয়ে লম্বা হাত তুলে ডাকে,

-হাই যশবীর!

-আরে তু?

ছেলেটি হর্ষর সহকর্মী ছিল, সম্প্রতি অন্য কম্পানিতে গেছে। হর্ষদের টেবল টু-সীটার। শব্দ করে খালি চেয়ার টেনে নেয় যশবীর। সঙ্গিনীকে বলে,

-ব্যৈঠ্‌। আমি আরেকটা আনছি।    

চেয়ার যোগাড় করে মেয়েটির গা-ঘেঁষে বসে, ট্রে থেকে খাবার তুলে খায়। বলে,

-ড্রিঙ্কস্‌ নহীঁ লী? আমি অর্ডার করে দিচ্ছি। মীট্‌ মাই রিসেন্ট গার্লফ্রেণ্ড মেঘা। তুই তোর গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে।

-এ্যাঁ?

বিশুদ্ধ বাংলায় চমকে ওঠে হর্ষ। সে স্মার্ট, ইংরেজি ও হিন্দী মাতৃভাষার সমান বলে। গার্ল-ফ্রেণ্ড! হটপ্যান্টস্‌ আর টীশার্ট, চুলে-চোখে-ঠোঁটে প্রচুর রঙমাখা মেঘা নামের মেয়েটি হাসে,

-হাই অল্‌!

-হ্যালো!

প্রায় একসঙ্গে বলে অদিতি ও হর্ষ, চোখাচোখি হয়। হর্ষের চোখে দ্বিধা, অদিতির  মুখে উদাসীনতা। ন্যাপকিনে আঙুল মুছে সে বলে,

-স্যরি এভ্রিওয়ান, আমি যাব এবারে। অলরেডি লেট্‌।

-ওয়েট অদিতি, স্যাটার্ডে সন্ধ্যেয় আমরা মীট্‌ করছি। যশবীর, মেঘা তোমরাও চলে এস।

-কোথায়?

-আমার ফ্ল্যাটে।

-অকেশন?

-নাথিং, এ্যায়সে হী—

-ও-কে ফাইন।

অদিতি কথা না বলে স্টিলটোতে সামান্য শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়। যশবীর ঠোঁট বেঁকিয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে’ শ্রাগ্‌ করে। বেশিক্ষণ আর বসেনা হর্ষও। সে উঠে আসার সময়ে যশবীর বলে,

-তেরী গার্লফ্রেণ্ড ঘমণ্ডী ক্যায়া?

হর্ষর কেমন অস্বস্তি হয়, প্রত্যুত্তর না করে বেরিয়ে আসে।

ড্রিঙ্কস্‌ একটু কড়া হয়েছিল, টিপসি লাগছিল হর্ষর। আসলে খুব একটা অভ্যেস নেই তার। ফ্ল্যাটে ঢুকে কোনোমতে জুতো খুলে চোখেমুখে জল থাবড়ে বিছানায় শুয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙল, অসম্ভব গরমবোধ হচ্ছে। নেশা কেটেছে। উঠে সব জামাকাপড় খুলে মাটিতে ফেলল। গলা শুকিয়ে কাঠ। সাইড টেবলের জলের বোতল শূন্য। লিভিং-স্পেসে এসে ফ্রিজ থেকে কনকনে জল খেল ঢকঢক করে।

বাড়ি একেবারে অন্ধকার নয়। রাত গভীর হলেও কাচের জানালার বাইরে ছিট-ছিট অনেক আলো। মোবাইলের কথা মনে পড়ল। ঘরে এসে বিছানা হাতড়ে দেখল, একেবারে কোণায় প্রায় ঝুলছে। নিশ্চিন্ত লাগল, ক্যাবে ফেলে এলে পাওয়া যেত না। এ-সি আঠেরোতে চালিয়ে বালিশে মাথা রাখল হর্ষ। মোবাইল তুলে নিল সামনে। ঊনিশটা মিসড্‌ কল। তার মধ্যে চোদ্দটা অদিতির, তিনটে তার মায়ের, আর দুটো অচেনা নম্বর। ফোনে ধরতে না পেরে তেত্রিশটা হোয়াটস্যাপ মেসেজ করেছে অদিতি।

‘রিচড্‌?’ লেখা একগাদা, ‘ওয়ান্ট টু টক্‌’ লেখা আরো কতগুলো। অনেকগুলো কিছু  লিখে ডিলিট করেছে। শেষ মেসেজটা ঘন্টা দেড়েক আগের। লেখা ‘উই’ল নেভার মীট্‌ এগেন। হোয়াট আর য়্যু?’ ঘাবড়ে গেল হর্ষ। ঘুম চটে গিয়ে মাথার মধ্যে ভোঁভোঁ করছে। ঘড়িতে রাত সওয়া তিনটে।

(ক্রমশঃ)    

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন