শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

মলয় রায়চৌধুরী

 

সোনালী মিত্রের যোনিজ কবিতা

 

একদিন সোনালী মিত্রের একটা কবিতা হঠাৎই নজরে পড়েছিল; পড়ে মনে হয়েছিল আমাকে আক্রমণ করে লেখা, কিন্তু না, কবিতার শেষের দিকে গিয়ে মনে হয়েছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার শুভা চরিত্রটিতে প্রতিস্হাপনের  গোপনেচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে। কেবল তা কিন্তু নয়; তাঁর কাজটি একজন নারীর যৌনতাবোধকে সেনসর করার বিরুদ্ধে স্বাবলম্বী ক্ষমতা হিসাবে উপস্হাপিত; সোনালী মিত্র কবিতাটির মাধ্যমে তাঁর নিজের দেহের কর্তৃত্ব দাবি করছেন, নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, নিজের জ্যোতির্ময়তা, যা পুরুষদের আকর্ষণ করে। বস্তুত শুভার স্হান দখলের ইচ্ছা বহু তরুণীই ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু সেগুলো সোনালী মিত্রের থেকে ভিন্ন।

 সোনালী মিত্রের কবিতাটা এই রকম:


হাংরি

 

আরো একবার যদি প্রবল বর্ষায় ভেসে যায় দ্বীপ

আরো একবার যদি প্রচণ্ড বিদ্যুৎএ কেঁপে ওঠে বুক

তোমার মধ্যসত্তরের বায়োস্কোপ পিছিয়ে গেছে পাঁচটি দশক

বলিরেখা মুছে গেছে, চুলের রঙ অভুক্তনিগ্রো

সটান শরীরে সভ্যদেশে লিখছ – ‘ছোটলোকের কবিতা’

মনোহর আইচ চেহারায় শুভাকে নিচ্ছ তোমার হাংরি বুকে

শুভা তীব্রতম হচ্ছে, ঐ-তো শুভাকে নিয়ে লড়াই করছে

ক'টি কালো পোশাকের আইন

কালো পোশাক ঠিক করে দিচ্ছেন, কবি অশ্লীল, কবি ইতর

কখন, কীভাবে অজান্তে যদি শুভা হয়ে উঠি এই একুশ শতকে

ছিনিয়ে নিই শুভার রাজমুকুট? যদি বলিঃ-

কবি, নারীর গ্রীবার ওপরে মাথা, মাথায় দু'টো চোখ

কঙ্কালযোনি একটা কবিতায় এগিয়ে যেতে পারে

আত্মা পুড়িয়ে 'যোনিকেশরে' মন্থিত হতে পারে অমৃতযোগ

কবি, পাঁচ দশক আগে আমি জান্মালে? পাঁচদশক আগে

আমাকে পুড়িয়ে দিতে-দিতে একবারও ভাবতে না

নারী দুষ্প্রাপ্য সোনালীসেডনা?

নদীর বুক ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, ক্রমশ নৌকা ছোট

পূর্ণাঙ্গ জীবন মিলিয়ে যেতে যেতে সূর্য দেখছে সামনে অন্ধকার

পথ অন্ধকার, অন্ধকারে একটা হাতই যথেষ্ট, কবি

একটা হাতই যথেষ্ট, হাত ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেকবিতাটি পড়ার পর ওনার কবিতাগুলো, অনুসরণ বলব না, বস্তুত ওনাকে স্টকিং করা আরম্ভ করলুম, যেভাবে একজন সুন্দরী যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার পেছন-পেছন উন্মাদের মতন ছায়া হয়ে বেড়ায় একজন পুরুষ। পড়তে-পড়তে মনে হলো, এনার কবিতা যেভাবে গড়ে উঠছে, একে তো সমসাময়িক মহিলা কবিদের, বিশেষ করে মল্লিকা সেনগুপ্তের ফেমিনিস্ট কবিতা, কৃষ্ণা বসুর পিতৃতন্ত্রবিরোধী কবিতা, যশোধরা রায়চৌধুরীর সংসার ও গার্হস্হজীবনের কবিতা, বলা যাবে না।

সোনালী মিত্রের কবিতার লিরিকাল কন্ঠস্বর এবং সেই লিরিসিজমের ভেতরে বুনে দেয়া ইরটিক ন্যারেটিভ একেবারে অন্যরকম। আমি তাঁর কবিতাকে তাই বলেছি ‘যোনিজ কবিতা’। দেহে যোনি থাকার দরুন একটি মেয়ের কৈশোর থেকে অস্তিত্বে যে বহুবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হতে থাকে তাদের প্রকাশ করার একটি পথ তিনি কবিতার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন। পথটা দ্রোহের, র‌্যাডিকাল, সমসাময়িক কবিতার প্রতিষ্ঠানের বা নির্ধারিত ক্যাননের বিরুদ্ধে দ্রোহ। সোনালী মিত্র বেপরোয়া, তাঁর চেতনা যোনিজ।

শুভাকে কেন্দ্র করে সোনালী মিত্রের আরেকটি যোনিজ আক্রমণ :

বিস্ফোরণ ও শুভা

ক্রমশ উর্দ্ধ সত্তরের প্রেমে ডুবে যাচ্ছে বসন্তবর্ষীয় আয়ু,

সারসার দিয়ে রক্তকীট ...বাস্তুতন্ত্রের বিষাক্তফণা ধেয়ে গেল

গঠনপোক্ত মধ্যে তিরিশের দিকে, তাদেরও

হারিয়ে দিতে পারে বুকে লাটখেয়ে যাওয়া

তোমার সাদা চুলের ঘোড়া।

ছুটছে, ছুটছে ছত্রপতি শিবাজি চত্বর পেরিয়ে মহানভারত দরজায়

উড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ পতাকার স্নেহ।

পতাকার দন্ডে আত্মমৈথুনরত সাহিত্যচেতনা।

থ্রিজি নেটওয়ার্কেও কেন গিলে নিতে পারছি না সমগ্র তুমিকে!

পিচ্ছিলজাত পরমান্নে ফসকে যাওয়ার খেলা।

উফ! আর পারছি না কেন! জ্বলে যাচ্ছে সৃষ্টিশীল তুরুপ?

কেন ডুবে যাচ্ছি তোমার মধ্যে?

তোমার থেকে তোমার আগুন জ্বলানো বীর্যক্ষয়ী শব্দের শরীরে?

সেখানে আউসের শীষে সোনালী শিল্পের ক্ষণজন্ম

তেমন ভাবে জরুরী কি?

সেখানে আমাদের মত সহস্র তামাটে চামড়ার ছড়াছড়ি

যারা চিচিং ফাঁক মেলে ধরে সিঁধিয়ে নিয়েছিল ছয় ফুট

আট ইঞ্চির আত্মঘাতী ধাতব সমীকরণ...

দশেরার রাবণ মারতে মারতে আমিও পুরুষ বিরোধী

হয়ে উঠছি সময়?

আমিও সেঁটে নিচ্ছি তকমা! নারীবাদী হলে

কতটুকু লাভ চেটেপুটে নেওয়া যায় ক্যালকুলেশনে বইয়ে দিচ্ছি

ফেসিয়ালে লোমতোলা মোম ত্বক!

আমার শিরায়-প্রতিশিরায় একশ ছিনেজোঁক বাসা

বাঁধবে বলে নি,

আমার জঙ্ঘার মধ্যবিত্ত গুহায় ঘোলা রসে তোমার নাম নিয়ে

প্যান্টি ভিজিয়ে যাবে এমনও ঘটে নি প্রিয় পুরুষ।

তবুও তোমার প্রেমে পড়া যায়!

গত এককুড়ি রমণীর মত

বুকের ওড়না সরিয়ে বলতেই পারি আমিই বা কম কিসে!

যারা তোমার শীতঘুম ভাঙনের অহরহ নায়িকা, চোখ তুলে

দেখ নব্বই মিলিয়ন উষ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি শূন্যদশকের

খাতা জুড়ে। একশ শ্বাপদ হামলে পড়েছে নারীর

রসালো খাদ্যের দিকে। সন্ধ্যারতি থেকে ভোরের নামাজ

তক ছুঁড়ে দিচ্ছে মুঠোমুঠো উপঢৌকন উপাচারে।

আমি ওদের পাত্তা দিই না...

তোমার কথা ভেবে, বালিসে চুমু খেতে খেতে এটা তো জানি

কাগজের গায়ে উষ্ণতা দিতে সক্ষম বলেই আমার আগে ও পিছের

রাধাবিন্দুর একচ্ছত্র সম্রাট তুমি।

অগ্রজ 'শুভা' মহলক্ষ্মী হলে তুমি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মে

তেভাগার নারায়ণ,

রূপের পরে কয়েকটা শূন্য বসালেই জলন্ত সূর্যের তাপ ক্রমশ হ্রাস।

তখন কাকে আগ্রাধিকার দিয়ে বলবে প্রিয়

তোর শ্রীমুখ ঐশ্বর্যের উপর অন্নপূর্ণা!

ঐশ্বর্যের উপর নিটোল ফিগার এঞ্জেলিনা তথাস্ত ঠোঁটের আগমন!

না মশাই কেবল রূপের মহিমা নই...

সন্ন্যাসী এবং শরীরখোড় ঈশ্বর এলেও তরতর করে

লিখে যেতে পারি বিশ্বাসঘাতিনী শব্দ।

তোমার মত একচাদরের নীচে নারী ও শিল্পকে সঙ্গমরত করে

বলতে পারি নারী ও শিল্পের মত বিশ্বাসঘাতিনী আর কিছু নেই।

প্রেমিকার চোখের দিকে চোখ রেখে জেগে ওঠা পুরুষাঙ্গের মত

অস্থির কলমের দিব্যি - ঘাড়ের নীচে কামড়ে ধরে থাকা ক্ষুধার্ত

বাঘিনীর দল

তোমার শিরদাঁড়া ভাঙা জন্তুটাকেও নাড়িয়ে চাড়িয়ে

তারাও বলতে পারে-

যৌবন থেকে শিল্প পর্যন্ত গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়াও একটা আর্ট,

যৌনতা থেকে কবিতা পর্যন্ত সৃষ্টিকে সফলতা দেওয়াও একটা আর্ট।

শুধু সেখানেই তুমি-আমি কি সফল! 'ওরা' বলে,

নষ্ট শব্দের কচকচি ঘাঁটার চেয়ে

তোমার আর্থ্রাইটিস ভোগা অঙুল ঢের বেশি ভাল।

যাদের জড়িয়ে বলতে পারি,

যে শিশুদের জন্ম দিয়ে গেল বাতক্ষয়িত আঙুল

তারা তোমার বীর্যের চেয়েও দামী।

শ্লেষ্মা কষ্টে হৃৎপিন্ডে জাগা বুকে শেষবারের মত ভরে নাও

বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর একবার তোমার নীচে

আরাম গ্রহণকারিনী নারীটিকে ভেবে ছড়িয়ে দাও বীর্য

৩০০০০০০ শিশু উড়ে যাক গ্রিক মিথোলজির দিকে

সাবর্ণ লাম্পট্য আমপ্লিফিয়ার ছিঁড়েখুঁড়ে

নারীর পরম মমতার দিকে বেঁচে থাক মাইলের পর মাইল

নায়িকা ও পুরুষের পুনর্মিলনের পরে সৃষ্টি ইতিহাস।

তাঁর কবিতাগুলোর জন্য সোনালী মিত্র নিজস্ব এক আঙ্গিক গড়ে নিয়েছেন।  সনাতন ভারতীয় ভাবনাকে যদি আশ্রয় করি তাহলে আঙ্গিকমুক্তিকে বলতে হয় ‘নির্গুণ’, আর আঙ্গিকবদ্ধতাকে বলতে হয় ‘সগুণ’। সোনালী মিত্র দেবী-দেবতায় বিশ্বাসী, তাঁর পুজোর ঘরে আছেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তি, অর্থাৎ তিনি ঘোরতর আস্তিক। হিন্দুদের ধর্মচিন্তায় ‘নির্গুণ’ হলো যৌনতাহীন, বিবাহহীন ও সন্তানোৎপাদনের অনুপযুক্ত। ‘সগুণ’ হলে তা স্বয়ম্ভূ অথবা যোনিজ। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে তাঁর দেহে দুটি গর্ভপথ আছে, একটি যোনি এবং অপরটি আত্মা; এই বক্তব্যটি একটি টেনশনের ভারসাম্য। এই একই টেনশনের ভারসাম্য গড়ে তোলার প্রয়াস করেন সোনালী মিত্র। সুতরাং ‘নির্গুণ’ বড়ো না ‘সগুণ’ বড়ো এরকম তর্ক তোলা যায় না তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে। ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’ আমরা এই টেনশনের ভারসাম্য প্রত্যক্ষ করি। ‘মহাভারতকে’ যেমন যৌনতাহীন কল্পনা করা অসম্ভব, তেমনই সোনালী মিত্রের এই গ্রন্হের কবিতাগুলো। নারীকে সোনালী মিত্র পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উপস্হাপনের পরিবর্তে, যা ফেমিনিস্টরা সচরাচর করে থাকেন, তিনি কাছে টেনে নিয়ে মৈত্রীবন্ধনে আটক করতে চেয়েছেন।

যৌনতাকে যাঁরা কবিতায় আনতে কুন্ঠিত বোধ করেন, তাঁদের আদি শঙ্করাচার্য সম্পর্কে প্রচলিত গল্পটা মনে করিয়ে দিই। শঙ্করাচার্য ছিলেন চিরকুমার। মণ্ডণ মিশ্রের স্ত্রী উভয় ভারতী তাঁর সঙ্গে তর্কে শঙ্করাচার্যকে বলেন যে তাঁর জ্ঞান খণ্ডিত, কেননা যৌনতার আনন্দ সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা নেই। শঙ্করাচার্য তাই কাশ্মীরের মৃত মহারাজা অমরুর দেহে প্রবেশ করেন এবং মহারাজাকে জীবিত করে তুলে যৌনতার আনন্দ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে বাধ্য হন।

কবি সোনালী মিত্র জানেন যে নারীর অনুভূতি ও সংবেদনকে অপব্যবহার করা হয়, বিকৃত করা হয়। তাই তিনি ইরটিসিজমকে নারীর ক্ষমতায়ন হিসাবে প্রয়োগ করেছেন তাঁর কবিতায়, যা বাংলা কবিতায় প্রান্তিক ক্যাননের স্হানও পায়নি এতোকাল। নারীর দৃষ্টিপ্রতিভা দিয়ে দেখেছেন প্রেম এবং সৃষ্টিকে, যে নারী একজন ব্রতী, সৎ ও দুঃসাহসী ।

পাঠক, কবি সোনালী মিত্রের সুস্পষ্ট ইরটিক কন্ঠস্বরের গভীরে যে চোটজখম রয়েছে, যে সুরক্ষাহীনতার বোধ রয়েছে, তার অন্তস্হ আত্মিক, মানসিক ও দৈহিক পীড়ার সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁর আত্মসন্দেহ ও আত্মআবিষ্কারের অভিজ্ঞতার অংশভাক হয়ে ওঠেন।


নাইটফল অথবা সমুদ্রযাত্রা

তখন রাতগুলো পরী ভালবাসায় ভরপুর

হরিদার চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় ফেলে আশা

মিঠু বউদি আর ঝিলিক সেনের ঝিকিরমিকির দুই চাঁদ

রাতে নাড়িয়ে দিলে গো। ঘুম, ঘুম আসে না

অস্থির, বুকের ভিতরের হ্যাংলা কুকুরটা বনেদী নয়

ঠিক, ঠিক যেন ভাদ্রের মত অবস্থানে

আর কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠু না ঝিলিক সেনের বুকে

বুঝলাম না...

আর নাভি খাচ্ছে, আর কোমর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে দাঁতে

দরদর ঘামে ভিজে উঠছে গা

থামবে না, এ-খাওয়া থামবে না

সমস্ত বেডকভার ড্রেনডাইট চটচটে, আহা মায়াবী আঠা

ক্রমশ কুকুরের গা মোচড়ানো শিথিল হয়ে ওঠে

ঘুম, ঘুম, ঘুম

সকালে ভুলে যায় আস্ত একটা কুকুর নিয়ে আমার রাতের সংসার

কেননা তখন আমাদের রাত্রির বুক অবিবাহিতকলা

কেননা তখন পায়জামার অন্ধকারে হাজার ওয়াট

তখন আমাদের নিজস্ব রাতের নাম ছিল-

'নাইটফল মেমরি'।

উল্লেখ্য যে সোনালী মিত্র দিল্লির মতো একটি বদনাম কসমোপলিসে চাকরি করেন, সেই শহরের বেয়াড়া ভিড় ও জাঠ খাপসংস্কৃতিতে প্রতিপালিত এঁড়ে পুরুষদের জমঘটের প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। ছেলের পড়াশোনার খেয়াল রাখতে হয়। সংসার সামলাতে হয়। এই কাজগুলোর পাশাপাশি তিনি কবিতা লিখে চলেছেন। কলকাতার মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে প্রতিদিনকার মেলামেশা, তর্ক, আলোচনা, নিয়মিত কবিতাপাঠ ও আড্ডার সুযোগ নেই সেখানে। পশ্চিমবাংলার কবিতা পত্রিকাগুলোও পৌঁছোয় না, যাতে তিনি সমসাময়িক কবিতার ট্রেণ্ড টের পেতে পারেন। তা সত্বেও তিনি নিজস্ব একটি ধারা গড়ে তুলতে পেরেছেন। কীভাবে তিনি নারীযৌনতার বিস্তার ঘটিয়েছেন তা চ্যালেঞ্জের মতো ছুঁড়ে-দেয়া, অরিণ দেবকে উদ্দেশ্য করে রচিত এই কবিতাটিতে স্পষ্ট, কোনো রাখঢাক নেই। কবিতার লাইনগুলো তাঁর প্ল্যাসেন্টার আহ্লাদযন্ত্রণাকে বয়ে নিয়ে যায়।

 

অশ্লীল কবিতা

(অরিণ নামটি এখানে আধার মাত্র, ওই নামের স্থানে রাম-শ্যাম-যদু-মধুও হতে পারেন। কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে সাযুজ্য খুঁজে দয়া করে এক্সট্রা রস আস্বাদনের প্রয়াস করবেন না।)

চেনা হাফডজন পুরুষের কোলাজে তুমি ঠিক পড় না।

বাবুগিরির চোদ্দআনা সিনেমাটিক রঙিনজলের মেহেফিলে

ডিগবাজি খাওয়া চোখে তুলে নিচ্ছে

আমার যন্ত্রমুগ্ধযৌন ১৪ মেগাপিক্সেল 'অ্যাপেল'।

নিম্নে ধাবমান শুক্রকীটের আক্রোশ নিয়েই কি শুধু ভাববে

আমার অদ্বিতীয় পুরুষবাজ? তবে কি

মরফিন-ঘুমে তলিয়ে থাকা ভুঁইফোড় অতিরঞ্জিত সময়ে

বিষাক্ত জেলিফিশের চেয়ে রমণীর শুঁড় আনন্দদায়ক?

আমিও জেলিফিশ খাওয়া কুমিরদাঁত শান দিয়ে

ডাকব অরিণ, এসো, এসো পেতে রেখেছি

পুরুষের অন্তিমশয্যা, জো জমিনে ফলিয়ে নাও ফসলমাঠ

আর নারীশরীরী সমুদ্রসৌকর্য নিয়ে সৃষ্টি করো সাহিত্য।

পুরুষের জ্বলন্ত সিগারের ওপর চিত শুয়ে আছি

পটাশিয়াম সাইনায়েড নেই নারী গুহা-গহ্বরে

স্তনে, যোনিতে বাজছে পিয়ানো রিডের গিমিক

ত্রিশলক্ষ কীট পাঠিয়ে দাও তোমাদের সভ্যতা পালিত ক্ষেতে

আমিও ভ্যানিসিং ম্যাথডের অঙ্ক জানি

কীটদের নিহত ভবিষ্যৎ রেখেছি জন্মনিরোধক পিলে।


অরিণ, পৃথিবীতে একচক্ষু মাকড়শা জাল বুনে যাচ্ছে

নারীর স্তনের দিকে আদিমমত্ত কামনায়

একটা গোটা 'জন ওয়াকর’- মুখে ঢেলে এগিয়ে আসছে

যোনি-রক্তখোর মহাজোঁক,

র‍্যাটেল স্নেকের বিষাক্ত ধ্বনি নিয়ে

দু'ই ঠ্যাঙের ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিশ্বশান্তির পতাকা

প্যালেস্টাইনের হাভাতে শিশুরা গর্ভ থেকে চিৎকার করছে-

মা, আমাকে পৃথিবীতে এনো না

আমাকে জরায়ুর মধ্যেই হত্যা করতে পারতে মহাসৃষ্টি!

শুধু যুদ্ধ করো নারী শরীরের অভয়ারণ্যে

নিহত বর্তমান নিয়েই নারীর অন্তিম সুর-শয্যা?

আমার জীবন্ত শরীরে শবপোকায় অবৈধ রেণুসম্ভোগে

স্যাঙাত থেমো না, মিনিটে ১২০ হার্টবিট তোল বুকে

৩৬০ ডিগ্রি নারী-গুহার দিকে একপাল ঘেও কুকুর লেলিয়ে

ধ্বজভঙ্গ জানে না কোন হাতে মাই, কোন হাতে থাকে নিমাই

আমিও আমার শরীর একান্নপীঠ তীর্থ করার জন্য

ব্লাউজহীন নীলসৌন্দর্যের দিকে রাখবো না আর শেষশ্বাস!

আমাকে গ্রহণ করতে কষ্ট হয় তোমার প্রেম?

গলার কাছে জমে আছে অমিতব্যয়ী শ্বাসকষ্ট

ইনসুলিন নির্ভর জলসোহাগের সঙ্গমে পাঁচ'টা ঠোঁট

পাঁচ'টা নামাজী বা পাঁচ'টা পুরোহিত বা পাঁচ'টা বিশপ

যখন ধীরে ধীরে এঁকে দিচ্ছিল লিঙ্গকলার মধ্যে মৃতলক্ষ্মীর মুখ

তখন বাতাসের বেগ যথারীতি স্বাভাবিক...

বৈদিক যজ্ঞ থেকে উঠে এসেছি আমি, নারী

চন্দ্রের ঘরে ষোলআনা অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে শিল্পের সমাধান, নারী

অথচ তোমরা, তোমরা ধর্ষিতা শব্দ আনলে, গণধর্ষণ আনলে

আর শিল্প সাহিত্যে ফুটিয়ে তুললে ধর্ষণশিল্প!

সাইজ ৩৪ ক্যাপের খোলে গণনাতীত মনু-পুরুষের লালা

লালা শেষে হস্তমৈথুনঅঙ্গে ক্যাথিডার মালা পরে

হাসপাতালের চির-নীরোগ নবোদয়!

২০১৫ সালকে প্রেমের স্মরণীয় মাইলফলক বানাতে চাও?

চাও কি আত্মহত্যা করি?

মা, পঞ্চাশ অধিবর্ষ ঘুমিয়ে রয়েছে, পঞ্চাশ অধিবর্ষ পাটক্ষেতে শুয়ে

ঘুমন্ত শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে খেলে গেছে ফসল

হাজার-লক্ষ যুগসন্ধিক্ষণের শিশুরা কলরোলে হারিয়ে গেছে

এক্স-ওয়াই ফ্যাক্টরে

তোমার আগের প্রেমিকারা কোথায় এখন জেনেছ কি?

হাজার-হাজার বেদ-উপনিষদ শ্লোক জুড়ে সুস্থতা

হাজার-হাজার তীর্থংকর বর্ণমালা

যা শুনিয়ে গেছে জীবতত্ত্বে

সেসব অস্বীকার করে 'এ'-ছাপ ময়দামাখা নরমের দিকে ছুটবে?

স্থবিরতা, শারীরিক নয় বলি যদি মানসিক?

মা বলেছিলেন তুলসীগাছ পুঁতে দিও উঠোনের কোণে

তুলসী নারী পবিত্রতা

তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাতে-জ্বালাতে

অসতী তুলসী হয়ে গেলাম মা, হাজারজোড়া

গণবুট পিষে দেয় দু'শো ছয়'টা মেয়েহাড়ের কঙ্কাল

তখন তোমরা কোথায় থাক পুরুষ? কোথায় ছিলে অরিণ

কোন বিশল্যকরণী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রেম? কোন লৌকিক শিল্প

আমার ভাঙা বুকের কাছে হয়েছিল অর্জুন সারথি?

প্রেম ক্রমশ বাজার দরের চেয়েও ভয়ানক সস্তা হয়ে যাচ্ছে

রজঃস্বলা পৃথিবীর স্তন, যোনি, নাভি, উরুজঙ্ঘা

শিল্প সাহিত্য ললিতকলায় ধর্ষণ শিল্পে হয়ে এলে

আমি, হ্যাঁ আমি হাজার ধর্ষিতা নারীর প্রতিনিধি

হয়ে অশ্লীল ও এডাল্ট কবিতায় বারবার বলবে

ধর্ষণের চেয়ে কোন এডাল্ট শব্দ নেই

ধর্ষণের চেয়ে অশ্লীল কোন শব্দ নেই অভিধানে।

সানগ্লাস চোখে যারা পৃথিবীর শিল্পের কারবারি, যারা

নারীর উরুজঙ্ঘা, ঠোঁটের উপপাদ্যে নিজের অব্যক্ত কাম

ফুটিয়ে তোলেন তথাকথিত শিল্প সাধনায়

তাদের সুখের জন্য সোনালী মিত্র দায়ী নয়।

নারীর পায়ের ওপর কোমর, কোমরের ওপর স্তন, আর

সবার ওপর একটা মাথা আছে এই সত্যর সামনে

দ্বিধাহীন বলি - পৃথিবীর সমস্ত নারীঘাতী চোখ অশ্লীল।


হিন্দু পৌরাণিক অতিকথার সূত্রে সোনালী মিত্র একযোগে অভিন্নতা, সংহতি, ঐক্য এবং নিপীড়িতের বোধকে একই পাটাতনে উপস্হাপন করেছেন, যেমন তাঁর ‘রাধাতত্ত্ব’ কবিতায়। সেই সঙ্গে বৃত্তটির পরিধি বিস্তার ঘটান ইতিহাস ও পুরাণের মিশেল দিয়ে। উপস্হাপিত হয় নারীর আত্মজ্ঞান। তাঁর কবি-পারসোনার ইরটিক স্পষ্টভাষণ ও দেহের উৎসববোধ গোঁড়া সমালোচকদের বিব্রত করতে পারে। আমি বলব সেটাই সোনালী মিত্রের লক্ষ্য।

রাধা তত্ত্ব

তারাখচিত ধাবা। ধুধু বিশলাখি চাকামাতম। আহাঃ প্রান্তিকট্রাক-

ট্রাক-ট্রাক, আহাঃ পরীযোনিধাবা, চোদ্দআনাগরম।

ফার্মালিনব্রাহ্মণরাত। হুডখোলা প্রান্তরে উলঙ্গবন্দর। আসে ত্যাজ্যযোনি

বাবু, রাতের অভাব জানি। জানু-জানু-জানুউ। কাতুকাতুমাখা দেহাতিট্রাক, রাতটম্বুর, শ্বাসটম্বুর, শ্বাসটম্বুর, 'খুলে দাও প্রিয়া খুলে দাও বাহুডোর'।

হে, সার্ফসফেদদ্রবণ, হে আকন্দক্ষয়, শাদা, মিহিনদুধশাদা, সাধি, সাধ্যাতীত নাও। পেছনে ট্রাকআলো, মেঘআলো, চিন্তিত একবিন্দু।

কড়কড়, কড়কড়ে, ঘামমাখা টাকা একশো কুড়ি।

চিন্তিতসরণ, স্মরণ, শরম, সতীসাধ্বী পয়মুখতদেহ, ওগো রাখালিরাধা

ওগো, সখিমোর লিঙ্গসাধা।


কেন ফোটাফোটা গোলাপজল। জালভৈরব। ক্ষয়জয়, জয়ক্ষয়

দুঃখট্রাক পরিপাট নিখাত নিখাত।

জ্বলতব্য বুকপাথর, প্রথমসোহাগ শালি মাসিমণি মেয়ে। তারপর, তারপর

অনেকটা ধনঞ্জয়। কৃষ্ণবিবর, নিকুচি করেছি  মাগি, শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজয়।

মাটিরাস্তা, পিচরাস্তা। রাতরাস্তা। যৌনমেদুর।

মাগি, এ-সস্তারাতে, শালা ফাঁকা ধাবায়, তারাদের যৌনকেলী


এসো ছল, খল, মল, জল ও অপ্সরা

 


২টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. প্রতিটি কবিতা দৈহিক বোধের সীমানাকে ছাপিয়ে গেছে। মানুষের প্রবৃত্তির চিরকালীন আদিমতার ক্ষেত্র থেকে তা রাষ্ট্রিক বিপর্যয়ের অমানবিক প্রশ্রয়ের ব্যাপ্তিকে নির্দেশ করেছে। পৌরাণিক মিথের সঙ্গে মানবীয় প্রবৃত্তির যাপনগুলিও নিরন্তর প্রক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বাক্যবিন্যাস ও শব্দাবলীর এক দোলায়মান সংশ্লেষ ও সাংকেতিকতার প্রভাব কবিতাগুলিকে ভিন্নতা দান করেছে। ইতিহাস দর্শন ও শরীরবৃত্তীয় প্রজ্ঞার আলোয় এক বিদ্রোহের পরিচয় আছে আর তা কাব্যকুশলীর কাছেও নতুন মাত্রা পেয়েছে।

    উত্তরমুছুন