শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>


 কালিমাটি অনলাইন / ৮১ 

 

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে এখনও পর্যন্ত মুক্তির কোনো উপায় খুঁজে পায়নি তাবৎ বিশ্বের মানুষ। প্রতিদিনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর ভেসে আসছে, কোথায় কতজন সংক্রমিত হয়েছে এবং কতজন মারা গেছে। বিভিন্ন দেশের ল্যাবরেটরিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অক্লান্তভাবে গবেষণা করে চলেছেন করোনার প্রতিষেধকের জন্য। কয়েক জায়গায় গবেষণা সফল হয়েছে বলে  শোনা যাচ্ছে, নমুনা মানুষের ওপর সেই প্রতিষেধকের প্রয়োগ সফল হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা বিশ্বের ওষুধের বাজারে না আসছে,  সাধারণ মানুষের ওপর তা প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার সামগ্রীক ফলাফলও জানা যাচ্ছে না। তবু অনন্যোপায় মানুষ হা-পিত্যেশ করে বসে আছে, কবে সেই  ভ্যাকসিন তার শরীরে প্রয়োগ করার পর সে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে, কবে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে তার প্রত্যাবর্তন ঘটবে।

বস্তুতপক্ষে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে তো আমরা অতি অবশ্যই বাঁচতে চাই, কিন্তু সেইসঙ্গে মুক্তি পেতে চাই করোনার কারণে পৃথিবীর অসুস্থতা থেকেও। পৃথিবীর শুধুমাত্র যে প্রাকৃতিক দূষণ, তা নয়, একইসঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানসিক দূষণও। সবদিক থেকে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষেরা বিভিন্ন দূষণের আওতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এবং এইসব দূষণের ফলে তাদের মধ্যে যে বিভিন্নরকম বিকার অনুপ্রবেশ করেছে, তা আরও মারাত্মক। এখন অনেক সময় কিছু কিছু মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকছে অহেতুক ভয়, আতঙ্ক, অসহায়তা, অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, অপরাধপ্রবণতা, অমানবিকতা – যার পরিণতিতে তাদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই মনুষ্যোচিত নয়। কেউ কেউ তাদের এই আচরণকে তুলনা করছে মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গেও। যদিও তা ঠিক নয় কখনই। যে কোনো মনুষ্যেতর প্রাণী, যাদের আমরা পশু নামে অভিহিত করি, তারা কিন্তু তাদের স্বাভাবিক পশুসুলভ আচার আচরণ করে থাকে। অপশুসুলভ কিছু করে না। নিজেদের পশুধর্ম তারা বজায় রাখে। কিন্তু মানুষ এমন এক প্রাণী, যে বিপদের সম্মুখীন হলে, সংকটের মুখোমুখি হলে, নিজের স্বার্থপরতায় ঘা লাগলে বা সুখ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে অনেকসময় তার মনুষ্যধর্মকে বজায় রাখতে পারে না। তার আচরণ তখন অমানবিক হয়ে ওঠে। বহুদিন আগে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, “অবস্থাবিশেষে মানুষ হিংস্র জন্তুমাত্র”। সাধারণত, মানুষ তার মনুষ্যধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে তাকে পশুর সঙ্গেই সবাই তুলনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই ভাবনাটা আমাদের পাল্টানো প্রয়োজন। আমার বিশিষ্ট বন্ধু এবং কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন ও গবেষণাগারের কর্ণধার ও প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত তাঁর ফেসবুকের টাইমলাইনে একটা পোস্ট দিয়েছেন, “মানুষের আচরণ ও  প্রবৃত্তির সঙ্গে মনুষ্যেতর প্রাণীর উপমা বন্ধ হোক!” খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট। মানুষের অনাচারের, অমানবিকতার, অপরাধের দায় কেন অন্য কোনো প্রাণী নেবে? তাদেরকে অপমানিত করার এই বুদ্ধিহীনতা থেকেও যেন আমাদের মুক্তি ঘটে। মানুষ হয়ে যখন জন্মগ্রহণ করেছে, তখন মানুষের মর্যাদা রক্ষা করার দায়ও শুধুমাত্র মানুষেরই।  

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com                 

দূরভাষ যোগাযোগ :           

08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

                                         


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 

বাঙলা সাহিত্যে দেশভাগ ও শরণার্থী দুর্দশা — আমরা আর ওঁরা



 

বন্ধু অধ্যাপক বাংলা সাহিত্যের বাঘা পণ্ডিত। আমায় বললেন বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের নীরবতা কি ওঁদের সাহিত্যে সত্যের প্রতি অনিষ্ঠার জ্ঞাপক নয়? আমি বললাম ‘হোঁ’! ‘হোঁ’ বা ‘হেঁ’ ভালো শব্দ! হেঁ বললে কিছু বলতে হয় না। হেঁ-র সঙ্গে একবার আবার হেঁ, মানে হেঁহেঁ বললে একটু হাত কচলানো স্তাবকতাও মেশে। হোঁ-তে অনেক কিছু বলা যায়। ক্রমানুযায়ী সেগুলো হলো: ১) ওঃ হ্যাঁ; ২) মরুকগে, আমার কী, এইগুলোই ক্লাসে পড়ান; ৩) বাক্যব্যয়ে কাজ নেই। কারণ বাংলা সাহিত্য নিয়ে কিছু বলতে আমি বেশ ভয় পাই।

 

তিন নম্বরটা নিয়েই বলি! তুষ্ণীক হওয়ার কারণ হলো আমার অবস্থাটা খানিকটা সেই প্রবাদিত গ্রামীণ মুচির মতো যে তার প্রতিযোগী সাহেব শল্যবিদদের ষড়যন্ত্রে শল্যবিদ্যা শিখে ফেলে নিজের আগে অনায়াসে করা অস্ত্রোপচারগুলিও আর নির্ভয়ে করতে পারতো না। ছোটোবেলায় অবহেলে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পাঁচ কথা লিখে দিতাম ক্লাসে, পরীক্ষায়। কিন্তু মনে পড়লো যে কিছুকাল আগে এক প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা বিভাগে ‘বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক সমাজ, সংস্কৃতি সাহিত্য, ১৯৫০-২০০০’ শীর্ষক সেমিনারে চুম্বকবক্তৃতা দিতে গিয়ে আমি ‘বাংলা সাহিত্য’ কথাটাতেই আটকে গেলাম। সেখানে রাজনৈতিক সমাজ তথা পুরসমাজ সম্বন্ধে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে নীরবতার আপাতঃ অরূপান্তরের অরূপবীণার ঝঙ্কারের কথা বলতে গিয়ে আমায় প্রথমতঃ বাংলা সাহিত্য কথাটার আগে পশ্চিমবঙ্গীয় বিশেষণটি যোগ করতেই হলো! কারণ আন্তর্জালে ১৯৫০ থেকে ২০০০ বাংলা সাহিত্যের এন্ট্রি দিলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তাবৎ নাম ও কোর্স উঠে আসে, পশ্চিমবঙ্গের নয়। আর ১৯৫০ থেকে ২০০০ বাংলা উপন্যাস এন্ট্রি দিলে উঠে আসে ওপার বাংলার লেখকদের এই বিদগ্ধ আক্ষেপ, কেন পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ইতিহাসকাররাও এই খণ্ডিত দৃষ্টির শিকার, যে তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশের কবি, গল্পকার,  ঔপন্যাসিকরা উল্লেখিত হন না। টরণ্টোনিবাসী বাংলাদেশি সাহিত্যিক সুব্রতকুমার দাস, ‘প্রথম আলো: দূর পরবাসব্লগে দেখিয়েছেন যে ১৩৪৫ (১৯৩৮) সালে প্রকাশিত শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা-র ১৯৯২ সালের নবম সংস্করণে অবধি সৃজ্যমান উপন্যাস সাহিত্য শিরোনামের সর্বশেষ অধ্যায়টির প্রায় সোয়াশো পৃষ্ঠায় ভারত-বিভাগ-উত্তরকালের বাংলা উপন্যাস নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের কোনো ঔপন্যাসিক এতে অন্তর্ভুক্তি পাননি। আবার ১৯৬৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পর ক্রমাগতঃ নব সংস্করণায়িত সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা উপন্যাসের কালান্তর বইতেও বাংলাদেশের লেখকদের নামগন্ধ নেই। দাস একই অভিযোগে বিঁধেছেন  বাংলা সাহিত্য আলোচনার আরো অনেক দিকপালকে। যেমন, ১৯৬২  খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ভূদেব চৌধুরীর বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প ও গল্পকার (চতুর্থ পরিবর্তিত পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৯৮৯) ;১৯৮৮ সালে প্রকাশিত অশ্রুকুমার শিকদারেরআধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস; সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়েরউপন্যাস: দ্বান্দ্বিক দর্পণ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৬); বাংলাদেশের সমালোচক সমীরণ মজুমদার সম্পাদিত উপন্যাস শিল্প (১৯৯৭); ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত রুশতী সেনের সমকালের গল্প-উপন্যাস: প্রত্যাখ্যানের ভাষা; একই বছরে প্রকাশিত স্বরাজ গুছাইতের বিনির্মাণ ও সৃষ্টি: আধুনিক উপন্যাস; সুমিতা চক্রবর্তীর উপন্যাসের বর্ণমালা (১৯৯৮) ইত্যাদি বইকে। তাহলে আর অবিশেষিত বাংলা সাহিত্যর কথা বলি কী করে? বাংলা সাহিত্য কথাটার জায়গায় পশ্চিমবঙ্গীয় বসিয়ে নেয়াই ভালো!

দ্বিতীয়তঃ দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের নীরবতা না হয় আছে, কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিকদের সরবতা কতখানি? আসলে আমরা দেশভাগ আর উদ্বাস্তু অন্তঃপ্রবাহকে গুলিয়ে ফেলি। এরা পরস্পর সম্পৃক্ত হলেও একার্থক নয়। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। দেশভাগ পাঞ্জাবে আর বাংলায় একবারই হয়েছে ১৯৪৭ সালে। কিন্তু দেশভাগ সঞ্জাত শরণার্থী আগমন পাঞ্জাবে একবার হলেও, পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে পাঁচ-ছয়বার, ১৯৪৬-এ নোয়াখালির দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে পূর্ব পাকিস্তানের পাট চুকিয়ে কলকাতা ও অন্যান্য জেলায় চলে আসা অনেক মানুষের কথা যদি বাদ দিই-ও। ১৯৪৯-এ খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ জেলাগুলোতে আবার দাঙ্গা শুরু হলে শরণার্থীদের ঢল নামে। এরপর ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৬৫-র পাক ভারত যুদ্ধ হয়ে ১৯৭১-এর বাংলাদেশি স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যবর্তী কালে পূর্ব পাকিস্তানে অজস্র জাতিদাঙ্গায় হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন। ১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা তথা পাকিস্তানি পুলিশ, প্যারামিলিটারিবাহিনী কর্তৃক বাঙালি হিন্দুদের ওপর হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন,অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদির ফলে অজস্র, অসংখ্য মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। ঢাকা,বরিশাল (মুলাদি হত্যাকাণ্ড খ্যাত), চট্টগ্রাম (সীতাকুন্ড গণহত্যা খ্যাত), সিলেট, রাজশাহী (অ্যান্ডারসন সেতুর হত্যাকাণ্ড খ্যাত), ময়মনসিংহ, যশোর, ইত্যাদি বহু জেলা এই রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের কবলে পড়েছিল। অনেকে বলেন ৬৫০,০০০জন হিন্দু ১৯৫০ সালে বরিশাল থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। ৯৫০ সালের ৪ এপ্রিলে বিধানচন্দ্র রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা জানান যে তখন পর্যন্ত প্রায় ২০ লক্ষ শরণার্থী ইতমধ্যে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর মতে ৩৫ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী ১৯৫০ সালে ভারতে পালিয়ে আসে।আবার ১৯৬২-এর রাজশাহী হত্যাকাণ্ড বলতে ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী ও পাবনা জেলার স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধ, সাঁওতালদের গণহারে হত্যা করার ঘটনায় ১১,০০০- এরও পর সাঁওতাল ও রাজবংশী ভারতে পালিয়ে যান। পরন্তু জম্মু-কাশ্মীরে হজরতবাল মসজিদে হজরত মুহাম্মদের সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি করা হয়েছে–এই গুজবে জন্ম নেওয়া খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ ইত্যাদি জায়গাতে ১৯৬৪ সালের পূর্ব-পাকিস্তানের দাঙ্গার ফলে কমপক্ষে ১,৩৫,০০০ হিন্দু শরণার্থী প্রবেশ করে। শুধু তাই নয়, ১৯৯০ সালে অক্টোবরের শেষে এবং নভেম্বরের প্রথম দিকে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এই গুজবের ফলে শুরু হওয়া জাতিদাঙ্গার পর আবারো একটি বড় ধরনের বাঙালি হিন্দু শরণার্থীর স্রোত আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গে। শেষতঃ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এসে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এককোটি। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয়দাতা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আশ্রিতের সংখ্যা ছিল ৭৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৪। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ত্রিপুরা। তবে সেখানে আশ্রিত ১৪ লাখ ১৬ হাজার ৪৯১ শরণার্থী ছিল ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। এগুলোতে ভারতের দেশভাগ হয়নি, ১৯৭১-৭২এ পাকিস্তান দুভাগ হয়ে যাওয়া ছাড়া। কিন্তু পাঞ্জাবে না হলেও পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী স্রোত আছড়ে পড়েছে। এই ১৯৬২ থেকে ১৯৭১র মধ্যে আসা ছিন্নমূলদের কথা বাংলা সাহিত্যের পশ্চিমবঙ্গীয় বা বাংলাদেশি চাঁইরা কতটুকু লিখেছেন?


বাংলা সাহিত্যের প্রণালীবদ্ধ পাঠ আমার নেই। তবুও আমার সীমিত রাডারে যা ধরা পড়ে তার ভিত্তিতে বলছি পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা সাহিত্য দেশভাগের রাজনীতির সন্নিষ্ঠ বিশ্লেষণ সেভাবে করেনি। যে অর্থে নীতীশ সেনগুপ্তবা ইয়াসমিন খানদেশভাগকে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা সাহিত্যে তার উদাহরণ কই? যেসব লেখা আছে তাদের সবই পূর্ব-পাকিস্তানে থেকে যাওয়া মানুষের বা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা ছিন্নমূল মানুষের লড়াইয়ের, যন্ত্রণার, নিস্ক্রিয় বিধুরতার ছবি বা খণ্ডচিত্র। এই খণ্ডচিত্রত্ব বাংলাদেশি বাংলা সাহিত্যেও আছে। যেমন, দুটো মিলিয়ে বললে গল্পের মধ্যে মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন মিঞা, ‘বন্দেমাতরম’, এস এম বজলুল হকের ‘ভাগনা দিয়ে ভাগানো’, অঞ্জলি দেবীর ‘নবীন আশার খড়গ’, অপূর্বকুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, সুমথনাথ ঘোষের ‘উদ্বাস্ত্ত’, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পুনশ্চ, ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিকপাত্র’ ও ‘সড়ক’, ফণীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘গোপাল উড়ের লেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, ‘স্থানে ওস্তানে, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেডমাস্টার’ও ‘পালঙ্ক’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’, ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুকূল হারা’ ও ‘অপরাহ্ণে’। ওপার বাংলায়, মানে দেশভাগের পর — নইলে এঁরা কেউ কেউ অবিভক্ত বঙ্গের ছিলেন — সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, নূর আলীর ‘মোহাজের’, বেগম হাশমত রশীদের ‘ফরিয়াদ’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ছুরি’, ইত্যাদি। অথবা দুদশক পরে আসা  উপন্যাসের ক্ষেত্রে এপারের জ্যোতির্ময়ী দেবীর এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা (১৯৬৭); আর ওপারের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা (১৯৯৬), সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা (২০০৭), হাসান আজিজুল হকের ‘শিউলি’ (২০০৬), ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ (২০১৩)। এছাড়া আত্মজীবনীমূলক  মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’ (২০০৩), সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ (২০০৮), সীমা দাশের ‘দ্যাশ থেকে দেশে ‘ (২০১০) ইত্যাদির নাম করা যেতে পারে।

 

কিন্তু এগুলোকে দেশভাগের ব্যাপারে রাজনৈতিক উপন্যাস বলতে অসুবিধে লাগে। এগুলো বরং পূর্ব পাকিস্তান থেকে মূলতঃ দেশত্যাগী (বা অল্পক্ষেত্রে থেকে যাওয়া) বাঙালি মধ্যশ্রেণির কিছু লেখকের বিধুর অতীতচারিতা, স্বর্গ হতে বিদায়ের কথা।  যদিও আমি প্রথম যখন সাহিত্যিক-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চাণক্য সেন তথা ভবানী সেনগুপ্ত যখন আক্ষেপ করতে দেখলাম যে ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে বাংলা সবচেয়ে বেশি ‘politically radical’ হলেও তার সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস এখনও 'adult literary personality' পায়নি, বাঙালি নাট্যকার এবং কবির চেয়েও বাঙালি ঔপন্যাসিক, 'far less politically sensitive', আর চাণক্য সেন ছদ্মনামে লেখা রাজপথ জনপথ, ওমুখ্যমন্ত্রী ছাড়া কোনো উপন্যাসকেই রাজনৈতিক বলতে রাজী নন, তখন প্রথমে আমার ধাক্কা লেগেছিলমনে হয়েছিল যে সেনগুপ্ত রাজনৈতিক উপন্যাসের সংজ্ঞাই পাল্টে দিচ্ছেন। কিন্তু পরে আবার ভাবলাম পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য কি দেশভাগের যন্ত্রণাটাই ভদ্রলোকের চেতনার বাইরে ধরেছে? অশ্রুকুমার শিকদার ভাঙা বাংলার আখ্যানে আমরাআর ওরা”’ প্রবন্ধে বলছেন, ‘দেশভাগে মুসলমান মধ্যশ্রেণি লাভবান হয়েছিল মোটের উপর, সেই কারণে দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে পূর্ববঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্য রচিত হয়নি। কিন্তু বাংলা ভাগে পূর্ব থেকে পশ্চিমে উদ্বাস্তু হয়ে আসা হিন্দু মধ্যশ্রেণি বিপর্যস্ত হয়েছিল। সেই তাদের বিপর্যয় নিয়েই দেশভাগের আখ্যান এই বাংলায় লেখা হয়েছে। বাঙালির  ইতিহাসে সব চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা যে বঙ্গবিভাজন তা নিয়ে যে স্তরের সাহিত্য লেখা উচিত ছিল, তা লেখা হয়নি, কিন্তু যতখানি লেখা হয়েছে সে হয়েছে ভদ্রলোকের কথা, মধ্যশ্রেণির আমাদেরকথাউদাহরণ, সাবিত্রী রায়ের স্বরলিপি, জীবনানন্দর জলপাইহাটি, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্জুন, নারায়ণ সান্যালের বল্মীক, বকুলতলা পি. এল. ক্যাম্প, শঙ্খ ঘোষের সুপুরিবনের সারি, শান্তা সেনের পিতামহী, অমিতাভ ঘোষের The Shadow Line, অভিজিৎ সেনের স্বপ্ন ও অন্যান্য নীলিমা, এইসব উপন্যাস ছাড়াও, জ্যোতির্ময়ী দেবী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, দিনেশচন্দ্র রায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়-এর ছোটগল্প। এগুলোতে আমাদের মত মধ্যশ্রেণির মানুষের কথাআছে। এই সব বইতে অবশ্য প্রথমে উচ্চবর্ণের হিন্দুর ভারত আগমনে নিরাশ্রয় বোধ করার ফলে মুরুব্বিহারা নমঃশূদ্র এবং অন্যান্য লক্ষ লক্ষ তপশিলভুক্ত হিন্দুর কথা নেই। তারা উঁচু জাতের ভদ্রলোকশ্রেণির বাঙালির/মানুষের মতো কলকাতার উত্তরে বরানগরে/দমদমায় বা দক্ষিণে জবরদখল কলোনিতে জায়গা পায়নি। প্রথমে শেয়ালদা বা অন্যান্য রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে ধুবুলিয়া-রাণাঘাটের মত ক্যাম্প হয়ে ডোল বন্ধ হওয়ার চাপে তরাইএর বন, আন্দামান, দন্ডকারণ্য-মালকানগিরি অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়। তাদের নিয়ে লেখা বলতে আন্দামানের প্রসঙ্গে প্রফুল্ল রায়ের নোনাজল মিঠেমাটি উপন্যাস; দন্ডকারণ্য-মালকানগিরির অসহনীয় পাথুরে জীবনের কষ্টের প্রসঙ্গে নারায়ণ সান্যালের অরণ্যদন্ডক উপন্যাস;আর অনেক পরে সেখান থেকে অভ্যস্ত নদীজলের জীবনের আশায় সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে উপনিবেশ তৈরি করা মানুষদের সহিংস উৎখাত নিয়ে লেখা অমিতাভ ঘোষের Hungry Tide আর সর্বত্র বধির করা নীরবতা।


ফলে মুসলমান মধ্যশ্রেণির সাহিত্যিকরাই যে কেবল দেশভাগের কথা বলেননি, তা নয়, হিন্দু মধ্যশ্রেণিও নিজেদের বাইরে কারুর কথা বলেন নি। দ্যাশ থেকে দেশে-তে সীমা দাশ যদ্দিন পূর্ব বাংলার কথা লিখেছেন, তাঁর শৈশব স্মৃতিতে কোনো মুসলমান চরিত্র দখলদারি বসায়নি। সুনন্দা শিকদারের এই সমস্যা নেই, তাঁর পালিকা মার সব সংকীর্ণতার বাণীকে অক্লেশে হারিয়ে দেয় তাঁর প্রজা দরিদ্র বর্গাচাষি মাজম ফজরের সরল জীবন দর্শন — ‘ওমা, দয়া তুই কি পাগুলনি; আল্লাহর সঙ্গে দুগ্গা-লক্ষ্মীর কুন কাজিয়া নাই। বেহেস্তে তো সগ্গলের মধ্যে ভাব-ভালবাসা, কুন কাজিয়ার জায়গা নাই। ওইসব মাইনষে করে।’ কিন্তু যেমন হিন্দু মধ্যশ্রেণির লোকরা গরিব মুসলমানের চোখ দিয়ে অত্যাচার শোষণের ছবি দেখেন নি, তেমনি পরে অ-মধ্যশ্রেণির দেশান্তরের কথাও বেশি লেখেন নি। রিফিউজিকাব্যে উপেক্ষিত রয়ে  গেছে তরাইএর বন, আন্দামান, দন্ডকারণ্য-মালকানগিরি অঞ্চলে চালান যাওয়া মানুষেরা। কিন্তু দেশভাগের পর সুব্যবস্থিত ভদ্র ও ছোটোলোক বাংলাদেশিরা যে ধর্মের মোড়কে বাংলার উর্দুয়ানিকে রুখতে রুখতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পত্তন করে ফেললেন, তা নিয়ে লেখা বইও যেমন আবু জাফর শামসুদ্দীন-এর পদ্মা মেঘনা যমুনা, দুই বাংলার সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাবে না? অথবা সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের দুই নগর (২০১৬) উপন্যাসের নায়িকা জয়তী চক্রবর্তী আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হানের চোখে শাহবাগ আন্দোলনের আবহে দেশভাগের পরের মানুষের কপাল ভাঙা আর কপাল খোলার ছবির কথাও বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের লিস্টিতে তার নাম নেবো না? একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ-তরুণীদের সংক্ষুব্ধ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাতে ডিনারের আমন্ত্রণ রুমানাদের বাসায় জয়তীর বাবা ইতিহাসের অধ্যাপক দেবব্রত চক্রবর্তীর বন্ধু তরিকুল আর রায়হানের সঙ্গে ডিনারে তরিকুল যখন জয়তীকে জানায় যে বাংলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি পৃথিবীর ইতিহাসে ‘বিরল ভাগ্যবান এক শ্রেণি। দু দুটো প্রমোশন পেয়েছে — ১৯৪৭ সালে একবার মুসলমান হয়ে, আর ১৯৭১ সালে একবার বাঙালি হয়ে, তখন মনে হয় যে বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের নীরবতা নিয়ে যে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা হয়, তার ক্যাঁতায় আগুন। আগে নিজের নীরবতাগুলো কান পেতে শুনুন! আচ্ছা, আপনারা মোকাম্মেলের ওই উপন্যাস প্রসঙ্গে মনি হায়দারের গ্রন্থালোচনার এই শব্দগুলি শুনুন--



‘ভারত ভাগের ফলে যারা এই দেশে ভারত থেকে এসেছে তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে, খুব বেশি প্রতিযোগিতা ছাড়াই। এমনিতে পূর্ববাংলার শিক্ষিত বিকশিত সম্প্রদায় ছিল হিন্দুরা, তারা দলে দলে চলে যাওয়ায় বিরাট যে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার ভেতরে নিজেদের সেটিয়ে দিয়েছে তারা অতীব যোগ্যতার সঙ্গে। হিসাব করলে দেখা যাবে, সেই শ্রেণিটি এখনও দিব্যি আছে। সেই সময়ের উন্মূল শাসকশ্রেণিও ভারত থেকে আসা রিফুইজিদের পক্ষে ছিল। কারণ, তারাও রিফুইজি ছিল, নিরপত্তা হীনতায় ভুগছিল। অনেকটা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস আর কি! কিন্তু ভূমিপুত্ররা থেকে গেছে বলয়ের বাইরে। তারা তখনও লড়াই করেছে, এখনও এই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দাঁত কামড়ে লড়াই করছে। তানভীর মোকাম্মেল ভূমিপুত্রদের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেছেন। আর একটা ছোট উপন্যাসে কতটাই বা আনা যায়?’ শুনলেন?


 

তথ্যসূত্র

 

১।সুব্রত কুমার দাস, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সীমানা: খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি – Prothom Alo’, https://www.prothomalo.com › দূর পরবাসকানাডা, উদ্ধৃত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।

২। Rabindranath Trivedi, "The Legacy of the Plight of Hindus in Bangladesh Part IV", Asian Tribune (World Institute for Asian Studies) 11:460 (20 July 2007)।

৩। Nitish Sengupta, Bengal Divided: The Unmaking of a Nation 1905 1905-1971, Penguin, Random House, India, 2012)।

৪।Yasmin Khan,The Great Partition: The Making of India and Pakistan, New Haven; London: Yale University Press, 2007)।

৫। Bhabani Sen Gupta, 'The Political Novel in Bengal', in (Ed.)Yogendra Kumar Malik, Politics and the Novel in India (New Delhi: Orient Longman, 1978, originally Leiden: E.J.Brill, 1975), pp. 86-93।

৬। অশ্রুকুমার শিকদার, ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য (কলকাতা: সাহিত্যলোক,  ২০০০, পৃঃ ৯৪-৯৭)।

৭।মনি হায়দার,দুই নগর দুই মানুষ : মাঝখানে কাঁটাতার  ধর্মের অসুখ https://risingbd.com/art-literature-news/193130প্রবিষ্ট ১১ আগস্ট ২০২০।  

 


ফারহানা রহমান

 

‘দি গ্রেট গ্যাটসবি’ : প্রেম এক জাদুকরী শিল্প

 

উপন্যাস পড়ার নেশা থাকলে ভালো উপন্যাস পড়ে অভিভূত না হয়ে কি কেউ পারে? স্কট ফিটসেলাল্ডের বিখ্যাত  উপন্যাস ‘দি গ্রেট গ্যাটসবি তেমনই এক উপন্যাস যা বহুদিন মনের ভিতর আবেশ ছড়ায়। ভালোবাসার এইসব   বিস্ময়কর  উপাখ্যান নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক ‘প্রেম’ নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ করে চলে। আর তা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে নারীপুরুষের প্রেমাসক্ত অনুভূতির মাত্রা কি ভিন্ন কিনা, তা নিয়ে অথবা স্থান কাল ভেদে কি কোন ভিন্ন প্রভাব পড়ে কিনা, তা নিয়ে ভাবতে

‘দি গ্রেট গ্যাটসবি’ উপন্যাসের কাহিনী মূলত গ্যাটসবি নামক একজন নব্য ধনাঢ্য ব্যক্তিকে নিয়ে যিনি তার প্রেমের জন্য  নিজের জীবন পর্যন্ত বলিদান দেন গ্যাটসবির বন্ধু নিক ক্যারাওয়ে, ওয়াল স্ট্রিটের একজন ট্রেডার এবং লেখক।  এলকোহলিক ও  ইনসোমেনিক নিক চিকিৎসার জন্য একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অবস্থান করেন একসময় চিকিৎসকের কাছে অতীত জীবনের  কথা বর্ণনা করতে গিয়ে সে নস্টালজিক হয়ে পড়ে চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখে অতীত জীবনের একটি গল্প১৯১২ সালের সামারের দিনগুলিতে সে আমেরিকার লং আইল্যান্ডের উপসাগরের পাশে একটি বাড়িতে বসবাসের জন্য স্থায়ী হয়বাড়িটির চারপাশে ছিল অসংখ্য গাছপালাগ্রীষ্মকালে লোকেরা যখন সমুদ্রের তীরে আনন্দ অনুষ্ঠান করত,  নিক তখন সেসব তার বারান্দা থেকে দেখতে পেতোমাঝে মাঝে নিকের একটি বিশেষ অনুভূতি হতো কে  কেউ একজন সারাক্ষ আড়াল  থেকে যেন তাকে দেখছেএকদিন সে পাশের বাড়িটি, যেটা  ছিল একটি বিশাল প্রাসাদ, সেখানকার একটি জানালা দিয়ে একজনকে লুকিয়ে  তার দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলোনিকের বুঝতে বাকী রইলো না যে এই সেই লোক যার নাম জে গেটসবি, লোকটা একাই থাকে আর বেশিরভাগ সময় পার্টি করে আর হৈ চৈ নিয়ে থাকতে  ভালবাসে

সামারের শুরুতেই নিক গেটবির পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়। ওখানে ওর সাথে পরিচয় হয় জর্ডান বেকারের। এবং পরিচয় হয়  বিস্ময়কর নিঃসঙ্গ যুবক স্বয়ং  গ্যাটসবির সাথে। মহাযুদ্ধের সময় একই ডিভিশনে যুদ্ধ করেছিল লে গ্যাটসবি নিককে মুহূর্তেই চিনে গেল। পরবর্তীতে জর্ডানের মাধ্যমেই নিক জানতে পারে যে ১৯১৭ সাথে যেসব তরুণ অফিসার ইউরোপের জন্য কাজ করতো তাদের সাথেই নিকের কাজিন ডেজি ও তার বন্ধুরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতো। আর তখনই সৌভাগ্যক্রমে গ্যাটসবি ও ডেজির দেখা হয়ে যায়। প্রথম দেখাতেই গ্যাটসবি ডেজির প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়ে আর সেই প্রগাঢ় ভালবাসার অনুভূতি এখনো ঠিক আগের মতোই আছে। ডেজির সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করার তীব্র বাসনা নিয়ে সে তার জীবন অতিবাহিত করছে। জর্ডান আরও জানায় যে গ্যাটসবি উপসাগরের উপকূলে যে প্রাসাদ কিনেছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে ডেজি ও টমের বাড়ি ঠিক এর বিপরীত দিকে অবস্থিত। এবং শুধুমাত্র ডেইজির নজর কারার জন্যই সে এতসব বন্য ও উদ্ভ্রান্ত পার্টি করে থাকে। গ্যাটসবির মনে একটি গোপন আশা ছিল যে ডেজি কোন একদিন কৌতূহলী হয়ে ওর আঙিনায় পা দেবে এবং সে তখন ওর সামনে নিজেকে একজন যোগ্য ও ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবে। গ্যাটসবির পার্টিতে নিককে দাওয়াত দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন নিক, ডেজি ও গ্যাটসবির মধ্যে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপনে সাহায্য করে।

অপর দিকে, নিকের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন এক জায়গায় থাকে নিকের কাজিন ডেইজি। ডেইজি বিবাহিত নিকেরই কলেজের এক পরিচিত ব্যক্তি টমের সাথে। এদিকে ডেইজি নিককে জানায় যে সে তার স্বামী টমের সঙ্গে সুখী নয় কারণ টমের মারটিল উইলসন নামক একজন মিসট্রেস আছে।

নিক, গ্যাটসবির উপস্থিতির কথা না জানিয়েই ডেজিকে চা খাওয়ার দাওয়াত দেয়। দেখা হওয়া মাত্রই দুজনের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদিকে টম ডেজি ও গ্যাটসবির সম্পর্কের ব্যাপারে দিনদিন সন্দিহান হয়ে ওঠে। এর মাঝে একদিন টম গ্যাটসবিকে পার্টিতে দাওয়াত দেয় এবং নিউইয়র্ক সিটির ভিতর সবাইকে ড্রাইভ করতে বাধ্য করে। পার্টির এক পর্যায়ে গ্যাটসবি ঘোষণা করে যে ডেজি টমকে ছেড়ে দিতে যাচ্ছে। এবং এটাও বলে যে ডেজি আর গ্যাটসবি খুব শিগ্রী বিয়ে করতে যাচ্ছে। যদিও টম খুব ভালো করেই জানতো যে ডেজি টমের এতসব প্রাচুর্য ফেলে সদ্য ধনবান হওয়া গ্যাটসবিকে কখনই বিয়ে করবে না।  যাইহোক পার্টি থেকে বাড়িতে ফেরার পথে টম, নিক এবং জর্ডান  দেখতে পায় যে গ্যাটসবির গাড়ির সাথে টমের মিস্ট্রেস মারটিলের এক্সিডেন্ট হয়েছে এবং মারটিল নিহত হয়েছে। যদিও নিক পরে জানতে পারে যে আসলে ডেজি সেসময় ড্রাইভ করছিলোকিন্তু ডেজিকে বাঁচানোর জন্য গ্যাটসবি নিজে সব দোষ স্বীকার করে নেয়এদিকে টম  মারটিলের স্বামী উইলসনকে জানায় যে গ্যাটসবি হচ্ছে মারটিলের গোপন প্রেমিক এবং সে মারটিলকে খুন করেছে। ফলে মারটিলের স্বামী গ্যাটসবিকে অনুসরণ করে তার প্রাসাদে প্রবেশ করে এবং তাকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করে। গ্যাটসবির মৃত্যুর পর নিক তার বারিয়ালের আয়োজন করে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় যে প্রকৃতপক্ষে তার পরিচিত কেউ গ্যাটসবির মৃত্যু নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয়।

গ্যাটসবির মৃত্যুর পর কোনপ্রকার সৌজন্য না দেখিয়েই একদিকে টম ও ডেজি ছুটি কাঁটাতে শহর ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে এতদিন যে সমস্ত ব্যক্তিরা অতি উৎসাহ নিয়ে প্রতিনিয়ত গ্যাটসবির পার্টিতে এসে মদ খেতো এবং নানারকম ফুর্তি করতো তারা সবাই শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আসতে অস্বীকৃতি জানালোএমনকি গ্যাটসবির বিসনেস পার্টনার জনসম্মুখে তার মৃত্যু নিয়ে শোক প্রকাশ করতেও অস্বীকৃতি জানালো। জীবিত অবস্থায় যে মানুষটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেকটা আকাশচুম্বী, মৃত্যুর পর মুহূর্তেই সে সকলের মন থেকে চিরবিস্মৃত হয়ে গেলো।

আর এটাই হচ্ছে গ্যাটসবির প্রেমের পরিতি।

 

এই তো গেলো গ্যাটবির প্রেম কাহিনী। তবে যেকথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানে আবারো ফিরে যাই। নারী পুরুষের ভালোবাসার উন্মাদনায় আসলে কে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা জানতে ইচ্ছে হয়? ভালোবাসার বাজি ধরে নিঃস্ব হয়ে যাবার পথে এগিয়ে আছে কে? নারী নাকি পুরুষ? সেটা হয়তো হিসেব কষে বলা কঠিন। তবে যুগযুগ ধরে ভালোবাসার খেলায় নারীদের হিসেবী চেহারাটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পে উপন্যাসে সেটা আরও বেশী করেই হয়ত বা করা হয়েছে। সেই কবে কিশোরী বয়সে যাযাবরের দৃষ্টিপাত পড়েছিলাম আর চারুদত্ত আধারকারের গভীর বেদনায় সহমর্মিতা জানাতে বিশ্বাস করেছিলাম তারই অনুভূতিগুলো


যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়,

যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা

ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে।

প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই  নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিস্ম, না আছে উচ্ছ্বলতা।

ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে

পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।

জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডেরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য 

রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্য ত্যাগ। বিবাহিত নারীকে ভালবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন  নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ। পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে জীবনে কোনদিন কোন নারী রয়নি চিরকুমারী”।

কিন্তু সত্যি কি তাই? তাহলে এন্তভ চেখভের ‘লেট ব্লসমস’-এর সেই হতভাগিনী প্রিন্সেস মারুস্যার অবিনাশী প্রেমকে আমরা কীভাবে দেখবো? যে কিনা তার স্বর্গত পিতা প্রিন্স প্রিকলনস্কির চিরদাস মজুরের ছেলে ডাক্তার তপকরভের প্রেমে   পড়ে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকে আর একটিবার মাত্র ডাক্তারের  সান্নিধ্য পাওয়ার যে নিদারুণ আকুতি প্রকাশ করে, তাতে কী প্রমাণ হয় জানি নাতবে মৃত্যুর পূর্বে রুগী হয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলে রুগী দেখার পর ডাক্তার জানায় ‘রুগী দেখা হয়ে গেছে আপনি যেতে পারেন

মারুস্যা চেয়ার ছেড়ে উঠলো নাপ্রকৃত সত্য হচ্ছে সে কিছুতেই উঠতে পারলো না কারণ তার সর্বস্ব ক্ষয়ে গেছে ভালবাসা নামক শুশুকের শোষণে। শেষ জীবনী শক্তির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটুকু দিয়ে যতটা শব্দ উচ্চারণ করা যায় তাই দিয়েই ফিসফিস করে শুধু এতটুকুই বলতে পারে, ‘ডাক্তার আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ এসব বাতুলতা বোঝার ক্ষমতা তো ডাক্তারের থাকার কথা না সে রুগীর চিকিৎসা করে অর্থ উপার্জনের জন্য। ভালোবাসা নামক এমন অযাচিত কোন বস্তু চিকিৎসার বিনিময়ে কোন রুগী তাকে প্রস্তাব করতে পারে এমন অবাস্তব কল্পনা করার সময় বা মন কোনটাই তো তার থাকার কথা নয়!  তাই  মারুস্যা আবার বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ আবারও, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ডাক্তার

হায়রে প্রিন্সেস!

ডাক্তার শুধাল, ‘আমি কী করতে পারি?’ প্রিন্সেস মারুস্যার তো জীবনবায়ু নিভে গেলোতাতে ডাক্তারের কী এসে গেলো?

 আবারও ফিরে যাই যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাতে’-

জগতে মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। 

যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপরসারাজীবনভোর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে 

রস, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি

রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র, ভাষ্কর পাষাণ খণ্ডে

উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা

তাহলে কী দাঁড়ালো? উপরের প্রত্যেকটি শব্দ শুধুই পুরুষের জন্য প্রযোজ্য? নারীর মনে প্রেমের কি কোন স্থান নেই? নারী শুধুই সাধারণ আর পুরুষ মাত্রই অসাধারণ? জগতে নারীরাই শুধু বুদ্ধিমতি এরা ভালোবাসে বিয়ে করার জন্য আর চাকুরী করে ব্যাঙ্কে টাকা জমানোর জন্য স্যাকরার দোকানে যায় গহনা গড়ানোর জন্য আর তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই কি পুত্র-কন্যা-স্বামী নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়?

কিন্তু প্রেমিক যে পুরুষ, সে সংসারে রইলো বঞ্চিত হয়ে, হৃদয় নিয়ে করলো ব্যঙ্গ, যে উপহাসের পরিবর্তে নারীকে দিল প্রেম। সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন বহু কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য পুরুষ


তাহলে তো দেখছি পুরুষই সবদিক দিয়ে মহান! কিন্তু সত্যি কি প্রেম শুধুই পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি? তাই তাদের জীবনকেই শুধু ঐশ্বর্যময় করে তোলে প্রেম আর মহিমা দেয় মৃত্যুকে? আর প্রেমে পড়ে নারীর সব ত্যাগ এমন কি জীবনও বুঝি হিসেব কষার খাতার মতই সাধারণ ও মলিন হয়ে রয় পুরুষের চোখে? খুব জানতে ইচ্ছে হয় কী সেই কারণ যা শিল্প সাহিত্যে যুগ যুগ ধরে  পুরুষকে মহান করে রেখেছে আর নারীকে চিহ্ণিত করেছে খেলো করে? কে বলতে পারে এর কারণ এমন নয়তো যে সর্বযুগে সর্বকালে পুরুষই আধিপত্য ধরে রেখেছে শিল্প-সাহিত্যের জগতে? আমার জানা নেই। বিজ্ঞ পাঠক আপনি ভাবুন আর ভেবে বের করু এর সঠিক কারণ কী হতে পারে।