বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০

শ্রাবণী দাশগুপ্ত




ধারাবাহিক উপন্যাস

লাল-নীল-পেন্সিল 


 

(৬)  

নিস্তব্ধ ঘরে ফুলস্পিডে পাখা ঘোরার শন্‌শন্‌ শব্দ। পাশে সশব্দ নিঃশ্বাসে ঘুম ভাঙে গায়ত্রীর। ঘুমোয় নি মাম্পি? কান সজাগ করে টের পান, জেগে আছে। এমন অনেক রাতে তিনি অনেক কিছু টের পেয়ে যান। বয়স বাড়ার সঙ্গে ঘুম পাতলা হয়ে গেছে। ফলে রাত দীর্ঘ মনে হয়। বরং দুপুরে অল্প সময়ের ভাতঘুম অনেক গভীর হয়। গায়ত্রী চোখ বুজে শোনেন নিঃশব্দে কাঁদছে মেয়েটা! তিনি পাশ ফিরে কাঠ হয়ে থাকেন, ইচ্ছে করে ওর কপালে মাথায় হাত রাখেন। কিন্তু মাম্পি হয়ত অস্বস্তিতে পড়বে। ওকে তিনি অনেকটা বোঝেন, নিজেকে দেখেন ওর মধ্যে। বাইরে শক্ত নিষ্প্রাণ, ভেতরে অন্যরকম। তাঁর বা দেবিকার মতো বেঁটে এবং তেমন ফর্সা নয়, বাবার মতো সটান লম্বা। মুখের গড়ন বা নাক-চোখও তাই, চোখা-চোখা। ছোটো জামাই কৌশিক অল্পবয়সে সুদর্শন ছিল।

ঘুম কেটে গেছে। মশারির মধ্যে বলে বেশি গরম লাগছে। দেবিকাদের ঘরের এ-সির আওয়াজ, খাওয়ার ঘরের দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক জোরে শোনা যাচ্ছে। বাচ্চু অনেকবার বলেছে তাঁর ঘরে এ-সি লাগিয়ে নিতে। তিনি রাজী হননি। ওর কাছে চাইতে খারাপ লাগে। এখানে না থাকলেও দরকার মতো যথেষ্ট করে।

রাতে দুএকবার বাথরুম যাওয়ার জন্যে উঠতে হয়। মাম্পি অঘোরে ঘুমোয় বলে টের পায় না। তাঁকে এবারে উঠতেই হবে, চেপে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। কী করবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। শরীরের তাগিদ অনেক বেশি। কাপড়ে হয়ে গেলে নিজেকে ধুয়ে নিতে হবে। বাধ্য হয়ে সন্তর্পনে উঠে বসেন গায়ত্রী। মশারি সাবধানে তুলে নেমে যান। বেশ মশা বাইরে। কাজ সেরে হাত-পা ধুয়ে ফিরে আবার মশারিতে ঢুকে নিঃশব্দে শুয়ে পড়েন। মাম্পির সম্ভবত ঘুম এসেছে। তাঁর আর ঘুম আসবে না, জেগে থাকবেন ভোর পর্যন্ত।
জেগে থাকলে অজস্র পোকা নাচতে থাকে চারিদিকে, আচ্ছন্ন করে রাখে। শ’য়ে শ’য়ে হাবিজাবি পুরনো স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে।

বড়ো দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন সম্বন্ধ করে। দেখতে ভালো না হলেও তিন মেয়েরই ‘সর্বদোষ হরে গোরা’। আর অল্পবয়সের লাবণ্য ছিল। সত্য বুঝে সত্যসাধন দেরি করেন নি। বড়ো লতিকা গ্র্যাজুয়েশন করতে পারেনি, করতে দেননি সত্যসাধন। প্রতিষ্ঠিত ছেলে, ভালো পরিবার। প্রায় দশবছরের বড়ো হওয়া সত্বেও বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর কানপুরে চলে যায়। আর বিশেষ যোগাযোগ রাখে না। মেজো লিপিকা লেখাপড়ায় ভালো। থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষে তার বিয়ে দেন। পরে নিজের চেষ্টায় আরো খানিক পড়াশোনা করেছে। বাচ্চা হওয়ার সময়ে মেয়েদের বাপের বাড়ি আসা অলিখিত নিয়ম। দুই মেয়ের একজনও নিজের জায়গা ছেড়ে তাঁদের কাছে আসেনি। অবশ্য লিপিকার ছেলে হওয়ার সময়ে দেবিকাকে নিয়ে তুলকালাম চলছে।

গায়ত্রীর মনখারাপ হয়েছিল। অপরাধবোধের কথা সত্যসাধনকে জানিয়ে ছিলেন। সত্যসাধন বলেছিলেন,
-তুমি অগরে আসার জন্যে বলেছিলা, আসতে চায় না। যে যেখানে ভালো থাকে, থাক। এত ভাইব না, আর ডাকাডাকি করার দরকার নাই।
বক্তব্যে যুক্তি ছিল, গায়ত্রীর মেনে নিয়েছিলেন। লতিকা ও লিপিকার মাঝে একমাত্র ছেলে শিবতোষ। ছেলের প্রতি আলাদা টান গায়ত্রী বরাবর গোপন করেছেন। সে বউ নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাট কিনে চলে গেলেও মায়ের খোঁজখবর নেয়। তার অংশের ভাড়ার টাকার এক-তৃতীয়াংশ মায়ের হাতে দিয়ে যায়। গায়ত্রীর ভেতরে অভিমান জমে, রাগ করতে পারেন না। শিবতোষ আকৈশোর বদরাগী। সেসব নিয়ে একদা সমস্যা হত, বয়স বাড়ার সঙ্গে নিজেকে বদলেছে। কিন্তু দেবিকা-কৌশিককে আজও সহ্য করতে পারেনা। গায়ত্রীকে তার কাছে পাকাপাকি থাকতে না বললেও, নিয়ে যাওয়ার জন্যে জোর করে। তিনিই বাড়ি ছেড়ে এক-পা বেরোতে চান না। সত্যসাধনের মৃত্যুর পরে পুরোমাত্রায় স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে গেছেন।

স্কুলে থাকতে দেবিকা পাখা মেলছিল। সুন্দরী নয়, চটকদার। তাছাড়া সাজগোজ, কথা, হাসিতে গলে পড়া। বড়ো দুই মেয়ের মতো শান্ত, সুবোধ নয়। সত্যসাধন স্পষ্টতঃ অসন্তুষ্ট হতেন কিন্তু গায়ত্রীকে দোষারোপ করতেন না। গায়ত্রী শাসন করতে পারেন না, একটা চড় পর্যন্ত লাগান নি কখনো। বকাবকি যা করতেন, মেয়ে উড়িয়ে দিত। গড়িয়ে গড়িয়ে প্রায় ঊনিশবছরে থার্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করল। সত্যসাধনের ভেবেছিলেন কোনোক্রমে বারোক্লাসে উঠলে বিয়ে সেরে ফেলবেন। দুএকটা সম্বন্ধ আসছিল। কৌশিক বছরদুই আগে হায়ার সেকেণ্ডারিতে ব্যাক পেয়ে পড়া ছেড়ে বসে আছে। সারাদিন পাড়ার মোড়ে, ক্লাবের সামনে আড্ডা। বাবার প্রচণ্ড ধমকে কিছুক্ষণের জন্যে দোকানে গিয়ে বসত। মুদী দোকানটার পেছনদিকে ওদের ছোটো বাড়ি, টালির ছাত। কৌশিকেরা পাঁচ ভাইবোন। দিদি বড়ো, সে মেজো।
কৌশিকের প্রেমে পড়ল দেবিকা। মেলামেশা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছাল। পাড়াময় রয়টার – একদিন টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরে তুমুল অশান্তি করল শিবতোষ। পারলে বোনকে সেদিন খুন করে ফেলত। কানাঘুষো গায়ত্রীর কানে যে আসেনি তা নয়। দেবিকাকে ডেকে নিয়ে ঘরের দরজা দিলেন।
-পাড়ার লোকে যা বলছে, সত্য?
-কী শুনি?
-ঢং করিস? তোর বাপের কানে গ্যালে ঘর থেকে বাইর করে দেবে।
-দিলে দেবে।
-যাবি কোন চুলায়? খাওয়াব কে? পাড়ার লোকে ডাক নেয়—। লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকাইয়া দিছস। দিদিদের দেখেও শিখস নাই?
-দিদিরা! হুঁহ্‌, উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বয়। চেনাশুনা নাই লোকের ঘর করে—!
-ক্ষতি কি হইছে? চালচুলা নাই ছেমড়া তোরে সুখে রাখবে?
-পাড়ার লোকে কী বলে শুনি না একবার!
-জানস না! সত্যসাধনবাবুর ছোটো মেয়ে বখা গুণ্ডা ছেলেটার লগে—!
-গুণ্ডা কে বলেছে? হাঁড়ির খবর নেওয়া ছাড়া পাড়ার লোকের কাম কি!
-জীবনটারে এর’ম নষ্ট করবি? বাচ্চুরে আজ কারা জানি ডেকে—।
-দাদা এবাড়ির কর্তা নাকি? খাওয়ায় না পরায়? মোড়লি করার কে? নিজের চরকায় তেল দিক না গিয়া!  চুকলি করতে কে লাগিয়েছে?
শিবতোষের নামে দেবিকা জ্বলে উঠেছিল। মায়ের সঙ্গে প্রচণ্ড অশান্তি – চেঁচামিচি, ঝগড়া, কথা বন্ধ।

শিবতোষ রাস্তায় পেয়ে শাসিয়ে এল কৌশিককে। কৌশিক অবশ্য চুপ করেছিল। আসলে সে খানিক ভীতু প্রকৃতির। পরের মাসখানেক মোটামুটি শান্ত। এর মধ্যে দেবিকার বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। টুয়েল্ভে উঠতে প্রমোশন আটকেছে স্কুল। সে আপাতত বাড়িতে, সপ্তাহে  তিনদিন কোচিং-ক্লাসে যায়। ফেল-করা বিষয়গুলোতে আবার পরীক্ষা হবে। তার ওসব মাথাব্যথা নেই। রেজাল্ট নিয়ে কেউ বিশেষ বকাবকি করেনি। লেখাপড়া তার হবে না। সে বাড়িতে আছে, এই যথেষ্ট। একদিন সকালে সে হঠাৎ বমি করল। গায়ত্রীর মনে কুডাক। তবু জিজ্ঞেস করলেন না, পাছে আশঙ্কা সত্যি হয়। এর দু’তিনদিন পরে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, সঙ্গে বমি। গায়ত্রী চেপে ধরলেন,
-বমি করছস কেন? কি হয়েছে তোর?
-আঃ! কি হবে? কিছু না।
-মিছা কথা বলবি না মাইরা ফেলব। মাসিক হয় নাই কয়মাস?
-তিনমাস। জ্বালিও না, যাও দেখি!
-কী কমু তোরে! লজ্জা নাই? ভয় নাই তর? সর্বনাশ বাধিয়ে রাখছস! ধিঙ্গি মেয়ে বাপের মাথা নিচা করলি! 
সে কৈফিয়ৎ দেয়নি, একটা জবাব পর্যন্ত দেয়নি। খাটের কোণে গোঁজ হয়ে বসেছিল। অপরিণামদর্শী অপরিণত মেয়ে। ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। ভয়ে, দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে গায়ত্রীর কেঁদে ফেলেছিলেন। ইচ্ছে করছিল মেয়েকে শেষ করে দিয়ে নিজে মরেন। শিবতোষকে, সত্যসাধনকে না জানিয়ে উপায় ছিল না। সত্যসাধন তখন প্রায়শঃ অসুখে পড়ছেন। প্রেশারের ওঠানামা ঘনঘন, আরো নানা উপসর্গ। কৌশিকের বাবা হাতজোড় করেছিলেন,
-বিয়া হইয়া যাউক। কিন্তু সত্যবাবু আমার পোলার বউয়েরে খাওয়ানর ক্ষমতা নাই। জানেনই ত ফ্যাফ্যা কইরা ঘুরে বেড়ায়। ক্ষমতা আমারও নাই। হের পরে আপনেরা যা ভাল বুঝেন, তাই হইব।
মেনে নিতে হয়েছিল। সেদিন কৌশিক অস্বীকার করলে, ওর বাড়ির লোক মেনে না নিলে কী করতেন? এতবছর পরেও মনে পড়লে চোখ জ্বালা করে। বুকে অদ্ভুত ভারবোধ হয়। কেন যে ভুলতে পারেন না! 

খালি-গা সত্বেও ভীষণ ঘেমে উঠছেন গায়ত্রী। অত্যধিক গরম লাগছে। রাত-বিরেতে হঠাৎ শরীর খারাপ মানে দেবিকাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা। চেয়ে দেখলেন, মাম্পি এতক্ষণে ঘুমোচ্ছে। মন জুড়ে মায়া ছেয়ে গেল। ছোটোবেলায় সামান্য কারণে ওকে তুমুল মারত দেবিকা। বছরে দুতিনবার লিপিকা ছেলে নিয়ে আসত কলকাতায়। মাম্পি আর হর্ষ চারমাসের ছোটো-বড়ো। ওরা এলে ভীষণ খুশি হত মাম্পি। অজ্ঞাত কারণে সেই ক’দিন দেবিকার মেজাজ খারাপ। মেয়েকে টেনে নিয়ে চলে যেত শ্বশুরবাড়িতে।
বছরপাঁচেক তখন, খেলছিল দুজনে। লিপিকা ডাকতে এসে বলল,
-খেতে দিয়েছি, এসো। কি খেলছ তোমরা? মাম্পি-বাবুল?
-আমরা বর-বউ খেলছি মেজোমাসি। ও বর, আমি বউ।
লিপিকা অস্বস্তিতে পড়েছিল। বাচ্চাদের মতি, বাচ্চাদের খেলা। বেশি গুরুত্ব দিলে অন্যরকম কৌতূহল তৈরি হয়। তবু বুঝিয়ে বলেছিল, ভাইবোনে অমন খেলে না। বাবুল মেনে নিয়েছিল, মাম্পি প্রশ্ন করছিল। কাছাকাছি কোথাও ছিল দেবিকা। ছুটে এসে নড়া ধরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মাম্পিকে। দরজা বন্ধ করে মেয়েকে এমন মেরেছিল, দমবন্ধ হয়ে ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল সেদিন। মনে পড়তে শিউরে উঠলেন গায়ত্রী।

তারপর লিপিকা আরো কমিয়ে দিয়েছিল আসা – বছরে একবার, দিনসাতেকের জন্য। মাম্পি বড়ো হতে হতে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে লাগল – গম্ভীর, অন্যমনস্ক, খামখেয়ালি। লেখাপড়াক্ষেত্রেও তাই, কিন্তু রেজাল্ট ভালো হত। মাত্র একটি বিষয়ে অসম্ভব মনঃসংযোগ, আঁকা। জগৎ ভুলে ড্রইংখাতা, রঙপেন্সিল, তুলিতে ডুবে থাকত। বছর তেরো বয়স তখন। দুদিন আগে ফিরে গেছে লিপিকা আর হর্ষ। অনেক রাতে গায়ত্রীর গা ঘেঁষে এসেছিল মাম্পি। কিশোরীর গায়ের মিষ্টি গন্ধ ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। আদর করে বলেছিলেন,
-কি হল মাম্পি?
-মেজোমাসি চলে তোমার মনখারাপ হয়, না?
-একটু হয়। বাবুলের জন্যে বেশি।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে-ধীরে বলেছিল মাম্পি,
-আমার যে ভীষণ হয়।
-তা তো হইবেই। ভাই-বোন, কত ভাব তোমাদের। গল্পগাছা, খেলাধুলা কর—।
-ভাই-বোনে বিয়ে হয় না, না দিদু?
কেঁপে উঠেছিলেন গায়ত্রী। আবার যেন সিঁদুরে মেঘ দেখছেন! তাড়াতাড়ি নিজের হাত চাপা দিয়েছিলেন নাতনির মুখে,
-এর’ম বলতে নাই সোনা। আর ককখনো বলবা না।
দিদিমার দিকে ফিরে কাত হয়ে শুয়েছে শ্রুতি। গায়ত্রী বাইরে থেকে আসা সামান্য আলোতে ওর মুখখানা দেখেন। বুকের মধ্যে কেমন যেন মুচড়ে ওঠে, মেয়েটার আজ অস্তিত্বই থাকত না হয়ত! থাকতে না পেরে, নরম হাতের পাতাখানা মাম্পির কপালে বুলিয়ে দেন। আধোঘুমে তাকানোর চেষ্টা করে সে। গায়ত্রী বলেন,
-কই গেছিলি?

(ক্রমশঃ)   





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন