সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

কাজল সেন



কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৫




জয় পরাজয়


বলে লাথি মারলেই ফুটবল খেলা হয় না। লাথি তো সবাই মারতে পারে! লাথালাথি মানুষের জন্মাধিকার। সারাজীবনই তাই করে। কিন্তু ফুটবল খেলতে   গেলে খেলাটা শিখতে হয়, খেলার নিয়মকানুন শিখতে হয়ে, নিয়মিত অভ্যাস  করতে হয়, নিজেকে খেলোয়াড় ভাবতে হয় এবং নির্মাণ করতে হয়। বুঝলি? আনতাবাড়ি পা চালালে আর দৌড়লেই ফুটবল খেলা হয় না!

বিজয়েন্দ্রদা নিজে কত বড় ফুটবলার ছিলেন, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে উপযাচক হয়ে মাঠে এসে আমাদের মতো আনাড়ি ছেলেপুলেদের যেভাবে ধমকে উপদেশ দেন, তা কিন্তু ফেলনা নয়। তিনি প্রতিদিনই বিকেলে হাফপ্যান্ট-জীর্ণজার্সি-কেডস পরে নেমে পড়েন আমাদের সঙ্গে। বয়সের ভারে শরীর দুর্বল, দম কমে গেছে, অল্পতেই হাঁফিয়ে ওঠেন, তবুও বল ধরা, বল ছাড়া, পাসিং ড্রিবলিং ট্যাকেলিং ড্যাসিং, সব কিছুতেই তাঁর অতীতের কিছু সোনালি  মুহূর্ত মাঝে মাঝেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আমরা হাততালি দিয়ে হইহই করে উঠি। 

বিজয়েন্দ্রদার বাড়িতে আমরা কখনও সখনও যাই। গেলে খুব খুশি হন। আমরা যদি তাঁকে দাদু বা অন্তত জ্যেঠু সম্বোধন করি, তবে তা মানানসই হয়। কিন্তু তিনি রীতিমতো আদেশ জারি করেছেন, আমরা ফুটবলের সহখেলোয়াড়, তাই দাদু বা জ্যেঠু একেবারেই নয়। ম্যাক্সিমাম দাদা বলতে পারিস, আরও খুশি হব যদি খেলার মাঠে নাম ধরে ডাকতে পারিস।

বিজয়েন্দ্রদা মাঠে এসে যতই খেলার নিয়মকানুন কপচান না কেন, তাঁর বাড়িতে কোনো নিয়মকানুনের বালাই নেই। বাড়ির খেলোয়াড়রা যে যার খুশিমতো সংসারে আনতাবাড়ি লাথি মেরে চলেছে। তাঁর বড়ছেলেটা একটা আকাট মূর্খ, গায়ে গতরে বেড়েছে, বুদ্ধিতে নয়। সারাদিন ঘরে বসে পাড়ার কয়েকটা উচ্চিংড়ের সঙ্গে তাসের জুয়ো খেলে আর বিড়ি ফোঁকে। মেজছেলেটা পাঁড় মাতাল। সিভিল কন্ট্রাকটারিতে কাজ করে আর রাতে আকন্ঠ মদ গিলে ঘরে ফিরে খিস্তি করতে থাকে। ছোটছেলেটা আর এক পদের, পাড়ার একটি মেয়ের গর্ভে তার সন্তানকে গছিয়ে দিয়ে এখন নিরুদ্দেশ।  

বিজয়েন্দ্রদা বলেন, খেলাটাকে সবসময় মনে করবি একটা যুদ্ধ। খেলার মাঠটা হচ্ছে রণক্ষেত্র। নিজের দলের সবাই হচ্ছে তোদের সহযোদ্ধা। প্রতিপক্ষ দলের সবাই তোদের শত্রু। হ্যাঁ, খেলার মাঠে তাই মনে করবি, মাঠের বাইরে কখনই নয়। আর খেলা বা যুদ্ধের একটাই উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা অর্থাৎ জয়লাভ করা। এবং সবসময় মনে রাখবি, যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য যেমন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়, খেলার মাঠেও তাই। তবে যুদ্ধে ইদানীং অনেক ছল চাতুরি চলে, সেটা খেলার মাঠে কখনই চলতে পারে না। মনে রাখিস, খেলাধুলো আসলে হচ্ছে ভদ্রলোকের, সেখানে অভদ্রলোকের প্রবেশ নিষেধ।

একদিন বিজয়েন্দ্রদা বিষণ্ণ মুখে বললেন, তোরা মাঝে মধ্যে আমার বাড়িতে আসিস, খুব ভালো লাগে। কিন্তু আজ আমি মিনতি করছি, আর আসিস না! এটা ভদ্রলোকের বাড়ি নয়। মাঠেও হয়তো আর যাওয়া হবে না। শুধু অপেক্ষায় আছি, তোদের দিদার জন্য। কিডনিতে ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। ডাক্তার জবাব দিয়েছে। দেখি, আর ক’দিন বেঁচে থাকে!   
 

৩টি মন্তব্য: