সমকালীন ছোটগল্প |
ব্যবচ্ছেদ
বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়া যাওয়ার পথে পড়ে লালপুর। প্রত্যেক
বাসই এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। দাঁড়ায় বলা বোধহয় ঠিক হবে না -- বলা যায় দাঁড়াত। এখন
মনে হয় বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। কলেজ-হস্টেল থেকে মাঝেমধ্যে বাড়ি আসার পথে শান্তনু
লালপুরে নেমে গরম গরম তেলেভাজা খাওয়ার লোভ সামলাতে পারত না। অপূর্ব সেই স্বাদ!
এখনও জিবে লেগে আছে! কোন এক সময়ে এই বিষয়ে বাড়িতে গল্পও করেছিল। তা শুনে মা বলেছিল
-- নিয়ে আসিস তো একবার। ...হয়ে ওঠেনি। ভুলেই গিয়েছিল সেসব কথা। কতদিন আগের ঘটনা,
প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের। কেন কি জানি আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
মা-বাবা চলে গেছে অনেকদিন আগে, ইহধাম ছেড়ে। স্ত্রী
দেবযানীও চলে গেছে ডিভোর্স নিয়ে, বছর কুড়ি হল। রিটায়ার্ড হওয়ার পর শান্তনুর হাতে
তাই এখন অফুরন্ত সময়। আচ্ছা, পুরনো কথাগুলো আজকাল মনে পড়ে যায় কেন? স্মৃতিকাতরতা
কি বার্ধক্যের লক্ষণ? দেখতে দেখতে ৬৫ বছর তো হয়েই গেল। বার্ধক্যের পর্যায়-ই তো
চলছে। ছেলেটা মানুষ হয়েছে, না অমানুষ -- আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না শান্তনু। হাজার
সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কিছুই করে উঠতে পারল না জীবনে। হয়তো বা সবার দ্বারা
সবকিছু করা হয়ে ওঠে না। মানুষ বোধহয় নিয়ে আসে গত জন্মের কিছু সুকৃতি। আর সেই
নিরিখেই নিয়ন্ত্রিত হয় এই জীবনের সাফল্য। এখন এই বয়সে এসে এ ধরনের ভাবনা, বোধ
মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
বাবা-ছেলে একসাথেই থাকে। বাড়িতে রয়েছে পুরনো দিনের কাজের
মহিলা। রান্না থেকে শুরু ক'রে যাবতীয় কাজকর্ম ও-ই করে। কোনো পিছুটান নেই। অনেক পুরনো
বিশ্বস্ত মহিলা।
অনেক আশা নিয়ে, স্বামী-স্ত্রীতে আলোচনা ক'রে ছেলের নাম
রাখা হয়েছিল -- উজ্জ্বল। হায় রে! নিয়তির
কী পরিহাস! রিটায়ার্ড প্রধানশিক্ষক বাবার টাকায় ইদানিং একটা দোকান খুলেছে পাড়ার
মোড়ে -- দশকর্মা ভান্ডার। শুরুতে খুব লজ্জা লাগত শান্তনুর। মাথা নীচু ক'রে পেরোত
পাড়ার রাস্তাটুকু। ধীরে ধীরে অবশ্য গা-সওয়া হয়ে গেছে। স্ত্রী ডিভোর্স নিয়ে চলে
যাওয়ার পরও লোকলজ্জার ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল শান্তনু। স্বাভাবিকতা ফিরেছিল বেশ
কিছুদিন পর। সত্যি, সময় এক অবিশ্বাস্য ব্যথা-হরণকারী অব্যর্থ ওষুধ। আজকাল শান্তনুর
জীবনদর্শন এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, যেখানে দাঁড়িয়ে সবকিছু মনে হয় অর্থহীন। যেন
কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তবে কখনো-সখনো বুকের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করে।
দেবযানী-কাঁটা। সবকিছু তো মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছিল। তবু কেন যে চলে গেল দেবযানী!
ইগো? নাকি মতানৈক্য?
দাম্পত্যজীবনের এতগুলো দিন পেরিয়ে যাবার পরও পঁয়ত্রিশ
বছর বয়সে ছেড়ে চলে গেল সাজানো সংসার। অবসর সময়ে বসে বসে ভাবে শান্তনু -- দোষ কি
শুধু আমারই ছিল? অবশ্য কথায়-আচরণে দেবযানী এই কথাটাই বারে বারে বোঝাতে চেয়েছে যে
আমি নাকি অকম্মার ঢেঁকি, বাস্তববোধ কিছুমাত্র নেই, আর স্বভাবটাও নাকি হলহলে। ...ওর
এখনো চাকরি রয়েছে কয়েক বছর। সারদাসুন্দরী
গার্লস স্কুলে ভূগোল পড়ায়। ছোট্ট ভাড়াবাড়ি নিয়েছে স্কুলের কাছেই। সৌভাগ্য এই যে,
দেখা-সাক্ষাত হয়-ই না। কেননা ওর স্কুলটা মাইল পাঁচেক দূরে। একসাথে যখন ছিল এখান
থেকে আসা-যাওয়া করত ট্রেকারে।
বাইরের যারা তারা প্রায়ই বলত -- সত্যি, আপনি-ই মশায়
সুখে-শান্তিতে আছেন। দুজনের চাকরি, একটামাত্র ছেলে, মেয়ে-টেয়ে নেই, কি ভাবনা
আপনার? ওপরের খোলসটা দেখে কি বোঝা যায় ভেতরে ভেতরে কত রক্তক্ষরণ! আজ শান্তনু বুঝতে
পারে, দুটো মনের সঠিক টিউনিং যদি না হয়, তাহলে শুধুমাত্র নিছক দায়িত্ব আর
কর্তব্যপরায়ণতার আচরণে সংসারকে ঠেকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় মাত্র। এক একটা দিন পার
করা। প্রয়োজনে একে অন্যের সহযোগিতা পাব, এই স্বার্থপরতায় শুধু ভালবাসার অভিনয় করে
যাওয়া। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়ে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় জীবনচর্যার অঙ্গ।
আচ্ছা, ওর হুল-ফোটানো কথাগুলোর মধ্যে সত্যতা কি কিছুই
ছিল না? সব অভিযোগ-ই কি ছিল ভিত্তিহীন? সমাজসেবা আর অপরের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে
দিতে গিয়ে কি ঘরকে অবহেলা করেছি? চাইলে ওকে একটু বেশি সময় দেওয়া যেত কি? বা ঘরের
কাজে সামান্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া? ...সে বেচারাও তো সারাদিন স্কুলে পরিশ্রম ক'রে
বাড়ি ফিরে আসত। মিষ্টি কথার জালে ভুলিয়ে মন রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে -- একসময়
বেরিয়ে আসত দাঁত-নখ। তখন পালিয়ে বাঁচা।
রবিবারের আনন্দবাজার পত্রিকাটা নিয়ে সকালবেলায়
একটু উল্টেপাল্টে দেখে শান্তনু। ছেলের বয়সও তো থেমে নেই, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হল।
বিয়ে-টিয়ে একটা দিতে হবে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা বিজ্ঞাপন -- O+ গ্রুপের রক্তের কিডনি
চাই। কোন সহৃদয় ব্যক্তি দান করলে বাধিত হব। ফোন নম্বর -- 94310...। বিদ্যুতের চমক
খেলে যায় শান্তনুর সারা শরীরে। এই ফোন নম্বর তো খুবই চেনা। দেবযানীর এই নম্বরে
কতবার রিচার্জ করিয়েছে ও। ওর রক্তের গ্রুপ তো O পজিটিভ-ই। কিডনি ফেল করেছে ওর!
...সারা শরীর ঝিম্ ঝিম্ করতে থাকে। কী দুশ্চিন্তায়, কষ্টে-উদ্বেগে দিন কাটছে
বেচারার। হলোই-বা ডিভোর্স, খবর নেওয়া
বোধহয় উচিত ছিল। এক সময় তো...! কাজের মহিলাকে 'একটু আসছি' বলে বেরিয়ে পড়ে শান্তনু।
আজ তো রবিবার, দেবযানীকে নিশ্চয়ই বাড়িতে পাওয়া যাবে। এই অবস্থায় ওর পাশে দাঁড়ানো,
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া নৈতিক কর্তব্য -- এই ভেবে পৌঁছয় দেবযানীর ভাড়াবাড়ির
সামনে। ঠিকানাটা মোটামুটি জানাই ছিল, তাই বিশেষ অসুবিধা হয়নি।
বাইরে থেকেই শোনা যায় গানের আওয়াজ। সিডি প্লেয়ারে বাজছে
রবীন্দ্রসংগীত -- এই করেছ ভালো নিঠুর হে ...
কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে অবাক দেবযানী জিজ্ঞেস করে, কী
ব্যাপার, তুমি? হঠাৎ?
- না, মানে, খবরের কাগজে দেখলাম -- তোমার দেওয়া বিজ্ঞাপন
-- তোমার নাকি কিডনি...
- ও হো, না না। ওটা আমার নয়। গরীব এক ছাত্রীর হ'য়ে বিজ্ঞাপনটা
আমি-ই দিয়েছি।
- ও! আমি ভাবলাম... ঠিক আছে, আসি তাহলে।
- তুমি কি আমার ওপর করুণা দেখাতে এসেছিলে?
- না, ঠিক তা নয়।
- শোনো, এখনও সময় আছে, নিজেকে একটু বদলানোর চেষ্টা
কর। ঘর না দেখে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে সারাজীবন
তো অপরের জন্যই করে গেলে। জেনে রেখো, সবাই তোমায় ব্যবহার করবে। সিঁড়ির মতো। তরতর
করে উঠে যাবে ওপরে, আর ফিরেও তাকাবে না। তোমাকে তারা বোকা আহাম্মক-ই ভাববে, ভেবো
না মাথায় করে রাখবে।
একটু চুপ ক'রে থেকে আবার বলে -- বোসো, আসছি একটু। কথা
আছে।
ভেতরে ঢুকে দেবযানী রান্নাঘরে চায়ের জল চাপিয়ে ভাবে,
একসময় মানুষটাকে তো আমিও নিঙড়ে নিয়েছি।
বেচারা নিজের দিকে কোনদিনই নজর দেয়নি -- না খাওয়া-দাওয়া, না সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। শুধু
একটাই নেশা ছিল পরোপকার। নিজের জন্য কম খাটিয়েছি ওকে! মুখ বুজে মানুষটা যতটুকু
সাধ্য করে গেছে। নিজের প্রয়োজনের কথা কাউকে বলত না। মনে আছে একবার ওর প্যান্টের
নীচের সেলাই খুলে যাওয়ার জন্য পিন দিয়ে আটকে কাজ চালিয়ে নিচ্ছিল। সেই প্যান্ট
কাচতে গিয়ে কাজের মহিলার হাতে পিন ফুটে রক্তারক্তি কান্ড। এই নির্বুদ্ধিতার জন্য
ওকে সেদিন কত কথা শুনিয়েছিলাম। কিন্তু ওর দৃষ্টিকোণ দিয়ে ব্যাপারটা দেখলে সবকিছু
কত সহজ হয়ে যেত।
একগ্লাস জল নিয়ে দেবযানী বলতে বলতে ঢোকে সামনের ঘরে --
অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম বলব ...
এসে দেখে বারান্দা থেকে নেমে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে
শান্তনু। না-বলা কথা আর বলা হয়ে ওঠে না।
বাড়ি ফিরে এসে শান্তনু দেখে কাজের মহিলা না খেয়ে তার
জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। বেলা গড়িয়েছে অনেক, তবুও... কীসের এত টান!
আচ্ছা, ভালবাসাকে কি সবসময় সম্পর্কের বাঁধনে না বাঁধলে
তার গুরুত্ব বা গভীরতা কমে যায়? কি জানি! সত্যি বিচিত্র মানুষ! আর বিচিত্র তার
চরিত্র! কোনটা যে মুখ, আর কোনটা যে মুখোশ,
বোঝা সত্যি মুশকিল। আমি-ই বা কতটুকু চিনি আমাকে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন