ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৪)
শ্রুতি সাবেকী আয়নার সামনে আবছা আলোতে একটু পরিপাটি হয়ে নিল। চুলে চিরুনির দু’একটা টান দিয়ে, আই-ব্রো সেট করে নিল। ঘুরেফিরে দেখে নিল কুর্তির ভাঁজটাজ। দেওয়ালে ঝোলানো ছোটো ঠাকুরের তাকের দিকে তাকিয়ে হাত জড়ো করে বারদুই
কপালে ঠেকাল। দিদিমার ঘুমিয়ে পড়েছেন, নাকডাকার অস্পষ্ট শব্দ উঠছে। মাথার কাছে
ভাঁজ-করা খবরের কাগজ, চশমা। শ্রুতি
থাকে এই বড়ো ঘরটায় দিদিমার সঙ্গে। দিদিমা নীরব নির্লিপ্ত মানুষ, সারাদিন কাজে
ব্যস্ত। ঘরের কাজকর্ম তার মায়ের চেয়ে ঢের বেশি করেন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কথা প্রায়
বলেন না, বাড়ির বাইরে বিশেষ যান না। মাঝে-মাঝে পাড়ার কেউ দেখা করতে আসে।
এ বাড়িটা প্ল্যানহীন ছিরিছাঁদহীন ছড়ানো, এদিককার নব্বই শতাংশ বাড়ি এরকমই।
সাড়ে-পাঁচ কাঠামতো জমি ছিল, যখন যেমন দরকার পড়েছে বাড়ানো হয়েছে। ছোটোবড়ো মিলিয়ে
পাঁচছ’খানা ঘর। মাঝখানে দেওয়ালের পার্টিশন – ওপাশে মামার অংশ ভাড়া দেওয়া। এদিকের
অংশে আর একটা ছোটো ঘর আছে, ফাঁকাই মোটামুটি। একটা তক্তপোশ রাখা। পরিষ্কার করে গুছিয়ে নিয়ে শ্রুতি নিজের মতো থাকতে পারত।
তার পছন্দ হয় না
ঘরটা। একটামাত্র জানালা কোণের দিকে,
বন্ধ রাখতে হয়। খুলে লাভ নেই – পাশের বাড়ির ইঁট বের-করা পাঁচিলে দৃষ্টি ও বাতাস
দুইই আটকে থাকে।
রোজই ভরদুপুরে মাঝের ঘরে খাটের ওপরে কোলবালিশ পেঁচিয়ে তার
বাবা অঘোরে ঘুমোয়। মেঝেতে মাদুরে মা। ওঘরের দরজা
অল্প ফাঁক করা থাকে। বত্রিশ পেরিয়ে-যাওয়া মেয়েকে সম্ভবত টিনএজার ভাবে ওরা!
শ্রুতি ঘরের সামনে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়াল, উইণ্ডো এ-সি চলার শব্দ
ছাপিয়ে যৌথ নাকডাকার কন্সার্ট শোনা যাচ্ছে। দিদিমার ঘরে এ-সি নেই, দক্ষিণে ঝাঁকড়া
পেয়ারা গাছ। মোটামুটি আরামদায়ক, হাওয়াও আসে। শ্রুতির অভ্যেস হয়ে গেছে। এ-সি চালানো তার মায়ের বাতিক, সারাক্ষণ গরম লাগে। ক্রমাগত
ফুলতে ফুলতে বেলুনের আকারে চেহারা হয়েছে – নিজের দোষেই ইদানিং অসংখ্য রোগের বাসা।
সে বিরাগসূচক মুখভঙ্গী করল। পার্টিশনের কারণে প্রায়ান্ধকার প্যাসেজ পেরিয়ে নিঃশব্দে দরজার কাছে পৌঁছল। দরজার ঠিক আগে ছাদে ওঠার সিঁড়ি, পাশে দেওয়াল ফুটিয়ে ওপাশে
যাওয়া-আসার কমন্ দরজা। বন্ধই থাকে।
শ্রুতি যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজার ভারী খিল তুলে পাশে
নামিয়ে রাখল। কটকটে সবুজ রঙের দরজা খুলে তালা দেওয়া কলাপ্সিবল গেট। দিদিমা বাদে বাড়িতে প্রত্যেকের কাছে গেটের আলাদা চাবি।
শ্রুতি সাবধানে তালা ও গেট খুলল এবং বেরিয়ে বন্ধ করল। সামনে একফালি বাঁধানো উঠোন,
ঠা ঠা
রোদে তেতে আছে। একপাশে টিউব-ওয়েল। অনেকবছর আগে একমাত্র জলের উৎস ছিল এবং এখনো সচল। খুব গরমে বিকেলে গা ধুতে পাম্প করে দুয়েক বালতি জল তুলে
নেয় শ্রুতিও। এই উঠোনও কমন।
অনিচ্ছাসত্বেও ভাড়াটেদের গ্রিল-ঘেরা বারান্দায় চোখ ফেলল
শ্রুতি। কেউ নেই। বছর সাতের বাচ্চা মেয়েটি পুতুল, খেলনাবাটি ছড়িয়ে খেলছে। শ্রুতিকে
দেখতে পেয়ে উঠে গ্রিল ধরে দাঁড়াল। রিনরিন করে বলল,
-কোথায় যাচ্ছ গো মাম্পিপিসি?
-একটু কাজ আছে ঝিলাম।
-ও। তুমি বড়ো হয়ে গেছ কিনা তাই অনেক কাজ। একা বেরুলেও কেউ
বকে না।
আমাকে মা বিশ্বর বাড়িতেও একা যেতে দেয় না।
-পাকা বুড়ি! দোকা কোথায় পাব সব সময়ে? বিশ্ব তোর সেকশনে পড়ে বুঝি?
-হ্যাঁ গো মাম্পিপিসি।
-আচ্ছা। যাই এবারে।
-ছাতা নিয়েছ? রোদ মাথায় করে যাচ্ছ।
শ্রুতি জবাব না দিয়ে হেসে তাড়াতাড়ি ছোটো গেট খুলে বেরিয়ে
গেল। ঘাড়ে-ঘাড়ে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি সৌন্দর্যহীন, সরু অলিগলি ধরে পাঁচমিনিট হাঁটলে
রাস্তার মোড়। ওখানে অটো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিক্সা পাওয়া যায়। প্যাঁকপ্যাঁক করতে করতে রিক্সাগুলো অবশ্য ভেতরে আসে। সে
এদিকওদিক তাকাতে থাকে – রিক্সা পেয়ে গেলে আপাতত বাঁচা যেত। সোজা বড়ো রাস্তায় পৌঁছে
পাওয়া যায় বাস্--। অটোগুলো ভেতর দিয়ে এপাড়া-ওপাড়া যায়, বড়োজোর আর কয়েক কিলোমিটার।
ভাগ্য ভালো, কয়েক-পা এগোতে রিক্সা পেয়ে গেল শ্রুতি।
রিক্সাওয়ালা সেন্টু চেনা ছেলে, ভেতরের দিকে থাকে। আগে ওদের ছোটোখাট পোল্ট্রি ছিল।
শ্রুতিকে দেখে থামল, ময়লা কাপড় দিয়ে কপাল মুছল। বলল,
-যাবে নাকি দিদি?
-হ্যাঁ সেন্টুদা’।
-যাও কোথায় রোদ মাথায় করে?
-তুমি এত বেলায় কার বাড়ি এসেছিলে?
-বিশ্বাসবাড়ির মাসিমাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম। আশ্রমে গেছিল।
-ও আচ্ছা। একটু জলদি চল, তাড়া আছে।
রাস্তার দুপাশে ঘেঁষাঘেঁষি দোকান। বেশিরভাগ এখন ঝাঁপবন্ধ,
ভেতরে দু’একজন কর্মচারী থাকে। পাঁচটার পরে মালিকেরা হেলতে-দুলতে আসবে। পেরিয়ে গেল শ্রুতির
বাবা কৌশিকের ‘ভট্টাচার্য
স্টোর্স’।
শাটার টানা, বিপ্লব এসে খোলার ঘন্টাখানেক পরে তার বাবা
হেলেদুলে আসবে।
বড়ো রাস্তায় পৌঁছে হাঁফ ছাড়ল শ্রুতি। হাতঘড়ি দেখল, তিনটে
কুড়ি। ভালোরকম গরম পড়েছে। সে বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়াল। মুক্ত লাগছে, নিঃশ্বাস নিতে
পারছে। ওই বাড়ি, ওই ঘিঞ্জি পাড়া, ওই পরিবেশ তার ভীষণ বিচ্ছিরি লাগে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন