মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

সোনালি বেগম



সমকালীন ছোটগল্প



অণু-পরমাণু

মোবাইল বেজে বেজে স্তব্ধ হয়ে গেল। সকাল সাতটা। এখন থেকে টানা তিনঘন্টা  লিখে  যাওয়ার যে আনন্দ, কাকে আর বলে বোঝাব! ভুল তো হয়েই যায়, আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ! মোহ, মানবিক অবসাদ ঘিরে ধরে কখনও কখনও। অনুকূল পরিস্থিতি      খুঁজতে অলৌকিক যোগাযোগ হয়ে যায়। না! এ বয়সে আর নতুন করে কিচ্ছু চাওয়া পাওয়া নেই। এখন এই নিশ্চিত অবসর কেটে যাবে, শুধু  অনুসন্ধানটা চলতে থাকবে...

আমার পরিবার বাধা দেবে কি না, জানি না। এই সত্তর  বছররের তরুণকে দেখে কত সব  তরুণী ধেয়ে  আসছে, আমি কাতর হচ্ছি, অবাক বিস্ময়ে  ফিরে যেতে চাইছি সেই পাহাড় তুষারপাত ঘেরা সন্ধ্যায়।
কেন এ-রকম  ভাবছি?  এখন গরম চা-এর  ভাপে গলে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে  করছে , আমি তো পঁচিশ নই, কিন্তু তুমি তো দুর্দান্ত পঁচিশ!

হৃষীকেশ-এর গঙ্গা-আরতি-র কথা  খুব  মনে পড়ে।  আমি, আমার বউ পাতার  নৌকায়  ফুল ধূপ আলো  দিয়ে সাজিয়ে জলের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।
তুমি তো মৃন্ময়ী, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তুমিই এখন আমার হাওড়া ব্রিজ।  মনের  মাঝারে দীপ জ্বেলে দিলে এত সন্তর্পণে, বুঝতে পারিনি গো!

সেই যে কবি সম্মেলন হল, বাংলা আকাদেমি-র  জীবনানন্দ সভাঘরে। আমি সভাপতির পদ অলংকৃত করে বসে আছি। তুমি এলে ধীর পায়ে ফুলের স্তবক তুলে দিলে হাতে। সত্যি বলছি, তখন ভেবেছি,  তুমি  নবীন এক কবি। ভাল  লেখো, অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নবিহ্বল। খুব সুন্দর দুটি প্রেমের কবিতা পড়লে। ভালো লাগল। আমিও পড়লাম। ব্যাস, এই পর্যন্ত!

‘মোবাইলটা  বাজছে দাদু, ওঠাও’  –– দুরন্ত নাতি অপু খেলতে চলে যায়।
‘মৃন্ময়ী নামটা জ্বলজ্বল ভেসে আছে স্ক্রিনে, ওঠালাম। ‘হ্যালো! কেমন আছো  মিনু?’ গলায় আতঙ্কিত ভাল লাগা।
‘তুমি যে কাছে নেই, সোনা?’  উদ্বেগ ছড়িয়ে  পড়ে ––
‘আমি তো সব সময় তোমার সঙ্গেই আছি, মৃন্ময়ী, আমার মিনু’ আশ্বস্ত করি।
‘বিশ্বাস নেই আর। প্রতিদিন  যেভাবে কাটছে  আমার, খবর  রাখো তার!’
‘জানি, জানি, জানি, নতুন কিছু লিখলে?’

‘প্রবাহিত তরঙ্গে ভাসমান ফুল লতাপাতা
তুমি আর আমি পৃথিবীর সমগ্র সুখ
আন্দোলিত প্রবাস  আর আন্দোলন
অনিবার্য যোগাযোগ কঠিন সত্য আছড়ে  পড়ছে
জড়িয়ে  নিচ্ছি  হাত-পা-শরীর ও  বল্কল।...’

‘বাঃ, বাঃ, অসাধারণ সব পঙক্তি, লেখো  আরো  লেখো, প্রসারিত খোলা  পথ দেখতে পাচ্ছি ––
‘পাঁচ মাস হয়ে গেলো, স্বপ্ন দেখছি প্রতিদিন পিঠে-পিঠ, হাতে-হাত, গ্রহ-চাঁদ-তারা-র  ভিড়’  আন্তরিক খিলখিল  হাসির ফোয়ারায় স্নান সেরে নিলাম।
‘জানি  গো  জানি, চিনি  গো  চিনি, সেই সব দুরন্ত সময় সত্তর  আর পঁচিশ  মিলেমিশে একাকার  ধ্বনি’
‘পির সাহিত্য পড়েছো  আমার  কবি?’
‘হ্যাঁ, বাংলায়’।  ‘ইসলাম ধর্ম প্রচারে সুফি পিরদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। হঠাৎ পিরভক্ত হয়ে  উঠলে নাকি?’
‘পিরদের অলৌকিক ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ পথিক হয়ে আছি’।
‘সম্প্রতি গবেষণায় জানা গেছে  যে, দুর্গম অঞ্চলে কৃষিবিস্তারে পিরেরাই ছিলেন  তখন উদ্যোগী  কর্ণধার’।
‘অলৌকিক  কিছু না ঘটলে, আমরা একই ছাদের নিচে থাকব কীভাবে, বিনয়?’
‘মৃন্ময়ী, অত উতলা হওয়া  তোমায়  মানায়  না, সোনা!’  ওকে কীভাবে বোঝাব আমার স্ট্যাটাস, মানসম্মান-ভরা সংসার!
‘একই  কথার পুনরাবৃত্তি! আমার মাথাটা  খারাপ  হয়ে যাচ্ছে  দিন-প্রতিদিন...’  বিরক্ত স্বরধ্বনির প্রতিধ্বনি  মোবাইল-এ  বেজে  চলল...
‘সৌন্দর্য উপলব্ধি করো, দার্শনিক  অনুসন্ধান...  মন  খারাপ হলে আমার কাছে মাঝে মাঝে আসতেই পারো’–– এর বেশি আর কী বলব বা বলা উচিত বুঝতে পারছি না, আমার কম্পিত কণ্ঠস্বর।
‘শুধু কিছুক্ষণ নয়, বলতে পারো, আমি পুরনোপন্থী, একটা ঘরের স্বপ্ন তাড়িয়ে  নিয়ে  বেড়ায়  দিন-প্রতিদিন’।
ফোনটা  কেটে গেল।

বৃষ্টির ঝড়জল জানালা ছাপিয়ে পড়ার টেবিল  লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে জামার আস্তিন, পাজামার বাঁধন খুলে পড়ছে... আমি  অসহায় নিরুপায়  ভালোবাসার চরম মুহূর্তটি  উপলব্ধি  করছি... এখন কোনও কেন বা  সমাজ-এর দরকার মনে আসছে না।  শৃঙ্গাররস পরিবেশনে সীমারেখা কোথায় পৌঁছয়  তার মাপজোক  হারিয়ে  ফেলছি  ক্রমশ...

(২)

পোস্টমর্ডানিজম  নিয়ে  যুক্তি  খাড়া  করতে করতে  মৃন্ময়ী  টেবিলের  ওপাশে  এবং  আমি  বিনয়  সরকার  এপাশে। রেস্টুরেন্ট  কেবিনে  বসে  নানা  অন্তরঙ্গতাও  চলছে।  ভেজিটেবল চপ  আর চা  নিয়ে  বসে থাকা  সময়। বছর  তিনেক হল আমার বউ মারা গেছে। বুকটা  খালি খালি, সেটা পূর্ণ  হয়ে  গেল মৃন্ময়ীর সাহচর্যে।  শিক্ষিত অথচ এই বৃদ্ধ লেখকের প্রেমে  পাগল হয়ে ওঠা আশ্চর্য  সেই  নারী।
‘একটা কবিতা শোনো। আজ লিখলাম। কবিতার নাম  : ‘সাগর’

‘পরিত্যক্ত শিশু ঝরনা-জলে খোঁজে উৎস  মুখ।
পর্বতশিলায় চতুর্ভুজ ঝোড়ো  হাওয়ায়  ––
মাতাপিতার সন্তান হওয়ার সাধ জাগে
ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে খোঁজে বংশনাম।
স্খলিতচরণে  ক্রমশ  সহজ হয়ে ওঠে পথঘাট
ঘরের দরজায়  ঠান্ডা  বাতাস ও অনুচর  ––
এখন জনরব  ঘিরে  ব্যগ্রতা  বাড়ে, খেয়ালি-প্রেম
কল্পনার অনশন ভেঙে সাগর জড়িয়ে  ধরে...’

‘বাঃ, মিনু, সময়  সমাজকে  ঘিরে একটি পরিত্যক্ত শিশুর কলরোল আলোড়ন  তুলছে, আমি রিয়েলি  মুগ্ধ!’
মৃন্ময়ীর  চোখের  তারায় নানা রঙ ফুটে উঠছিল, কখনও রাগ কখনও অনুরাগ  –– ‘আমি এখন কী করব বল?’ আই য়াম্ সিরিয়াস, হোয়াটস্ ইয়োর  ডিসিসন?’
মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে হাতখানি ধরলাম  –– ‘সময়ের দর্পণে মনোজগতের নানা খুঁটিনাটি দৃশ্যপট পরিস্ফুট কর। কবিতা নামক রসের জিনিসটি উপলব্ধি কর। প্রতিটি লেখার পেছনে যে পরিশ্রম থাকে তাকে তো তুমি অস্বীকার করতে পার না...’
এমন সময় ওয়েটার এসে জানিয়ে গেল যে রাত দশটা, রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে।
আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম পথে। কলেজস্ট্রিট। সামনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্সি  কলেজ নিজস্ব গৌরবে।  ‘চলো,  গড়িয়াহাটে আমার ঘরে’ -আমি অনুরোধ করলাম।
মৃন্ময়ী কী সব সাত-পাঁচ ভাবল। মেয়েদের মন বোঝা অসাধ্য বলে মনে হয় আমার।  ‘তোমার হোটেলের ঘরে?’ - মৃন্ময়ী প্রশ্নচিহ্ন আঁকল।
‘শুধু ভালোবাসার জন্য...’
আমার স্বীকারোক্তি। এরকম বৃষ্টির রাতে ট্যাক্সি পাওয়াও মুশকিল হয়ে ওঠে কখনও কখনও। ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আমরা দুজন। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ মন্তব্য করল, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি আর কী!’
তাকিয়ে দেখি বছর কুড়ি-বাইশের দুজন যুবক আমাদের দিকে আসছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। একজন যুবক হাত মুঠো করে বলল,  ‘কোথায় যাবে দাদু?’ অন্য যুবকটি দাঁত বের করে টিপ্লনি কাটল, ‘কোথায় আবার সোনাগাছি’ ––   হেঁ  হেঁ করে হাসতে থাকল দুজনেই।  ‘তা এই যে ছোকরি, এবুড়োর সঙ্গে এত কী রস পাচ্ছো? এসো আমরা তোমাকে’  কথাটা শেষ করতে হল না, মৃন্ময়ী
দুটি হাত শক্ত করে বলল, ‘চলুন দাদু, রাস্তার ওইদিকে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে, চলুন!’ যুবক দুটি হতভম্ব হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। মৃন্ময়ীর হাত ধরে আমি এগিয়ে চললাম  আরও কিছুদূর...

(৩)

‘দাদু, তুমি সারাদিন বসে বসে এত লেখো কীভাবে?’ অপুর জিজ্ঞাসিত চোখ।
‘হ্যাঁ, দাদুভাই, এটা আমার অভ্যাস  হয়ে গেছে’। ‘তুমিও বড়ো হয়ে লেখক হবার স্বপ্ন দেখো।’
‘আমি তো টিয়াপাখির গান শুনি, ময়ূরের নাচ দেখি, আর মেঘ ডাকলে আমার বেশ ভয় করে,
তখন মাকেই খুঁজি।’
‘তুমি খুব প্রতিভাবান দাদুভাই। তুমি তো ছবি আঁকতেও ভালোবাসো, তাই না!’
‘রঙ-তুলির  সঙ্গে  সাদা কাগজ রঙিন হয়ে ওঠে, গাছ, বাগান, নদী, পাহাড় সব জীবন্ত হয়ে যায়’ –––– বেশ কৌতুক নিয়ে আট বছরের অপু হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাদুকে বোঝাতে থাকল...
‘আচ্ছা, দাদু, বড়রা কেমন  যেন বড়ো,  ছোটোদের মানুষ বলেই মনে করে না!’
‘কেন বল তো দাদুভাই?’
‘প্রায়ই দেখি আমার পাপামম্মি ঝগড়া করে। আমাকে বলে যে ছোটো ছেলে, তোমার এসব শুনতে নেই, তুমি এখন দাদুর কাছে যাও’
‘হ্যাঁ দাদুভাই, বড়দের জগতটা খুবই জটিল, তুমি এখন বুঝতে পারবে না। তুমি ছবি আঁকবে, পড়া  করবে  আর  খুব  খেলা  করবে।’
‘থ্যাংকু দাদু। তুমিই আমার কথাগুলো বোঝো, তুমি খুব ভালো’ –– অপু আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে...

‘কি হল, ও-রকম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কী দেখছো?’
‘মৃন্ময়ী,  আমার  মিনু, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ নিংড়ে নিয়েছি, পেয়েছি-ও’ ––
আমরা দুজন বিছানায় কোল ঘেঁষে কিছুটা অন্তরঙ্গতারআবেশে জড়িয়ে যেতে থাকি ক্রমশ...
‘তোমার পরিবার নিয়ে তুমি, সুখী  অ্যাম আই  রাইট?’
‘এখন আবার ভূতটা মাথাচাড়া দিচ্ছে,  তুমি  যুগের মেয়ে সেটা ভুলে যাও কেন?
‘বুঝতে পারছি না,সামাজিক গ্রহণে বাধা কোথায়? তুমি আমাকে প্রথমদিন গ্রহণ  করলে কেন? বুঝতে পারছি না সামাজিক গ্রহণে বাধটা কোথায়?’

‘নিজস্ব দর্শনে ভেসে উঠছে স্থলপদ্ম। রোমান্টিককিছু কবিতার জন্ম অনিবার্য হয়ে  উঠছে। গ্লোবালাইজেশন-এর ঢেউ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, ইংরেজিতে  লেখার তাগিদ অনুভব করছি। আর কটা    বছরই বা বাঁচব, তবুও কিছু রচনা ইংরেজিতে করে যাব’  –– আমি অধীর আগ্রহে আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলাম। ...
‘লেখা আমার বন্ধ হয়ে যাবে,  জানো। টিউশনের টাকা নষ্ট করে বই ছেপে কি লাভ!  কে  পড়বে বা পড়ে আমার বই?’ –– মৃন্ময়ী অস্থির হয়ে ওঠে।
‘কারুর পড়ার জন্যই লিখছি, এমন তো নয়। নিজের আনন্দে পরিশ্রম নিষ্ঠা আর সৎ চিন্তার প্রকাশ করা ছাড়া,  লেখার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই’ –– আমি ওকে বুকে টেনে নিই। মিনুর শরীরের অণু-পরমাণু অনুভব করার উদ্যোগ  নিতে থাকি।
‘একটা চাকরি খুঁজে নেব, যে কোনোও... সিংগল মাদার হয়ে কাটিয়ে  দেব বাকি জীবন। সমাজকে তো আমি ভয় পাই না ––
আমি অশ্রুনয়ন। অশ্রুহীন মৃন্ময়ী। একসময়  সন্ধ্যা নামল।  চরাচরে পাখির কূজন থেমে গেল। এমন সময় হ্যান্ড ব্যাগ কাঁধে মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াল  ––
‘দেরি হয়ে গেল, এখন আমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে...’




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন