ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৩)
দেবিকার ফোন মানে একঘন্টা আনতাবড়ি বকরবকর। ঘেঁটে থাকে
মেয়েটা। লিপিকার চেয়ে মোটে আড়াই বছরের ছোটো, সংসার করছে কত বছর ধরে। বর কৌশিক
দায়িত্ববান হলেও উদ্যমী নয়, অলস। দেবিকাও গোছাল নয় - যেমন তেমন করে চলে যাচ্ছে
ওদের। কল ব্যাক না করলে একটু পরে নিজে আবার করবে আর অনুযোগে পাগল করে দেবে, ‘তোরা
কেউ ছোটো বোনটার খোঁজ নিস না’।
লিপিকা ফোন হাতে তুলে নেয়। এঘরে শোভন কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে,
জানালার পর্দা টেনে দেওয়া। সে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে দেখে আস্তে আস্তে দরজা টেনে দিয়ে
বেরিয়ে যায়। সরু প্যাসেজ পার হয়ে পাশের ঘর – ঘরটি বেডরুমের তুলনায় ছোটো। হর্ষ এলে
ওখানে থাকে। মাঝারি মাপের রট্ আয়রনের খাট, একটা আলমারি আর সরু লম্বা বুককেস রেখে
ঘর ভরে গেছে। বিছানায় শোভন কাগজপত্তর হাবিজাবি ছড়িয়ে রাখে, সরাতে দেয় না। লিপিকা
ঢুকতে গিয়েও ঢুকল না, মুখ বেজার করে বেরিয়ে এল। লিভিংরুম সংলগ্ন ব্যালকনিটা
পশ্চিমমুখী। বেশ তেতে থাকে এসময়ে। ওদিকের দরজা বন্ধ। খুলবে ভেবে পা বাড়িয়ে ফিরল
সে, গরমে বসে ফোন করতে ইচ্ছে করছে না। একটু অস্থির লাগছে, আনচান করছে শরীর। লিপিকা
ডাইনিং টেবিলে রাখা বোতল খালি করে জল খেল। তক্ষুনি ছলাৎ করে শব্দ হল। বদ্ধ ঘরে
স্পষ্ট ও প্রকট হয়ে শোনা গেল। চেনা শব্দ, এ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে সলমন পাশ ফিরল,
লেজের ঝাপটে হাল্কা ঢেউ উঠল জলে। অনেকসময়ে রাতে ঘুম পাতলা হয়ে এলে নিস্তব্ধতা ভেঙে
এই শব্দ শুনতে পায় লিপিকা। আশ্বস্ত লাগে। মুঠোর মধ্যে ফোন আবার বাজতে আরম্ভ করেছে।
লিপিকা সোফায় বসে ফোন ধরে বলে,
-হ্যালো দেবী, বল।
-ম্যাম আয়্যাম হেয়ার টু টক এ্যাবাউট আওয়ার ইনভেস্টমেন্ট
পলিসি...।
-স্যরি নট ইন্টারেস্টেড।
স্টাইলিশ স্বরে ফোন – রেকর্ডেড ভয়েস নয়। গত কয়েকমাস হল
প্রায়শঃ এধরনের ফোন আসতে থাকে। কেটে দেয় লিপিকা। দুবছর প্রায় হল শোভন অবসর নিয়েছে। ফলে
লিপিকাকে চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। তার এখনো বছরখানেক বাকি ছিল। চোখ বুজে পিঠ এলিয়ে সে চুপ করে বসে থাকে। মাথার মধ্যে ছোটো ছোটো অস্ফুট
প্রবাহ খেলে যাচ্ছে – মাছেদের নড়াচড়ার মতো নিঃশব্দে। আবার ফোন বাজে, এবারে দেবিকা।
--তোকে ফোন করলা বেজে গেল, ধরলি না কেন রে মেজদি?
--খাচ্ছিলাম তখন, বল।
--এত বেলায়? কী কী রান্না করলি?
--তেমন কিছু না। আসলে এ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করতে বসে দেরি
হয়ে গেল। কেমন আছিস তোরা? মা ভালো আছে?
--আছি একরকম, চলে যাচ্ছে। সব দায়িত্ব আমার। তোদের আর কি?
ঝাড়া হাত-পা। বড়দি প্রায় যোগাযোগ রাখে না, আর দাদা থেকেও নেই মনে হয়।
--সে-ই। আর কী খবর বল।
--শ্রুতিটা এত জ্বালাচ্ছে!
--কী হল আবার?
-তোকে বলব‘খন - পারলে একবার আয়। অনেক কথা ছিল। তোদের গাড়ি আছে, আমার নেই। হাই-ফাই ব্যাপার
- ইচ্ছে হলেই আসতে পারিস, আসিস না। বোকারোতে থাকতে চালাত না
শোভনদা? তবে এখানে কি হল?
--যাব’খন এর মধ্যে। ঘুম পাচ্ছে রে, রাখি। পরে ফোন করব।
--ঠিক আছে, ছাড়ছি।
অনিচ্ছায় ফোন কেটে দিয়েছে দেবিকা। পাত্তা না দিলেও
কথাবার্তা শুনে মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। নিউ টাউন থেকে যাদবপুরে ঘনঘন দৌড়নো সম্ভবপর
হয়ে ওঠেনা। চিরকাল সংসারের সব কাজ প্রায় একা হাতে সামলায় সে। তখন শোভন ব্যস্ত
থেকেছে অফিস নিয়ে, রিটায়ার করে ক্রমশঃ আলভোলা হয়ে যাচ্ছে। একুশ বছর বয়সে বিয়ে
পরীক্ষার পরে সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বাবা। দিদি লতিকারও বিয়ে হয়েছিল
কোন্কালে - আঠেরো পূর্ণ হওয়ার আগেই।
প্রেম করে বিয়ে করেছিল দেবিকা, পাড়ার ছেলে কৌশিক। কলোনিতে
অনেকটা জায়গা জুড়ে বড়ো বাড়ি বানিয়েছিলেন ওদের বাবা সত্যসাধন। বহু বছর হল একটা অংশে
দেবিকারা থাকে মায়ের সঙ্গে। ছিয়াশি বছরের মা এখনো যথেষ্ট শক্ত সমর্থ।
কখন তন্দ্রা এসেছিল খেয়াল করেনি, সোফাতে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছিল
সে। হিজিবিজি স্বপ্ন দেখছিল – এ্যাকোয়ারিয়ামের সীমিত পরিসরে মাছের মুখগুলো বদলে
ছেঁড়াফাটা চেনা মুখের কোলাজ।
হঠাৎ কপালে আলতো ছোঁয়া। আধবোজা চোখে দেখে শোভন দাঁড়িয়ে আছে
সামনে, হাতে এগিয়ে ধরা চায়ের কাপ। দীর্ঘ ক্ষীণদেহী মানুষ, ইদানিং যেন ঝুঁকে
যাচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন,
--নার্ভের সমস্যা হতে পারে। সাবধানে থাকুন। উত্তেজনা এড়িয়ে
চলুন।
লিপিকা সোজা হয়ে বসে। বলে,
--এবাবা সন্ধ্যে হয়ে গেছে?
--হ্যাঁ। তোমায় খুঁজতে গিয়ে দেখি, এইখানে...।
লিপিকা অসন্তোষ না লুকিয়ে বলে,
--তুমি আবার কিচেনে গেছ? কতবার যে বলেছি আগুণের সামনে
যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনা—। আমি একটু বাদে উঠেই পড়তাম...।
--চায়ে চুমুক দিয়ে দেখ তো পেরেছি কিনা - সব সময়ে তুমি সব
কর। খুঁজতে গিয়ে দেখি এখানে...। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছ দেখে ডাকতে ইচ্ছে করল না।
ভাবলাম করে খাওয়াই তোমাকে।
স্বরে আশ্চর্য মায়া আর অনির্দিষ্ট দূরত্ব লিপিকা অনুভব করে,
গলার কাছে বাষ্প জমে। সহজ হতে চেয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সরে বসে বলে,
--এখানে বস।
--সকাল থেকে অনেক পরিশ্রম করেছ।
--তা...। হ্যাঁ, একএক দিন হয়ে যায়।
--আমার শখের ছিল ওটা, তোমার ঘাড়ে পড়েছে।
--সে আর কী করা যাবে? চা ভালো হয়েছে। মুখে দিয়ে দেখ।
--আচ্ছা।
শোভন চায়ে ছোটো চুমুক দিয়ে নিঃশব্দে মাছের বাক্সের দিকে চেয়ে
থাকে। অন্ধকারে অস্পষ্ট চোখের ভাষা পড়া যায়না। লিপিকার অস্বস্তি হতে থাকে।
ব্যস্ততা দেখিয়ে হাল্কা ঠেলা দিয়ে বলে,
--শেষ কর চা, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
--শোন লিপি, মাছ-টাছ শুদ্ধু এই এ্যাকোরিয়াম বিক্রি করে
দেওয়া যায় না? ও-এল-এক্স-এ এ্যাড দিয়ে দেখবে?
লিপিকা চমকায়, কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনা। কাপ হাতে উঠে
গিয়ে আলো জ্বালায়। শোভনের চশমা-পরা চোখ এ্যাকোয়ারিয়ামে স্থির, সেই হারিয়ে যাওয়া
অনচ্ছ দৃষ্টি।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন